লন মোয়ার জেমস ফারুক কাদের
প্রথম যেদিন আমার বাড়ীর ব্যাক ইয়ার্ড আর সামনে খোলা জাগায় ঘাস কাটার অবস্থা হল, ঘাস কাটার মেশিন তখন কেনা হয়নি। এদিকে কয়েক দফা ভাল বৃষ্টির পর ঘাস সাঁই সাঁই করে বাড়ছিল। রাস্তার ওপারে থাকে সত্তোর্ধ সিঙ্গেল অজি মহিলা ক্যারলের কাছে জানতে চাইলাম, পরিচিত লন মোয়ার কেউ আছে কিনা! ক্যারল বলল, তুমি জেমস মোয়ারকে দেখ নাই? আমি নম্বর দিয়ে দিচ্ছি, ফোন করে খবর নাও। এক কাজ করা যায়, এই উইক-এন্ডে আমার লন মো করব। আমি বলে দেব তোমারটা ও করে দিয়ে যাবে। আর হ্যাঁ, যদি ফ্রন্ট ইয়ার্ড ও ব্যাক ইয়ার্ড এক সাথে কর, খরচ কম পড়বে। শেষে জেমসকে ফোন করে আসতে বললাম।
নির্দিষ্ট দিনে সময় মত জেমস এক পিকআপে তার ঘাস কাটার যন্ত্র চড়িয়ে আমার বাসায় এসে হাজির। মাথায় হ্যাট, হাতে পায়ে অদ্ভুত ট্যাটু, গালে উসকো-খুসকো কাঁচা পাকা দাড়ি, গায়ে খাকি রঙের শার্ট ও হাফ প্যান্ট, পায়ে বুট। মো করার আগে তার রেট বলে গেল জেমস। “তুমি সিনিয়র, আমি তোমাকে ১০% ডিসকাউন্ট দেব।“যাবার সময় জেমসের তাড়া লক্ষ্য করলাম, “মাইট, কারিন্ডা স্ট্রীটে আরো দুটো লন মো করতে হবে, সি ইউ।”
জেমস অনেক বছর ধরেই লন মোয়িং, গাছ কাটা, লন মোয়ার মেরামত, রুফ ক্লিনিং এর কাজ করে আসছে কারিন্ডা স্ট্রীটে। বাড়ীর অপ্রয়োজনীয় ও অবাধ্য গাছপালা, বা প্রতিবেশীর সমস্যা করছে এমন গাছ ও সে কেটে থাকে। কেউ যদি লন মো করার জন্য কাউকে জেমসের রেফারেল দেয়, তবে জেমস তাকে একটা ফ্রি লন মো করে দেয়। ওকে সবাই জেমস মোয়ার বলেই ডাকে। কেউ শুধু বলে মোয়ার। কারিন্ডা স্ট্রীটের অনেকেই জেমসের ক্লায়েন্ট। ক্লায়েন্টের মধ্যে ক্যারল ছাড়াও আমার এক প্রতিবেশী ওয়াল দম্পতিও আছে। বাড়ীর লন মো করার সুবাদে জেমসের সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠল।
গাছ কাঁটার সময় জেমস একটা টিম নিয়ে আসে, সাথে থাকে একটা ট্রাকে চাপান গাছ কাটার নানা যন্ত্রপাতি: চেইন সও, ওয়েজ, হাতুড়ি, শাবল আর কাটা গাছ থেকে মালচ তৈরির ভারী মেশিন। এই মেশিন দিয়ে বড় বড় গাছের কাণ্ড ও গুড়ি বিকট শব্দে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে চুড়ে দিয়ে মাটির চাড়ার সাইজের মালচ তৈরি করা এক এলাহি কায় কারবার! মালচ মানুষ সবজী বাগানের চারা ও উঠতি গাছের গোরায় ছড়িয়ে দেয় যাতে মাটি জল ধরে রাখে। এই বড় গাছ মরে যেয়েও মানুষের কত উপকার করে! বাগানে সদ্য ছিটিয়ে দেয়া মালচ থেকে নেশা লাগাবার মত একটা ভেজা তীব্র বুনো গন্ধ বের হয়।
আমার প্রতিবেশী ওয়াল দম্পতির বাড়ীর অনেক বড় একটা ইউক্যালিপটাস গাছের ডাল পালা আমার বাড়ীর উপরে এসে পড়েছে। অনেক সময় এসব গাছ ঝড়ে পড়ে যায়, তাই প্রচণ্ড ঝড়ের সময় দুর্ভাবনা হয় বৈকি। আমি অবশ্য ওয়ালকে আমার দুর্ভাবনার কথা বলিনি। কিন্তু একদিন দেখি জেমস তার টীম নিয়ে এ গাছ কাটতে লেগে গেছে। বড় গাছ, অনেক সময় লাগল গাছ কাটতে। জেমস গাছ থেকে পাওয়া মালচ থেকে এক বস্তা আমাকে ও দিয়ে গেল।
মাস তিনেক জেমসকে দিয়ে বাড়ীর লন মো করালাম। তারপর একটা লন মোয়ার কিনে ফেলি। তখন থেকে আমার স্ত্রী ব্যাক ইয়ার্ডের লন মো করে। ফ্রন্ট ইয়ার্ড আমি আর ছোট ছেলে অনীক ভাগাভাগি করে করি।
