হরবিন্দার কাউর করতারপুর গুরদোয়াড়া যাবে ফারুক কাদের
সিডনীর ইঙ্গেলবার্ন শহরতলী - যেখানে আমি থাকি, সেখানে নানাবিধ সম্প্রদায়ের বাস। আমাদের কারিন্ডা স্ট্রীটে এংলো-সেক্সন বাদে এক শিখ, একাধিক নেপালি ও ভারতীয়, এবং আমাকে নিয়ে চার বাংলাদেশী পরিবার বাস করে। ভারতের শিখ সম্প্রদায়কে নিয়ে আমার বিশেষ কৌতূহল ছিল।
সেদিন ইউ টিউবে করতারপুর শিখ গুরদোয়াড়ার উপর একটি ভিডিও দেখছিলাম। পাক-ভারত সীমান্তের নিকটে পাক অধ্যুষিত পাঞ্জাবে গুরু নানকের স্মৃতি বিজড়িত এই করতারপুর। করতারপুরে বিশ্বের বৃহত্তম গুরদোয়াড়া অবস্থিত। শিখদের ধর্মীয়ে উৎসবের সময় সীমান্তের অনেক বিধি নিষেধ তুলে নেয়া হয়, তখন ভারত ও পাকিস্তান এই দুই দেশের অগণিত শিখ ও নানা ধর্মের মানুষ করতারপুর গুরদোয়াড়ায় মিলিত হয়। পাকিস্তানে অবশ্য শিখদের সংখ্যা খুবই কম। উৎসবের সময় ভারত থেকে আগত শিখ ও পাকিস্তানের মুসলমানদের মধ্যে সৌহার্দপূর্ণ মেলামেশার এক হৃদয়গ্রাহী পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ভিডিও তৈরি করেছে করতারপুরে উৎসব উপলক্ষে ভারত থেকে আগত এক শিখ তরুণী। করতারপুর গুরদোয়াড়া এখন এক আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান।
শিখদের গুরদোয়াড়ায় অন্নছত্র সারাদিন খোলা থাকে। সারাদিন চাল, ডাল, আটা-ময়দা, সবজী আসছে আর শিখ স্বেচ্ছাসেবীরা রান্না করছে, জিলেবী ভাজা হচ্ছে। বাইরে থেকে আসা ক্ষুধার্ত মানুষ, যে ধর্ম বা গোত্রেরই হোক, তাদের এক কাতারে বসিয়ে মেজবানি আহার করায় স্বেচ্ছাসেবীরা। গণ-খাবার বা মেজবানির প্রতি আমার গভীর আকর্ষণ। আমার ধারনা গণ-খাবার সুস্বাদু হয়। একবার যশোরে জিয়াউর রহমানের মৃত্যু-দিবস পালন উপলক্ষে পাক করা প্যাকেটে দেয়া গণ-খিচুড়ি খুব উপভোগ করে খেয়েছিলাম। সিডনীতে বেশ কিছু গুরদোয়াড়া আছে। আমার ইচ্ছে সিডনীর কোন এক গুরদোয়াড়ায় যেয়ে এই গণ-খাবারের স্বাদ গ্রহণ করা।
করতারপুর গুরদোয়াড়া ভিডিও দেখার পর শিখ ধর্মের বিধির উপর পাঁচ মিনিটের একটা ভিডিও দেখি। মনে হোল শিখ ধর্ম সোজা, সহজ; অন্ততঃ কনসেপ্ট ও চর্চার দিক দিয়ে, এবং যথেষ্ট মানবিক। শিখ ধর্মাবলম্বীরা মুসলমানদের মত এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, কিন্তু হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের মত শিখরা পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে।
ইতিমধ্যে কারিন্ডা স্ট্রীটের এক মাত্র শিখ পরিবারের তরুণী গৃহবধূ হরবিন্দার কাউরের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। হরবিন্দার কাউরের সাথে প্রথম দেখা স্থানীয় ইঙ্গেলবার্ন লাইব্রেরি আয়োজিত এক স্পোকেন ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ কোর্সে। ল্যাঙ্গুয়েজ কোর্সে অংশ নিয়েছিলাম সময় কাটাতে। আমার পাশের সিটেই বসেছিল হরবিন্দার। তখন হরবিন্দার সদ্য অস্ট্রেলিয়ায় এসেছে। স্ট্রলারে সন্তান বসিয়ে নিয়ে