bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia












এই লিংক থেকে SolaimanLipi ডাউনলোড করে নিন


গল্প

কোল-ক্লিফ
ফারুক খান


রোববারের অলস সকাল, পুব আকাশের লাল সূর্য ধীরে ধীরে সোনালি হোয়ে উপরে উঠে আসছে। ঘুম ভাঙ্গা পাখীর কাকলীতে ধরণী জেগে ওঠে কিন্তু সিডনি-বাসির ঘুম যেন আর ভাঙ্গেনা! গিন্নী চাদর টেনে পাশ ফিরে শোয়, ঘুমের শেষ আমেজ টুকু আরও কিছুক্ষণ ধরে রাখতে চায়। কিন্তু আমার সেই শৌখিনতার সময় নেই! আলসেমি ঝেড়ে উঠে পড়লাম বিছানা থেকে, নাস্তা সেরে বেরিয়ে পরলাম গন্তব্যের পথে। রাস্তা একেবারেই ফাকা, ল্যাম্প পোস্টের বাতিগুলি এখনো জ্বলছে, হালকা কুয়াশার পর্দা ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছি, পথে কোথাও লোক জন নেই, চার দিকে সুনসান নীরবতা। ছুটির সকালের এই রূপটা আমার খুব ভাল লাগে। কিছুক্ষণের ভিতর পৌঁছে গেলাম ট্রামওয়ে মিউজিয়ামের কাছে। মিউজিয়াম ডানে রেখে একটু এগুলেই ফার্নেল এভিনু। ফার্নেল এভিনুর এই মাথা থেকেই ন্যাশনাল পার্ক শুরু। প্রশান্ত মহাসাগরের তীর ঘেঁষে বিস্তীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চল নিয়ে গড়ে উঠেছে এই পার্ক। পার্কের একদিকে সবুজ তৃণভূমি আর লতা গুল্মের ঝাড় অন্যদিকে গভীর রেইন ফরেস্ট যেখানে দিনের বেলায়ও হেড লাইট জ্বেলে গাড়ী চালাতে হয়। প্রকৃতির এই লীলাভূমিতে কত যে বিনোদনের উপকরণ সাজিয়ে রাখা হয়েছে তা বলে শেষ করা যায় না। বার্ড ওয়াচিং, বুশ ওয়াকিং, মাউন্টেন বাইকিং, পিকনিক, ক্যাম্পিং, সার্ফিং, ফিশিং এর স্বর্গরাজ্য এই পার্ক। এতবার এই পথ দিয়ে যাওয়া আসা করেছি অথচ প্রতিবারই এখানকার সৌন্দর্যে আমি মুগ্ধ হয়েছি। পথের দুপাশে আকাশ ছোঁয়া ইউক্যেলিপ, রেড়গাম আর পাইনের গভীর বন, পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝরনার ধারা, ছোট নদীর কাঁচ চকচকে পানি, লতা-গুল্মের বনজ ঘ্রাণ আর ঝিঝির একটানা আওয়াজ যেন রূপকথার স্বর্গকেও হার মানায়।

রেইন ফরেস্টের ভিতর দিয়ে এঁকে বেঁকে উঠে পরি পাহাড়ের চুড়ায়। সাদার-ল্যান্ড থেকে শুরু হওয়া সবুজ পাহাড়ের শারি প্রশান্ত মহাসাগরের তীর ঘেঁষে মিশে গেছে দিগন্ত সীমায়। এই নীল সবুজের মিলন রেখায় মাঝে মধ্যে দেখা যায় সোনালি বালির বীচ। এমনি একটা বীচের পাশে ছোট্ট একটা গ্রাম, নাম কোল-ক্লিফ। বাইরের লোকের কাছে কোল-ক্লিফের তেমন একটা গুরুত্ব নেই। কারণ এখানে ম্যাকডোনাল্ড নেই, কেন্টাকি নেই, সুপার মার্কেট নেই। এখানকার লোকেরা অসুখ-ব্যাধিতে পাশের শহরে ডাক্তার দেখায়, ছুটির দিনে সেজে গুজে অন্য শহরের নাইট ক্লাবে নাচতে যায়। যে রাস্তাটা কোল-ক্লিফের ভিতর দিয়ে দক্ষিণে চলে গেছে, সেখান দিয়ে লোকজন ফেইরিমিডো, উলংগং, শেল হারবার ছাড়িয়েও আরও বহুদূর চলে যায় কিন্তু ওদের কেউ ক্ষণিকের জন্যও এখানে দাঁড়ায়না বা দাঁড়ানোর প্রয়োজন মনে করেনা। তা নিয়ে অবশ্য এখানের লোকদের মোটেও দুঃখ নেই বরং এভাবে বহিরাগতের প্রভাব থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখতেই তারা বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এখানকার লোকেরা সাগরের মুক্ত বায়ুতে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়, বালুকা বেলায় শরীর উন্মুক্ত করে সূর্যস্নান করে আর মনের সুখে সাগরে মাছ ধরে। এই ছোট্ট গ্রামটার সবাই সবাইকে চেনে, আপন জনের মত সবাই মিলে-মিশে এক সাথে বাস করে, কখনো কারো সাথে মনোমালিন্য হোলে পাবের টেবিলে বসে বিয়ারের গ্লাসে তা মীমাংসা করে নেয়। এখানে সূর্য সাগরের বুক রক্তাক্ত করে ভোরের আলো ফুটায় আর দুপরে পাহাড়ের আড়ালে হারিয়ে গিয়ে সন্ধ্যার বহু আগেই রাতের আঁধার নামায়।

