করোনা কালের কথা ড. ফেরদৌসী জাহান
অফিস থেকে বের হয়ে অল্পসময়ে সহজেই চলে এলাম কুমানারা পার্কওয়ে তে। লেডিগেম ড্রাইভ পার হতে মাত্র কয়েক মিনিট লাগলো। ড্রাইভ করে চলেছি দীর্ঘ কুমানারা পার্কওয়ের ১০ কিলোমিটার পথ; সুন্দর শান্ত পরিবেশ, নির্জন রাস্তা, পড়ন্ত বিকেলের স্নিগ্ধ আলোছায়ার মাঝে। রাস্তার দুই ধারে সারি সারি গাছ আর পাহাড়ের সমাহার। কিভাবে যে এই রাস্তাগুলো তৈরি করেছে সেই সময়, এই বিরাট পাহাড় কেটে সেটা ভাবি আর ড্রাইভ করি। উঁচুনিচু ঢেউ খেলে একে বেঁকে চলেছে পাহারের গা ঘেঁষে। করোনার কারণে রাস্তাঘাট অনেক ফাঁকা তাই মাঝে মেঝে গাড়ীর বেগ বেড়ে ৭০ কিলোমিটার হয়ে যাচ্ছে, যদিও গতি সীমা ৬০ কিলোমিটার। মনে পড়ে আগে যখন এই রাস্তা দিয়ে যেতাম, সারি সারি গাছের পাশে থাকতো সারি সারি গাড়ীও। এই ১০ কিলোমিটার পথ যেতে সময় লাগতো ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট। আর এখন মাত্র ১০ মিনিটেই চলে যাচ্ছি এই পথ। খুব অল্প গাড়ী এখন রাস্তায়, কেমন শান্ত নিঝুম নিস্তব্ধ পরিবেশ চারিদিকে।
আজ ২৩ শে এপ্রিল ২০২০। পাঁচ সপ্তাহ হোল আমাদের এখানে লকডাউন চলছে। এই লকডাউনের মাঝে আমাদের অফিস (National Measurement Institute) খোলা রয়েছে। অস্ট্রেলিয়ান সরকারের নিয়ম অনুযায়ী আমাদের অফিস আবশ্যক কাজের মধ্যে পড়ে, তাই অফিস খোলা। আমাদের বিল্ডিংটাও এমনভাবে তৈরি যে আমরা সহজেই সামাজিক দূরত্ব রেখে কাজ করতে পারছি। আমার ল্যাবে এবং অফিসে আমি একাই কাজ করি। ল্যাবে কাজ থাকে তাই আমরা সপ্তাহে ২/৩ দিন করে অফিস করছি আর বাকি দিনগুলো বাসায় থেকে কাজ করছি। তবে এসময় আমাদের অফিস এবং ল্যাবের দরজাগুলো খোলা রাখা হয়, যাতে প্রয়োজন হলে করিডোর থেকে একজন অন্যের সাথে কথা বলতে পারে। কমন এরিয়াগুলো যেমন ক্যান্টিন, জিম, কিচেনেট বন্ধ রয়েছে। শুধু টেকএওয়ে খাবার কেনার জন্য ৩-৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। সব সোফা এবং চেয়ারগুলো উল্টো করে রাখা হয়েছে, যাতে কেউ বসতে না পারে। তাই অফিসে এখন সুনসান নীরবতা। সারাদিনে কারও সাথে দেখা হয় না বললেই চলে। আমাদের মিটিং রুমগুলোর সামনে নোটিস টানানো হয়েছে কতজন ঐ রুমে বসা যাবে। তবে এখন ভার্চুয়াল মিটিং হচ্ছে, জুম, স্কাইপ, এগুলো ব্যবহার করে।
আগের মতো দুপুরে হাঁটতে বের হই। অফিস বিল্ডিং এর চারিদিকে এক কিলোমিটার পথ - রাস্তার ধার দিয়ে শুধু বড় বড় গাছ। অফিসের ভিতরের রাস্তা, লেনকোভ ন্যাশনাল পার্ক দিয়ে ঘেরা। পুরো রাস্তায় কাউকে চোখে পড়ে না। কার পার্কগুলোতে মাত্র অল্প কিছু গাড়ী। উপরওয়ালার কাছে লাখ শুকরিয়া, আমাকে শুধু ঘরে বন্দী হয়ে থাকতে হচ্ছে না। এই লকডাউনের মধ্যেও অফিসে আসতে পারছি। ঘরে বন্দী হয়ে না থেকে এই সুন্দর নিঝুম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারছি। আমার মেয়েরা বাসায় থেকে কাজ করছে, তবে আমার ডাক্তার মেয়েকে অবশ্যই প্রতিদিন হসপিটালে যেতে হচ্ছে। মেয়েটা আমার একদিন বলছিলো “তোমরা প্লান করো কে কিভাবে কোথায় বসে কাজ করবে আর সময় কাটাবে। আমি এখন একটা দিনও ছুটি নেবার কথা বলতে পারবো না”।