কোর্সে আসত। কোর্সের সময় আমাদেরকে ইংরেজিতে কিছু বলার জন্য উৎসাহ দেয়া হয়। হরবিন্দার আমাদেরকে ওর গ্রামের কথা ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে বলে যায়। সে পরিবার নিয়ে অমৃতসর স্বর্নমন্দিরে গিয়েছিল, তার গল্প শোনায়। আপনারা লক্ষ্য করেছেন কিনা, ভারতীয়রা ইংরেজিতে টেনে কথা বলে। শুনতে ভালই লাগে। হরবিন্দারের ইংরেজি বাচন এর ব্যতিক্রম ছিলনা। কোর্সের টি-ব্রেকের সময় হরবিন্দারের সাথে আলাপ হয়। জানতে পারি সে আমাদের কারিন্ডা স্ট্রীটেই থাকে।
কোর্স শেষ হবার পর কারিন্ডা স্ট্রীটে হাঁটাহাঁটির সময় হরবিন্দারের সাথে আবার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। হরবিন্দার ওর স্বামী ত্রিলোচন সিং আর দুই শিশু সন্তান নিয়ে কারিন্ডা স্ট্রীটের পুরনো একটা বড় হাউজে ভাড়াটে হিসেবে বাস করে। হরবিন্দারের বাড়ী পাঞ্জাবে; হরবিন্দারের শ্বশুর বাড়ীও সেখানে। শ্বশুর সোহান সিং এখন হরবিন্দারের সাথে থাকে, শাশুড়ি রেশম কাউর ও সাথে ছিল, কিন্তু এবার করোনার জন্য দেশে যেয়ে আটকা পড়েছে; অষ্ট্রেলিয়ায় এখনও ফিরে আসতে পারেনি। মনে হয় হরবিন্দার ও ওর স্বামী ত্রিলোচন সিং গ্রামের কৃষক পরিবার থেকে এসেছে। এ সবই অবশ্য আমার কল্পনা।
হরবিন্দারের নিষ্পাপ, ঢলঢল চেহারা, মায়াবী দুটো চোখ। জঙ্গল থেকে মায়া হরিণী ভুল করে লোকালয়ে এসে পড়লে যেমন ইতি উতি চায়, তেমনি হরবিন্দারের চাহনি। হরবিন্দার যখন রাস্তা দিয়ে দুলে দুলে হাঁটে, তখন মনে হয় পাঞ্জাবের গ্রামের ক্ষেতে গমের শিষ হাওয়া দুলছে।
হরবিন্দার একবার রাস্তায় আমাকে দেখে আমন্ত্রণ করে ওর বাড়ীতে নিয়ে যায়। ওর হাতের মাসালা চা খেতে খেতে শিখদের আচার ও ধর্ম নিয়ে আলাপ হোল। সব শিখ পুরুষের মধ্য নাম “সিং”, মহিলাদের “কাউর।” শিখরা সাধারনতঃ নিরামিষাশী হয়। হরবিন্দারের পরিবারে শুধু হরবিন্দারই নিরামিষাশী, বাকীরা অল্প বিস্তর মাছ গোশত খেয়ে থাকে। শিখদের গুরদোয়াড়ার অন্নছত্রে অন্ন গ্রহণের ইচ্ছের কথা হরবিন্দারকে কোন এক সময় জানিয়েছিলাম। হরবিন্দার আশ্বাস দিয়েছিল আমাকে নিয়ে যাবে। করোনার বিধি নিষেধের কারণে এই প্ল্যান আপাততঃ স্থগিত।
কারিন্ডা স্ট্রীটে ৪-৫ টা পুরনো বাড়ির সামনে খোলা জায়গা আছে বেশ। সেখানে মহিলা বাসিন্দারা সবাই কম বেশী খোলা জায়গায় পায়রাদের খাবার বিলায়, যেমন হরবিন্দার করে থাকে। হরবিন্দারের বাড়ীর সামনে খোলা জায়গায় এক দঙ্গল পায়রা ছিটিয়ে দেয়া পাউরুটি খেতে প্রতিদিনই ভিড় করে। কাছেই তিনটি লম্বা ইউক্যালিপটাস গাছ দাঁড়িয়ে আছে। গাছের উঁচু ডালে কখনও ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা কাকাতুয়া বসে। এদের কর্কশ কণ্ঠস্বর শুনে মনে হবে এরা তুমুল ঝগড়া করছে। যখন কাকাতুয়া নীচে নেমে আসে, তখন পায়রাগুলো ভয়ে দূরে সড়ে যায়। একই ভাবে খেতে আসা দুটো তিনটে শালিক দূর থেকে করুন চোখে পায়রা গুলোর রুটি খাওয়ার মহোচ্ছব দেখে। হরবিন্দার কিভাবে রুটি বিলায় তা এখনও দেখা হয়নি।
