করোনা কালের কথা (২) ড. ফেরদৌসী জাহান
আজ ১৪ ই আগস্ট। রাত ৭ টা বাজে। টিভিতে খবর হচ্ছে। এখন খবর শুনলে মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আজ সাত সপ্তাহ হল আমাদের এখানে (গ্রেটার সিডনিতে) কঠোর লকডাউন চলছে। কেউ কারও বাসায় যেতে পারছে না, নেই কোন শপিং মলে যাওয়া, নেই কোন আড্ডা দেওয়া, কারও সাথে কোন ধরনের দেখাদেখি। সিডনীতে থেকেও আমার মেয়েরা আমাদের সাথে দেখা করতে পারছে না। তদুপরি আমার ডাক্তার মেয়ে ও তার ডাক্তার জামাইয়ের জন্য একটা ভীতি সব সময় মনে বিরাজ করে। তবে এই ভয়াবহ কোভিড মহামারীর সময়ে সকল স্বাস্থ্য-কর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
গত বছর যখন লকডাউন শুরু হয়েছিল, তখন আমি bangla-sydney তে একটা আর্টিকেল করোনা কালের কথা লিখেছিলাম তখনকার মনের অনুভূতি নিয়ে। সেই সময় একটা অন্যরকম অনুভূতি কাজ করেছিল। প্রথম অভিজ্ঞতা লকডাউনের কি কি করা যাবে, আর কি কি করা যাবে না, নতুন করে টেকনোলজির সাহায্যে ভার্চুয়াল মিটিং করতে শেখা, স্বজনদের সাথে ভার্চুয়ালি কথা বলা, বাসায় থেকে অফিসের কাজ করা, সেইসাথে বাসায় পরিবারের সাথে বেশী সময় কাটানো ইত্যাদি বেশ একটা অন্যরকম ভাল লাগা কাজ করেছিল। আরও একটা কারণ ছিল, যেহেতু আমাদের এখানে করোনার অবস্থা তেমন খারাপ হয়েছিল না, অন্যান্য দেশের তুলনায়। তাছাড়া তখন সঠিক ধারনা ছিল না যে এই মহামারী এভাবে পৃথিবীকে বিপর্যস্ত করে ফেলবে।
কিন্তু এবারে এই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এসে সবকিছু যেন তছনছ করে দিল। কোভিড এবারে এত বেশি প্রকট ভাবে দেখা দিয়েছে, আমাদের সিডনীতে! প্রতিদিন করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, আইসিউ তে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, ভেন্টিলেশনে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, সর্বোপরি মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। কেমন একটা আতংক চারিদিকে, সবকিছু থমথম করছে। আমাদের সাবার্বে যখন হাটতে বের হই দেখি রাস্তা ঘাট সব শুনশান করছে, চারিদিকে নীরবতা। মনটা আপনা থেকেই কেমন খারাপ হয়ে যায়।
এখনও আমাদের অফিস (National measurement Institute) খোলা, তাই আমি এখনও অফিসে যাচ্ছি। তবে এই কঠোর লকডাউনে অফিস আরও ফাঁকা। আমাদের বড় বিল্ডিংটা একদম ভুতুড়ে মনে হয়, খুব কম মানুষ আসে অফিসে। গাড়ী পারকিংগুলো একদম ফাকা। অবরুদ্ধ কাউন্সিল এলাকাগুলি থেকে কেউ আসতে পারে না। লম্বা করিডোরগুলোতে আধো আলো আধো অন্ধকার, লাইট অনেক নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে, ছুটির দিনের মতো। রিসেপশনিস্ট নাই, কোন বহিরাগত ভিজিটর আসতে পারবে না। অবশ্যই সবাইকে মাস্ক পরে থাকতে হবে সব সময়। তবুও সপ্তাহে দুই-তিন দিন অফিসে যেতে বেশ ভালই লাগে, একেবারে বাড়ি বন্ধী না থেকে। তবে কাজে নেই তেমন উৎসাহ উদ্দীপনা, সবকিছু থিতিয়ে গেছে মনে হচ্ছে। অথচ করোনা না থাকলে এখন কত ব্যস্ততা যেতো। এই বছর অক্টোবর মাসে, আমাদের একটা বড় কনফারেন্স ছিল ক্যালিফোর্নিয়াতে, ডিজনি ল্যান্ডে। কত প্লান করেছিলাম সেই সময়, কনফারেন্সের পরে কিছুদিন ছুটি নিয়ে বেড়াবো অন্যান্য জায়গায়। ২০২২ এ প্যারিসে আরেকটা কনফারেন্স হবার কথা ছিল। পেপার রেডি করা, পাওয়ার পয়েন্ট এ প্রেজেন্টেশন রেডি করা, কত উত্তেজনা কত প্ল্যান, এখন আর কিছুই নাই। সব পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে ২০২৩ শে। করোনার আগে আমাদের কিছু কলিগ একসাথে প্রতিদিন চা-কফি খেতাম ক্যান্টিনে । এখন ক্যান্টিন সহ সব কমন জায়গাগুলো বন্ধ। তাই আমরা সেই কজনা টি ব্রেকের সময় ভার্চুয়ালি যোগাযোগ করি ই-মেইল র মাধ্যমে। কিছুটা মন ভাল করার প্রয়াস!
