শৈশবে বিক্রমপুর নদীপথে লঞ্চ ভ্রমণ ফারুক কাদের
বিক্রমপুরে পদ্মা নদীর পাড়ে শ্রীনগর উপজেলার ভাগ্যকূল গ্রামে আমাদের পৈত্রিক ভিটে বাড়ী, আর মামাবাড়ি সিরাজদীখান উপজেলার কুশুমপুর গ্রামে। এই দুই গ্রাম আমার শৈশব স্মৃতির এক বিরাট অংশ জুড়ে আছে। এই স্মৃতির এক উজ্জ্বল খন্ডচিত্র ছিল সদরঘাট থেকে লঞ্চে চড়ে ছুটি কাটাতে ভাগ্যকূল আর কুশুমপুরে যাওয়া আসা। পদ্মা, ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা, ইছামতী নদীর প্লাবন ভূমি আর আড়িয়ল বিলের নিচু এলাকা নিয়েই ছিল বিক্রমপুর অঞ্চল। লঞ্চ বা নৌকায় নদীপথে যাতায়াত তখন এ অঞ্চলের মানুষের জীবন যাত্রার ছিল অবধারিত অনুষঙ্গ। বছরে আমরা দু তিন বার বাবার কলেজ বা আমাদের স্কুলের ছুটির সময় ভাগ্যকুল বা কুশুমপুর গিয়েছি। যাবার কয়েক দিন আগে থেকে আমাদের দিন গোনা শুরু হয়ে যেত। যাবার আগের দিন উত্তেজনায় রাতে ঘুম হোতনা। ভাগ্যকূল বা মামাবাড়ি কুশুমপুরে যাবার লঞ্চ ভ্রমণ আমার কাছে এতই আকর্ষণীয় ছিল।
ঋতু ভেদে সদরঘাট থেকে ভাগ্যকুলে যাওয়ার দুটো লঞ্চ রুট ছিল: শুকনো মওশুমে বর্ষায় সদরঘাট থেকে বুড়িগঙ্গা-ধলেশ্বরী-মেঘনা হয়ে চাঁদপুর বাঁয়ে রেখে ভাগ্যকুল (এ রুটে ষ্টীমার সার্ভিস ছিল গোয়ালন্দ পর্যন্ত); এবং বর্ষায় সদরঘাট থেকে শ্রীনগর ও শ্রীনগর থেকে ভাগ্যকুল বাকী পথ হেঁটে বা নৌকায়। শুকনো মওসুমে ভাগ্যকূলে যাওয়ার আর একটি শর্টকাট রুট ছিল মুন্শীগঞ্জের তালতলা ঘাটের কাছে গৌরগঞ্জের খাল দিয়ে দক্ষিণে সিলিমপুর-বালিগাঁও-ডহরী-লৌহজং-মাওয়া হয়ে ভাগ্যকূল। ছোটবেলায় তালতলা-ডহরীর প্রায় পনের কিমি লম্বা এই শর্টকাট নদী পথ কে তালতলা-গৌরগঞ্জের খাল বলেই আমরা জেনেছি। এই খালকে বাংলার সুয়েজ খাল বলা হোত। সন্দেহ নেই এই খাল ব্রিটিশ আমলে খনন করা হয়েছিল; কে কবে খনন করেছিল জানা হয়নি। মামাবাড়ি কুশুমপুর যাওয়ার বহুল পরিচিত লঞ্চ রুট বুড়িগঙ্গা-ধলেশ্বরী-ইছামতী নদীপথে সদরঘাট থেকে ফতুল্লা, মুন্শীগঞ্জ, মীরকাদিম, কাঠপট্টী, বেতকা হয়ে তালতলা পর্যন্ত; তারপর বাকী পাঁচ কিঃমি পথ হেঁটে বা নৌকায় চড়ে মামাবাড়ি।
