করোনা ডাইরি ফারুক কাদের
২২/০৩/২০২০ করোনা প্রতিরোধে গৃহবন্দী জীবন শুরু আজ রবিবার থেকে। গতকাল শনিবার নারায়ণগঞ্জে এক বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছিলাম। বিয়ের অনুষ্ঠানে আসন্ন করোনা দুর্যোগ সংক্রান্ত জল্পনা কল্পনা কানে এলো না। শুক্রবার গিয়েছিলাম নরসিংদী, আমার এক বন্ধুর গ্রামের বাড়ী। আজ ৯-৫টা অফিস জীবনের খোলস, গোপন কুঠরিতে রেখে দিয়ে গৃহবন্দী জীবনের দীক্ষা নিলাম।
বিকেলে মুক্ত আলো বাতাস গায়ে লাগাতে বিল্ডিং এর ছাদে গিয়েছিলাম। ছাদের তিন কোনে তিনটি মিনি ফ্ল্যাট আছে। ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা ছাদের উন্মুক্ত অংশে গ্রিলের ফেন্স দিয়ে যে যার যার সীমানা টেনে নিয়েছে। সীমানার ভেতরে উঠোনের মত। ভেতরে টব, ড্রাম, ইটের গাঁথুনির মধ্যে ফল, সবজী ও ফুলের বাগান; সাথে দোলনা। ফ্ল্যাটের ছাদেও বাগান। আম, পেঁপে, কলাগাছ, ওড় বড়ই ছাড়াও কয়েকটা বড় টবে আখ লাগান হয়েছে। বাগান পরিকল্পনায় ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানের আমেজ পাওয়া যায়। সীমানার বাইরে বিল্ডিং এর নীচতলা বাসিন্দাদের হাঁটা হাঁটি ও কাপড় শুকবার জন্য দু চিলতে জাগা।
নীচে ফিরে আসার পর দেখি ছাদের এক ফ্ল্যাট-বাসী আমাদের গেন্ডারী উপহার পাঠিয়েছে। কৌতূহল বশতঃ চিবিয়ে আঁখ খেলাম, অনেক অনেক বছর পর; সত্যি সুখ পেলাম। টবে লাগান আখ যতনা মিষ্ট তার চেয়ে স্বাদ বেশী। আঁখ খেতে যেয়ে সাবধান হতে হয়েছে, দু একটা দাঁতে ফিলিং দেয়া আছে তো! আখ নিয়ে আমরা ছোটবেলায় ধাঁধা জিজ্ঞেস করতাম: বলত দেখি এইটা কি জিনিস? আল্লাহ্’র কি কুদরত, লাঠির ভিতর শরবত!
বিক্রমপুর কুসুমপুর গ্রামে নানাবাড়িতে ক্ষেত থেকে আখ তুলে চিবিয়ে খেয়েছি! ছোটবেলায় বর্ষাকালে নানাবাড়ি প্রায়ই যেতাম। কুসুমপুরে বর্ষাকালের সৌন্দর্য কি ভোলা যায়! বাড়ীর চারপাশের পাট আর আঁখের ক্ষেতখোলা বর্ষার পানিতে ভেসে গেছে। পুকুরগুলোর ঘাট শুধু জেগে আছে। ভিটে বাড়ীর সাথে লাগোয়া একটা হিজল গাছে নৌকা সব সময় বাঁধা থাকত। আমরা নৌকা করে ক্ষেত থেকে গেন্ডারী তুলে নিয়ে আসতাম। কখনো বা শাপলা। একবার শাপলা তুলতে যেয়ে নৌকা থেকে পড়ে ডুবতে বসেছিলাম। তখন সাঁতার জানতাম না (এখনও জানিনা)। মনে হচ্ছিল, আমি পাতালে হারিয়ে যাচ্ছি ধীরে ধীরে। খুব সম্ভবতঃ নানা আমাকে টেনে তুলেছিল।
পরদিন সকালে ছাদে। আজ মনে হচ্ছে এই ছাদে আমি চিরকাল ধরেই আসছি। ড্রামে লাগান আম গাছে গুঁটি ঝুলছে। কয়েকটি টবে বনসাই করা কয়েকটা পাকুড় গাছ আছে। পেয়ারা গাছে একটা দুটো ফুল এসেছে। সজনা গাছে অনেক সজনা ঝুলছে, কিছু শুকিয়ে গেছে। চৈত্র মাসে শুষ্ক গরম আবহাওয়ায় কাঁচা আম বা সজনার ডাল দেহ মনে সতেজ ভাব আনে।
২৩/০৩/২০২০
করোনা প্রতিরোধে হস্ত প্রক্ষালনের পদ্ধতি আমার কাছে খুবই কঠিন মনে হচ্ছে। বাইরে যাওয়া ছাড়া ঘরের ভেতর নানা স্থানে হাত লাগে। সব জাগায় ধুলো। ২০ সেঃ হাত ধোয়া কোন সমস্যা নয়, কিন্তু প্রতিটা আঙুল ঘষে ঘষে ধোয়া?
শুচিবাই গ্রস্ত মহিলাদের কথা মনে পড়ে? যে সারাদিন হাত পা ধুচ্ছে বা ঘর ধোয়া মোছা করছে। আমার এক মামী শাশুড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর উপজেলার দ্বীপেশ্বর গ্রামে থাকেন। গ্রামের নামটা ভীষণ সুন্দর তাই না! আমি ও আমার স্ত্রী একবার এই মামী শাশুড়ির বাড়ীতে কয়েক দিন বেড়িয়েছিলাম। তখন মামী শাশুড়িকে দেখেছি টিনের চালে উঠে চাল ঘষামাজা করতে। আমার মামা শ্বশুরকে অবশ্য এ নিয়ে অভিযোগ করতে দেখিনি। করবেন বা ই কেন? উনি খুবই সোজা সাপটা স্ত্রী ভক্ত (না অনুগত প্রাণ!) মানুষ। আমার মামী শাশুড়ি সারাদিন ধোয়া মোছা সেরে সন্ধ্যাবেলা বাড়ীর সামনের বড় পুকুরে ঘণ্টা খানেক গোসল সেরে বাড়ী ফিরতেন।
আমরা হয়তো করোনা ভাইরাসের প্রকোপ কাটিয়ে উঠবো। হাত ধোয়ার ব্যাপারটি অনেকের মনস্তত্ত্বে স্থায়ী ছাপ রেখে যেতে পারে। যেমন হয়েছিল সেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ নাটকের লেডী ম্যাকবেথের বেলায়। লেডী ম্যাকবেথ স্বামী ম্যাকবেথ কে হত্যা করেছিল তার পরকীয়ার পথের কাঁটা দূর করবে বলে। লেডী ম্যাকবেথের খুঁতখুঁতি জন্মে যে তার হাতে এখনও স্বামীর রক্তের দাগ লেগে আছে। মহিলা বারে বারেই হাত ধোয় রক্তের দাগ মুছে ফেলতে, কিন্তু পারছেনা। তাই সে ঘুমের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে স্বগতোক্তি করে: Here's the smell of the blood still. All the perfumes of Arabia will not sweeten this little hand.
ফারুক কাদের, ঢাকা থেকে, মোবাইল: 01756 454871
|