পালাবদল ফারুক কাদের
আনুষ্ঠানিক ভাবে অস্ট্রেলিয়ায় শীত এসেছে ১লা জুন। কিন্তু ঋতুর পালাবদল তো ক্যালেন্ডারের পাতা অনুসরণ করে হয়না, কিছুটা হেরফের তো হতেই পারে। প্রকৃতির পালাবদল দেখে আমরা বরং ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টোই প্রকৃতির আচরণ সঙ্গতিপূর্ণ কিনা নিশ্চিত হতে। এবার হেমন্তের শেষে শীতের আগমন কাছে থেকে দেখেছি। আমার বাড়ীর রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি গাছ: ইউক্যালিপটাস, গাম, আকাশিয়া, ম্যাপল, ক্যাকটাস, ও আরও অনেক নাম না জানা গাছ। একটি ম্যাপল গাছ অন্য সব গাছ থেকে আলাদা করে চোখে পড়ে। হেমন্ত-শীতের পালাবদল এ গাছের সর্বাঙ্গে অভিনীত হয়ে যাচ্ছে। আর আমি যেন থিয়েটার দর্শক, মুগ্ধ হয়ে দেখছি। হেমন্তের শুরুতে ম্যাপল গাছের সবুজ পাতার রং বদলে যায়: প্রথমে মেরুন তারপর উজ্জ্বল হলুদ। একই গাছে সবুজ, মেরুন আর হলুদ রঙ্গের পাতার বর্ণীল সমাহার। ধীরে ধীরে হলুদ রং ম্রিয়মাণ হয়ে আসে। শীতের হাওয়া বয়ে আনে পাতা ঝরার গান: শিহরন জাগিয়ে দেয় ম্যাপল পাতার শিরায় শিরায়! পাতারা কেঁপে কেঁপে ওঠে, আর দলে দলে পাখীর পালকের মত ধরার বুকে ঝরে পড়ে। শুরুতে গাছের উঁচু অংশ পত্র-শূন্য হতে থাকে। একে একে সব পাতাই ঝরে পড়ে। ম্যাপল গাছ তার পত্রাভরণ হারিয়ে দীনহীন নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। কবে আবার বসন্ত আসবে তারই প্রতীক্ষা।
আমার প্রতিবেশী সত্তুরোর্ধ ক্যারল, তার বাড়ীর নাম রুবী রোজ কটেজ। শুনেছি রুবী ক্যারলের মায়ের নাম; মায়ের কাছ থেকে ক্যারল বাড়ী উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। ক্যারল একা থাকে; বাড়ীর সামনে এক সুন্দর বাগান করেছে ও। এ প্রচণ্ড শীতেও লাল, সাদা ও হলুদ গোলাপ, অন্য বাহারি ফুলের মিষ্টি হাসি অম্লান। ক্যারল শীতের সময় খুব একটা বের হয়না। এ পাড়ায় ক্যারল পঞ্চাশ বছর ধরে আছে। ওর দু'ছেলে শহর থেকে দূরে গ্রামে থাকে। কালে ভদ্রে দেখা করতে আসে।
এ কদিন শীত পড়েছে বেশ। কুয়াশা আর মেঘের মাঝামাঝি অস্বচ্ছ কিছু একটা সারা আকাশ ডোমের মত ঢেকে রেখেছ। মাঝে মাঝে আড়ালে থেকে সূর্য হাড়কিপটের মত আলো দিয়ে যায়। গাছের সব পাতা বিবর্ণ হলুদ। শিথিল বায়ে একটা দুটো করে পাতা ঢেউ তুলে গাছের নীচে বৃত্তাকার জাগায় লুটিয়ে পড়ছে ঘাসের উপর। তারপর সে পাতাই উড়ে উড়ে গাটারে আর আশে পাশে বাড়ীর ফেন্সের গোঁড়ায় জমছে।
