হজ্ব: সেকাল আর একাল ফারুক কাদের
হেঁটে মক্কায় যেয়ে হজ্ব পালন করেছেন, এমন হাজ্বীদের কথা শুনেছি। এটা সম্ভবতঃ বৃটিশ আমলের কথা। এখন হজ্ব উপলক্ষে মক্কায় যাওয়া অনেক অনেক সহজ হয়েছে। সুদূর অতীতের হাজ্বীদের হজ্বে যাবার জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি নিতে হত: অল্প অল্প করে হজ্বের পাথেয় সঞ্চয়; পুত্র-কন্যার বিবাহ; সম্পত্তির বণ্টন; ধার-দেনা শোধ। তারপর আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মক্কার পথে যাত্রা করাই ছিল প্রথা। অনেকেই খাদ্য রসদ হিসেবে সঙ্গে নিতেন চিড়া-গুড়। সুদূর অতীতের হাজ্বীরা কতটা কষ্টসাধ্য ও বিপদ সংকুল পথ আর অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে হজ্ব সম্পন্ন করতেন, তা এ জামানার হাজ্বীরা হয়তো চিন্তা করতে পারবেনা।
বৃটিশ আমলে হাজ্বীরা বোম্বাই (বর্তমানে মুম্বাই) থেকে জাহাজে সমুদ্র পথে সৌদি আরব যেতেন; এ জাহাজ ছাড়ার নির্দিষ্ট সময় ছিলনা; জাহাজে রপ্তানির মালামাল ও থাকত। ভারতের আনাচে কানাচে থেকে দল বেঁধে পায়ে হেঁটে, গরুর গাড়ী চড়ে, নৌকায় পাড়ি দিয়ে বোম্বাই বন্দরে এসে পৌঁছতেন হাজ্বীরা। উনিশ দশক পর্যন্ত বোম্বাই ও ভারতের অন্যান্য বড় বড় শহরের মধ্যে সীমিত ট্রেন যোগাযোগ হাজ্বীদের হজ্ব রুটের জন্য তেমন সহায়ক ছিলনা। বোম্বাই পর্যন্ত হজ্ব রুটে পেশাদার পথ প্রদর্শকদের ভূমিকা থাকা টাই স্বাভাবিক ছিল।
বোম্বাই থেকে প্রথমে করাচী - সেখানে আরো হজ্ব যাত্রী সওয়ার হত; তারপর আরব সাগর পাড়ি দিয়ে আরব উপদ্বীপের এডেন বন্দরে জাহাজ ভেড়ান হত মালামাল খালাসের জন্য। এরপর, ইয়েমেনের উপকূলীয় দ্বীপ কামারানে কোয়ারেন্টাইনের জন্য হাজ্বীদের নামিয়ে দেয়া হত। কোয়ারেন্টাইন ক্যাম্পে অবস্থানের সময় সীমা হাজ্বীদের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি বিবেচনা করে এক পক্ষকাল থেকে মাসাধিক হওয়া বিচিত্র ছিলনা। কোয়ারেন্টাইন শেষে জাহাজে করে জেদ্দায় অবতরণ; তারপর জেদ্দা থেকে হজ্ব কাফেলায় অংশ নিয়ে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত হজ্বের জন্য পায়ে হেটে মক্কার পথে যাত্রা। মক্কায় হজ্ব পালনে সপ্তাহ-খানেক সময় লাগত। হজ্ব শেষে সব হাজ্বী কাফেলায় হেটে মদিনা যেতেন নবীর রওজা মুবারক জিয়ারত করার জন্য। হজ্ব সেরে সহি সালামতে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল অনেকটা ভাগ্যের ব্যাপার। সময় লেগে যেত চার থেকে ছ মাস। অনেক হাজ্বী হজ্ব পালন করা অবস্থায় বা পথে ডাকাত দস্যুর আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন।
বোম্বাই থেকে সমুদ্রপথে হজ্ব যাত্রা ১৯৯৫ সন পর্যন্ত বলবৎ ছিল। ভারত সরকার সমুদ্রপথে এই হজ্ব রুট ২০১৮ সন থেকে আবার চালু করতে যাচ্ছে। স্বাধীনতা আগে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালী হাজ্বীরা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জাহাজে সৌদি আরব যেতেন। স্বাধীনতার পরে বিমানে হজ্ব যাত্রা চালু হয়।
