বাদশাহ নামদার ফারুক কাদের
“বাদশাহ নামদার” প্রয়াতঃ কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমদের লেখা এক ঐতিহাসিক উপন্যাস। মোগল সম্রাট হুমায়ূনের জীবনী অবলম্বনে রচিত এ উপন্যাস এক দমেই পড়ে ফেলি। হুমায়ূন কেন এক মোগল সম্রাটকে উপজীব্য করে উপন্যাস লিখলেন, এটা জানার কৌতূহল থেকেই গ্রন্থটি হাতে নিয়েছিলাম। পরাক্রান্ত মোগল সম্রাটদের বর্ণাঢ্য জীবন-যাত্রা ও ভোগ-বিলাস কারও অজানা নয়। হুমায়ূন এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তবে তার খামখেয়ালীপনার সাথে লেখক হুমায়ূনের মিল আছে। সম্ভবত: এটাই “বাদশাহ নামদার”উপন্যাসের বিষয়বস্তু নির্বাচনের কারণ।
উপন্যাসে পাওয়া মোগল বাদশাহদের বিলাসী জীবন-যাত্রার চিত্র আমাকে হতবাক করেছে। যুদ্ধ, শান্তি বা উৎসব পাবন, যেকোনো পরিস্থিতিতে মোগল বাদশাহদের আহারের বহর যেনে চোখ উঠেছে কপালে। মোগল রাজা বাদশাহরা যে ভোজন-বিলাসের জন্য বিখ্যাত ছিলেন, তার একটা নমুনা লেখক হুমায়ুন তার উপন্যাসে দিয়েছেন।
সম্রাট হুমায়ূন বাংলা-বিহারের অধিপতি শের খাঁ র বিরুদ্ধে বাংলা মূলকে যুদ্ধ যাত্রা করেছেন। সাথে সম্রাটের পরিবার ও জেনানা মহল আছে। সম্রাটের এ যুদ্ধকালীন বাবুর্চির সংখ্যা ছিল এক হাজার। পথে বিরতির সময়ে সম্রাটের ভোজন বিলাসের ফিরিস্তি লেখক হুমায়ুনের বর্ণনা অনুযায়ী নিম্নরূপ:
• পোলাও পাঁচ পদ • রুটি সাত পদ • কিসমিসের রসে ভেজান ঘিয়ে ভাজা হরিয়াল, বনমোরগ ও ময়ূরের মাংস • আস্ত ভেড়ার রোষ্ট • পাহাড়ি ছাগের রোষ্ট (সম্রাটের বিশেষ পছন্দ) • বাছুরের মাংসের কাবাব • ফল, শরবত ও মিষ্টান্ন
খাবারের ফিরিস্তি দেখে মনে হবে বাদশাহ নামদার পিকনিক বা শিকারে বের হয়েছেন। তালিকায় শাক-সবজীর বালাই নেই। তবে এটা বিবেচ্য নয়; কারণ মোগল বাদশাহদের মোগলাই খানার অর্থই পোলাও মাংস আর ঘিয়ের মৌতাত। বাংলা মুলুকে যুদ্ধ যাত্রা করার সময় সম্রাটের রসদ ভাণ্ডারে মহিষ আর গরুর দুধের ঘি ছিল ৪০ মন। ওদিকে সৈন্যদের জন্য বরাদ্দ ছিল: এক ঘটি দুধ, যবের রুটি, এক পোয়া ছাতু, মাংস ও পিয়াজ।
যুদ্ধকালীন সময়ে খাওয়ার এন্তেজাম থেকে শান্তির সময়ে রাজধানী দিল্লীতে মোগলদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকা অনুমান করা কষ্ট নয়। সন্দেহ নেই, শাহী দস্তরখানায় পরিবেশন-কৃত খাবার, বিশেষ করে উৎসব পাবনে বা অতিথি সেবার সময়, এক জাঁকজমকপূর্ণ প্রদর্শনীর আকার নিত। আঞ্জামকৃত খাবারের একটা বিরাট অংশ অপচয় হওয়া অস্বাভাবিক নয়। বাদশাহ নামদারের খাদ্য-তালিকা প্রণয়নে দিল-দরিয়া হওয়াটাই শাহী বাবুর্চিদের জন্য ছিল বুদ্ধিমানের কাজ; অন্যথায় মুণ্ড হারানোর ভয় ছিল।