এর মাঝে অনেক প্রতিবাদ সত্ত্বেও অলিম্পিক ২০২০ হল টোকিওতে। টিভিতে দেখতাম আর ভাবতাম কি দুনিয়া হল এখন! সবাই মাস্ক পরে, কাউকে চেনার উপায় নাই। দর্শক ছাড়া স্টেডিয়ামে খেলোয়াড়রা সেরা খেলা উপহার দিল, কিন্তু কেউ মেডেল পরালো না বিজয়ীদের গলায়। নিজেদের মেডেল নিজেকেই পরতে হল। বিশ্বের সব বড় বড় অনুষ্ঠানে এখন সবাই মাস্ক পরে থাকছে, সে যত বড় ক্ষমতাবান লোক হোক না কেন, কারও রেহাই নাই। কিন্তু তবুও করোনার বিষাক্ত ছোবল থেকে রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিটা দেশ হিমশিম খাচ্ছে। উন্নত দেশ, অনুন্নত দেশ, ধনী-গরিব, কেউ বাদ পড়ছে না।
করোনার ছোবলে এর মাঝে কত নামী দামি মানুষ, কত বিখ্যাত শিল্পী, রাজনীতিবিদকে আমরা হারিয়েছি। গল্প-উপন্যাসে আগে প্লেগ, বসন্ত, কলেরার মত মহামারীর কথা পড়েছি, কিন্তু কখনও কি ভেবেছিলাম নিজের জীবনে এরকম একটা মহামারী দেখতে হবে! এত মৃত্যুর খবর শুনতে হচ্ছে, কাছের- - - দূরের- - - ! মরতে একদিন হবে, জানি, আগে আর পরে, কিন্তু এই সময়ে সবচেয়ে যেটা কষ্টের মনে হয়, সেটা হোল প্রিয়জনকে শেষ মুহূর্তে দেখতে না পারার বেদনা। অন্য সময় কেউ অসুস্থতার খবর পেলে যেয়ে দেখা করা যেত, কিন্তু এখন বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া থেকে অন্য দেশে যাবার অনুমতি পাওয়া যাবে না। নিজের ভাইবোন অথবা কারও বাবা-মার অসুস্থতার খবর পেয়েও, কেউ কাছে যেতে পারবে না, শেষ দেখা করতে পারবে না। কিযে কষ্ট আর বেদনা, প্রিয়জনের বিপদে তাদের কাছে না যাবার, সাহায্য করতে না পারার!
খবরের কাগজে দেখতে পাই বাংলাদেশে অনেক সময় পরিবারের লোকজন ভয়ে আপন করোনা রোগীর কাছে আসছে না, মৃত্যুর সময়েও। অনেক পরিবারে একদিনে কয়েকজন মারা যাচ্ছে। এমন অনেক নির্মম খবর পড়ে চোখ জলে ভিজে উঠে। বিদেশের মাটিতে আছি অনেকদিন, তবু নিজের জন্মভূমি বাংলাদেশকে ভুলে থাকতে পারি না। দুই এক বছর পর পর ছুটে যেতাম দেশের মাটিতে, নিজের আপনজনদের কাছে। ভাগ্য ভাল তাই, ২০২০ এর জানুয়ারিতে, করোনার আগেই আমরা দেশ থেকে ফিরেছিলাম। জানিনা কখন, কতদিন পরে আবার দেশের মাটিতে পা রাখতে পারব, আপনজনদের সাথে দেখা করতে পারব।
তবে কিছু ভাল খবরও পড়ি খবরের কাগজে। অনেকে এইসময় অনেক ভাল কাজ করছেন। মনটা তখন কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে। যেমন দেখলাম কুষ্টিয়ার একটা গ্রামে একটা মেয়ে সবাইকে অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ করছে বাড়িতে বাড়িতে, যেখানে দরকার। অনেকে জীবন ফিরে পেয়েছে তার কাছ থেকে অক্সিজেন পেয়ে। আর একটা খবরে দেখলাম, একটা গোষ্ঠী, নাম বিবেক, তারা গ্রামের যারা করোনাতে মারা যাচ্ছেন, তাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করছে এবং সেখানে সব ধর্মের লোকই আছে। নিশ্চয় তারা তাদের ভাল কাজের প্রতিদান পাবে। এমন অনেক ভাল কাজ অনেকে করছে, এই দুঃসময়ে, তারা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।
আগে উইকেন্ড আসলে প্লান করা হত আজ কোন শপিং এ যাব, কোন দাওয়াতে যাব, আর এখন শুধু বাসাতেই। তবে হ্যাঁ, এখন আমাদের বাসার ছোট ব্যাকইয়ার্ডে একটু বেশী সময় থাকতে পারি, যেটা খুব উপভোগ করি। আমরা যে এখনো ভাল আছি সেজন্য অনেক শুকরিয়া মহান আল্লাহর কাছে। এত গবেষণা, এত টেকনোলজি তবু প্রায় দুবছর হতে চলল, সারা পৃথিবী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তবে সুখবর যে এখন ভ্যাকসিন এসেছে। এখনকার বিজ্ঞানীরা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার এত অল্প সময়ে ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারার জন্য। আমরা সবাই ভ্যাকসিন নিয়ে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাব। সারা পৃথিবীর অবস্থা দেখে মনে হয় মানুষ কত অসহায়। মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা এই ভয়ংকর মহামারী থেকে আমাদের সবাইকে রক্ষা করুন। আমরা যেন আবার আনন্দ উচ্ছল হয়ে উঠতে পারি, নির্মল বাতাসে মাস্ক না পরে নিঃশ্বাস নিতে পারি। সুন্দর এই পৃথিবীকে আবার সুস্থভাবে ফিরে পাব এই কামনা করি।
ড. ফেরদৌসী জাহান, ক্যাসেল হিল, সিডনি
|