গাছের ঝরা পাতা উড়ে রুবী রোজ কটেজের আঙ্গিনায়ও এসে জমেছে। একদিন দেখি ঝাড়ু দিয়ে পাতা জড় করছে ক্যারল। ক্যারলের বয়স হয়েছে, তারপরও সবকিছু নিজ হাতে করার চেষ্টা করে। মনে হল ধকল যাচ্ছে। আমি এগিয়ে গেলাম: ‘তোমাকে সাহায্য করি?’ ‘অনেক ধন্যবাদ ফারুক, আমার কাজ আমাকে করতে দাও। হতচ্ছাড়া ম্যাপল গাছটা আমাকে খুব জ্বালাচ্ছে। সব পাতা ঝরে গেলে বেঁচে যাই।‘ ‘গাছটার ওপর তোমার রাগ বুঝি? কটা দিন সবুর কর, ওর পাতা ঝরার দিন শেষ হয়ে এল বলে।‘
ঝাড়ু গুটিয়ে ক্যারল নীরবে গাছটা দেখল কিছুক্ষণ, তারপর কটেজে ঢুকে পড়ল। পালাবদলের ঢেউ এসে লেগেছে এপাড়ায়। বাড়ী-ঘর কেনা বেচার হিড়িক পড়েছে; পুরনো বাড়ী ভেঙ্গে উঠছে নতুন বাড়ী ঘর। পুরনো মানুষরা সরে যাচ্ছে, নতুন মানুষ বসতি গড়ছে। নতুনদের সবাই পরিযায়ী মানুষ: বাংলাদেশী, নেপালি, ইন্ডিয়ান, আইল্যান্ডার, ভিয়েতনামিজ; বাংলাদেশীদেরই সংখ্যা বেশী। ড্রাইভওয়ে আর রাস্তায় পার্ক করা গাড়ীর সংখ্যা নাটকীয় ভাবেই বাড়ছে। আর রাস্তার দু পাশে বাড়ী বিক্রির নোটিশ অহরহ দেখতে পাচ্ছি। রিয়েল স্টেট ব্যবসায়ীরা ভীষণ ব্যস্ত।
পাঁচ বছর আগে, আমি সিডনী ছেড়ে ব্রীজবেন যাব শুনে ক্যারল কিছুটা হতাশ। জীবিকার প্রতি পরিযায়ী মানুষের সম্মূখটানের তীব্রতা অনুভব করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। ফ্যামিলি রেখে যাব শুনে আশ্বস্ত হল। পাড়ায় বাইরে থেকে আসা মাল্টি-কালচার জনগোষ্ঠীর ভিড় আর প্রাচীন এংলোস্যাক্সন-বাসীদের বসতি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হওয়া ক্যারল কে দুর্ভাবনার মধ্যে ফেলেছে সম্ভবতঃ। ক্যারলের খেদ, ‘আমার আশেপাশে যদি তোমার মত আরও প্রতিবেশী থাকত!’ সেকি আমাকে তার এংলোস্যাক্সন প্রতিবেশীদের বিকল্প ভাবছে, জানিনা। তবে আমি বুঝি ক্যারল আমাদেরকে অন্য ভাবে দেখে, কারণ আমরা যেচে গিয়ে কথা বলেছি; আমার ও আমার স্ত্রীর নিসর্গ প্রীতি আর বাগান করার সখ ওকে আকর্ষণ করেছে। রাস্তায় দেখা হলে আমরা সময় নিয়ে ওর সাথে কথা বলি। এদেশে নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ বৃদ্ধারা কথা বলার মানুষ পেলে বেঁচে যায়, সে সাদা হোক আর কালো।
ব্রীজবেন থেকে সিডনী ছুটিতে আসলে পরে রাস্তায় মাঝে মাঝে দেখা হয়েছে। ক্যারল মজা করে বলত, সালমা তোমাকে সময় দিচ্ছে তো, মজার খাবার খাওয়াচ্ছে বুঝি। জলদি বাড়ী যাও, সালমা খাবার সাজিয়ে বসে আছে। আমার স্ত্রী সালমা অসুস্থ জেনে একবার ওর জন্য ফুলের তোড়া পাঠিয়েছিল। ফুল গাছপালা নিয়ে কথা হলে খুব আগ্রহ দেখাত, ওর বাগানের ফুলের কথা বলত আবেগ নিয়ে। এ পর্যন্ত ক্যারলের বাসায় আমাদের যাওয়া হয়নি; আমরা ও বলতে পারিনি, ক্যারল, আমাদের বাড়ী এসে এক কাপ কফি খেয়ে যাও। আমাদের কথাবার্তা হয়েছে রাস্তায় আর বাড়ীর আঙ্গিনায়। আমরা আমাদের কমফোর্ট জোনের বাইরে যাওয়ার সাহস করিনি বা আমরা কেউ কাকে ভাল করে বুঝে উঠতে পারিনি। পাঁচ বছর ব্রিজবেনে জীবন কাটিয়ে সিডনী ফিরে এসে ক্যারলের সাথে শুধু একবার দেখা। রোজ গার্ডেনে দাড়িয়ে ছিল রোদে, ওভারকোটে গা ঢাকা। মুখে বলিরেখা গুলো হিমশীতল আবহাওয়ার নিষ্পেষণে যেন দুমড়ে মুচড়ে গেছে। আমি এগিয়ে গেলাম। ‘কেমন আছ ক্যারল?’ ‘ফ্লু আমাকে ভীষণ ভোগাচ্ছে। মনে হচ্ছে ফ্লু আমাকে কবর পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাবে, আমার চার নম্বর এন্টিবায়োটিকের ডোজ চলছে। আর কত! প্রতিবছর ভ্যাকসিন নিচ্ছি আর এন্টিবায়োটিক গিলছি।’ ‘কেউ তোমাকে দেখা-শোনা করছে?’ ‘মিটাগং থেকে বব এসেছিল। আমি গেট থেকে ওকে বিদেয় করে দিয়েছি। বললাম, ভাগো, এখানে পারত পক্ষে এসনা, পারলে ফোনে বুড়ো মায়ের খোঁজ নিও। এ পাড়া থেকে অনেকেই চলে যাচ্ছে। আমি একবারে সিমিটারীতেই চলে যাব না হয়। আমি বাপু ওল্ড-হোমে যেতে পারবনা। যতদিন পারি, রুবী রোজ কটেজ আগলিয়ে রাখব।‘ ক্যারলকে এতটা অস্থির লাগেনি কখনও। ওর সুস্বাস্থ্য কামনা করে চলে এলাম। মাঝে প্রচণ্ড শীত জেঁকে বসেছিল। ট্রেনে সিটি যাওয়ার সময় গ্লেনফিল্ডের গল্ফকোর্স দেখলাম কুয়াশার পুরু এক আস্তরণে ঢাকা পড়ে গেছে। ট্রেনে বসে আমি যেন কুয়াশার জলকণা দেখতে পাচ্ছিলাম। আসার সময় পথে দেখেছি ঘাসের উপর হিমকনা জমেছে। শীতের রাতের হিমশীতল স্পর্শ শিশিরকে করেছে হিমকনা, কেড়ে নিয়েছে প্রথম সূর্যের আলো বিচ্ছুরণ করার আশ্চর্য ক্ষমতা। ক্যারলের বাড়ীর সামনে ম্যাগনোলিয়া ফুল গাছ তার পত্রাভরণ বিসর্জন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নগ্নিকার মত। ডালে ডালে একটি দুটো করে নূতন ফুলের কুঁড়ি ঘুম থেকে যেন জেগে উঠছে।
ক্যারলকে অনেক দিন দেখিনি: বার্ধক্য আর জড়া হয়তো ওকে ধীরে ধীরে কাবু করে ফেলছে। জড়ার বিরুদ্ধে মানুষের এ অসম লড়াইর ফলাফল একটাই: মানুষের আত্মসমর্পণ। রুবী রোজ কটেজের ভেতর ক্যারল এখন কি করছে: হয়তো ব্যাক-ইয়ার্ডে রোদ পোহাচ্ছে, না হয় টিভি দেখছে। ক্যারলের বাড়ীর সামনের ম্যাগনোলিয়া গাছ সাদা নীলাভ ফুলে ফুলে গেছে ছেয়ে। ম্যাপল গাছ এখনও পত্র-শূন্য – বসন্ত প্রতীক্ষার এখনও অবসান হয়নি। রুবী রোজ কটেজের গোলাপের হাসি এখনও অম্লান।
অনেক দিন পরে আকাশে ঝলমলে রোদ হেসেছে। নির্মেঘ সুগভীর নীল আকাশ থেকে আলোর ঝর্ণাধারা আসছে নেমে। পরমা-কান্তি ও বিমল এ আলো পান করে ধরা যেন নেশাগ্রস্ত। এক অসীম আনন্দ গানের সুর চরাচরে যেন উঠেছে বেজে। এক ঝাঁক কবুতর নীল আকাশে ঢেউয়ের মত দুলে দুলে উড়ছে। ইলেকট্রিক তারে গায়ে গা লাগিয়ে বসে আছে এক জোড়া ঘুঘু পাখী। আমি পথে বেড় হয়ে পড়ি; এক বিহ্বলতা নিয়ে হাঁটতে থাকি।
ফারুক কাদের, সিডনি
|