ডাইরির পাতা থেকে তুরস্ক এবং গ্রীস ভ্রমণ ড. ফেরদৌসী জাহান
ফজরের আযান শুনে ঘুম ভাঙ্গলো আজ! খুব ভাল লাগলো অনেকদিন পরে এভাবে আযান শুনে। হ্যাঁ, আমরা গতকাল, ২৪ আগস্ট ২০২৩, ইস্তানবুল এসেছি। হঠাৎ করেই এই প্লানটা করা হয়েছে, তুর্কী এবং গ্রীস ঘুরবো। গতকাল তুরস্কের ঐতিহাসিক Blue Mosque এ মাগরিবের নামাজ আদায় করলাম। খুব ভাল লেগেছিল। বিরাট মসজিদ আর কি সুন্দর কারুকার্য করা! মসজিদের বাহিরে বসার সুন্দর একটা জায়গা আছে। নামাযের পরে আমরাও কিছুক্ষণ বসে সময় কাটালাম, আর কর্ন ভাজা খেলাম। আকাশে তখন একাদশীর চাঁদ ছিল। সামনে আলোকিত ঝরনা, সুন্দর ফুলের বাগান, তার পিছনে আলোক সজ্জায় সজ্জিত ঐতিহাসিক হাজিয়া সোফিয়া, যার তুর্কী নাম আয়া-সোফিয়া। সব মিলিয়ে খুব সুন্দর একটা পরিবেশ ছিল। মসজিদের কাছেই আমাদের হোটেল। হাটতে হাটতে চলে আসলাম, একটা রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরলাম।
 আয়া-সোফিয়া মসজিদের ভেতরের দৃশ্য ইস্তানবুলে দ্বিতীয় দিনে, সারাদিন তোপকাপি প্যালেস এ ঘুরলাম। এত ভাল লাগলো! অটোম্যান সাম্রাজ্যের গৌরব উজ্জ্বল অধ্যায় ৬০০ বছর, সেই ১৫শ সেঞ্চুরি থেকে! কিছুদিন আগেই নেটফ্লিক্স এ অটোম্যান এম্প্যায়ার সিরিজটি দেখেছিলাম, তাই আরও বেশী কানেক্ট করতে পারছিলাম।
তোপকাপি প্রাসাদের প্রবেশ দ্বারে | এতই বিশাল এলাকা। মিউজিয়াম, লাইব্রেরী, হারেম (সুলতানদের প্রাইভেট বাসস্থান), স্কুল বা মাদ্রাসা- প্রিন্স ও প্রিন্সেসদের জন্য। প্রায় ৩০ জন সুলতান এই তোপ কাপি প্রাসাদ থেকে বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করেছেন। প্রায় ৪০০০ থেকে ৫০০০ মানুষ এই প্রাসাদে বাস করতো। একটা জিনিস দেখলাম ইসলাম ধর্মের প্রতি তখনকার সুলতানদের অনুরাগ। প্রাসাদের প্রায় প্রতিটি দেওয়ালে কোরান শরীফের আয়াত আছে। মিউজিয়ামের একটা প্রধান অংশ The Chamber of Holy Relics. সেখানে অনেক মূল্যবান জিনিস রাখা আছে। বিভিন্ন সময়ে এগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে। আমি খুব আবেগপ্রবন হয়ে পড়েছিলাম, যখন আমাদের প্রিয় নবী মোহাম্মাদ (সা:) র পায়ের ছাপ দেখতে পেলাম। ওনার ব্যবহার করা একটা চাদর, আমাদের চার খলিফার ব্যবহৃত তরবারি, লাঠি এরকম অনেক কিছু, এমনকি পবিত্র মক্কা ও মদিনা শরিফের কিছু ভাঙ্গা ইট-কংক্রিট এখানে সংগৃহীত আছে। সব ঘুরে ক্লান্ত হয়ে বের হলাম সন্ধ্যার আগে। দুজনে আইসক্রিম খেয়ে হোটেলে চলে এলাম।
