পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার বুনোফুল (২) ড. নজরুল ইসলাম
পার্থ অঞ্চলের বুনোফুলগুলো জুলাই থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ফোটে। এই অঞ্চলে আমাদের দেখা তিনটি উল্লেখযোগ্য স্থান হলো - ইয়র্ক, টুজে (Toodyay) এবং বিন্দুন। এগুলো পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার হুইটবেল্ট অঞ্চলে অবস্থিত ছোট ছোট শহর। জনসংখ্যা - ইয়র্ক আড়াই হাজার, টুজে সাড়ে চার হাজার এবং বিন্দুন এক হাজার। পার্থ থেকে এক ঘণ্টার ড্রাইভ। ইচ্ছা করলে একদিনেই দেখে যায়। তবে আমরা সময় নিয়ে এলাকাগুলো ঘুরে ঘুরে অনেক বার দেখেছি। প্রতিবারই কিছু না কিছু নতুন বুনোফুল আমাদের অবাক করে দিয়েছে। এই শহরগুলোর আশেপাশে অনেক রিজার্ভ রয়েছে যেখানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বুনোফুল সংরক্ষণ করা হয়েছে।
ইয়র্ক এভন নদীর তীরে অবস্থিত পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার প্রাচীনতম অভ্যন্তরীণ শহর। পার্থ থেকে ৯৮ কিলোমিটার। এ অঞ্চলে প্রচুর ক্যানোলা চাষ হয়। অগাস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে ইয়র্ক যাওয়ার পথে রাস্তার পাশে অনেক চোখ ধাঁধানো ক্যানোলা ক্ষেত দেখা যায়। অনেকটা আমাদের দেশের সরষে ক্ষেতের মতো। শহরের মধ্যে আছে ইয়র্ক ওয়াইল্ড ফ্লাওয়ার সোসাইটির স্বেচ্ছাসেবীদের দ্বারা পরিচালিত ইয়র্ক বুশল্যান্ড গার্ডেন। এই বাগানে স্থানীয় বিরল এবং বিপন্ন গাছগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে। ইয়র্ক শহরের আশেপাশের রিজার্ভগুলোর মধ্যে রয়েছে ওসওয়াল্ড সার্জেন্ট রিজার্ভ এবং মকাইন রিজার্ভ। এই এলাকায় দেখা বুনোফুলের মধ্যে ছিল – বিভিন্ন ধরণের অর্কিড, স্থানীয় জবা, বাটারকাপ এবং এভারল্যাস্টিং।
এভারল্যাস্টিং পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় বুনোফুল। গোলাপি এবং সাদা রঙের ফুলগুলো দেখতে অনেকটা কাগজের ফুলের মতন। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার অনেক জায়গাতে এই ফুলটার দেখা পেয়েছি। তবে টুজেতে দেখা এভারল্যাস্টিংগুলো ছিল সবচেয়ে সুন্দর। টুজে পার্থ থেকে ৮৭ কিলোমিটার আর ইয়র্ক থেকে ৬৪ কিলোমিটার। এই শহরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এখানে রাস্তার পাশে প্রচুর বুনোফুল সংরক্ষণ করা হয়েছে। তাই গাড়ি চালিয়ে বুনোফুল দেখা যায়। টুজে শহরের কাছেই পেলহাম রিজার্ভ। পাহাড়ের উপর অবস্থিত এই রিসার্ভে একটা লুকআউট আছে। সেখান থেকে পুরো শহর দেখা যায়। এই লুকআউটের আশেপাশে অসংখ্য এভারল্যাস্টিং ফুটে ছিল। টুজে শহরের আশেপাশের রিজার্ভগুলোর মধ্যে রয়েছে ডন অ্যাটওয়েল রিজার্ভ এবং ওঙ্গামাইন (Wongamine) রিজার্ভ। এভারল্যাস্টিং ছাড়া এখানে দেখা বুনোফুলের মধ্যে ছিল – ক্যাঙ্গারু প, কপার কাপ, ক্ল ফ্লাওয়ার এবং স্পাইডার অর্কিড।
এভারল্যাস্টিং, টুজে বিন্দুন চিটারিং ভ্যালিতে অবস্থিত একটা ছোট শহর। পার্থ থেকে ৭৫ কিলোমিটার আর টুজে থেকে ৫১ কিলোমিটার। পার্থ থেকে বিন্দুন যাওয়ার প্রধান রাস্তা হলো গ্রেট নর্দার্ন হাইওয়ে। এছাড়া একটা টুরিস্ট ড্রাইভ আছে। আমরা গিয়েছিলাম সেই পথ দিয়ে। সবুজ উপত্যকার ভিতর দিয়ে এই ড্রাইভটা ছিল খুব মনোরম। বিন্দুন পৌঁছনোর ১৪ কিলোমিটার আগে, রাস্তার পাশেই ব্ল্যাকবয় রিজ রিজার্ভ, স্থানীয় গাছপালা এবং বুনোফুল দেখার জন্য একটা সুন্দর জায়গা। এখানকার লুকআউটে পোঁছাতে