বৌ কথা কও ফারুক কাদের
ঢাকা থেকে সড়ক পথে বিক্রমপুর ভাগ্যকূলে এসেছি; বাপ দাদার ভিটে সরদার বাড়ী যাব। বাড়ীর উঠোনে এখন গাড়ী নিয়েই চলে যাওয়া যায়। সরদার বাড়ীর পাশাপাশি সারেং বাড়ী। সারেং বাড়ীর কাছাকাছি এসে পড়েছি, দেখি রাস্তার পাশেই চাচাত ভাই সিরাজ দাঁড়িয়ে। গাড়ী থামালাম, সিরাজ কাছে এসে বলল, দাদা এই সারেং বাড়ীতেই দাদীর কবর, চলেন দেইখা আসি। সিরাজকে আগে বলে রেখেছিলাম, আমাকে দাদীর কবর দেখাতে নিয়ে যাবি।
ঢাকায় বড় হয়েছি, কিন্তু গ্র্রামের সাথে যোগাযোগ ছিল; ২০০২ সাল থেকে অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী। ইতিমধ্যে আমার দেখা ভাগ্যকূল ও সরদার বাড়ী অনেক বদলে গেছে। নতুন প্রজন্মের মানুষের পদচারনায় সরদার বাড়ীর অঙ্গন এখন মুখরিত। এরা দাদীর কথা শুনেছে মাত্র বাপ মার কাছে, যাদের সম্বল শোনা কথাই। দাদীকে যারা দেখেছে, তারা অনেক আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে।
দাদীর সারেং বাড়ীতে জন্ম, এ বাড়ীতেই তার জীবনের শেষ কয়েকটা দিন কেটেছে; এখানেই তিনি চিরশয্যায় শায়িত। পরমা সুন্দরী দাদী কিশোরী বয়সে সরদার বাড়ীতে বৌ হয়ে আসেন। চার নাবালক পুত্র সন্তান রেখে তরুণী বয়সেই মারা যান ( দাদীর মৃত্যুর পর দাদা আবার বিয়ে করেন; দাদার দ্বিতীয় স্ত্রীকেই দাদী বলে জেনেছি এত কাল)। দাদীর এই স্বল্পায়ু জীবন এখন আমাকে চুম্বকের মত টানে। তাই দাদীর স্মৃতি, চিহ্ন বা তার ব্যপারে কথন যা সরদার আর সারেং বাড়ীতে ছড়ায়ে ছিটিয়ে আছে তা খুঁজে ফিরছি। স্মৃতি বিস্মৃতির অস্পষ্ট টুকরো টুকরো ছবি জোড়া দিয়ে দাদীর এক মানস প্রতিমা গড়ে তোলা অবসেশনের মত আমাকে তাড়া করছে। আজ সারেং বাড়ীতে দাদীর কবর এই প্রথম দেখতে এসেছি।
আমি আর সিরাজ দাদীর কবরে কাছে গেলাম। খুবই সাধারণ একটা কবর; বাড়ীর পেছনে, বাঁশ ঝোপের আড়ালে। নাম খোদাই করা নেই, নেই জন্ম-তারিখ ও মৃত্যুদিন। কবরের আয়তকার ইটের গাঁথুনির বেড়টা নুতন; সম্ভবতঃ সংস্কার করা হয়েছে। শুনেছি দাদীর কবরের সংস্কার নিয়মিতই করা হয়।
দাদীর কবরের কাছেই একটা ডেউয়া গাছ; বাঁশ ঝোপ ছাড়াও বুনো লতাপাতা জড়াজড়ি করে আছে; কালাকুচ পাতার লতা সোহাগে ডেউয়া গাছ জড়িয়ে ধরেছে। গাছে পাকা ডেউয়া ঝুলছে; কবরের আশে পাশে দু একটা পাকা ডেউয়া গলে নরম মাটির সাথে প্রায় মিশে গেছে। ভেজা মাটির উপর দিয়ে একটা কেড়া পোকা হেলতে দুলতে চলে গেল। বুনো লতাপাতায় বাহারি ছোট ছোট হলুদ রঙের ফুল ফুটেছে। ফুলের গন্ধ নিতে গেলাম, অমনি ঝোপ থেকে একটা বেজী ছুটে পালাল। সিরাজ বলল, মিঞা ভাই, সাপ থাকতে পারে। আমি মাথা ঘামালাম না।