তৃতীয় দিনে আমার ছোট মেয়ে এবং জামাই আমাদের সাথে যোগ দিল। ওরা দুই সপ্তাহ আগে তুর্কী এবং গ্রীস ঘুরতে এসেছে। আমরা সবাই মিলে ইস্তানবুলের সোলায়মান মসজিদে গেলাম। একই ধরনের আর্কিটেকচার। সেখানে মসজিদের পাশে আছে চারিদিকে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা কবরস্থান। দুইটি আলাদা জায়গায় আছে সুলতান সোলায়মান এবং তার স্ত্রী হুররেম এর কবর। আমরা কিছুক্ষণ সময় সেখানে কাটিয়ে ট্রেনে চলে এলাম ইস্তানবুলের বিখ্যাত গ্র্যান্ড বাজারে। হাজার রকমের তার্কিশ মসল্লা, বিভিন্ন রকমের চা, শুকনা ফল ইত্যাদি অনেক পণ্য ভর্তি, ব্যস্ত একটা বাজার। কিছু কেনাকাটা করে গুগল ম্যাপ ধরে মেয়েদেরকে অনুসরণ করে হেটে এলাম একটা রেস্টুরেন্টে। ছোট্ট একটা লিফট নিয়ে উপরে উঠলাম, একটু বিরক্ত হচ্ছিলাম কেন কষ্ট করে এই রেস্টুরেন্টে আসতে হবে। কিন্তু উঠে যখন বসলাম সেখানে, সব কষ্ট দূর হয়ে গেল। জানালার পাশে সুন্দর দৃশ্য ছিল, ছোট হলেও খুব সুন্দর করে সাজানো। খাবারের প্রতিটা আইটেম ছিল চমৎকার। আমার মেয়ে নাকি এর আগে এখানে তিনবার এসেছে। সেখান থেকে আমি আর হেদায়েত ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে চলে এলাম। সেদিন আমার মেয়ে-জামাই সিডনি চলে গেল। পরের দিন সকালে (২৮ আগস্ট, সোমবার) আমরা যাত্রা করলাম শান্তরিনির উদ্দেশ্যে।
 গ্রান্ড বাজারের সামান্য একটি অংশ অনেক শুনেছি শান্তরিনির কথা। আমার তিন মেয়ে ঘুরে এসেছে। তাই আমাদেরও প্লান ছিল এখানে আসার। অদ্ভুত সুন্দর একটা জায়গা। এজিয়ান সাগরের মাঝে গ্রীসের একটা দ্বীপ শান্তরিনি! নামের মতই সুন্দর। নীল সাগরের পাশ ঘিরে সব বিল্ডিংগুলো সাদা। নীল আর সাদার মিশ্রণে অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশ। আর মাঝে মাঝে অপরূপ বাগান-বিলাসের সমাহার। আমাদের ছুটির শ্রেষ্ঠ সময় কাটিয়েছিলাম এখানেই। আমাদের হোটেলটা একদম সাগরের পাশে ছিল। তবে হ্যাঁ, প্রথমে যখন ট্যাক্সি নামিয়ে দিয়ে গেল, অবাক হয়ে দেখলাম অনেকগুলো সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আমাদের রুমে পৌছাতে হবে। ভয় পেয়ে গেলাম, ভাবছিলাম কিভাবে সুটকেস নামানো হবে। তবে না, দেখলাম হোটেলের লোক সেগুলো কাঁধে নিয়ে সিড়িগুলো পার করে নির্দ্বিধায় রুমে দিয়ে গেল। প্রায় ৬২ টা ধাপ ছিল সিঁড়িতে। দিনে একবারই শুধু উঠা-নামা করতাম। সকালে রুমের সামনে সাগরকে সামনে রেখে নিজস্ব বেলকনিতে ব্রেকফাস্ট দিত। কিযে একটা শান্ত নিবিড় পরিবেশ ছিল। দীর্ঘ চল্লিশটা বছর আমাদের একসাথে পথ চলার সময়টাকে স্মরণীয় করার জন্য এই হলিডের প্লান হয়েছিল।
