গল্পক্ষুধা ফারুক কাদের
| পদ্মা নদীর এই পাড়ে মাওয়া বাজার, ঐ পাড়ে শিবচর বাজার; মাঝে ফারাক প্রায় ছয় কিলোমিটার। এই দুই পাড় জোড়া দেবে যে পদ্মা ব্রিজ, তার নির্মাণ কাজ জোরে সোরে চলছে। নদীর এপার থেকে ওপার একটার পর একটা দৈত্যের মত বিশাল বিয়াল্লিশটি আরসিসি পিয়ার দাঁড়িয়ে গেছে; প্রতি জোড়া পিয়ারের মধ্যে ষ্টীলের গার্ডার বসানোর কাজ চলছে সকাল সন্ধ্যা। ইঞ্জিনিয়ার, লেবার, সার্ভেয়ার, টেকনেশিয়ানদের ছুটোছুটি; নির্মাণ কাজ আর ভারী মেশিনের শব্দে নদীর দুই পার গম গম।
পদ্মা ব্রিজের নির্মাণ কাজের ঢেউ মাওয়া বাজার ও আশে পাশের গ্রাম- ভাগ্যকূল, মান্দ্রা, যশলদিয়ার জন জীবনে প্রবল আলোড়ন তুলেছে; চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগের নির্জনতা আড়মোড়া ভেঙ্গে গ্রাম গুলি আজ জেগে উঠছে। সবাই বলে মাওয়া বাজার, ভাগ্যকূল, যশলদিয়া একদিন শহর হবে - পাকা রাস্তা-ঘাট, শপিং মল, রকমারি রেস্তোরা, সিনেমা হল হবে। এলাকার চেহারাই পাল্টে যাবে; সোনার দামে জায়গা কেনা বেচা হবে। মানুষ অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে কবে পদ্মা ব্রিজ চালু হবে!
ভাগ্যকূল মান্দ্রা গ্রামের রশীদ ওরফে রইস্যা; বয়স আঠার কি উনিশ; এ সংসারে ওর কেউ নেই। ছোটবেলায় পোলিও হয়েছিল; নদী ভাঙ্গনের শিকার ওর গরীব বাবা মার পক্ষে উপযুক্ত চিকিৎসা দেওয়ার প্রশ্ন আসেনা, তাই পোলিও ওর হার্টের একটা ভাল্ব প্রায় অকেজো করে রেখে গেছে; আর ডান পা টা গেছে শুকিয়ে। তাই খুঁড়িয়ে হাঁটে রইস্যা; মান্দ্রা থেকে মাওয়া বাজার এভাবেই হেঁটে আসে।
মাওয়া বাজার আর পদ্মা নদীর পাড় – এখানেই রইস্যার সময় কাটে সারাদিন। ও প্রায়ই নদীর পাড়ে বসে ব্রিজের কাজ দেখে আর ভাবে - ‘এইহানে নদীর চর আছিল; আষাঢ় মাইস্যে উজানের ঘিয়া রঙের ঘোলা পানির কাটাল পেঁচাইতে পেঁচাইতে ভাঁডিতে নাইমা যাইত। অহন দেহ হেই নদীরে কেমুন পোষ মানাইয়া ফালাইছে! কি সব আজদাহার মত পিলার হইছে! ব্রিজের নীচ দিয়া বলে টেরেন যাইব!’ রইস্যা আর কিছু ভাবতে পারেনা; মাথা চুলকায়। ‘মাইনষে কত কি করতে পারে, আল্লাহ রে!’
মাওয়া বাজারে পাঁচটা হোটেল চুটিয়ে ব্যবসা করছে; তার একটি রহমানিয়া হোটেল। বেঁচে যাওয়া সামান্য খাবার যা ফেলে দেওয়া হয়, তার আশায় রহমানিয়া হোটেলের পেছনে ঘুর ঘুর করে রইস্যা; যেমন আবর্জনার মাঝে ইঁদুর খাবার খুঁজে বেড়ায়।
রহমানিয়া হোটেলের ভেতর থেকে খেতে আসা কাস্টমারদের কলরব, পরোটা ভাজার তেল চপ চপ শব্দ, রসনা অবশ করা ডিমের ওমলেটের মৌতাত আর চায়ের কাপ-পিরিচ ও চামচের টুং টাং ও চায়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ভেসে আসে ভেতর থেকে।
রইস্যার পেট ভরে খেতে ইচ্ছা করে। শেষ কবে পেট ভরে খেয়েছে মনে পড়েনা। মাওয়া বাজারে কেউ ওকে কাজ দেয়না। ক্ষুধার জ্বালা চোখে মুখে নিয়ে বাজার ঘুরে বেড়ায়। হোটেলের পেছনে যেয়ে রান্নাঘর থেকে মশলা কষানোর ঝলসান গন্ধ নাকে টেনে নেয়।
হোটেলের পাকঘরের পেছনের বারান্দায় বড় টেবিলে রাখা জুটা খাবার ওর কপালে মাঝে মাঝে জুটে। বাসি ডাল-ভাত, কাঁটা গিজ গিজ করে ইলিশ মাছের মাথা আর শক্ত কাঁটার লেজের অংশ; মুর্গীর গলা – যেখানে হাড্ডির ফাঁকে ক্ষুদের চালের সাইজের টুকরা মাংস লেগে থাকে, তা রইস্যার খুব প্রিয়; মুর্গীর গলার এই নরম হাড্ডি ও খুব মজা করে চিবিয়ে খায়; ওর মনে হয় ঢেঙ্গা মোরগের রানের মাংস খাচ্ছে।