দেড় কিলোমিটার হেঁটে যেতে হয়। তবে কষ্ট করে ওঠাটা সার্থক ছিল কেননা ভিউটা ছিল খুব সুন্দর। পথের ধরে ছিল প্রচুর বুনোফুল আর ব্ল্যাকবয় গাছ। এই রিজার্ভে দেখা বুনোফুলের মধ্যে ছিল – ক্যাঙ্গারু প, কোনফ্লাওয়ার, ফেদারফ্লাওয়ার এবং ডনকি অর্কিড। ব্ল্যাকবয় রিজ রিজার্ভ ছাড়াও বিন্দুন শহরের আশেপাশে আরো অনেক জায়গায় বুনোফুল দেখা যায়। এরকমেরই একটা জায়গায় দেখা পেলাম নীল লেশনাটিয়া (leschenaultia) ফুলের। রাস্তার পাশে ঝোপঝাড়ের পেছনে লুকিয়ে ছিল ফুলগুলো।
নীল লেশনাটিয়া, বিন্দুন পার্থের দক্ষিণ অঞ্চলের বুনোফুলগুলো জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ফোটে। এই অঞ্চলে আমাদের দেখা তিনটি উল্লেখযোগ্য স্থান হলো - মার্গারেট রিভার, আলবানী এবং এস্পেরান্স। মার্গারেট রিভার পার্থ থেকে ২৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত একটা ছোট শহর, ওয়াইন উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। এছাড়া এখানে আছে অবিশ্বাস্য সার্ফিং স্পট, দৃষ্টিনন্দন উপকূলরেখা এবং রহস্যময় ক্যারি ফরেস্ট (এক ধরনের ইউক্যালিপটাস বন)। মার্গারেট রিভার অঞ্চল বিশ্বের ৩৪ টি বায়োডাইভারসিটি হটস্পটগুলোর মধ্যে একটি এবং অস্ট্রেলিয়ার একমাত্র বায়োডাইভারসিটি হটস্পট। এই অঞ্চলে বুনোফুল দেখার সবচেয়ে বিখ্যাত জায়গা হলো ভারত মহাসাগরের উপকূলে অবস্থিত লিউউইন -ন্যাচারালিস্ট (Leeuwin- Naturaliste) ন্যাশনাল পার্ক। এখানে দেড় শতাধিক প্রজাতির অর্কিড সহ প্রায় ২,৫০০ প্রজাতির বুনোফুল রয়েছে যার মধ্যে অনেকগুলো বিরল এবং বিপন্ন। পার্কের দুই প্রান্তে আছে অস্ট্রেলিয়ার দুটি বিখ্যাত বাতিঘর - উত্তরে কেপ ন্যাচারালিস্ট লাইট হাউজ এবং দক্ষিণে কেপ লিউউইন লাইট হাউজ। মার্গারেট রিভার থেকে কেপ লিউউইন যাওয়ার একটা চমৎকার টুরিস্ট ড্রাইভ আছে। আকাশ ছুঁয়ে যাওয়া ক্যারি গাছগুলো আর তার মাঝ দিয়ে আলোর ঝলক দেখতে খুব ভালো লাগে। কেপ লিউউইন লাইট হাউজ অস্ট্রেলিয়ান মহাদেশের মূল ভূখণ্ডের সবচেয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। এখানে দাঁড়িয়ে ভারত মহাসাগর এবং দক্ষিণ মহাসাগরের মিলনস্থানটা দেখা যায়।
আলবানী পার্থ থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত একটা বন্দর নগর। আবহাওয়া পার্থের তুলনায় ঠাণ্ডা, তাই গরমের সময়ে অনেক পার্থ-বাসী ছুটি এখানে কাটাতে আসে। আলবেনীর প্রধান পর্যটন আকর্ষণ হলো টর্নডিরাপ (Torndirrup) ন্যাশনাল পার্কে অবস্থিত - দ্যা গ্যাপ এবং ন্যাচারাল ব্রিজ। গ্রানাইট পাথরের এই কাঠামোগুলো দক্ষিণ মহাসাগরের ঢেউয়ের আঘাতে তৈরি হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া যখন সুপারকন্টিনেন্ট গন্ডোয়ানাল্যান্ডের অংশ ছিল তখন পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার এই অংশটা এন্টার্কটিকার সাথে যুক্ত ছিল। আলবানী শহরের মধ্যে বুনোফুল দেখার সেরা স্থান হলো মাউন্ট ক্লারেন্স লুকআউট এবং মাউন্ট মেলভিল লুকআউট। আলবানী শহর থেকে ৯৬ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে স্টার্লিং রেঞ্জ ন্যাশনাল পার্ক। পাহাড়ের পটভূমিতে অনন্য এবং প্রচুর বুনোফুল এই পার্কটাকে খুব আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এই পার্কে দেড় হাজারেরও বেশি প্রজাতির স্থানীয় উদ্ভিদ রয়েছে, যার মধ্যে ৮৭ টি পৃথিবীর কোথাও পাওয়া যায় না। এখানে দেখা বুনোফুলের মধ্যে ছিল – ব্যাংকসিয়া, বিভিন্ন ধরণের অর্কিড এবং মাউন্টেন বেল।