সদরঘাট টার্মিনাল থেকে লঞ্চে ওঠাই একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার ছিল। লঞ্চের টাইম টেবিল কদাচিৎ অনুসরণ করা হোত। আমরা পাটুয়াটুলীর বাসা থেকে হেঁটে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে পৌঁছেছি। টার্মিনালে লোকজন গমগম করছে, ব্যস্ত যাত্রীদের গুঞ্জনে মুখরিত। কুলী আমাদের লাগেজ-বোঝা (বিছানার চাদর, বালিশ, কাপড়-চোপড়) মাথায় সদরঘাটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা পেছনে কুলীকে অনুসরণ করছি। টার্মিনালে বাবা-মা আমাদের দিকে খেয়াল রাখছে, আমরা ভিড়ের মধ্যে যেন হারিয়ে না যাই। ভেড়ানো সারি সারি লঞ্চের খালাসী, সুকানী, লঞ্চ রুট ও গন্তব্য স্থান চোঙ্গা ফুঁকে সবাইকে জানান দিচ্ছে আর যাত্রীদেরকে ডেকে ডেকে লঞ্চে তুলবার প্রয়াস পাচ্ছে। এখন যেমন ঢাকার রাজপথে বাসের হেল্পার প্যাসেঞ্জার বগল দাবা করে।
টার্মিনালের এ মাথা থেকে ঐ মাথা পর্যন্ত বেকারি থেকে আনা গরম পাউরুটি, নান রুটি, কেক-বিস্কিটের হাঁট বসে গেছে। কোন প্যাসেঞ্জার লঞ্চ ছাড়ার আগে রুটি-বিস্কিট কিনে তড়ি ঘড়ি করে তার লঞ্চের পানে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। তার সকালে নাশতা করা হয়নি, লঞ্চে বসে বৌ ছেলে মেয়ে নিয়ে বেকারির কেক-বিস্কিট দিয়ে নদীর দৃশ্য দেখবে আর নাশতা করবে। ওদিকে বৌ ছেলে মেয়ে দুশ্চিন্তা করছে, বাবা কেন দেরী করছে? লঞ্চ তো ছেড়ে দেবে। আমরা কুলীর পেছনে ঘাট আর লঞ্চের মধ্যে ফেলে রাখা সাঁকোর মত কাঠের তক্তার উপরে সাবধানে দেখে শুনে হেঁটে লঞ্চের ডেকে অবতীর্ণ হই। লঞ্চ ছাড়ার আগের মূহুর্ত গুলি অস্থিরতার মধ্য কাটত: কেন এখনও লঞ্চ ছাড়ছে না? যখন লঞ্চ ছাড়ছে, তখন কি আনন্দ! আমরা বলতাম লঞ্চ “ব্যাগার” দিসে। “ব্যাগার” শব্দ মনে হয় “ব্যাক গিয়ার” থেকে এসেছে। টার্মিনাল ছেড়ে যাবার সময় লঞ্চ পিছন দিকে যেয়ে তারপর নদী পথ বরাবর সোজা হত।
আমরা সবসময় লঞ্চের আপার কেবিনে ভ্রমণ করতাম। আমি প্রায়ই লঞ্চের সারেং এর সাথে বসে থেকেছি; সারেং কিভাবে লঞ্চ স্টিয়ার করে বা খালাসী ও সুকানী কে গাইড করে, সব মনোযোগ দিয়ে দেখেছি। দু একবার আহ্লাদে আবদারে বশীভূত করে সারেং এর পাশে দাঁড়িয়ে স্টিয়ারিং এ হাতও রেখেছি: ভাবখানা যেন আমিই লঞ্চ চালাচ্ছি।
বাইরে নীল আকাশ, নদীর ঢেউ, ঢেউয়ের মাথায় কচুরিপানার নাচানাচি, বিরাট গয়না নৌকার গুন টেনে যাওয়া, পাল তোলা নৌকার ভেসে ভেসে যাওয়া, তীরে মানুষের আসা যাওয়া, ঘাটে বধূ-মাতা-কন্যাদের স্নান ও শিশুদের জলকেলি জলছবির মত এখন চোখে ভাসে। একটা দৃশ্য খুব মনে পড়ে: নদীতে ক্ষণে ক্ষণে শুশুক বা ডলফিনের ভূষ করে ভেসে ওঠা। দূষণের কারণে বুড়িগঙ্গা নদীতে ডলফিন এখন দেখা যায়না।