বাইরের লোকজন এখানে না এলেও কোল-ক্লিফের প্রতি আমার বিশেষ একটা দুর্বলতা আছে আর সে জন্যই প্রায় প্রতি গ্রীষ্মে আমি এখানে আসি। কোল-ক্লিফ পৌছতেই বড় রাস্তা ছেড়ে বাম দিকে মোড় নিলাম। এই রাস্তাটা সোজা বীচের দিকে নেমে গেছে। বীচের পাশেই ছোট্ট একটা পার্কিং, ওখানে গাড়ি পার্ক কোরে মাথায় ক্যাপ আর চোখে পোলারয়েড সানগ্লাস লাগিয়ে নিলাম। গত রাতেই প্রয়োজনীয় জিনিষ পত্র গাড়িতে তুলে রেখে ছিলাম। গাড়ির বুট থেকে আমার প্রিয় বীচরড বের কোরে রীল লাগালাম, রীলে ব্রেইড ভরা ছিল, সাথে বিশ পাউন্ডের লিডার। লিডারের এক মাথায় সুইভেল আরেক মাথায় হুক আর সিঙ্কার লাগিয়ে ছিপটা পরীক্ষা কোরে দেখলাম। তারপর কাঁধে ব্যাক-প্যাক, এক হাতে ট্যেকেল বক্সে আরেক হাতে ছিপ নিয়ে গিয়ে বসলাম বীচের দক্ষিণ কোনে আমার প্রিয় মাছ ধরার জায়গাটায়।

আমার থেকে অল্প দূরে হালকা পাতলা গড়নের এক মহিলা মাছ ধরছিল। বীচের কিনারে একটা ফোল্ডিং চেয়ার পাতা, চেয়ারের দু’ধারে দুটি কোরে ছিপ। লক্ষ করলাম মহিলা দ্রুত পায়ে এক ছিপ থেকে আরেক ছিপে ছুটে যাচ্ছে, ছোট ছোট মাছ উঠিয়ে এস্কিতে রাখছে। তারপর নূতন টোপ লাগিয়ে আবার ছিপ পানিতে ফেলছে, মাঝে মধ্যে চেয়ারে এসে বসছে বটে, কিন্তু পরক্ষনেই চেয়ার থেকে উঠে আবার সেই একই কাজ অবিরাম ভাবে কোরে যাচ্ছে। ছিপ দিয়ে যে সব ছোট ছোট মাছ ধরছিল ওগুলি আমি কখনো ধরি না তাছাড়া ওর ছিপ গুলিও বীচ ফিশিং এর জন্য মোটেও উপযুক্ত ছিল না। আমি সমুদ্রের একটু গভীরে আমার ছিপ ফেলে বসে আছি আর অবাক হোয়ে মহিলার অদ্ভুত অঙ্গ ভঙ্গি লক্ষ করছি। দেখে বোঝা যাচ্ছিল ওর ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে খুব কষ্ট হচ্ছিল, শুধু তাই না, ও যখন চলাফেরা করছিল মনে হচ্ছিল কেউ বোধয় পিছন থেকে শক্ত সুতা দিয়ে ওকে বেধে রেখেছে ফলে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু সুতার টানে মেরুদণ্ড পিছনদিকে ধনুকের মত বেঁকে আসছে! কৌতূহলী হোয়ে ঘুরে ফিরে শুধু ওকেই দেখছিলাম আর মাঝে মধ্যে আমার ছিপের দিকে নজর রাখছিলাম।