হোক সেকাল বা একাল, হজ্ব-যাত্রী বা যেকোন ধর্মের তীর্থযাত্রীদের মধ্যে আধ্যাত্মিক মনোবাসনায় এক ঐক্য বিরাজ করে: সৃষ্টিকর্তার পরম সান্নিধ্য পাওয়া। এটা সত্য সৃষ্টিকর্তা শুধু তীর্থস্থান নয়, সর্বত্রই বিরাজমান। তবে সারা বিশ্বের অযুত মুসলিম জনতার ভিড়ে মিশে ইসলামের পবিত্র ভূমিতে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্যে হজ্বের ব্রত পালন করার মধ্যে এক অপূর্ব অনুভূতি জাগে; যেন আধ্যাত্মিকতার সাগরে স্নান। একই অনুভূতি অন্য ধর্মের তীর্থযাত্রীদের মধ্যেও কাজ করে। তাই হজ্ব শুধুই ব্রত পালন নয়, আধ্যাত্মিক উপলব্ধিও এর এক বিরাট অনুষঙ্গ। যারা হজ্ব করেনি, তারা এটা উপলব্ধি করতে পারেনা।
অনেকে যারা সৌদি আরবের নাগরিক বা দীর্ঘ দিন সৌদি আরবে বসবাস করেছেন, তারা একাধিক বার হজ্ব পালন করেন। সৌদি আরবের বাইরে থাকেন এমন অনেক সচ্ছল মুসলমান ও একাধিক বার হজ্ব পালন করে থাকেন। একাধিক বার উমরাহ পালন করেছেন, এমন মুসলমানের সংখ্যাও কম নয়। এদের মধ্যে অনেকেই সৌদি আরব সফরের অনুষঙ্গ হিসেবে উমরাহ পালন করেছেন।
সপ্তাহ দুই আগে এক গেট-টুগেদারে সৌদি আরব প্রবাসী এক বাংলাদেশী বিদ্যুৎ প্রকৌশলীর সাথে আলাপ। জেদ্দায় থাকেন উনি; সন্তান-সন্ততি সিডনী-বাসী। ভদ্রলোক জানালেন উইক-এন্ডে গেট-টুগেদার ছাড়াও প্রায়ই মক্কায় উমরাহ করে সময় কাটান তিনি। উমরাহ করে উইক-এন্ড কাটানো যায় ব্যাপারটি আমার জানা ছিলনা। এটাকে আধ্যাত্মিক অবসর বা প্রশান্তি বলা যেতে পারে।
যারা হজ্বে যান, তারা সবাই একনিষ্ঠ ধার্মিক হবেন, এটি না ও হতে পারে। আমরা অনেকেই ভেবে থাকি হজ্ব ফেরত মানুষের জীবনে পরিবর্তন আসবে, এটা অবশ্য হাজ্বীরাই ভাল বলতে পারবেন। আমার এক আত্মীয় অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য এই প্রথম হজ্বে যাচ্ছেন। এ অভিজ্ঞতা আধ্যাত্মিক ও জাগতিক দু ধরনেরই হতে পারে; তবে তা আগেই বলা সম্ভব নয়। এ জামানার ও সুদূর অতীতের পদব্রজী হাজ্বীদের জাগতিক অভিজ্ঞতার মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ হবে তা বলাই বাহুল্য। হতে পারে হজ্বের পর আমার আত্মীয়ার জীবন যাত্রার খোল নলচে পাল্টে গেছে। পরিপূর্ণ ধর্মভীরু নন উনি এখনও; কিন্তু হজ্ব থেকে ফিরে এসে নিষ্ঠাবান ধার্মিক হয়েও যেতে পারেন।
হজ্ব ফেরত পদব্রজী হাজ্বীদের ঝুলিতে বিলাবার জন্য বড় জোর নিজের ব্যবহৃত বোতলে জমজমের পানি বা আরবের খেজুর পাওয়া যেত। তারপর তসবিহ, জায়নামাজ ও টুপি যোগ হল। সময়ের সাথে বদলে গেছে অনেক কিছু। কেনাকাটায় বর্তমানে জৌলুস এসেছে; বোতল-জাত জম জমের পানি এখন গ্রোসারী শপে কিনতে পাওয়া যায়। বর্তমানে হজ্ব শেষে অনেক হাজ্বীই আত্মীয়-স্বজনকে উপহার দেওয়ার মানসে কেনা কাটা করেন। সোনা-গহনা ক্রয় করেন কেউ কেউ, পরতা পড়ে তাই। বাজার অর্থনীতি, ভবের হাটের কেনা বেচায়ও পরিবর্তন এনেছে!