 চোখ জুড়ানো সৌন্দর্যের লীলাভূমি, শান্তরিনি দ্বীপ কাকতালীয় ভাবে দেখলাম আমাদের পাশের রুমটাতে এসেছে আর একজোড়া অস্ট্রেলিয়ান, তাঁরাও চল্লিশতম বিবাহবার্ষীকি উপলক্ষেই এসেছে। আলাপ করে ভালই লাগলো। কয়েকটি দ্বীপ নিয়ে গঠিত শান্তরিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হলিডে ডেসটিনেশন গুলির একটি। আমরা ছিলাম Firostefani তে। নীল সাগরের পাশে balcony তে বসে থাকতে কি যে ভাল লাগতো। একদিন পাশের গ্রাম Oia তে কাটালাম, জায়গাটা সূর্যাস্ত দেখার জন্য অত্যন্ত প্রসিদ্ধ! বিকেল থেকেই প্রচুর লোকের সমাগম হতে লাগলো। আমরা সময় থাকতে একটা ভাল জায়গা বেছে বসে রইলাম সূর্যাস্তের অপেক্ষায়। শুনলাম সাগরের ধার ঘেঁসে যে রেস্তোরাগুলো রয়েছে, সেগুলো ভীষণ ব্যয়বহুল তো বটেই, সব অনেক আগে থেকে বুক করা। অনেকে নৌকা নিয়েও ঘুরছে সাগরে সূর্যাস্ত দেখবে বলে। আসলেই সব মিলিয়ে একটা মায়াবী পরিবেশ, মনে ধরে রাখার মত কিছু মুহূর্ত।
সেই রাতে বাস ধরে আমাদের হোটেলে পৌঁছলাম এবং সেই ৬২ টি সিঁড়ি পার হবার আগেই উপরে একটা রেস্তোরায় রাতের খাবার সেরে নিলাম। পরের দিন, ৩০ সে আগস্ট, আমাদের যাত্রা ছিল গ্রীসের রাজধানী এবং ঐতিহাসিক প্রাচীন শহর এথেন্স। একবার এজিয়ান সাগর দেখতে দেখতে যাবার ইচ্ছা ছিল, তাই প্লেনে না গিয়ে, দ্রুতগামী ফেরী সী-জেট এ টিকিট কেটেছিলাম শান্তরিনি থেকে এথেন্স। আমাদেরকে হোটেল থেকে বাসে নিয়ে এলো ফেরী ঘাটে। হাজার হাজার লোক ছিল বিভিন্ন ফেরীর যাত্রী। যখন ফেরীতে উঠলাম, সে আর এক অভিজ্ঞতা। শত শত মানুষ উঠছে, সবাইকে লাগেজ নীচের ফ্লোরে রাখতে বলছে; লাগেজ রেখে আমরা উপরে উঠে গেলাম আমাদের টিকিট অনুযায়ী জায়গায়। সুন্দর বড় বড় সীটগুলো অনেক আরামদায়ক। মাঝে মাঝে খাবার কেনার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু ভাবছিলাম লাগেজের কথা। কিভাবে ঠিকভাবে লাগেজগুলো নিব নামার সময়, মিক্সড হয়ে যায় কিনা অন্যান্য হাজারের উপর লাগেজের সাথে। কিন্তু না, কোন অসুবিধা হয় নাই, নীচে নেমে দেখতে পেলাম আমাদের লাগেজগুলো সেভাবেই আছে। সব থেকে ভাল লাগল এর মাঝে কোন ঠেলাঠেলি বা ধাক্কা ধাক্কি নাই। ট্যাক্সি নিয়ে যখন পৌঁছলাম আমাদের এপার্টমেন্টে। তখন প্রায় সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। আমরা সিটির মাঝেই ছিলাম। রাতে বের হলাম ঘুরতে, দেখলাম এত রাত হলেও সব জমজমাট, চারিদিকে লোকজন, রেস্তোরাগুলো সব ভর্তি।
