bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













প্রবাসে পঞ্চাশ বছর (১৮)
ড. নজরুল ইসলাম



আগের পর্ব

হাসুর প্রসবের প্রত্যাশিত তারিখের এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে কিন্তু প্রসবের কোনো লক্ষণ নেই। আর অপেক্ষা না করে হাসু ইবনে সিনা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। পরদিন সকালে আমি ওকে হাসপাতালে নামিয়ে দিয়ে কাজে চলে গেলাম। সারাদিন কাজে ব্যস্ত ছিলাম তাই খোঁজ নিতে পারিনি। তখনকার দিনে লিবিয়ায় টেলিফোন যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো ছিল না। কেবলমাত্র অফিস-আদালতে টেলিফোন ছিল। তবে কোন খবর থাকলে আমি জানতে পারতাম। হাসুর ক্লিনিকের ইন-চার্জ এমনটাই আশ্বাস দিয়েছিলেন। সন্ধ্যায় ওকে হাসপাতালে দেখতে গেলাম। তখনো প্রসবের কোনো লক্ষণ নেই। প্রসবের দেরি হওয়ায় হাসু চাইছিল সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করতে। কিন্তু হাসপাতালের ডাক্তাররা তাতে নারাজ। তাদের মতে, সিজারিয়ান অপারেশন সন্তান প্রসবের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া নয়। তাই অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। পরদিনও কোনো খবর পেলাম না। সন্ধ্যায় হাসপাতালে গিয়ে দেখি প্রসবের জন্য ড্রিপ চলছে। সঙ্গে বাচ্চার হৃৎস্পন্দন পর্যবেক্ষণের জন্য কার্ডিওটোকোগ্রাফি। হাসুকে বিদায় জানিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। পরদিনও কোনো খবর পেলাম না তাই বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লাম। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার, লিবিয়ান উইকেন্ড। কাজ শেষে বাসায় এসে দেখি হাসুর ক্লিনিকের এম্বুলেন্স আমাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি গাড়ি থেকে নামতেই ড্রাইভার জানাল আমাদের একটা মেয়ে হয়েছে। মা ও মে দুজনেই ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ! ড্রাইভারের সঙ্গে তখনি চলে গেলাম ইবনে সিনা হাসপাতালে।

হাসপাতালে গিয়ে দেখি হাসু বিছানায় শুয়ে আছে। ওকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। তবে ওর চোখে-মুখে ছিল একটা মাতৃত্বের আভা। হাসু জানালো, প্রসবের অপেক্ষায় থাকাকালীন, ডাক্তাররা বাচ্চার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলেন। বাচ্চার অবস্থার অবনতি দেখে ডাক্তাররা সিজারিয়ান অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নেন। তারা বাবার সম্মতি চাইছিলেন। হাসু এই সম্পর্কে জানত, সে আগেই সম্মতি ফর্মে আমার স্বাক্ষর নিয়ে রেখেছিলো। ঘণ্টা-খানেক পর আমাদের মেয়ের জন্ম হয়। আমি ঘরে ঢোকার পর নার্স একটা নবজাতক শিশু নিয়ে এলেন। তখন তার বয়স মাত্র কয়েক ঘণ্টা। এত ছোট বাচ্চা আমি আগে কখনও দেখিনি। বাচ্চাটাকে কোলে নিতেও ভয় পাচ্ছিলাম,পাছে সে ব্যথা পায়। প্রথম দৃষ্টিতে বাচ্চাটার যা আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছিল তা হল তার ঘন কালো চুল। সপ্তাহ-খানেক পর, মা ও মেয়েকে বাড়ি নিয়ে এলাম। সিজারিয়ান অপারেশনের পর হাসুকে এই সময়টা হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। তাতে একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছিল। ততদিনে আমাদের মেয়েটা বেশ বড় হয়ে গেছে।

আমাদের কারোরই বাচ্চা মানুষ করার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। ডাক্তার হওয়ায়,হাসুর কিছু ধারণা ছিল কিন্তু তা যথেষ্ট ছিল না। আমরা যা করেছি,যা শিখেছি তা ছিল বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে। দুই সপ্তাহ পর, মনে হলো আমাদের মেয়ের চুল কাটা উচিত। হাসু মেয়েকে কোলে নিয়ে ‘ডিসপোসেবল কার্টিজ রেজার' দিয়ে তার চুল কাটার চেষ্টা করছিল। কিন্তু মেয়ের চুল খুব ঘন হওয়ায় সে তা করতে পারছিল না। কাজটা শেষ করার জন্য আমাকে পুরনো স্টাইলের ‘সেফটি রেজার’ কিনতে শপিং সেন্টারে ছুটতে হয়েছিল।

