বাংলা নববর্ষের প্রেক্ষাপট ফারুক কাদের
শুভ নববর্ষ। সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা। বছর ঘুরে নববর্ষ আমাদের জীবনের দ্বারপ্রান্তে আবার উপস্থিত। নূতন এক বছরের সূচনা হয়েছে আমাদের বাংলা দিনপঞ্জিতে। আজ পহেলা বৈশাখ, ১৪২৪ বাংলা সন।
আজ থেকে ৪৩২ বছর আগে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা দিনপঞ্জি ও পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ উদযাপন এর প্রথা প্রচলন করেন। এর আগে রাজ্যের প্রজা বা কৃষক ইসলামিক হিজরি দিনপঞ্জি অনুসরণ করে তাদের কৃষি-কর বা ভূমি-কর পরিশোধ করে আসছিল। এই ইসলামিক দিনপঞ্জি (৩৫৪ দিনে বছর) আর ফসল উৎপাদনের চক্র (৩৬৫-৩৬৬ দিনে বছর)-এর মধ্যে ১১/১২ দিনের পার্থক্য থাকায় কৃষকদের পক্ষে বিনা ফসলের মওসুমে ভূমিকর প্রদান করা ছিল কষ্টসাধ্য। এ সমস্যা নিরসনের জন্য আকবরের নির্দেশে তার পারিষদ ও জ্যোতিপদার্থবিদ ফতেউল্লাহ সিরাজী তারিখ-ই-ইলাহিনামে নতুন একটি সৌর দিনপঞ্জি প্রবর্তন করেন। ইসলামিক দিনপঞ্জি ও প্রাচীন বৈদিক বাংলা সৌর দিনপঞ্জি সূর্য সিদ্ধান্তঅবলম্বন করে প্রণীত তারিখ-ই-ইলাহি ইংরেজি ১৫৮৫ সাল থেকে কার্যকরী হয়। উল্লেখযোগ্য প্রাচীন কাল থেকে ভারতবর্ষে ত্রিশের অধিক ধর্ম, ঐতিহ্য ও এলাকা ভিত্তিক দিনপঞ্জি প্রচলিত ছিল।
তারিখ-ই-ইলাহি অনুসারে নিম্নলিখিত সূত্র প্রয়োগ করে বাংলা সাল নির্ণয় করা হয়:
বাংলা সাল = Islamic year at Akbars crowning (963) + current Gregorian/English solar year (for example 2017) Gregorian/Englsih solar year at Akbars crowning (1556)
এই সূত্র অনুসারে বর্তমান ইংরেজি ২০১৭ সালের প্রেক্ষিত বাংলা সাল ১৪২৪।
বাংলা সাল = ৯৬৩ + ২০১৭ - ১৫৫৬ = ১৪২৪
প্রথমে তারিখ-ই-ইলাহির ১২ মাস এই নামে পরিচিত ছিল: কারওয়াদিন, আর্দি, ভাইষু, খোরদাদ, তীর, আমরদাদ, শাহরিয়ার, আবান, আঝুর, দাই, বাহাম ও ইস্কান্দার মিজ। এগুলো কখন বাংলা নামে পরিবর্তিত হল, সঠিক জানা যায়না। ধারনা করা হয় ভারতবর্ষে শক বংশীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা উদযাপনের জন্য ৭৮ খৃষ্টাব্দে প্রবর্তিত শকাব্দ দিনপঞ্জিতে ব্যবহৃত নক্ষত্রের নামের মাস বাংলা মাসের নামের উৎস। যেমন বৈশাখ মাসের নামের উৎস নক্ষত্র বিশাখা, ফাল্গুনের উৎস ফাল্গুনী, চৈত্রের উৎস চিত্রা।
আকবরের সময় থেকে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হয়ে আসছে। উদযাপনের প্রথা অনুযায়ী আগের বছরের শেষ দিন প্রজারা সকল বকেয়া ভূমিকর চুকিয়ে দিত। পরদিন নববর্ষের প্রথম দিনে রাজা বা জমিদার তাদের প্রাসাদে প্রজাদের নিমন্ত্রণ করে এনে মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করত। এই প্রথা পূন্যাহ নামে পরিচিত ছিল। এ উপলক্ষে সারাদিন মেলা আর উৎসবের আয়োজন হত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উত্তরবঙ্গে তার জমিদারী পরিচালনা কালে এই প্রথা অনুসরণ করেছেন। পরবর্তীতে এই উদযাপন রাজা ও জমিদারদের রাজস্ব সংগ্রহ ব্যবস্থার গণ্ডি অতিক্রম করে বাঙ্গালী সমাজের বৃহত্তর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে।