এ্যাক্রোপলিস, এথেন্স | পরের দিন আমরা শহরে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ঐতিহাসিক এ্যাক্রোপলিস দেখতে গেলাম। এ্যাক্রোপলিস এথেন্সের একটি অতি প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক আকর্ষণ। এটা একটা উঁচু (১৫০ মিটার) পাহারের সমতল রকের উপর অবস্থিত, যার আয়তন ৭.৪ একর। পুরো এথেন্স শহর দেখা যায় এখান থেকে। অনেক প্রাচীন ঐতিহাসিক বিল্ডিং, টেম্পল, থিয়েটার ধ্বংসাবশেষ দেখতে পেলাম। ইতিহাসে জানা যায় সেই ৫ম সেঞ্চুরি থেকে বিভিন্ন সাম্রাজ্যের অধীনে অনেক পরিবর্তনের মাঝ দিয়ে এর যাত্রা। হেলেনিক, রোমান, বাইজেন্টাইন, ল্যাটিন এবং অটোম্যান সাম্রাজ্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। গির্জা, মন্দির মসজিদ সবি হয়েছে সময়ের সাথে বিভিন্ন যুগের শাসকদের সাথে। একটা বিরাট অর্ধ-বৃত্তাকার থিয়েটার গ্যালারি দেখতে পেলাম। সেই বিখ্যাত অলিভ গাছটি দেখলাম, যেটা নিয়ে অনেক পৌরাণিক কাহিনী আছে। এই অলিভ গাছটি দেবী আথিনার দেওয়া উপহার এবং সে নিজে এটা মাটিতে লাগিয়েছিল। কথিত আছে এই অলিভ গাছটি কোন না কোন ভাবে সেই আসল গাছের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে, বীজ অথবা ডাল থেকে কেটে করা হয়েছে। সারা বিকেল আমরা ঘুরে ঘুরে দেখে ক্লান্ত হয়ে পরলাম, আসার সময় সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে, তার আলোকছটা ছড়িয়ে দিয়েছে আকাশে। অদ্ভুত ছিল দৃশ্যগুলো। তারপর নেমে এলাম আর হাঁটতে শুরু করলাম বাসের উদ্দেশ্যে। রাতে রেস্টুরেন্টে খেয়ে রুমে ফিরলাম। পরেরদিন হপ-অন-হপ-অফ বাসের টিকিট কেটে গ্রীস শহরটা দেখলাম। আমাদের পরর্বতী যাত্রা তুরস্কের আরেকটি শহর ইজমীর।
গ্রীসের এথেন্স থেকে আমরা ইজমীরে আসি ১ সেপ্টেম্বর। এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে পৌঁছলাম। প্রায় ৪৫ মিনিট ড্রাইভ। সমুদ্রের পাশ দিয়ে এই লং ড্রাইভটা খুবই ভাল লেগেছিল একপাশে এজিয়ান সমুদ্র আর এক পাশে সারি সারি উঁচু উঁচু বিল্ডিংগুলো, দেখতে একই রকম। বিকেলের নরম রোদে একটা মায়াময় পরিবেশ ছিল। তিনদিন ছিলাম ইজমীরে, আমাদের হোটেলের রুম থেকে পাহাড়ের উপর সুন্দর সাজানো ঘরবাড়ী দেখা যেত।
আমরা পরের দিন মেট্রো ধরে বের হলাম world clock, Grand Bazar and Blue Mosque দেখতে। নতুন শহরে যেয়ে নিজে নিজে ঘুরে ঘুরে দেখার মাঝে একটা অন্য রকম আনন্দ আছে। পরের দিন গাইডেড ট্যুর নিয়ে বের হলাম ঐতিহাসিক দুইটা জায়গা দেখতে। আমরা মাত্র চারজন ছিলাম ট্যুরের বাসে। প্রথমে আমাদেরকে নিয়ে গেল The House of Virgin Mary দেখতে। ইতিহাসে আছে ভার্জিন মেরী (আমাদের নবী হযরত ঈসা আঃ র মাতা মা মরিয়ম) শেষ বয়সে ঐ জায়গায় কাটিয়েছিলেন। একটা উঁচু পাহারের উপর অবস্থিত সেটা - ছোট্ট একটা ঘর আছে, সেখানে তখনকার যুগের একটা ছোট্ট পানির জলাশয় (water cistern) দেখতে পেলাম। সেদিন ছিল রবিবার, তাই সেখানে ক্যাথলিকদের একটা প্রার্থনা হচ্ছিল। প্রচুর গাছ-পালা দিয়ে আবৃত জায়গাটা, খুবই শান্তিময় পরিবেশ ছিল।