মোগল বাদশাহদের ভোজন বিলাস সন্দেহ নেই কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে। এ মোগলাই খাবারের খাদক যারা তাদের বেশী দিন বাঁচার কথা নয়। ইন্টারনেট থেকে পরাক্রান্ত মোগল সম্রাটদের আয়ুর একটা পরিসংখ্যান দেওয়া যাক: বাবুর বেঁচেছিলেন ৪৭ বছর, হুমায়ুন ৪৮, আকবর ৬৩, জাহাঙ্গীর ৫৮, শাহজাহান ৭৪ ও আওরেংজেব ৮৯; তাদের গড় আয়ু ৬৩ বছর। মোগল সম্রাটদের মধ্যে একমাত্র আওরাঙ্গজেব দরবেশদের ন্যায় কৃচ্ছতা-পূর্ণ জীবন যাপন করে গেছেন; হয়তো তার দীর্ঘজীবী হওয়ার কারণ এটাই। আওরেংজেবের পর ১৪ জন সম্রাট ক্রম-অবনতিশীল মোগল সাম্রাজ্য শাসন করেন। এরা রাজ্য শাসনের চেয়ে ভোগ বিলাস ও সংস্কৃতি চর্চায় জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছেন। মোগল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট ছিলেন দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ; তিনি বেঁচেছিলেন ৮৭ বছর। সর্বমোট বিশ (২০) মোগল সম্রাটের গড় আয়ু ৫৩ বছর। এটা বলা অযৌক্তিক হবেনা যে মোগল সম্রাটদের তুলনামূলক মিত আয়ুর জন্য তাদের বিলাসী জীবন যাত্রা অনেকটাই দায়ী ছিল।
মোগল বাদশারা বর্ণাঢ্য জীবন যাপন করে গেছেন; ভোজন-বিলাস ছিল তার একটি দিক। তারা কারুশিল্প, সঙ্গীত, স্থাপত্য শিল্প অনুরাগী ছিলেন। প্রতিভাবান শিল্পী, সঙ্গীতজ্ঞ ও কবিরা মোগল বাদশাহদের অঢেল পৃষ্ঠপোষকতা ও আনুকুল্য পেয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকেই পারিষদ বর্গের সদস্য ছিলেন; এদের সান্নিধ্যে বাদশাহদের ভাল সময় কেটেছে।
কতিপয় মোগল বাদশা শিল্পসম্মত শের বা কবিতা লিখেছেন। বাবুর ও হুমায়ুন মুখে মুখে শের রচনা করেছেন অসংখ্য। এটা খুবই সম্ভব যে মোগল বাদশাহদের কথোপকথন বা মুখের ভাষাই ছিল অনেকটা কাব্যিক। বাবুর যুদ্ধের ক্ষণিক বিরতিতে ও প্রেমের কবিতা লিখেছেন। বাবুরের রচিত “বাবুরনামা”ক্লাসিক আত্মকাহিনীর মর্যাদা পেয়েছে। শেষ মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর একজন শীর্ষস্থানীয় উর্দু কবি ছিলেন। সিপাহী বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ কর্তৃক তিনি রেঙ্গুনে নির্বাসিত হন এবং সেখানেই মৃত্যু বরণ করেন। নির্বাসিত বাহাদুর শাহ জাফরের এক কবিতায় জন্মভূমি ভারতের জন্য তার হাহাকার ফুটে উঠেছে (সাথে বাংলা অনুবাদ দেওয়া হল):
উর্দু ভাষ্য: কিতনা হ্যাঁয় বদনসিব জাফর দাফনকে লিয়ে দো গজ জমিন ভী না মিলি কূঁয়ে ইয়ারো মে। বাংলা অনুবাদ: জাফর তুমি এতই ভাগ্যহীন প্রিয়জনের মাঝে দাফনের তরে জুটেনি দু গজ জমিন।
খামখেয়ালী সম্রাট হুমায়ুন এক বর্ণীল চরিত্রের মানুষ ছিলেন। শের রচনা করেছেন প্রচুর। সম্রাটের প্রিয়তমা স্ত্রী ছিলেন হামিদা বানু, যার গর্ভে সর্বশ্রেষ্ঠ মোগল সম্রাট (মোগল-ই-আজম) আকবরের জন্ম। প্রিয়তমা স্ত্রীকে নিবেদন করা হুমায়ুনের একটি শের:
“একজন প্রেমিকের কাছে চন্দ্র হলো তার প্রেমিকার মুখ। আর জোছনা হলো প্রেমিকার দীর্ঘশ্বাস”।
বাদশাহ হুমায়ূন ছবি আঁকতেন, পড়াশোনা করেছেন প্রচুর; ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে অধ্যয়নে তার প্রচুর সময় কেটেছে। যাদুবিদ্যা, রন্ধন প্রণালী ও জ্যোতির্বিদ্যার প্রতি তার অনেক আগ্রহ ছিল। নতুনের প্রতি তার ছিল অসীম কৌতূহল।
