bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













প্রবাসে পঞ্চাশ বছর (১৭)
ড. নজরুল ইসলাম



আগের পর্ব

ধীরে ধীরে আমরা সিরতে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের সাথে পরিচিত হলাম। সেই সময় সিরতে বসবাসকারী বাংলাদেশি পরিবারের আনুমানিক সংখ্যা ছিল ৬০টি। এটা আমাদের জন্য ছিল একটা বড় পরিবর্তন; নোফালিয়ায় আমরাই ছিলাম একমাত্র বাংলাদেশি পরিবার। সিরতে আসার পর, প্রবাসী বাংলাদেশীদের সঙ্গে আমাদের মেলামেশার সুযোগ হলো। আমরা আমাদের সামাজিক জীবন ফিরে পেলাম যা আমাদের প্রবাস জীবনের নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। আমরা সবাই মিলেমিশে ছিলাম। এই ধরণের বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ না থাকলে লিবিয়ায় ৭ বছর (১৯৭৯-৮৬) কাটানো কঠিন হতো।

পেশা অনুসারে, সিরতে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের তিনটি দলে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম দলে ছিলেন ডাক্তাররা। তাদের বেশিরভাগই ছিলেন মধ্যবয়সী। তারা বাংলাদেশে বেশ কিছুদিন কাজ করার পর লিবিয়ায় এসেছেন। তাদের লক্ষ্য ছিল টাকা জমিয়ে দেশে ফিরে যাওয়া যাতে বাকি জীবন স্বাচ্ছন্দ্যে কাটাতে পারেন। ডাক্তারদের দলে কয়েকজন লেডি ডাক্তারও ছিলেন। তারা তাদের স্বামীদের সাথে এসেছেন। দ্বিতীয় দলে ছিল ইঞ্জিনিয়াররা। তারা ছিল বয়সে তরুণ। তাদের কাজের অভিজ্ঞতা ছিল তুলনামূলক ভাবে কম। তাদের লক্ষ্য ছিল টাকা জমিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া এবং সেখানে একটা মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করে স্থায়ীভাবে বসবাস করা। আমি হলাম দ্বিতীয় দলে – বয়সে তরুণ, ইঞ্জিনিয়ারিং আমার পেশা। তবে আমার লক্ষ্য ছিল ভিন্ন। আমি কখনোই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দেশ হিসেবে পছন্দ করিনি। আমার লক্ষ্য ছিল টাকা জমিয়ে অস্ট্রেলিয়া বা যুক্তরাজ্য থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করা। পশ্চিমা দেশে বসবাস করা আমার মূল লক্ষ্য ছিল না। তৃতীয় দলে ছিল শ্রমিকরা। তারা সিরত এবং এর আশেপাশের কোম্পানিগুলোতে কাজ করত। তাদের সাথে আমাদের খুব একটা যোগাযোগ ছিল না।

বেশিরভাগ ডাক্তার কাজ করতেন সিরত ডিসট্রিক্ট হসপিটালে। বাকিরা কাজ করতেন সিরাতের আশেপাশের ছোট ছোট চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে। সিরত ডিসট্রিক্ট হসপিটাল শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত হওয়ায় বেশিরভাগ ডাক্তার থাকতেন শহরের কেন্দ্রস্থলের কাছাকাছি। সমুদ্রের ধারে একটা হাউজিং ব্লক ছিল, যাকে আমরা 'বারাকা' বলতাম। সম্ভবত 'বারাকা' শব্দটা স্প্যানিশ/ইতালীয় ভাষা থেকে এসেছে যার অর্থ সামরিক কর্মীদের বাসস্থান। জানি না এগুলো কখন তৈরি হয়েছিল, এগুলো তৈরির উদ্দেশ্যই বা কী ছিল। বাড়িগুলো ছিল পুরনো, কিন্তু লোকেশন ছিল দারুন। বারান্দা থেকে সমুদ্র দেখা যেত; বাড়ির মধ্য দিয়ে বয়ে যেত সমুদ্রের ঠাণ্ডা বাতাস। সেখানে ৭/৮ জন বাংলাদেশি ডাক্তার তাদের পরিবার নিয়ে থাকতেন। এটা ছিল সিরতে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের একটা জনপ্রিয় আড্ডার জায়গা।