তারপর আমরা গেলাম অতি প্রাচীন শহর ইফেসাস (Ephesus) দেখতে। খৃষ্টপূর্ব ১০ম শতকে প্রতিষ্ঠিত এই শহরটি এর স্থাপত্যশৈলী এবং বিশালত্বের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল শত শত বছর ধরে।
ইফেসাস এর সেলসাস লাইব্রেরী
| বর্তমানে ইফেসাস তুর্কীর ছোট একটা শহর সেলচুক এর পাশে অবস্থিত। ইফেসাস একটা উল্লেখযোগ্য বন্দর ছিল সেই সময় - কৃষ্টি কালচার, ধর্ম, সাহিত্য সবদিক দিয়ে। রোমান সাম্রাজ্যের সময় রোমের পরে ছিল সবচেয়ে বড় শহর। ব্রোঞ্জ যুগের পর থেকে সেখানে জনবসতি শুরু হয় এবং প্রায় ২০০,০০০ জনবসতি ছিল একসময়। ইতিহাসের অনেক বিখ্যাত মানুষের পদধুলি পড়েছে এই ইফেসাসে; যেমন জুলিয়াস সিজার ক্লিওপেট্রা এবং সেন্ট পল। আমরা প্রায় ২-৩ ঘণ্টা সময় হেঁটে হেঁটে বিভিন্ন জিনিষ দেখলাম সেই এলাকায়। যেমন বিরাট সেলসাস লাইব্রেরী, যেখানে ২০,০০০ র বেশী বই ছিল, গ্র্যান্ড থিয়েটার যেখানে ২৫,০০০ জন লোকের বসার জায়গা আছে, মার্কেট প্লেস (The Agora), দেবী আর্টেমিসের মন্দির, জিমনেশিয়াম, সারিবেধে অনেকগুলো গোসলখানা, (Turkish Hamam) টয়লেট ইত্যাদি। পাথরের তৈরী উঁচু উঁচু কলামগুলো কারুকার্য করা, চওড়া রাস্তার দুইপাশে সাজানো। সেই প্রাচীনযুগের তৈরী এতসব দেখে খুব অবাক হয়েছি। শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হয়েছে, অনেক সাম্রাজ্যের আগমন ও প্রস্থান হয়েছে, কালের পরিক্রমায় ইফেসাসও হারিয়ে গিয়েছিল একদিন।
অটোমান শাসনামলে এটা মাটির নীচে ছিল। প্রথম খনন কার্য শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ মিউজিয়ামের পক্ষ থেকে ১৮৬৩ সালে। এখন এটা তুর্কীর একটা জনপ্রিয় দর্শনীয় জায়গা। প্রচুর দর্শকের সমাগম হয় এখানে।
আমরা এরপর ট্যুরের অংশ হিসেবে একটা সুন্দর জায়গায় খেতে গেলাম, সেলচুকের একটা ছোট্ট গ্রামে। বাসায় তৈরী তার্কিশ খাবার, সুন্দর বাগানে বসে খেলাম। খাবার পর তারা নিয়ে গেল তুর্কীর বিখ্যাত হাতের তৈরী কার্পেট বুনানো দেখতে। শুনে অবাক হলাম এমন কার্পেটও আছে যেটা বুনাতে দশ বছরও লেগে যায়। তারপর তুরস্কের আরও একটা বিখ্যাত জিনিষ, সিরামিকের কারখানা দেখে ফিরে এলাম হোটেলে দিনের শেষে। যদিও গরমে একটু কষ্ট হয়েছে, তবু এই দিনটির স্মৃতি মনের খাতায় অম্লান হয়ে থাকবে।