বড়শিতে মাছ ধরার জন্য আমি নিজ হাতে বানানো বিশেষ এক ধরনের টোপ ব্যাবহার করি। মালেট মাছ দিয়ে তৈরি এই টোপ ব্যাবহার করে আমি কখনো খালি হাতে বাসায় ফিরিনি। কিছুক্ষণ আগে তিন কিলো ওজনের একটা রেড স্নাপার ধরেছি এখন আবার কিছু একটা বড়শিতে গেঁথেছে। বেশ কিছুক্ষণ খেলিয়ে মাছটাকে পাড়ে উঠালাম এটাও আরেকটা রেড স্নাপার। মাছটা বড়শি থেকে খুলে ব্যাগে রাখতে যাব এমন সময় অদ্ভুত উচ্চারণে “নাইস ক্যাচ” শুনে ফিরে তাকালাম, দেখি মহিলাটি পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ব্যাগে মাছ পুরে “থ্যাংকস” বলে মহিলার দিকে তাকালাম। ওর বাড়িয়ে দেয়া হাতে হ্যেন্ডশেক কোরে আমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হলাম। জানলাম ওর নাম নিকিতা, জাপানি বংশোদ্ভূত কোল-ক্লিফেই থাকে। নিকিতার সাথে পরিচয়ের পালা শেষ হবার পর আমাদের দুজনের এটা ওটা নিয়ে আলাপ বেশ জমে উঠল।আমার উৎসাহ দেখে এক পর্যায়ে ও ওর জীবনের গল্প বলা শুরু করল। আমি সাথে নিয়ে যাওয়া চা আর বিস্কিট ওর সাথে শেয়ার করলাম। নিকিতার জাপানি টানে ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বুঝতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। একই কথা বার বার পুনরাবৃত্তি আর অঙ্গ ভঙ্গি করে আমাকে বুঝাতে চাইছিল আমিও আগ্রহ নিয়ে ওকে বোঝার চেষ্টা করছিলাম।

ওর কথায় আমি যা বুঝেছিলাম তা অনেকটা এরকম, নিকিতা জাপানি বিমানের বিমানবালা প্রতি সপ্তাহেই কয়েক বার ওকে সিডনির ফ্লাইটে আসতে হোত। মার্ক মাইনিং কোম্পানির প্রৌকশলী, কোম্পানির কাজে মার্কও মাঝে মধ্যে টোকিও যেতো। এভাবেই আসা যাওয়ার পথে কোন এক ফ্লাইটে মার্কের সাথে নিকিতার পরিচয়, পরিচয় থেকে ভালবাসা তারপর বিয়ে। বিয়ের পর নিকিতা চাকরি ছেড়ে সিডনি চলে আসে, এখানে স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে সুখে ঘর বাঁধে, নিকিতা দিনভর পরিপাটী কোরে ঘর সাজায়, বাগানে ফুলের গাছ লাগায়, নোংরা জামা কাপড় ধোয়, স্বামীর কাপড় ইস্ত্রি করে সাজিয়ে রাখে, মার্কের ফেরার সময় হলে খাবার বানিয়ে পথের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করে, সন্ধ্যায় মার্ক বাসায় ফিরেই নিকিতাকে বুকে টেনে আদর, সোহাগে ভরে দেয়। ছুটির দিনগুলিতে দুজনে মিলে সিনেমা দেখে, শপিং করে, রেস্তরায় খায় আর সারাদিন ঘুরে বেড়ায়। এভাবেই দেখতে দেখতে বছর পার হোয়ে যায়। হঠাৎ একদিন নিকিতা বুঝতে পারে সে সন্তান সম্ভবা। ওরা দুজনে মিলে একসাথে ডাক্তারের কাছে যায়, ডাক্তার ব্যাপারটা ওদের নিশ্চিত করে। নিকিতা দশ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা! খবরটা জানতে পেরে মার্কের মুখ শুকিয়ে যায়, ও এই মুহূর্তে সন্তানের বাবা হবার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলনা। মার্ক নিকিতাকে চাপ দিতে থাকে গর্ভপাত করানোর জন্য কিন্তু নিকিতার মাতৃ হৃদয় কোনভাবেই এই প্রস্তাব মেনে নিতে পারছিলনা, কিভাবে মা হোয়ে নিজের গর্ভে ধরা সন্তানকে মেরে ফেলবে? না এ কিছুতেই সম্ভব না! অনেক চিন্তার পর নিকিতা সিদ্ধান্ত নেয় কোন কিছুর বিনিময়য়েও সে তার ঔরসে ধারণ করা সন্তানের ক্ষতি হতে দেবেনা। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে প্রথমে মনোমালিন্য, ঝগড়াঝাঁটি তার পর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ছাড়াছাড়ির পর নিকিতা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় জাপানে বাবা মা’র কাছে ফিরে যেতে চাইলেও কি মনে কোরে শেষ পর্যন্ত এখানেই থেকে যায়। এক কাপড়ে বাসা থেকে বের হোয়ে কপর্দকহীন অবস্থায় সোশাল ওয়েলফেয়ারে নাম লেখায়, ওয়েলফেয়ারের মহিলা কোল-ক্লিফে নিকিতার জন্য ছোট্ট একটা বাসা ঠিক করে দেয়, সেই থেকেই ও এখানেই আছে।

