লেক ইলাওয়ারায় ফিশিং ট্রীপ ফারুক কাদের
গতকালের ফিশিং ট্রীপে কি পেয়েছি আর কি পাইনি – তার হিসাব মিলানো জরুরী কিনা? আমরা পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ও সরঞ্জাম নিয়ে সিডনী থেকে একশ কিলোমিটার দক্ষিণে লেক ইলাওয়ারাতে মাছ ধরতে যাই! সরঞ্জামের মধ্যে ছিল ফিশিং রড, কয়েক ধরনের মাছের চার। খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা তো ছিলই। আমাদের টীমে মৎস্য শিকারের মত অনিশ্চিত ও কঠিন বিদ্যায় সম্প্রতি দীক্ষা নিয়েছ এমন দুজন ছিল। আর ছিল একজন ফিশিং এক্সপার্ট। ট্রীপের আগে জটিল ফিশিং রড দিয়ে মাছ ধরার ছোট খাট ট্রেনিং নেয়া হয় তার। আমি এই ট্রীপে দর্শক হিসেবেই গিয়েছিলাম। আমাদের সাথে ছিল মৎস্য শিকারে উদাসীন এক গাদা তরুণ ভাগ্না ও ভাগ্নী।
লেক ইলাওয়ারা নিউ সাউথ ওয়েলস স্টেটের দ্বিতীয় সর্ব বৃহৎ লোনা পানির লেক; বিনোদন মূলক মৎস্য শিকারের জন্য বিখ্যাত। এই লেক আম শিকারিদের মৎস্য ভাগ্যের জন্য কতটা উৎসাহ ব্যঞ্জক সেটা সারাদিন রোদে ফিশিং ট্রিপে থেকে টের পেয়েছি। তবে কোন মাহেন্দ্রক্ষণে এই লেক থেকে তিন চার কেজি মাছ পেয়েছেন, এমন ভাগ্যবানের সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে। এটা মীথ কিনা, কে বলবে?
গতকাল ছিল উইক-এন্ড। লেক ইলাওয়ারাতে যেয়ে মনে হয়েছে মাছ ধরার উৎসব লেগেছে; দেশে হেমন্ত কালে বিলের পানিতে গাঁয়ের মানুষের পলো, জাল দিয়ে মাছ ধরার মহতসবের আঁচ পাচ্ছিলাম যেন! পাড়ের কাছে লেকের স্বল্প গভীর পানিতে ২০/৩০ মিটার পর পর ছিপ ফেলে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য মৎস্য শিকারি; পাশেই শিশু সন্তান, সে ও তার সাইজের ছিপ ফেলে কি যেন ভাবছে। আর ডাঙ্গায় মাদুর-চাদর বিছিয়ে বা ফোল্ডিং চেয়ারে বসে খাওয়া-দাওয়া, চা-কফি, কোল্ড ড্রিঙ্ক বা বিয়ার পান রত পরিবার সদস্য, অতিথি ও অভ্যাগতরা। আশেপাশে সূর্যস্নানের বসন-ধারী মেয়েরা ঘোরাফেরা করছে। এক মৎস্য শিকারি লেকের জলেই ফোল্ডিং চেয়ারে বসে ছিপ ফেলেছে। কারো বড়শীতে মাছ ধরা পড়েছে বা টোপ গিলেছে তার আলামত তখনও দেখিনি। দেখেছি মৎস্য শিকারিদের ধ্যানগম্ভীর মুখ।
ছিপ ফেলার আগে টোপ সহ বড়শী বা ফিশিং রড প্রস্তুত করা, বিশেষ করে নতুন মৎস্য যোগীদের জন্য, মহা কসরতের ব্যাপার। খাজনার চেয়ে বাজনা বেশী! মৎস্য শিকারের মহাযজ্ঞ দেখে বোঝা যাচ্ছিল, ফিশিং গিয়ার ব্যবসায়ীদের ভাল বাণিজ্য হচ্ছে, কিন্তু মৎস্য শিকারিদের মৎস্য ভাগ্য ততটাই খারাপ মনে হোল। তবে মানুষের উৎসাহের কোন কমতি নেই; সবাই পরিবারের সাথে সময় কাটান উপভোগ করছে।