পরের দিন আমরা নিজেরা গেলাম ওপেন এয়ার মিউজিয়াম দেখতে। এটাকে the Agora of Izmir বলা হয়ে থাকে। আলেকজান্ডার দি গ্রেট র সময়ে নির্মিত হয়েছিল। আগরা র অর্থ মার্কেট, সেই প্রাচীন কালে রোমানদের সময়ের একটা বড় মার্কেট প্লেস। এটার খনন কার্য শুরু হয়েছিল ১৯৩৩ সালে। তারপর হোটেলে ফিরে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম পরের গন্তব্য শহর কাপাডকিয়ার উদ্দেশ্যে।
তুরস্কের একটা অদ্ভুত শহর দেখলাম, কাপাডকিয়া। ইজমীর থেকে কাপাডকিয়া একঘণ্টার ফ্লাইট। কায়ছারি এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের হোটেলে যেতে একঘণ্টা লাগলো। কাপাডকিয়ার ফটোগুলো সবাইকে দেখাতে ইচ্ছা করছে। খুবই অবাক হয়েছি কাপাডকিয়ার ল্যান্ডস্কেপ দেখে। হোটেল থেকে গাইডেড ট্যুর নিয়েছিলাম।
গোরেমে ন্যাশনাল পার্ক, উছিসার ক্যাসল, ওপেন এয়ার মিউজিয়াম, লাভ ভ্যালি ইত্যাদি অনেক পুরানো সেই সব জায়গাগুলো। অনেক কেভ দেখলাম, যেগুলো সেই ব্রোঞ্জ- যুগের সময় হয়েছে। বিশেষ করে অবাক লেগেছে বিভিন্ন শেপ এবং সাইজের উঁচু উঁচু রক দেখে। তাদেরকে বলা হয় হুডুস (Hoodoos). বিভিন্ন সাইজের বিভিন্ন আকৃতির হয়ে থাকে, উচ্চতায় ১.৫ মিটার থেকে ৪৫ মিটার পর্যন্ত।
 কাপাডকিয়ার হুডুস হুডুস সাধারণত তুলনামূলক ভাবে নরম শিলার তৈরি, যার উপরে শক্ত, সহজে ক্ষয় না হওয়া পাথর থাকে। বিলুপ্ত আগ্নেয়গিরি হাজার হাজার বছর ধরে টাফ নিক্ষেপ করেছিল। সেই টাফগুলো বাতাস ও পানির কারণে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে বিভিন্ন শিলার আকৃতি তৈরি করেছে, যা প্রস্তর যুগ থেকে মানুষের প্রাকৃতিক আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। রোমান যুগে নিপীড়নের হাত থেকে পালিয়ে আসা খ্রিস্টানরা এই এলাকায় বিভিন্ন গুহার ভিতরে আশ্রয় নিয়েছিল। এই স্থানটি প্রারম্ভিক খ্রিস্টান ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে। আমরা দেখেছি সেখানে এমনকি সাততলা গুহাও আছে, যেখানে খ্রিস্টান সন্ন্যাসিনীরা বসবাস করতেন, পুরুষ ও নারীদের জন্য আলাদা গুহা ছিল। আমরা রান্নাঘরও দেখেছি, যেখানে রান্নার ব্যবস্থা (বাংলাদেশের মাটির চুলার মতো)এবং খাবার খাওয়ার ও বসার জায়গা ছিল।
কাপাডকিয়া মনোরম হট এয়ার বেলুন ভ্রমণের জন্যও বিখ্যাত। সূর্য ওঠার আগে হট এয়ার বেলুনে উঠতে হয়। ভীতু হবার কারণে নিজে বেলুনে উঠি নি। কিন্তু আমাদের হোটেলের ছাদে উঠে সূর্য উদয় দেখার সুন্দর ব্যবস্থা ছিল। সুন্দর কার্পেট ও বালিশ দিয়ে পুরো ছাদ সাজানো। আমরা সময়মত শেষরাতে উঠে ছাদে চলে গেলাম আর নানা রংয়ের শতশত বেলুনের আকাশে ওড়ার সেই মনোরম দৃশ্য অবলোকন করলাম। আকাশও তখন সূর্যের আগমনীর পূর্বাভাসে রঙ্গিন হয়ে উঠেছিল।