সম্রাট আকবর তারিখ-ই-ইলাহির একই সময়ে একাধিক ধর্মের মধ্যে সমন্বয় করে নতুন এক ধর্ম দিন-ই-ইলাহি প্রবর্তন করেন। আকবরের মৃত্যুর পর দিন-ই-ইলাহি বিলুপ্ত হয়। কিন্তু বাংলায় তারিখ-ই-ইলাহি কৃষিকাজে, পূজা পার্বণ ও নানা অনুষ্ঠানে বাংলা দিনপঞ্জি বা বঙ্গাব্দ নামে এখন ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই বঙ্গাব্দ বা বাংলা নববর্ষ সর্বোপরি নানা ধর্ম ও জাতপাত ধারী সকল শ্রেণীর বাঙ্গালীকে আজ সংস্কৃতির এক মোহনায় মিলিত করেছে।
এই বাংলা নববর্ষ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে, যেমন পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, কেরালায়, এবং দঃ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ যেমন থাইল্যান্ড, লাওস, মায়ানমারে অন্য নামে উদযাপন করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের একাধিক উপজাতি একই দিন সংক্রান উদযাপন করে। এই উদযাপনের একটা বৈশিষ্ট্য জল ছিটাছিটি করা। ১৯৮৮-৮৯ এ আমি ব্যাংককের এ আই টি তে পোষ্ট-গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা করছিলাম। তখন এ আই টির স্টাফদের দেখেছি জল ছিটাছিটি করে সংক্রানউদযাপন করতে।
আমি পুরনো ঢাকা শহরে বড় হয়েছি। এ এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, যেমন পুস্তক ব্যবসায়ী, স্বর্ণকার, দোকানদারদের নববর্ষ পালন দেখেছি। বছরের শেষ দিন পুরাতন বছরের লাভ-লোকসান ও দায়-দেনা হিসাব করে পুরাতন হালখাতা গুটিয়ে ও দোকানপাট ধোয়া মোছা করে নতুন বছরের প্রস্তুতি নিত ব্যবসায়ীরা। পর দিন নববর্ষের প্রথম দিনে নতুন হালখাতা উদ্বোধন করা হত। এই দিন ব্যবসায়ীরা দোকানে আগত গ্রাহকদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করত, তবে এই দিন বাকীতে পণ্য বিক্রয় সহজবোধ্য কারনেই ব্যবসায়ীদের জন্য কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ছিল।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই সাংগঠনিক উপায়ে ও সার্বজনীন ভাবে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হয়ে আসছে। এর নেতৃত্বে ছিলেন প্রখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপিকা সনজিদা খাতুন। তারই উদ্যোগে প্রবর্তিত ছায়ানটের রমনার বটমূলে নববর্ষের আবাহন আজ আমাদের বাংলা নববর্ষ উদযাপনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে। নববর্ষে উদযাপনের পরিধি ক্রমেই বেড়েই চলেছে। আর্ট কলেজ আয়োজিত নববর্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনেস্কোর শিল্পকলায় বিশ্ব-ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয়েছে। সারা বিশ্বের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙ্গালীরা আজ মহাসমারোহে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করছে।
ফারুক কাদের, সিডনি
|