জেমস আর একবার যখন কারিন্ডা স্ট্রীটে গাছ কাটতে এল, তখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওর সাথে গল্প করছিলাম। জেমসকে বলি, ঘাস কাটার সময় খেয়াল করেছে ঘাসে কত নানা জাতের ও রঙের ছোট ফুল ফোঁটে। ওদের জন্য তোমার মায়া হয়না? জেমস এমন ভাবে তাকাল যেন আমি জোক করছি। ফুল দেখেছি, কিন্তু মায়া হবে কেন? যত অপ্রয়োজনীয় গাছ, ফুল, লতা পাতা, আগাছা কেটে সাফ সুতরো করে লন ও বাড়ীর আশপাশ তকতকে মসৃণ করাই তো আমার কাজ। এদের নামও তো আমি জানিনে। ফানি ব্যাপার, তোমরাই আমাকে দিয়ে কাজটা করাও! ঠিক আছে, আমরাই করাই। আমি বলতে চেয়েছিলাম, ব্যাপারটা তোমাকে ভাবায় কিনা? এই যে লতা পাতা গাছ এদেরও প্রাণ ও অনুভূতি আছে। এরাও আঘাত পেলে ব্যথা পায়। তুমি বা আমরা যখন ঘাস কাটি, তখন ঘাস ফুল ভয়ে কাঁপে। বলে, আমাকে কেটোনা, আর কটা দিন বাঁচতে দাও। আমি জেমসকে আমাদের দেশের লজ্জাবতী চারার কথা বললাম। বললাম, আমাজন ফরেস্ট ছোট হয়ে আসছে; ইউক্যালিপটাস বন উজাড় হয়ে অস্ট্রেলিয়ার আইকন প্রাণী কোয়ালার আবাস হুমকির মুখে। আমি জেমসকে প্রশ্ন করি, তুমি কি বাগান করেছ বা গাছ লাগিয়েছ কোনদিন? জেমস যেন আকাশ থেকে পড়ল: এসব কোনদিনই ভেবে দেখিনি। আমি সিঙ্গেল মানুষ, আমার কেউ নেই। ঘাস আর গাছ কাটি, অন্য সময় পাবেই পড়ে থাকি। এসব ভাবার সময় আছে! বাগান করে কি হবে? আমাদের গল্প আর জমে উঠলনা।
জেমস এখনও কারিন্ডা স্ট্রীটে লন মো করতে আসে, আগের মত ঘন ঘন নয়। গাছ কাটতে আর দেখিনি। দেখা হলে জেমসের হাই হেলোতে আগের মত আন্তরিকতা খুঁজে পাইনা। এ রকম বদলে গেল মানুষটা। মনে হয় আমাকে এড়াতে চায়। আরেকটা কথা বলা হয়নি। ওয়াল একদিন আমাকে ওর বাড়ীর বড় ইউক্যালিপটাস গাছ কেটে ফেলার গল্প শোনায়। শুরুতে ওয়াল জানতে চায়: ফারুক, জেমসকে আমার কাছে তুমি পাঠিয়েছিলে গাছ কেটে ফেলার কথা বলতে? আমি বলি, এমন কিছু হলে আমিই তোমাকে বলতাম। জেমস আমাকে বলেছিল সে স্বপ্নে দেখেছে ঝড়ে গাছটা পড়ে ভাঙ্গা ডাল পালা ফারুকের বাড়ীর ছাদ ফুটো করে দিয়েছে। ফারুক, স্বপ্ন বাস্তবে ফলে যাবে আমি এসব বিশ্বাস করি না। কিন্তু জেমস এমন পীড়াপীড়ি করছিল, আমি শেষে তাড়া হুড়ো করে ওকে দিয়ে গাছটা কেটে ফেলি। যদিও গাছটার অনেক বয়স হয়েছিল।
অনেক দিন ধরে জেমসকে দেখিনা। ইদানীং লন মোয়ের কাজ অন্য কেউ করছে। আমি ক্যারল কে বললাম, জেমসের কি হয়েছে জান কিছু? জেমস লন মো করা ছেড়ে দিয়েছে। ক্যারলের কাছ থেকে জেমসের মোবাইল নাম্বার নিয়ে ফোন করি। “সরি মাইট, আমি লন মো করিনা এখন; মো করাতে চাইলে ০৪২৫….এ কল কর” ম্যাসেজ এল। এর পর আর ও অনেক দিন চলে গেছে। জেমসের নম্বরে ফোন করে দেখি ইনভ্যালিড নাম্বার। আমার কৌতূহল হোল, লোকটা এরকম হাওয়া হয়ে গেল!
খোঁজ নিয়ে জেমসের বাড়ী গেলাম। এ বাড়ীতে জেমসের পালক ছেলে রবার্ট থাকে। জেমস মারা গেছে, রবার্ট বলল। জেমস এর গ্রেভ ইয়ার্ডে যেতে চাও, কাছেই। আমি বললাম, চল। পাশেই একটা বনের মাঝে উঁচু জাগায় পাকা গাঁথুনির বেড় দেয়া জেমসের খুবই সাধারণ গ্রেভ ইয়ার্ড। চারপাশে উঁচু ইউক্যালিপটাস গাছ; নির্জন ও নীরব প্রকৃতি। ওর কবরটা ঘাসে ভরে গেছে, তাতে নাম না জানা অনেক রঙিন ক্ষুদে ফুল অবাক চেয়ে আছে! রবার্ট বলল, জেমস ঘাস কাটতে মানা করে গেছে।
ফারুক কাদের, সিডনি
|