৭ সেপ্টেম্বর আমরা চলে এলাম আবার ইস্তানবুলে। এবারে আমাদের হোটেল ছিল নতুন এলাকায়, বসফরাস নদীর কাছে। বসফরাস আসলে নদী না, এটাকে বলা হয় প্রণালী যেটা কৃষ্ণ সাগর এবং মারমারা সাগরকে সংযুক্ত করেছে। রাতে ৫ মিনিটের পথ হেটে, গেলাম একটা বিরাট শপিং কমপ্লেক্সে, বসফরাস নদীর পাশ ঘিরে। প্রচুর লোকের সমাগম, রেস্টুরেন্টগুলো জমজমাট সেই রাতে। আমরা ঘোরাফেরা করে রাতের খাবার খেয়ে চলে এলাম রুমে।
পরের দিন গেলাম মেট্রো ধরে দোলমাবাহজে প্রাসাদ (Dolmabahηe Palace) দেখতে। ৮ সেপ্টেম্বর আরও একটা সুন্দর দিন কাটালাম ইস্তাম্বুলে। সেদিন আবহাওয়াটা খুব ভাল ছিল। গরম কমে এসেছে, আকাশে শরতকালের মত ছিল সাদা মেঘের মেলা, ঝিরিঝিরি বাতাস বইছিল, বসফরাস উপসাগরের পাশে সুন্দর বাগান সহ এই প্যালেসটি। তুর্কী ভাষায় দোলমাবাহজে এর অর্থ বাগানে ভরা (filled with garden). এটা নির্মিত
দোলমাবাহজে প্রাসাদ (Dolmabahηe Palace) | হয়েছিল ১৮৪৩ থেকে ১৮৫৬ সালে। তোপকাপি প্যালেস যেহেতু অনেক আগের তৈরী, তাই আধুনিক ভাবে এই প্যালেসটাকে বানানো ও সাজানো হয়েছিল। অটোম্যান আর্কিটেকচারের সাথে ইউরোপীয় স্টাইলের মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। এই প্যালেসের চোখ ঝলসানো কারুকার্য দেখে অবাক হয়েছি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে দামী ক্রিস্টাল, নাম করা পাথর, সোনা-দানা ও বড় বড় ঝাড়বাতি (chandelier) আনা হয়েছে। এটা সাজাতে ১০০ কিলোগ্রাম সোনা ব্যবহার করা হয়েছে। তিন শতেরও বেশী ঘর রয়েছে, ৪৬ বিরাট হলঘর সহ বিশাল প্রাসাদ। আমরা অডিও গাইড ভাড়া করেছিলাম, তাতে ঐতিহাসিক সবকিছু শুনতে শুনতে ঘুরছিলাম, আর অবাক হচ্ছিলাম। হেরেম, যেখানে সুলতানদের পরিবারের নারী সদস্যরা থাকতো, সেখানেও অনেক ধরনের ঘর। সুলতানের মার জন্য সবচেয়ে বড় ঘর, তারপর সুলতানের স্ত্রীদের জন্য, কঙ্কবাইনদের জন্য, আলাদা ঘর ও বিশেষ বাথরুম রয়েছে। এত বড় প্রাসাদ এটা যে, আমরা সবকিছু দেখার সময় বা এনার্জি পাইনি, ঠিক যেমনটি হয়েছিল তোপকাপি প্যালেস দেখার সময়। সামনে মনো মুগ্ধকর সাজানো বাগান। বাগানের সামনে সুন্দর ডিজাইন করা বড় বড় গেট রয়েছে বসফরাস প্রণালীর পাশ ঘিরে। এখানেই অটোম্যান শাসনের সমাপ্তি হয়েছিল। তুর্কি বীর কামাল পাশা এ্রই প্রাসাদে বাস করতেন। যার কথা স্কুলজীবনে পাঠ্যবইয়ে পড়েছিলাম। যে ঘরে উনি থাকতেন এবং শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন, সেই ঘড়ে বিছানাপত্র সেভাবেই রাখা আছে। সেই ঘরে একটা ঘড়ি আছে, সেটার সময় থেমে আছে ৯টা ৫ মিনিটে, যে সময়ে তিনি পৃথিবী ছেরে চলে গিয়েছিলেন, ১৯৩৬ সালে।