ছয় সপ্তাহ মাতৃত্ব-কালীন ছুটি কাটানোর পর হাসু কাজে ফিরে গেল। ক্লিনিকে হাসুর পাশের ঘরটা সব সময় খালি থাকতো। হাসু সেখানে আমাদের মেয়েকে রেখে কাজ করতো আর কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাচ্চা দেখতো। নার্সরাও নজর রাখতো। এই ভাবে আমাদের মেয়ে বড় হয়েছে । নার্সরা আমাদের মেয়েকে অত্যন্ত স্নেহ করতো। লিবিয়ার ঐতিহ্য অনুযায়ী, আমাদের মেয়ে উপহার হিসেবে অনেক সোনার অলঙ্কার পেয়েছিলো যা এখনও আমাদের লিবিয়ার স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়।
কাতকো কোম্পানিতে আমাদের অ্যাসফল্ট মিক্সিং প্ল্যান্ট স্থাপনের কাজ শেষ। আমরা মারিনি কোম্পানির ইঞ্জিনীয়ারদের অপেক্ষায় আছি। বেশ কিছুদিন হয়ে গেলো কিন্তু হয়ে গেলো কিন্তু তাদের দেখা নেই। সিরতে আমাদের কোম্পানির আর সব কাজও শেষ। তাই আমাদের কোম্পানি সিরতে আর বসে থাকতে চাইলো না। আমাদের ম্যানেজার একটা স্থানীয় রোড বিল্ডিং কোম্পানির ম্যানেজারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। স্থানীয় কোম্পানির নাম ‘সিরত রোডস এন্ড পাবলিক ইউটিলিটিস কোম্পানি’। তাদের সিরত ছাড়াও বিন জাওয়াদে একটা বড় কাজ ছিল। তাই তারা এই প্রস্তাবে আগ্রহী ছিল। সিরতের অদূরে তাদের একটা অ্যাসফল্ট মিক্সিং প্ল্যান্ট ছিল। এটাও মারিনি অ্যাসফল্ট মিক্সিং প্ল্যান্ট, তবে আকারে ছোট। তবে সুবিধা হলো তাদের প্ল্যান্ট চালানোর ম্যানুয়াল ছিল। তাদের প্রস্তাব, আমরা যদি তাদের প্ল্যান্টটা চালু করতে পারি তাহলে তারা কাজটা আমাদের দিতে পারেন। আমরা তাদের প্ল্যান্টটা চালু করায় লেগে গেলাম। দুই সপ্তাহ খাটাখাটি পর প্ল্যান্টটা চালু হয়ে গেলো।

বিন জাওয়াদে কাজ শুরু হয় সকাল ৮টা থেকে। আমাদের ট্রাক বিন জাওয়াদ পোঁছাতে ২ ঘণ্টা লাগে। অ্যাসফল্ট গরম করতে লাগে আরো ২ ঘণ্টা। অর্থ্যাৎ বিন জাওয়াদে সকাল ৮টায় কাজ শুরু করতে হলে আমাদের সিরতে কাজ শুরু করতে হবে রাত ৪টায়। সেই ভাবে আমাদের কাজ শুরু হলো। রাত ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত আমার শিফট। এই ভাবে কষ্ট করে লিবিয়ায় চাকরি করেছি। নতুন রুটিনের সাথে মানিয়ে নিতে আমার বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল। আমি ঘুমাতাম আলাদা ঘরে।

এদিকে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে গেলো যার আন্তর্জাতিক তাৎপর্য রয়েছে। ঘটনাটা গণমাধ্যমে তেমনভাবে প্রকাশিত হয়নি। কাজ শেষে, বাড়ি ফিরে দেখি হাসু তখনও ফেরেনি। এমন হওয়ার কথা না। আমি মা ও মেয়ের জন্য চিন্তিত হয়ে পড়লাম। যখন হাসু ফিরে এলো তখন তার কাছ থেকে জানতে পারলাম, আজ সকালে সিরতের অদূরে ‘সিদ্রা উপসাগর’-এ আমেরিকান এবং লিবিয়ান নৌবাহিনীর মধ্যে একটা সংঘর্ষ হয়েছিল। তাতে লিবিয়ান নৌবাহিনী দুটি বিমান (সুখোই ২২) হারিয়েছে। উভয় পাইলটই প্যারাসুটের মাধ্যমে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে পেরেছিলেন। কিন্তু তারা কয়েক ঘণ্টা পানিতে পড়ে রয়েছেন, উদ্ধার করার জন্য লিবিয়ান কর্তৃপক্ষ সাহস পাচ্ছে না। পরে মার্কিন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে তাদের উদ্ধার করা হয়েছিল। এই পাইলটদের মধ্যে একজন হলেন আমাদের বন্ধু ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বেলগাসেম। হাসু বেলগাসেমের স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য তাদের বাড়ি গিয়েছিল। পরে কখনো এ ব্যাপারে বেলগাসেমের কাছ থেকে কিছু জানতে চাইনি। লিবিয়ায় এটাই ছিল নিয়ম – স্থানীয় রাজনীতিতে নিজেকে না জড়ানো। আমার এক প্রতিবেশী স্থানীয় রাজনীতিতে জড়ানোর ফলে রাতারাতি তাকে ডিপোর্ট করা হয়েছিলেন। আমি এতে অবশ্য খুশিই হয়েছিলাম। কারণ তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় নৃশঃস ভাবে মুক্তিবাহিনীকে নির্মমভাবে দমন করেছিলেন। প্রসঙ্গত, রকম আরো অনেক পাকিস্তানী সৈন্য মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের পর লিবিয়ান সেনাবাহিনীতে চাকরি নিয়ে ছিলেন।