সকালে সুলেমানী ফ্রেশ ব্রেড এন্ড বাটার বেকারী দোকানের কাছ দিয়ে হেঁটে গেলে গরম রুটির ওম দেওয়া কি যে মিষ্টি গন্ধ চারিদিকে ছুটে। তখন রইস্যা মাথা উঁচু করে লম্বা নিঃশ্বাস নেয়; নাসারন্ধ্রে সুড়সুড়ি দিয়ে পেটের নাড়ি ভুঁড়িতে পরশ বুলিয়ে মিষ্টি গন্ধ চুয়ে চুয়ে নামে। কি সোয়াদ! বেহেশতি ওমে রইস্যার তলপেট যেন ভরে যায়।
এই মওসুমে পদ্মায় জেলেদের জালে অনেক ইলিশ মাছ ধরা পড়ছে। পেটুক ঢাকা শহরের মানুষ যখন ভাজা ইলিশ মাছ খেতে মাওয়া বাজারে গাড়ী থেকে নামে তখন রইস্যা গাড়ীর দরজার কাছে এসে দাড়ায়। বলে, আসেন স্যার রহমাইন্যার হোটেল আসেন। এহেবারে পদ্মার তাজা ইলিশ স্যার; গরম গরম ভাজা ইলিশ; আর কুন হানে পাইবেননা। ভেজাল নদীর ইলিশ মাছ খাইয়েন না স্যার। রহমাইন্যা একদিন রইস্যারে হোটেলের ভেতরে ডেকে নিয়ে যায়। তারপরে এক ঝাড়ি দেয়, ‘ ‘হৌরের পো আমার হোটেল লইয়া তর এত বিলা কে? মাইনষে লাইন দিয়া আমার হোটেলের ভাজা ইলিশ খায়, আমার হোটেলের পাবলিসিটির কূন দরকার নাই। যা ভাগ এইহান থেইক্যা।‘
এর হপ্তা খানেক পর তখন অবেলা; রইস্যার পেট চোঁ চোঁ করছে; পারলে পদ্মা নদীর সব পানি চুমুক দিয়ে খেয়ে নেবে। রহমাইন্যার কানা বাবুর্চি রসুল রইস্যারে ডেকে পলিথিন ব্যাগে একটা ভাজা ইলিশ মাছের অল্প খাওয়া লেজ আর সামান্য বাসি ডাইল ভাত দেয়। রইস্যা এক গৃহস্থ বাড়ীর কলা গাছ থেকে পাতা ছিঁড়ে নদীর পারে পা ছড়ায়ে বসে; তারপর কলা পাতায় পলিথিন ব্যাগের ভাত ডাল উপুড় করে সাবধানে ঢালে যাতে পাতার বাইরে এক কণা ভাত আর এক বিন্দু ঝোল গড়িয়ে না পড়ে। ধীরে সুস্থে মজা করে ভাত খায়; ইলিশের ল্যাজের মেরুন অংশটুকু রইস্যার এত সুস্বাদু লাগে! লেজটা চুষে চুষে খায় অনেকক্ষণ। তারপর লেজের শক্ত কাঁটা একটা একটা করে চিবিয়ে গুড়ো করে মুখের লালা মিশিয়ে গিলে ফেলে; কলাপাতায় লেগে থাকা ঝোল মশলা চেটে পুঁটে খায়; পারলে ঝোলে মাখা কলা পাতা চিবিয়ে খাবে।
নদীতে তখন এক জোড়া পিয়ারের মাঝে ষ্টীল গার্ডার বসানোর কাজ চলছে। বার্জে বসান ক্রেনের মাথায় ঝুলে থাকা গার্ডার ধীরে ধীরে নামছে; দুই পিয়ারের উপর এক দল হলুদ রঙের ভেষ্ট ও হেলমেট পরা ইঞ্জিনিয়ার টেকনেশিয়ান যন্ত্রপাতি নিয়ে অপেক্ষা করছে গার্ডার জোড়া দেবার জন্য।
খাওয়া শেষে রইস্যা বাজারের মসজিদের চাবকল থেকে পানি খেয়ে ঢেকুর দেয়, মুখের উপরে হাত ধরে ঢেকুরের সাথে বের হওয়া বাতাসের ইলিশ ইলিশ গন্ধ নাকে টেনে নেয়। তারপর নদীর পাড়ে গামছা বিছায়ে একটু কাত হয়; নদীর মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা চল্লিশটা পায়ারের দিকে অবাক চেয়ে থাকে। তারপর ঘুমিয়ে পড়ে।
‘এই পদ্মা ব্রিজের কাজ কবে শেষ হইব? শেষ হইলে আমি কি পেট ভইরা ভাত খাইতে পারুম! একটা মোবাইল হইব আমার; আমাগো ভিটাবাড়ী গিলা খাইছে নদী অনেক বছর আগে; হেডা কি বুইঝা পামু। পদ্মার চরে কি একটা ছনের ঘর উডাইতে পারুম!’
হঠাৎ ব্রিজ কন্সট্রাকসন সাইট থেকে ইঞ্জিনিয়ার টেকনেসিয়ানদের আনন্দ উচ্ছ্বাসের শোরগোল বাতাসে ভেসে আসে: গার্ডার শেষ পর্যন্ত জোড়া লেগেছে। আওয়াজে রইস্যার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ও বুঝতে পারেনা, আসলে কি হয়েছে। কিন্তু ঠিকই টের পায়, পেটে ক্ষুধার চিন চিনে ব্যথা চাড়া দিচ্ছে।
ফারুক কাদের, ঢাকা, মো: 01756 454871
|