পৃথিবীর মানুষগুলো মনে হয় একটু বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সারাটা দিন শুধু দৌড়ের উপর থাকতে হত। অফিসের কাজ, ঘরের কাজ, বেড়ানো, শপিং করা, দাওয়াত, হলিডের প্লান – এইসব লেগেই থাকতো। একেক সময় আমার মনে হতো মানুষের মনের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো যেন হারিয়ে গেছে। এই করোনার কারণে মানুষ একটু স্থিতিশীল হতে বাধ্য হয়েছে। এখন তো আর বাহিরে যাওয়া নেই, রেস্টুরেন্টে খাওয়া নেই, দাওয়াতে রাত জেগে আড্ডা দেওয়া নেই, হলিডে যাবার প্লান করা নেই। বাসায় পরিবারের সাথে এতটা সময় কেউকি দিয়েছে? বাবা-মা, ছেলেমেয়ে যার যার নিজস্ব জগত নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। আর এখন প্রতিদিন প্রতিবেলায় একসাথে খাওয়া হচ্ছে। একসাথে টিভি দেখা হচ্ছে, আলোচনা হচ্ছে পরিবারের সবার সাথে। এখন সপ্তাহের উইকডের দিনগুলো কাজের ব্যস্ততায় কাটলেও উইকেন্ডের দিনগুলো মেয়েদের সাথে নিয়ে নানারকমের খাবার তৈরি, ঘরের অন্যান্য জমানো কাজগুলো করা আর টিভিতে করোনার খবর শুনে কাটছে। সময় মতো খাওয়া, সময় মতো ঘুমানো - সবকিছুর মধ্যে একটা নিয়মানুবর্তিতা দেখতে পাচ্ছি – এটা একটা মূল্যবান পাওয়া বৈকি!
তবে সারা পৃথিবীতে এই ছোট্ট ভাইরাস ‘করোনা’ যে মহামারির সৃষ্টি করেছে তার আতংক আজ সারা বিশ্বে বিরাজমান। টিভির পর্দায় দেখে, আর খবরের কাগজে পড়ে মনটা সব সময় ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে। ছোট-বড়, উন্নত-অনুন্নত, ধনী-গরীব কোন কিছু মানছে না এই করোনা ভাইরাস। আজ বিশ্বের সবগুলো দেশ যুদ্ধ করে চলেছে করোনা থেকে বাঁচতে।
এর আগেও পৃথিবীতে মহামারী এসেছে, অনেক মানুষের জীবন নিয়েছে কিন্তু তখন এমন আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল না। আমার ভাবতে অবাক লাগে আজ এই উন্নত বিশ্বে, আধুনিক চিকিৎসার জগতে মানুষ কেন পারছে না এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে জিততে। প্রতিদিন কত হাজার হাজার মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে করোনা। আমাদের ডাক্তার নার্সরা সবাই অসহায়। হসপিটালে কাজ করতে করতে, এত বেশী মানুষের মৃত্যু সহ্য করতে না পারায় আত্মহত্যার পথ নিয়েছে ডাক্তার-নার্স, এমন ঘটনাও ঘটেছে। তাই উপরওয়ালা কাছে আকুল আবেদন তাড়াতাড়ি আমাদেরকে এই মহামারী থেকে রক্ষা করুন! আবার আমাদের স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসুক। আবার আমরা ব্যস্ত পৃথিবীতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
ড. ফেরদৌসী জাহান, ক্যাসেল হিল, সিডনি
|