দুপুর গড়িয়ে গেল, পা ব্যথা হয়ে গেছে, ওখানেই রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাওয়া সারলাম, নামাজ পড়লাম। তারপর আরও কিছুটা সময় কাটিয়ে, নদীর পাশে একটা ক্যাফেতে কফি খেলাম বিকেলে। কফি শেষ করে উঠলাম বসফরাস নদীর সানসেট ক্রজে, যার জন্য ইস্তাম্বুলে আসার প্রথম থেকেই উদগ্রীব হয়ে ছিলাম। একঘণ্টার বেশী সময় ধরে হারবারের সে এক অপরূপ দৃশ্য, খুবই উপভোগ করেছিলাম। তবে ফেরার সময় আমাদের অন্য জায়গায় নামিয়ে দেওয়ায় একটু বেগ পেতে হয়েছিল হোটেলে ফিরতে।
পরের দিন, ৯ সেপ্টেম্বর, আবার বের হলাম দুজনে। এখন ভাবি কিভাবে এনার্জি পেয়েছিলাম জানি না, তবে ঐতিহাসিক জায়গাগুলো দেখতে এত ভাল লাগে যে, শরীরের ক্লান্তি আমাদেরকে থামাতে পারে নি। সেদিনও আমরা ঘুরলাম বাস নিয়ে গ্র্যান্ড বাজারে যাব বলে। কারণ যে দেশেই যাই না কেন, কিছু কেনাকাটা না করলে ভাল লাগে না। সব জায়গার স্মৃতি রাখার জন্য। যাবার পথে আরও একটা মসজিদ, (Nuruosmaniye Mosque) দেখলাম, যেটা গ্র্যান্ড বাজারের কাছেই। এই মসজিদ তৈরী শুরু হয়েছিল ১৭৪০ সালে সুলতান মাহমুদ ১ এর আদেশে এবং শেষ হয়েছিল ১৭৫৫ সালে সুলতান ওসমান ৩এর আমলে। এই প্রথম একজন অমুসলিম আর্কিটেক্ট নিযুক্ত হয়েছিল মসজিদ তৈরীতে এবং এখানে প্রথম কিছুটা ইউরোপিয়ান-অটোম্যান স্টাইল লক্ষ্য করা যায়। এর কাছেই রয়েছে রোমান এম্পায়ার এর সময়ের সবচেয়ে পুরাতন কন্সট্যানটাইন স্তম্ভ যেটা ৩৩১ এ,ডি, সালে তৈরী হয়েছে রোম সম্রাট কন্সট্যানটাইন এর স্মরণে।
তারপর কিছু কেনাকাটা করা হল, যেমন তুর্কীর বিখ্যাত সিরামিকের জিনিষ, জুয়েলারি এবং উপহার সামগ্রী। পরিশেষে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরলাম। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রাতের খাবারের জন্য আবার বের হলাম কাছের অন্য একটা মার্কেট, ১০-১৫ মিনিটের হাটা পথ। সেই রাতে সেখানেও দেখি জমজমাট সবকিছু। দোকানপাট সব খোলা এবং প্রচুর লোকজন, আমাদের মত টুরিস্টই বেশী। আমরা কিছু কেনাকাটা করে বেশ রাতে হোটেল এ ফিরলাম। পরের দিন ১০ সেপ্টেম্বর সবকিছু গোছগাছ করে সিডনির উদ্দেশ্যে এয়ারপোর্টে দিকে রওনা হলাম।
খুবই ভাল লেগেছে তুর্কির বিভিন্ন শহরগুলো ঘুরে। মনের মণিকোঠায় এই দিনগুলোর স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
 ড. ফেরদৌসী জাহান, ক্যাসেল হিল, সিডনি
|