রঙের মানুষ ফারুক কাদের
সিডনীর ক্যাম্পবেলটাউনের বাংলাদেশী সম্ভূত এলাকায় গোটা তিনেক বাংলাদেশী মালিকানাধীন গোসারি শপ আছে: প্রিয় বাংলাদেশ, বঙ্গ বাজার ও টুকিটাকি। এর মধ্যে প্রিয় বাংলাদেশ আমার নিকটতম। এই গোসারি শপের বুচার বা কশাই বা প্রয়োজনে শপ ম্যানেজার কাম হিসাব রক্ষক মোশতাক ভাই আমার দেখা এক সহজ সরল মজার মানুষ। মোশতাক ভাই মানুষটির সাথে তার মূল বুচারি পেশা মিলান কষ্টকর। তাকে বরং চটকদার পান-বিড়ি-চা-সিগারেটের এক দোকানদার হিসাবে মানানসই লাগত - যে হাসিমুখে সবাইর হাতে পানের খিলি আর সিগারেট তুলে দিচ্ছে আর নিজে পান চাবাচ্ছে।
ছোটবেলায় পুরানো ঢাকার রায়সাহেবের বাজার বা ঠাঁটারী বাজারে গরু, খাসির গোশত কিনতে যেতাম। সেখানে পাকান মোঁচধারী ও ভুড়িওয়ালা ঢাকাইয়া কসাইদের চাপাতি দিয়ে গোশত কাটা নিরাপদ দূরত্ব থেকে দাঁড়িয়ে দেখেছি। এরা যেভাবে দুই-তিনটা কোপ আর একটা হাড় মটকে খাসীর একটা আস্ত রানের গোশত আলাদা করে ফেলত, বা গোশতের কিমা বানাত তা অবাক হয়ে দেখতাম। মাঝে মাঝে গোশত, চর্বি ও হাড়ের ভাঙ্গা টুকরো গায়ে এসে লেগেছে। এই ভীতিকর দৃশ্যের সাথে মোশতাক ভাইকে কল্পনা করা রুচি বিরুদ্ধ কাজ হবে।
আমি ঢাকায় বসে স্ত্রীর কাছ থেকে ফোনে মোশতাক ভাইর সংবাদ পাচ্ছিলাম। মোশতাক ভাই জানতে চাইছে, শুনলাম ভাই ঢাকায় বড় চাকরী করে! ভাই কি আর অস্ট্রেলিয়া আইবো না? আমাগো কি ভুইলা গেল?
অস্ট্রেলিয়ায় অবশ্য আপনি যে পেশার চাকরীই করেন - বুচার, ক্লিনার, ড্রাইভার, ড্রেসার - যাই হোক আপনাকে কোর্স করে পরীক্ষায় পাশ দিয়ে লাইসেন্স অর্জন করে চাকরীতে আসতে হবে। মোশতাক ভাইর অর্জিত বুচার লাইসেন্স শপের দেওয়ালে ফ্রেমে বাঁধাই করে ঝোলান আছে। কারো যাতে সন্দেহ না জাগে, এই ছোটখাটো শুকনো পাতলা মানুষ যে ফ্রেঞ্চদের মত কিছুটা নাকি সুরে মোঁচের ফাঁকে মুচকি হেসে কথা বলেন, সে বুচার কি করে হয়!।
ইন্ডিয়ান কাস্টমার এলে উল্টো পাল্টা মিশেল বাংলা-হিন্দী কথার ফুলঝুরি মোশতাক ভাইর মুখ থেকে বের হয়: আপকা বাল-বাচ্চা কেয়সা হ্যাঁয়? কয় কিলো গোশত লাগে গা? আপকা পাস ভাংতি নাই? আমি শপের এক কোনায় দাঁড়িয়ে মোশতাক ভাইর দাগান বাংলা-হিন্দী ভোকাবলারী উপভোগ করি।
প্রিয় বাংলাদেশের মালিক আরাম প্রিয় মানুষ, শপে তেমন থাকেনা। মোশতাক ভাইকে শপের দায়িত্ব চাপিয়ে উনি কি করে বেড়ান তা অবশ্য আমার জানার প্রয়োজন নেই। মোশতাক ভাইকে তাই গোশত কাটা ও বিক্রয় ছাড়াও দোকান সামাল দিতে হয়। সে হিসেবে উনি এই গোসারি শপের পার্ট টাইম ম্যানেজারও বটে। কিন্তু গায়ে সব সময় গোশত কাঁটার সময়কার পরিধেয় বস্ত্র চাপিয়ে সব কিছু ম্যানেজ করেন। মোশতাক ভাই যখন ভিতরে কোল্ড রুমে মেশিনে গোশত কাটেন তখন শপে সিডিতে হিন্দী গান বাজে। আমি একদিন বলি, ভাই রবীন্দ্র সঙ্গীত বা অন্য বাংলা গান বাজাইতে পারেন না? ভাই যে কি কন, গোশত কাডার সময় গা গরম করা হিন্দী গান বাজাইতে হয়, জানেননা আপনে?
কোরবানি ঈদের সময় চলে এসেছে। মুশতাক ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই এইবার কোরবানি গরুর গোশত ভাগা কত টাকা ঠিক করলেন? আপনে কুরবানি দিবেন না? ভাই এইবার দেশে মার সাথে কুরবানির ঈদ কইরবো বইলা ঠিক করছিলাম; করোনা সব ভণ্ডুল কইরা দিল। দেশে আমার ভাতিজারে কইছি আমার নামে একটা গরু কোরবানি দিতে। ভাতিজা বলছে কুরবানির লাইভ ভিডিও আমারে দেখাইব ঈদের দিন।
কোরবানির পর মুশতাক ভাইর সাথে দেখা। জিজ্ঞাস করি, গরু কোরবানির ভিডিও দেখছিলেন? ভাই, মহা গ্যাঞ্জাম হইয়া গেছে। গরু জব দেয়ার সময় লাফ দিয়া উইঠা ভাতিজারে গুঁতা দিয়া জখম করছে, ও ভিডিও করতেছিল। ভাতিজারে হাসপাতালে নিতে হইছে। গোডা তিরিশ সিলাই দিতে হইছে। চিকিৎসার খরচ সব আমার। দেহেন কত ফ্যাসাদ। ভাই, আমার মনে অয় গরু ভিডিও করা পছন্দ করে নাই।
অনেকদিন পর আমি বিকেলবেলায় ফুটপাত দিয়ে হাঁটছি। হঠাৎ একটা ড্রাইভিং ট্রেনিং কার ফুটপাতের পাশের রাস্তায় থামল। দেখি ইন্সট্রাক্টরের সীটে মুশতাক ভাই বসে আছেন। ড্রাইভিং সীটে এক তরুণী মহিলা স্টিয়ারিং ধরে আছে। মুশতাক ভাই বললেন: ভাই, প্রিয় বাংলাদেশের চাকরী আমি ছাইড়া দিসি। আপনার ভাবী কইল, ছেলেমেয়ে বড় অইছে, বিয়া দিতে অইবোনা! আর কতদিন বুচারের চাকরী করবা? আমি অহন গাড়ী ড্রাইভিং ইন্সট্রাক্টর অইছি। ভাই আমার বিজনেস কার্ড রাখেন, আমার ছাত্রীর আগামীকাল টেস্ট। বাসায় আইসেন।
আমি মুশতাক ভাইর অপসৃয়মান গাড়ীর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকি। তারপর বিজনেস কার্ড দেখে আমার মোবাইলে মুশতাক ভাইর ডিটেল আপডেট করে নিলাম।
ফারুক কাদের, সিডনি
|