হরবিন্দারের স্বামী ত্রিলোচন সিং টিপিক্যাল সর্দারজী: গালে মৌমাছির চাকের মত জমাট কাল দাড়ি; মাথায় পটকা। জীবিকার জন্য বড় ও ভারী ট্রাক চালায় ত্রিলোচন। সিডনীর বাইরে নিউ সাউথ ওয়েলস স্টেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাল সামান আনা নেয়া করে। ত্রিলোচনকে অনেক সময় পথেই রাত কাটাতে হয়। মাঝে মাঝে দেখি ওদের বাড়ীর সামনে প্রশস্ত ড্রাইভ ওয়েতে ট্রাক পার্ক করা, তখন বুঝি ত্রিলোচন বাড়ীতে। ত্রিলোচনের ট্রাকের চাকা আমার বুক সমান উঁচু হবে।
হরবিন্দারের সাথে কথা বলে মনে হয়েছে সে আয়-রোজগারের চেষ্টা করছে, শুধু গৃহবধূ হয়ে থাকতে চায়না। একদিন পথে দেখা হবার পর জানায়, সে ক্যাটারিং শুরু করেছে। জানার পর আমি কয়েকবার ওকে অর্ডার দিয়ে ব্রেড পাকোড়া আনিয়েছি, পাউরুটির টুকরো মশলা মিশান ফেটান ডিমে ভিজিয়ে ডুবো তেলে ভাজা পাকোড়া। ও আমাকে বেশীই দিত; পাকোড়া খেতে মজাই লেগেছে। এবার করোনার সময় দেশ থেকে ফিরে এসে শুনলাম করোনার জন্য ক্যাটারিং বন্ধ হয়ে গেছে।
ইদানীং হরবিন্দারকে ঘর থেকে খুব একটা বের হতে দেখিনি। কারিন্ডা রোড দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় প্রায়ই দেখি শুধু ওর দুই শিশু পুত্র সন্তান সামনে খোলা জায়গায় খেলা করছে। ওরা এখন প্রাইমারী স্কুলে যায়। এদের মাথায় ও পটকা। শিখ মেয়েরা সাধারনতঃ পটকা ব্যাবহার করেনা। দু একবার দেখেছি হরবিন্দার বাচ্চাদের ড্রাইভ করে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে।
কারিন্ডা স্ট্রীটে এবার অনেকদিন পর হাঁটার সময় হরবিন্দারের সাথে দেখা। জিজ্ঞেস করি, কি করছ তুমি এখন? আমি একটা টেইলারিং কাজ শুরু করেছি গ্যারেজে, সাথে বিউটি সেলুন।
গ্যারেজ মে আইয়েনা একদিন, আমন্ত্রণ জানাল। মনে হোল হরবিন্দার টেইলারিং আর বিউটিশিয়ানের কাজ উপভোগ করছে।
ঠিক হ্যাঁয়, জাউঙ্গা, আমি বললাম।
হরবিন্দারের নিজস্ব ভাষা পাঞ্জাবী, যার বিন্দু বিসর্গ ও আমি জানিনা। ও ইংরেজি কতটা ভাল বলে জানিনা। আমি পাকিস্তান আমলে সিনেমা দেখে হিন্দি, উর্দু ভাষায় বাচনিক দক্ষতা অর্জন করেছি। তাই হিন্দি, উর্দু ও প্রয়োজনে ইংরেজি মিশাল দিয়ে গোজামিল এক ভাষায় কথা বলি ওর সাথে, যখন যা সুবিধা হয়।
হরবিন্দার গ্যারেজে যখন টেইলারিং বা সেলুনে কাজ করে, তখন গ্যারেজের শাটার অর্ধেক উঠিয়ে রাখে। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় বুঝতে পারি হরবিন্দার কাজ করছে। একদিন হরবিন্দারের গ্যারেজে উপস্থিত হলাম। গ্যারেজে একটা টেবিলে সেলাই মেশিন বসিয়েছে, আরেক টেবিলে সেলুন। একটা আলমারিতে সেলাইর কাপড় আর প্রসাধন সামগ্রী। হরবিন্দার সেলাইর মেশিনে কাজ করছিল।
বৈঠিয়ে না, আপ ক্যায়সে হ্যায়? হরবিন্দার আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ায়।
ম্যাঁয় আচ্ছা হূঁ, তুম বহূত বিজি হো শায়েদ (তুমি ব্যস্ত মনে হয়)?