এস্পারেন্স পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ উপকূলের একটা শহর, আমাদের দেখা পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে সুন্দর জায়গা। পার্থ থেকে ৭০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে আর আলবানী থেকে ৪৮০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত। আমরা গিয়েছিলাম আলবানী থেকে ন্যাশনাল রুট ওয়ান ধরে। এস্পারেন্স পৌঁছানোর ২০০ কিলোমিটার আগে ফিৎসজেরাল্ড রিভার ন্যাশনাল পার্ক। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ তালিকাভুক্ত এই পার্কে প্রায় ১,৮০০ প্রজাতির ফুল গাছ রয়েছে। এই পার্কে দেখা অনেক বুনোফুলের মধ্যে রয়্যাল হেকা এবং কোয়ালাপ বেল ফুল দুটো আমাদের সবচেয়ে ভালো লেগেছে। এস্পেরান্সের সবচেয়ে বড় পর্যটন আকর্ষণ হলো কেপ লা গ্র্যান্ড ন্যাশনাল পার্ক, শহর থেকে ৪০ মিনিটের ড্রাইভ। এই পার্কে যাওয়ার পথে রাস্তার দুইপাশে সোনালী/জাফরানি রঙের খুব সুন্দর একটা ফুল ফুটেছিলো, নাম ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিসমাস ফ্লাওয়ার। এই পার্কের এক প্রান্তে আছে লাকি বে, অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে সাদা বালুর সমুদ্র সৈকত। এ ছাড়া আরো অনেক সুন্দর সুন্দর সমুদ্র সৈকত আছে এস্পেরান্সে। এগুলোর পাশ দিয়ে চলে গেছে এস্পারেন্স গ্রেট ওশান ড্রাইভ।
ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিসমাস ফ্লাওয়ার, এস্পেরান্স প্রাকৃতিক পরিবেশে বুনোফুল দেখার আনন্দ আলাদা। তবে সে জন্য প্রচুর সময়ের প্রয়োজন। যাদের ঘুরে দেখার সময় নেই তাদের জন্য রয়েছে “কিংস পার্ক ফেস্টিভাল”। কিংস পার্ক হচ্ছে শহরের মধ্যে অবস্থিত বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম এবং সবচেয়ে সুন্দর পার্ক, পার্থ শহরের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষণ। এখানে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসে বুনোফুলের একটা চমৎকার প্রদর্শনী হয়। ২৫ হাজারেরও বেশি স্থানীয় গাছপালা এবং কয়েকশ প্রজাতির বুনোফুল দেখা যায় এখানে। এ বছর ৫৮ তম কিংস পার্ক ফেস্টিভাল হতে চলেছে। পুরো সেপ্টেম্বর মাস ধরে এই উৎসব চলবে। বুনোফুলের প্রদর্শনী ছাড়াও এখানে নানা রকমের কার্যক্রম থাকে, যেমন বাচ্চাদের জন্য বর্ণিল প্যারেড, মেডিটেশন, তাই চি এবং ইয়োগো ক্লাস, গার্ডেনিং ক্লাস, আর্ট ক্লাস, লাইভ মিউজিক এবং আরো অনেক কিছু। এখানে বুনোফুল দেখার বাড়তি সুবিধা হলো প্রতিটি গাছের সঙ্গে নাম লেখা থাকে। কাজেই চিনতে অসুবিধা হয় না।
কিংস পার্কে বুনোফুলের সমাহার: (১) কোয়ালাপ বেল, (২) পেপার ডেইজি, (৩) অরেঞ্জ স্টার এবং (৪) ফ্যারি ফ্যান-ফ্লাওয়ার এই লেখায় সংযুক্ত সব ছবি আমার নিজের তোলা। জায়গার সীমাবদ্ধতার জন্য আরো অনেক ছবি অন্তর্ভুক্ত করতে পারলাম না। আপনিও পারেন পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া এসে এখানকার বুনোফুলের রং এবং গন্ধ উপভোগ করতে। আর সেই সঙ্গে নিজের ক্যামেরায় বুনোফুলের সুন্দর সুন্দর ছবি বন্দি করে রাখতে। ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে এ বছর বুনোফুলের বাম্পার মরসুম আশা করা হচ্ছে। সবাইকে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার বুনোফুল দেখার আমন্ত্রণ রইলো। (সমাপ্ত)
ড. নজরুল ইসলাম, কার্টিন ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া
|