কবরের আশে পাশে রোদ খুব একটা পড়েনা মনে হয়; একটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব, বুনো লতাপাতার আদর মাখানো ভেজা গন্ধ। একটা পাখী ডাকল, বৌ কথা কও, ডেকে গেল কয়েক বার আকুল কণ্ঠে। দাদী কি বাঁশ ঝোপে এসে এই পাখীর ডাক শুনতেন? পাখী কি জানে এখানে সারেং বাড়ীর এক পরমা সুন্দরী কন্যা ঘুমায়ে আছে, যার ঘুম কখনই ভাঙ্গবেনা, পাখী যতই ডাকাডাকি করুক। মনে মনে বললাম, দাদী কথা কও, ঘুমাইয়া থাইকো না; হূমুইর দেও।
সরদার বাড়ীতে দাদী বৌ হয়ে আসেন অনেক অনেক বছর আগে, আন্দাজ ১৯১০ কি ১৫। পাল্কীতে চড়ে শ্বশুর বাড়ী এসেছিলেন নিশ্চয়। সে সময় এটাই চল ছিল। না জানি পাল্কীতে দাদীর ফর্সা লালটুকটুক মুখ লজ্জায় আনত হয়েছিল কত! এমন সুন্দর বৌরানীকে ধান দূর্বা দিয়ে বরণ করা হয়েছিল, কোন সন্দেহ নাই। সরদার বাড়ীতে সংসারী দাদীকে কল্পনা করি: ঘোমটা দেয়া কাঁধে আঁচল ছড়ানো বা কয়েক মাস বয়সী তার সর্বকনিষ্ঠ পুত্র সন্তান স্তন্যদান রত এক সুখী মায়ের ছবি।
মিঞা ভাই, সবাই বলে দাদী খুব সুন্দরী ছিলেন, টকটকে ফর্সা, সিরাজ বলল। চিন্তা কইরা দেখেন, বড় কাকা কত সুন্দর ছিলেন; মাঝারো কাকা, ক্ষ্যাপা কাকা সবাই ফর্সা আছিল; সবাই বলে, দাদী তার রূপ, রং ও বাহার বড় কাকার মধ্যে ঢাইলা দিছে। মাঝখানে খালী আমার বাবা শ্যামলা আছিল, সিরাজ হাসল, আমি বাবার রংই পাইছি। আমার মাইয়াডা ও শ্যামলা; কিন্তু দেখেন, কত লক্ষ্মী, সুন্দর আর ডাগর হইছে; মনে হয় দাদীর কাছ থেইকা পাইছে।
সিরাজ আরো বলে, দাদী সরদার বাড়ী বৌ হইয়া আসার পর ঘন ঘন বাপের বাড়ী যাইতে চাইত। আমাগো পরদাদা আদু সরদার দাদীরে খুবই আদর করত। সিরাজ জানাল, বালিকা বধূ দাদীর মন খারাপ হলে মেলা থেকে খেলার পুতুল আর মণ্ডা মিঠাই দাদীর জন্য কিনে আনতেন আদু সরদার। আদু সরদারের দুইটা ভারী তালা মারা একটা বড় সিন্দুক ছিল; সিন্দুকে সোনা গয়না, দামী বাসন কোসন, দলিল পত্র থাকত। দাদী বড় হলে পরে সিন্দুকের চাবি দাদীকে বুঝায়ে দেন।
মিঞা ভাই, দাদীর নামে মিলাদ পড়ায়ে দেন, সিরাজ বলল। আমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম।
কি বললি সিরাজ? মিঞা ভাই, বলছিলাম মিলাদের কথা, দাদীর জন্য; আমরা সবাই মিলা একসাথে দোয়া করতাম দাদীর জন্য।
ও তাই, তুই জানিস দাদীর কি হয়েছিল যে এত অল্প বয়সে মারা গেলেন?
শুনছি দাদীর জ্বর হইছিল।
দাদী জ্বরে মারা গেল?