এয়সি কৌই বাত নেহি। ইয়ে দেওয়ালীকে মাহিনে হ্যাঁয় না, সালওয়ার কি কুছ অর্ডার মিলা। ম্যায় পাঞ্জাবী কা অর্ডার ভি লেতা হূঁ; আপকা ঈদ কা মাহিনা যব আয়ে না, মুঝে বুলায়ে গা, ম্যাঁয় আপকে লিয়ে পাঞ্জাবী বানা দুঙ্গা।
সাচমুচ পাঞ্জাবী কে সাথ আপ কি সর পে এক পাগড়ী কাফি আচ্ছা লাগে গা, হরবিন্দার হেসে বলে।
আমার চোখে ভাসে, ফসল কাটা শেষে পাঞ্জাবের গাঁয়ের মাঠে রঙিন নকশা করা পাঞ্জাবী, লুঙ্গী আর মাথায় পাগড়ী পড়ে ঢোলের বাদ্যের তালে তালে পাঞ্জাবী পুরুষেরা দল বেঁধে ভাঙ্গড়া নাচছে। চারিদিকে গোল হয়ে পাঞ্জাবী শিখ মেয়েরা নাচ দেখছে; তার মধ্যে হরবিন্দার ও আছে। আমার মনে পড়ল, জীবনে একদিনই পাগড়ী পড়েছিলাম, বিয়ের দিন শেরওয়ানীর সাথে।
মুঝে দো মিনিট দিজিয়ে, আপকে লিয়ে চায়ে লিয়ে আতি হূঁ, হরবিন্দার বলল। ইসকি জরুরত নেহি, হারবিন্দার। তোম কাম করো, ম্যায় চলা যাতা হূঁ। ঠাইরিয়ে, ঘর মে জরুরী কাম হ্যায় কেয়া? চালিয়ে মেরে ঘর পে, ওহাঁ আরামসে চায়ে পিয়েগা।
হরবিন্দারের ড্রইং রুমে গেলাম। খুবই সাধারণ আয়োজন: পুরনো ফার্নিচার, সোফা, একটা পুরানা সিআরটি টিভি; দেয়ালে অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির ও গুরু নানকের ছবি। ড্রইং রুমে শ্বশুর সোহান সিং নির্বিকার বসে আছে। সোহান সিং এর সাথে আগেই পরিচয় হয়েছিল। সোহান সিং তখন বলেছিল ১৯৪৭ এ শিখ মুসলমান রায়টের সময় তার বাবা-মা সর্বস্ব হারিয়ে পাকিস্তান থেকে ভারতের পাঞ্জাবে চলে আসে। হরবিন্দার আমার কানের কাছে এসে ফিস ফিস করে বলে: মেরী শ্বশুর কি আঁখে কমজোর হো গায়ি, ইসলিয়ে আপকো পেহচানা নেহি।
সর্দারজী আপ ক্যায়সে হ্যাঁ? সোহান সিংকে জিজ্ঞেস করি। সর্দারজী বলল, ব্যায়ঠো; তারপর আবার নীরব। আমি বসলাম। এরই মধ্যে হরবিন্দারের বড় ছেলে ড্রইং রুমে হঠাৎ ঢুকে পড়েছে, মাথায় পটকা। হরবিন্দার ছেলেকে আমার কাছে টেনে এনে বলল, বেটা আঙ্কল সে মিলো। ছেলেটা লজ্জায় আসতে চাইছিলনা। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে ছেলেটাকে একটু আদর করে দেই।
হরবিন্দার, তুম করতারপুর গুরদোয়াড়া নেহি যাও গে? হরবিন্দারের মাসালা চা খেতে খেতে বলি।
কিঁউ নেহি? জিন্দেগী মে একবার যানা হি পড়েগা। ওঁয়াহা গুরু নানাক জী কা জনম-স্থান হ্যাঁয় না। দো সাল হো গ্যায়ি মেরা গাঁও নেহি গ্যায়া। ইয়ে করোনা কব যায়েগি, আঙ্কেল? তারপর দেয়ালে টাঙ্গান গুরু নানকের ছবিকে দু হাত জোড় করে বলে, গুরুজি প্রণাম।
ফিরে আসার সময় দরজা পর্যন্ত আমাকে এগিয়ে দিয়ে হরবিন্দার বলে, মেরে লিয়ে দোঁয়া কিজিয়ে গা, কে ম্যাঁয় জলদীসে মেরা গাঁও যা সাঁকু। উসকে বাদ করতারপুর গুরদোয়াড়া যাউঙ্গা, গুরুজি সে মিলনে।
মেরা দোঁয়া তুম হারে সাথ হামেশা রাহেগা, হরবিন্দারকে বলি।
ফারুক কাদের, সিডনি
|