উৎসাহী মৎস্য শিকারিরা লেকের মাছ ধরার সব স্পট দখল করে ফেলেছে। আমরা স্পট খুঁজে পেতে লেক আর সাগরের মোহানার কাছে ব্রেক ওয়াটার বা সি ডাইকের উপরে চলে এলাম। নীল সাগর থেকে শীতল, দেহ-মন জুড়ানো, পাগলা হাওয়া বইছে। এমন দুরন্ত হাওয়ায় আমার ১৫ ডলার দিয়ে কেনা নতুন ক্যাপ উড়ে ব্রেক ওয়াটারের স্টোন রিপ-রাপের ফাঁকে ঢুকে পড়ল, যেখান থেকে জান বাজী রেখে ক্যাপ উদ্ধারের প্রশ্নই আসেই না। আমার মন গেয়ে উঠল: হাওয়া মে উড়তা যায়ে মেরা পেয়ারী মাথার ক্যাপ, অর্থাৎ মাছ ধরা দেখতে এসে আমার ১৫ ডলার গচ্চা। এই ব্রেক ওয়াটারেও উৎসাহী মৎস্য শিকারির অভাব নেই; টীমের একজন ছিপ ফেলেছে, বাকীরা গল্প করছে। ওদিক মোহানার মুখে কতগুলো বেরসিক সশব্দে ওয়াটার স্ক্রুটার চালিয়ে মাছ ধরার ধ্যান গম্ভীর পরিবেশটাই নষ্ট করে ফেলছে। ব্রেক ওয়াটারে আমাদের মৎস্য ভাগ্য শূন্য।
তারপর ক্ষ্যামা দিয়ে ফিরে আসছি; অন্য স্পট খুঁজছি। এক স্পটে হিজাবধারী এক লেবানিজ মহিলা চোখের সামনেই একটা মাঝারী সাইজের স্যান্ড হোয়াইটিং ধরে ফেলেছে, তারপর মাছটাকে আদর করে আর চুমু খেয়ে বাকেটে চালান করে দিল। আমার চোখে বড়শীতে এই প্রথম মৎস্য দর্শন। আমরা হৈ হৈ করে উঠি, এখানে মাছ পাওয়া যাবে। লেবানিজদের কাছেই এক চিলতে জাগায় ছিপ ফেলে বসে যাই। হায় ঈশ্বর! এখানেও ফলাফল শূন্য বাকেট।
সকালে লেকের ভেতরে এক জেটিতে ছিপ ফেলে দেশী সরপুঁটি সাইজের ৪টি অপ্রাপ্তবয়স্ক মাছ পাই, যা রাজ্যের আইন অনুসারে লেকের জলেই বিসর্জন দিতে হোল। আমাদের ফিশিং গুরু লিমা ভাবী, যার ট্র্যাক রেকর্ড খুবই ভাল, টীমে থাকা স্বত্বেও কাজ হয়নি। সুতরাং আমরা শূন্য বাকেট হাতেই বাড়ী ফিরেছি।
দলের দুই নব্য মৎস্য শিকারি শপথ করেছিল, তারা ফিশিং ট্রীপ থেকে রাতের ডিনার যোগাড় করে আনবেই আনবে। শেষ পর্যন্ত তা দুরাশায় পরিণত হয়েছে। চাওয়া পাওয়ার মধ্যে এতটা আকাশ সমুদ্র ফারাক হবে, কে ভেবেছিল! তবে বুঝেছি মাছ ধরতে যেয়ে হৈ চৈ করাতে অনেক আনন্দ আছে। এজন্যই এত মানুষের ভিড় আর মৎস্য শিকারির চেয়ে উৎসুক মৎস্য শিকার দর্শনপ্রার্থীদের সংখ্যা এত বেশী। কিন্তু যাদের একবার মৎস্য শিকারের নেশা দংশন করেছে, তাদের এ ব্যাপারে ভাগ্য লেখা হয়ে গেছে; তাদের লেক ইলাওয়ারায় বারে বারেই আসতে হবে।
ফারুক কাদের, সিডনি
|