ফতুল্লার ওখানে নদীর তীরে ডালডা কারখানা ছিল মাইল স্টোনের মত। কারখানার বিরাট গোল স্টোরেজ ট্যাঙ্ক পার হলে মনে হয়েছে আমরা ঢাকা শহরের বাইরে চলে এসেছি। বুড়িগঙ্গা-ধলেশ্বরীর মোহনায় বেশ ঢেউ হোত; লঞ্চ দুলে উঠত। তখন প্রার্থনা করেছি, আল্লাহ তাড়াতাড়ি মোহনার এ অংশটুকু পার করে দাও। মুন্শীগঞ্জ কাঠপট্টী পুরো বাজার জুড়েই ছিল কাঠের দোকান; যেন কাঠের এক ছোট শহর! এটা ছিল আরেক মাইলস্টোন। কাঠপট্টীর পর বেতকা; এখানে নদীর ধারেই পাকিস্তান আমলেই এক আলুর স্টোরেজ ছিল।
অনেক সময় লঞ্চের নীচতলায় ইঞ্জিন কক্ষের পাশে বসে ইঞ্জিন চলার গুনগুন শব্দ শুনেছি। এই একটানা গুনগুন শব্দের মধ্যে যেন বাংলা সব গানের প্রতিধ্বনি খুঁজে পেতাম; লতা, সন্ধ্যা, হেমন্ত সবাই। ইঞ্জিন কক্ষের সাথেই একটা হ্যান্ড টিউবওয়েলে লঞ্চের টুটা ফাটা তলা দিয়ে চোঁয়ান নদীর পানি পাম্প করে বাইরে ফেলা হোত।
কোন ঘাটে লঞ্চ ভেড়ার আগেই ছোট অসংখ্য কোষা নৌকা লঞ্চের গা লাগিয়ে বন রুটি, বিস্কিট, লজেন্স, কলা, কটকটি, কেক, চানাচুর, গুড়, বাতাসা, খৈ ফেরী করত। আমার পছন্দ ছিল মালার মত গাঁথা এক সাথে অনেক লজেন্স। লঞ্চের পেছনে বাবুর্চির পরিবেশন করা ছোট কাঁচের গ্লাসে দুধ চায়ে লাঠি বা ইংরেজি S আকৃতির টোষ্ট বিস্কিট ভিজিয়ে খাওয়া ছিল ভীষণ প্রিয়।
ভাগ্যকুল বা কুশুমপুরে যাওয়ার লঞ্চ রুট আর নেই। কারণ মানুষ এখন সড়ক পথেই যাতায়াত করে। ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক কেন্দ্র করে বিক্রমপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম-গঞ্জ সংযোগকারী ব্যাপক পাকা রাস্তার জাল গড়ে উঠেছে। মানুষ এখন গাড়ী চড়ে বাপ দাদার ভিটে বাড়ী চলে আসে।
বাংলাদেশের সর্বত্র খাল বিল নদী-নালা দখলের মহোৎসব চলছে। আমাদের বিক্রমপুর-মুন্শীগঞ্জ এলাকা ও নদী খাদকদের হাত থেকে বাদ পড়েনি। বাংলার সুয়েজ খাল নামে পরিচিত তালতলা-গৌরগঞ্জের খাল পূনঃখনন করে নৌযোগাযোগ পুনরুদ্ধার করাই যেখানে কাম্য ছিল, সেখানে তা জায়গা দখলে জর্জরিত। আমাদের সময় এই রুটে ওয়াহিদ কোম্পানি লঞ্চ সার্ভিস পরিচালনা করেছে। গায়ক ফেরদৌস ওয়াহিদের পিতা আফসারুদ্দিন ব্যাপারী এই কোম্পানির মালিক ছিলেন। শুনেছি, এখন বড় নৌকা চলাই দুষ্কর। লঞ্চ সার্ভিস শুধুই স্মৃতি।
ফারুক কাদের, সিডনি
|