ওদের বিচ্ছেদের পর নিকিতার নিঃসঙ্গ জীবন আরও দুর্বিষহ হোয়ে ওঠে। অর্থনৈতিক দৈনতা, শারীরিক অসুস্থতা আর মানুষিক চাপে এমনিতেই সে জর্জরিত তার উপর ভাষার দূরত্ব তার জীবনকে আরও হতাশাগ্রস্থ করে তোলে। নিষ্ফল আক্রোশে কয়েক বার সে আত্মহত্যা করতে চেয়েছি কিন্তু সন্তানের দিকে তাকিয়ে সব ভুলে আবার নূতন করে জীবন শুরু করেছে। সেই থেকে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ অবস্থায় ছেলেকে তিল তিল কোরে বড় করে তুলেছে। নিকিতার ছেলের বয়স এখন ২২ বছর ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। নিকিতা ইংরেজিতে খুবই দুর্বল বলে প্রথম দিকে চাকুরী পেতে খুব কষ্ট হয়েছিল। এখন সে একটা চাকরি করে তা দিয়ে মা আর ছেলের দিন চলে যায়। আমাদের আলাপের মাঝে লক্ষ করছিলাম কি প্রকট ভাবে একাকী জীবন যুদ্ধের নির্মম স্বাক্ষর গুলি নিকিতার মুখে স্পষ্ট হোয়ে ফুটে উঠেছে। জীবনের সাথে দীর্ঘ সংগ্রামে কপাল আর চোখের দু’পাশের দাগ গুলো যেন বড়শির সুতার মত স্থায়ী ভাবে বসে গেছে। ওকে দেখে খুবই ক্লান্ত আর পরিশ্রান্ত মনে হচ্ছিল কিন্তু এত কিছুর আড়ালেও সাহস আর আত্মবিশ্বাসে ভরা ওর ডাগর কালো চোখ দুটো নবজাত শিশুর চোখের মত চক চক করছিল। নিকিতা বলছিল গত বছর ওর স্ট্রোক করেছিল সেই স্ট্রোকে তার শরীরের ডান দিকটা অবশ হোয়ে যায়। ডাক্তার বলেছে মাছ ধরা ওর জন্য ভাল আর সে জন্য সময় পেলেই ও মাছ ধরতে আসে। ওর কথা শোনার পর লজ্জায় আমার মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছা করছিল। এই বিশেষ ভঙ্গিতে হাটার কারণে কৌতূহলী হোয়ে বার বার আমি ওকে দেখছিলাম অথচ কখনো ভাবিনি এই ছোট খাটো মহিলাটির ভিতরে এমন একটা মহীয়সী মা লুকিয়ে আছে যার দেনা পৃথিবীর সমস্ত শ্রদ্ধা দিয়েও পূরণ করা যায়না! ওর দিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই চোখ দুটো ঝাপসা হোয়ে এল!



ফারুক খান, সিডনি

Photo: http://www.leeduguid.com.au/blog/latest-images/coalcliff-australia/







Share on Facebook               Home Page             Published on: 22-Jul-2015

Coming Events:
বৃষ্টির সম্ভাবনার কারণে মেলার তারিখ ১ দিন পিছিয়ে ২১ এপ্রিল ২০২৪ (রবিবার) করা হয়েছে......




A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far