মিঞা ভাই, তখন কালাজ্বর ও টাইফয়েড হইত, খুব কঠিন রোগ ছিল; না ছিল কোন চিকিৎসা ঐসময়। মনে অয় ঐরকম কিছুই দাদীর হইছিল।
আমি তখন থাকলে দাদীকে মরতে দিতাম না রে। দাদীরে আমি ক্যালকাটার বড় ডাক্তারদের কাছে নিয়ে যেতাম।
সিরাজ কিছুক্ষণ নীরব রইল। তারপর বলল, মিঞা ভাই, আমার কি মনে হয় জানেন, দাদা, পরদাদা আদু সরদার সবাই দাদীরে বাঁচায়া রাখবার জন্য সব চেষ্টাই করছেন। শুনছি ফরিদপুর থেইক্যা সেই সময় বিখ্যাত কবিরাজ হলধর সেনরে নিয়া আসা হইছিল দাদীর চিকিৎসার জন্য। কিন্তু আল্লাহর মর্জি ছিল অন্য রকম; আমরা তার মাজেজা কি বুঝতে পারি বলেন। আল্লাহ আমাগো দাদীরে ভেস্ত নসিব করুক।
কে একজন পিছন থেকে আমার কাঁধে হাত দিল, ভাই সাহেব আপনার পরিচয়? ফিরে তাকিয়ে দেখি একজন শুভ্র দাঁড়ী ধারী টুপি পরা একজন মানুষ, অন্য হাতে বাজারের ব্যাগ। সিরাজ পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, মিঞা ভাই, উনি দাদীর বড় ভাই বছিরুদ্দি সারেং এর নাতিন জমিরুদ্দিন। আর আমাকে দেখিয়ে বলল, বড় কাকার বড় ছেলে, অষ্ট্রেলিয়া থিকা আসছেন, দাদীর কবর জিয়ারত করতে আসছিলেন।
বসেন মিঞা ভাই, এই কে আছস, তিনডা মোড়া দিয়া যা, গাছ থেইকা ডাব পার। সরদার বাড়ী থেইকা মেমান আইছে। জমিরুদ্দিন ডাবের পানি খেতে দিয়ে বললেন, মিঞা ভাই, এত দিন পর দাদীর কথা মনে পড়ল! আপনাগো ভিটি খালী পইড়া আছে; বাড়ী উঠান। দেশের কথা ভুইলেন না।
মার কাছে শুনেছি, বাবা ম্যাট্রিক পড়ার সময় দাদী মারা যান। যদি ধরে নেই বাবার বয়স তখন ১৫ বা ১৬, দাদীর বয়স ২৫ থেকে ৩০ হবে যখন মারা যান, কারণ সে সময় ১০/১২ বছর বয়সেই মেয়েদের বিয়ে হত। একেবারেই যুবতী নারী ছিলেন যখন দাদী মৃত্যু শয্যায় শায়িত! দাদীর নাম ছিল কমলা বিবি। আমার বড় ছেলের নাম কমল দাদীর নাম থেকেই পাওয়া।
দাদী ছিলেন তার বাবার একমাত্র কন্যা সন্তান, তার ছিল দুই বড় ভাই রিয়াজুদ্দিন সারেং ও বছিরুদ্দিন সারেং। দুই ভাই তাদের একমাত্র আদরের বোনকে মৃত্যুর পর নিজদের কাছেই রাখতে চেয়েছেন, তাই দাদী তার বাপের বাড়ী সারেং বাড়ীতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এবং ওখানেই সমাহিত হন।
দাদীর কথা ভাবতে আমার চোখ ভিজে গেল। দাদী কেমন ছিলেন, কি করতেন, তার কি আশা আকাঙ্ক্ষা ছিল, সবই কল্পনা করতে যেন কত ভাল লাগে। কেন অল্প বয়সে দাদীকে পৃথিবী ছেড়ে যেতে হল! বেঁচে থাকলে তার ও কত বড় সংসার হোত, এক গাদা নাতি নাতকুড় দেখে যেতে পারতেন। দাদীর জন্য বাবার কি মনে কষ্ট ছিল! এ প্রশ্নের উত্তর দেবার কেউ নেই।
সারেং বাড়ী থেকে ফেরার আগে দাদীর কবরের কাছে আবার গেলাম। আমার ভেতরটা দাদীর জন্য হাহাকার করে উঠল, তোমাকে না দেখার কষ্ট সারা জীবনে যাবেনা। মনে মনে বললাম, তোমাকে আমরা দেখিনি দাদী, কিন্তু তুমি আমাদেরই ছিলে, আমরা তোমারই থেকে উৎসারিত, তুমি সব সময় আমাদের স্বত্বায় বসবাস করবে! দাদীর কথা ভেবে আমি আজ যেন জীবনের পরম সত্য আবিষ্কার করলাম: মাটির সাথেই আমাদের শিকড়ের সম্পর্ক। আমরা সবাই মাটির মানুষ, আমরা কেউ কারো চেয়ে বড় বা ছোট নই।
দুপুরে সিরাজের সাথে মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়তে গেলাম। নামাজ শেষে বাবা ও আমার প্রয়াতঃ আত্মীয় স্বজনের জন্য দোয়া করলাম। দাদীর জন্য বিশেষ করে। দাদীর কথা ভেবে মনে যে কান্না ভেজা প্রশান্তি এলো জীবনে তা খুব কমই পেয়েছি। মনে হোল দাদী যেন আমার মনের অবস্থা সব দেখছেন আর বলছেন, ভাল থাক দাদা, সব ঠিক হইয়া যাইবো, চিন্তা কইরোনা।
মসজিদ থেকে বের হয়ে সিরাজকে জিজ্ঞেস করলাম, সিরাজ, দাদীর জন্য দোয়া করছিস তো। সিরাজ বলল, হাঁ, মিঞা ভাই। দেখলাম, ওর চোখ ভেজা।
ফারুক কাদের, ঢাকা, মো: 01756 454871
|