লিবিয়ায় ৭ বছর ছিলাম। এই সময়ে অনেক কিছু ঘটে ছিল যা এই স্বল্প পরিসরে তুলে ধরা সম্ভব নয়। দুটো ঘটনা এখানে তুলে ধরলাম। প্রথম ঘটনা হলো আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স অর্জনের অভিজ্ঞতা। লিবিয়ায় ড্রাইভিং লাইসেন্স দুইভাবে পাওয়া যায়। বড় শহরগুলোতে এম্বসির মাধ্যমে নিজ দেশের লাইসেন্স পরিবর্তন করে আর ছোট শহরগুলোতে পরীক্ষা দিয়ে। আমাকে পরীক্ষা দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে হয়েছিল। প্রসঙ্গত, সিরতে ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা বেশ কঠিন ছিল। কারণ পরীক্ষার জন্য ‘ভক্সওয়াগেন বিটল’ গাড়ি ব্যবহার করা হতো। ভক্সওয়াগেন বিটলের গিয়ার, জাপানি গাড়ির চেয়ে আলাদা ছিল। বেশিরভাগ লোকই গিয়ার লাগানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হতো। তারপর ড্রাইভারকে একটা সরু রাস্তার ভিতর দিয়ে রিভার্স গিয়ারে যেতে হয়। আমাদের কোম্পানিতে আবু আলী নামে একজন লিয়াজোঁ অফিসার ছিলেন। তার কাজ ছিল বিভিন্ন সরকারি বিভাগের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। তার শরণাপন্ন হলাম। তিনি বললেন – চিন্তা করো না সব ঠিক হয়ে যাবে। উনার সাহায্যে পরীক্ষায় পাশ করে গেলাম।

আরেকটা ঘটনা হলো লিবিয়ায় মাছ কেনার ঘটনা। লিবিয়ায় মাছ খুব একটা পাওয়া যেতো না। তাই মাছের ট্রলারের প্রতি নজর রাখতাম, কখন ট্রলার ঘাটে ফিরে আসবে। মাছ কেনার জাগাটা ছিল সমুদ্রের পাড়ে। কষ্ট করে বালি পেরিয়ে সেখানে যেতে হতো। এক দিন মাছের দোকানে গিয়ে দেখি দোকানদার একজন বাঙালি। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম – কি ভাই আপনি এখানে কি করছেন? সে জানাল, সে একজন গ্রাজুয়েট, মাছ ধরার ভিসা নিয়ে এসেছে। সে মাছ ধরা জানে। তাই তাকে লিবিয়ান কর্তৃপক্ষ মাছ ধরার চাকরি দিয়েছে। আমাদের জন্য ভালোই হলো, মাছ থাকলে তার মাধ্যমে আমরা ভালো মাছ পেয়ে যেতাম।

‘দাওয়াত’ বাংলাদেশী সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ, বিশেষ করে প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য। বুলগেরিয়া, সুইডেন, লিবিয়া যেখানেই গেছি সেখানেই এই রকম দেখেছি। বিভিন্ন উপলক্ষ, যেমন বাচ্চাদের জন্মদিন, দম্পতিদের বিবাহ বার্ষিকী ছাড়াও মাসে দু’চারটা দাওয়াত লেগেই থাকতো। অনেক দাওয়াত বেশ ঘটা করে পালন করা হতো। বিশেষ করে বাচ্চাদের প্রথম জন্মদিন। আমাদের বেলাও তাই হলো। বড় মেয়ের প্রথম জন্মদিন আমরা বেশ ঘটা করে পালন করেছিলাম। সিরত শহরে না ছিল 'পার্টি সপ', না ছিল 'কেক শপ'। পার্টির সাজসজ্জা, টেবিলওয়্যার, মুকুট, ইত্তাদি পার্টির জিনিসপত্র বানাতে সাহায্য করেছিলেন ভাবীরা। আমাদের কোম্পানির এক ড্রাইভার ৩০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ‘মিসরাতা’ শহর থেকে কেক নিয়ে এসেছিলো। লিবিয়ার গরমে এত দূর থেকে কেক নিয়ে আসাটা ছিল চ্যালেঞ্জিং। সব কাজে সাহায্য করছিলো আমার কোম্পানির লোকেরা। তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল সহকর্মীর। তাই সব কাজ তারা খুশি মনে করেছিল, অধীনস্থ কর্মকর্তা হিসেবে নয়। তাদের সহয়াতায় আমরা এমন একটা পার্টির আয়োজন করতে পেরেছিলাম যা আজও মনে পড়ে। (চলবে)



প্রথম জন্মদিনে মায়ের কোলে আমাদের বড় মেয়ে


আগের পর্ব



ড. নজরুল ইসলাম, কার্টিন ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া



Share on Facebook               Home Page             Published on: 12-Aug-2025

Coming Events:
Bangladesh Australia Disaster Relief Committee AGM 2025
26 Oct 2025, 65 Spurway St, Ermington