শের শাহের সাথে যুদ্ধে পরাজিত ও পলায়নপর বাদশাহ হুমায়ূন এক ভিস্তীওয়ালার করুণায় নদীতে ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা পান। হুমায়ূন কৃতজ্ঞতা স্বরূপ একদিনের জন্য হলেও ভিস্তীওয়ালাকে দিল্লীর তখতে আসীন করবার প্রতিশ্রুতি দেন। হুমায়ূন তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন। যুদ্ধে অবরুদ্ধ চিতরের রাজপুত-রানী কর্ণাবতীর পাঠান রাখীবন্ধনের আহ্বানে চিতোর ছুটে গিয়েছিলেন রানীকে উদ্ধার করতে।
শের শাহ একে একে দিল্লী, আগ্রা ও লাহোর দখল করে নিলে বাদশা হুমায়ূনের পলাতক জীবন শুরু হয়। এ দুঃসময়ে হুমায়ূনের সার্বক্ষণিক সঙ্গী ও প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন বিশ্বস্ত: সেনাপতি বৈরাম খাঁ। বিপদে-আপদে, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও শান্তিতে এবং রাজ্য শাসনে বৈরাম খাঁ সব সময়ে হুমায়ূনের পাশে ছায়ার মত থেকেছেন। হুমায়ূনের দুই ভাই মীর্জা কামরান ও মীর্জা হিন্দাল মূলতঃ এ সময়ে হুমায়ূনের পাশে না দাঁড়িয়ে বরং শের শাহ এর অনুগত থেকেছে আখেরে দিল্লীর সিংহাসন কব্জা করবার জন্য।
পলাতক হুমায়ূন শেষ পর্যন্ত দল বল নিয়ে পারস্য সম্রাট শাহ তামাস্পের আশ্রয় গ্রহণ করেন। এই পারস্য সম্রাটের সামরিক সহায়তায় ও বৈরাম খাঁর সেনাপতিত্বে হুমায়ূনের সৈন্য বাহিনী দিল্লীর সিংহাসন পুনরুদ্ধার করে। অনেক মোগল বাদশাহ রাজ্যের ক্ষমতা দখল ও সুসংহত করতে যেয়ে নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছেন। কারো হাত ভাতৃহত্যার রক্তে রঞ্জিত ছিল। কিন্তু হুমায়ূন ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী ও যুদ্ধে পরাজিত তার ভাই মীর্জা কামরানকে ক্ষমা করেন।
দিল্লীর সিংহাসন পুনরুদ্ধারের প্রায় এক বছরের পরের ঘটনা। হুমায়ূন তার লাইব্রেরীতে অধ্যয়ন রত ছিলেন। এমন সময় আজান শুনে তাড়াহুড়োর করে নামার সময় সিঁড়ী গড়িয়ে পড়ে মস্তিষ্কে আঘাত পান; তার বগলে ধরা ছিল এক গাদা বই। এ আঘাত থেকেই হুমায়ূন মৃত্যু বরণ করেন। হুমায়ূনের নির্দেশে বালক সম্রাট আকবরের অভিভাবক হিসেবে হিন্দুস্তানের শাসনভার বৈরাম খাঁর হাতে ন্যস্ত হয়। বৈরাম খাঁর হাতে শাসন ক্ষমতার ভার অন্য আমীর, এমনকি হামিদা বানুর মধ্যেও অসন্তোষ সৃষ্টি করে। শেষ পর্যন্ত সিংহাসন নিষ্কণ্টক করার লক্ষ্যে তরুণ সম্রাট আকবর আততায়ী পাঠিয়ে বৈরাম খাঁ কে হত্যা করেন।
হুমায়ূনের ভাই মীর্জা কামরানও শের রচনায় পটু ছিলেন। তার লেখা একটি শের শোনা যাক:
“রাজ্য হলো এমন তরুণী যার ঠোঁটে চুমু খেতে হলে সুতীক্ষ্ণ তরবারির প্রয়োজন হয়”।
পিতৃব্য রচিত এই শেরের মর্মবাণী তরুণ সম্রাট আকবর নিশ্চয় উপলব্ধি করে থাকবেন।
ফারুক কাদের, ইঙ্গেলবার্ণ
|