এটা মনে রাখা প্রয়োজন, প্রাক ইসলামী যুগে আরবের পৌত্তলিকরা কাবায় হজ্ব পালন করেছে; সাফা মারওয়া এই দুই পর্বতের মাঝে ছোটাছুটি সে সময়ের হজ্ব পালনের একটি অঙ্গ ছিল, যা এখনও আছে। সে সময় হজ্ব উপলক্ষে আরবের নানা স্থান থেকে ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য মক্কায় আগত পণ্যবাহী কাফেলা নিয়ন্ত্রণ করত কুরাইশ বংশ। মক্কায় ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হলে কাবায় মূর্তি পূজা বন্ধ হবে; হজ্বের উপলক্ষটাই থাকবেনা; পরিণামে ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ হয়ে কুরাইশ বংশ আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এ আশঙ্কা থেকেই মূলতঃ কুরাইশ বংশ ইসলাম ধর্ম ও নবীর বিরোধিতা করে আসছিল। আমাদের নবী (স:) র দূরদর্শিতার জন্য হজ্ব ইসলাম ধর্ম-চর্চার পাঁচটি অত্যাবশ্যকীয় (ব্যক্তির সক্ষমতা সাপেক্ষে) অঙ্গের একটি হিসেবে পরিগণিত হওয়ায় সে আশঙ্কা দূর হয়।
প্রতি বছর বিশ্বের প্রায় ২০ লক্ষ মুসলমান হজ্ব পালন করে। ২০১৬ সালে হাজ্বীদের সংখ্যা ছিল ১৮ লক্ষ; এর মধ্যে বাইরে থেকে আসা হাজ্বীদের সংখ্যা ছিল ১৩ লক্ষ। তেল ও গ্যাসের পর হজ্ব ও ধর্মীয় পর্যটন সৌদি আরবের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। গত বছর হাজ্বীরা প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার সৌদি অর্থনীতিতে অবদান রেখেছে। সাপ্লাইর চেয়ে ডিমান্ড বেশী থাকায় ধীরে ধীরে সৌদি সরকারের উদ্যোগে বিনিয়োগ বাড়ছে। মক্কায় অবস্থাপন্ন হাজ্বীদের আবাসনের জন্য হাই রাইজ বিল্ডিং উঠেছে; পাঁচতারা হোটেল তো আছেই। দ্রুত আবাসনের কবলে মক্কার বেশ কিছু ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় স্মৃতি বিজড়িত স্থান ও পাহাড় বিলুপ্ত হওয়ার পথে। দ্রুত বর্ধমান মক্কা নগরীকে এখন অনেকে নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের সাথে তুলনা করেন। সাধারণ মানুষ হজ্বের খরচ বহন করতে হিম সিম খাচ্ছে। মক্কার হাই রাইজ বিল্ডিং আর দামী হোটেল তাদের নাগালের বাইরে। তারপর ও সাধারণ ধার্মিক মুসলমান শেষ সঞ্চয় অবলম্বন করে হজ্বের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে এবং জীবনের পরম ব্রত ও মনস্কামনা পূর্ণের লক্ষ্যে মক্কার পথে বের হয়ে পড়ে।
তথ্য সূত্র: 1. http://www.muslimink.com/history/290-hajj-1860-journey-indian-pilgrims
2. Mishra, S. (2011). Pilgrimage, politics, and pestilence: The Haj from the Indian subcontinent, 1860-1920. New Delhi: Oxford University Press.
ফারুক কাদের, সিডনি
|