সিরত শহরে বাংলাদেশিদের আড্ডার আরেকটা জনপ্রিয় জায়গা ছিল। সেটা হলো ‘সিরত পাওয়ার এন্ড ডিস্যালাইনেশন প্ল্যান্ট’। আমরা সংক্ষেপে বলতাম 'প্ল্যান্ট’। প্ল্যান্টটা ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে ইতালির কারিগরি সহায়তায় নির্মিত হয়েছিল। তখনও সেখানে ৮/১০ জন ইতালীয় বিশেষজ্ঞ কাজ করতেন। এই প্লান্টে সমুদ্রের নোনা পানিকে ফুটিয়ে এবং পুনঃ-ঘনীভূত করে মিঠা পানিতে রূপান্তরিত করা হতো। সঙ্গে যুক্ত ছিল একটা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের বর্জ্য তাপ সমুদ্রের পানি গরম করার জন্য ব্যবহৃত হতো, যা একই সাথে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য শীতলতা সরবরাহ করতো। ফলে, প্ল্যান্ট চালানোর জন্য ৫০ থেকে ৬৭ শতাংশ কম জ্বালানি (ভারী জ্বালানি তেল) লাগতো। এই প্ল্যান্টে ২০/২৫ জন বাংলাদেশি ইঞ্জিনিয়ার/টেকনিশিয়ান কাজ করত। তাদের বেশিরভাগই ছিল বুয়েট থেকে পাশ করা তরুণ ইঞ্জিনিয়ার। সেখানে কাজ হতো তিন শিফটে: সকালের শিফট সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত, বিকেলের শিফট দুপুর ২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এবং রাতের শিফট রাত ১০টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত। তিন সপ্তাহ একটানা কাজ করার পর, এক সপ্তাহের ছুটি। সন্ধ্যায় সেখানে গেলে, একমাত্র বিকেলের শিফটে যারা কাজ করতো তাদের ছাড়া সবাইকে পাওয়া যেত। প্ল্যান্টে কর্মরতদের জন্য ছিল চমৎকার থাকার ব্যবস্থা। বাড়িগুলো ছিল নবনির্মিত কমপ্যাক্ট ডিজাইনের বাড়ি। পুরো এলাকাটা ছিল সুন্দর ভাবে ডিজাইন করা। সন্ধ্যার পর, সেখানে লোকেরা দলে দলে ভাগ হয়ে আড্ডা দিত। পুরো এলাকাটাকে মনে হতো যেন 'মিনি বাংলাদেশ'।

সিরতে কোন বিনোদনের ব্যবস্থা ছিল না। তাই আড্ডা ছিল সময় কাটানোর সবচেয়ে ভালো উপায়। আমাদের বাসা ছিল সিরতে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের আড্ডার জনপ্রিয় জায়গা দুটো থেকে কিছুটা দূরে। তাই ইচ্ছা থাকলেও কম যাওয়া হতো। আমরা যখন নোফালিয়ায় ছিলাম তখন একটা টেলিভিশন সেট কিনেছিলাম। কিন্তু সব টেলিভিশন অনুষ্ঠানই একঘেয়ে লাগত কারণ আমাদের আরবি ভাষা বোঝার মতো পর্যাপ্ত জ্ঞান ছিল না। তাছাড়া, বেশিরভাগ অনুষ্ঠানই ছিল গাদ্দাফি সরকারের প্রশংসায় ভরা দেশাত্মবোধক অনুষ্ঠান। যতদূর মনে পড়ে, লিবিয়ায় দেখা একমাত্র ইংরেজি টিভি অনুষ্ঠান ছিল আমেরিকান টেলিভিশন সিরিজ 'ডালাস'। টিভি এবং আড্ডার বিকল্প ছিল ভিডিও ক্যাসেট রেকর্ডারে (ভিসিআরে) সিনেমা দেখা। সিরতে আসার পর সেনাবাহিনীর ডিউটি ফ্রি দোকান থেকে একটা ‘ভিসিআর’ কিনে ফেললাম। সিরতে ভিডিও ক্যাসেট ভাড়া করার দোকান ছিল না। আমাদের পরিচিত লোকজনদের কাছ থেকে ভিডিও ক্যাসেটগুলো সংগ্রহ করতাম। আমার প্রধান উৎস ছিল আমার কোম্পানিতে কর্মরত পাকিস্তানি শ্রমিকরা। তাছাড়া ডিফেন্স কলোনিতে বসবাসরত পাকিস্তানিরাও ছিল, বিশেষ করে বিমান বাহিনীতে কর্মরত টেকনিশিয়ানরা। আর বাংলাদেশিরা তো ছিলই।

আমি আগে উল্লেখ করেছি যে আমি সন্ধ্যায় আমার কোম্পানিতে পাকিস্তানি শ্রমিকদের সাথে দেখা করতে যেতাম। এর মূল কারণ ছিল তাদের কাছ থেকে ভিডিও ক্যাসেট সংগ্রহ করা। তাছাড়া, তাদের সঙ্গে অনেক কথাবার্তা হত; তারা তাদের সুখ-দুঃখের কথা বলতো। তাদের বেশিরভাগই ছিল 'ফয়সালাবাদ' থেকে। করাচি এবং লাহোরের পর ফয়সালাবাদ হলো পাকিস্তানের তৃতীয় বৃহত্তম শহর যা আগে 'লায়ালপুর' নামে পরিচিত ছিল। তাদের অনেকেই বিবাহিত ছিল। তারা তাদের স্ত্রীদের দেশে রেখে এসেছে। অনেকের স্ত্রী ছিল নিরক্ষর; তারা চিঠি লিখতে পারতো না। তারা ক্যাসেটে রেকর্ড করে স্বামীদের কাছে বার্তা পাঠাতো। ডাকযোগে ক্যাসেটগুলো পাওয়ার পর তাদের স্বামীরা একইভাবে উত্তর পাঠাতো। ৪৫ বছর আগে বার্তা আদান-প্রদানের এই অভিনব পদ্ধতিটা জেনে আমি অবাক হয়েছিলাম। আজকাল বার্তা পাঠানোর জন্য কত মেসেজিং অ্যাপ পাওয়া যায়! আমরা প্রায় প্রতি রাতেই ভিসিআরে সিনেমা দেখতাম। কয়েকটা ইংরেজি সিনেমা ছাড়া, সবই ছিল হিন্দি সিনেমা। মনে পড়ে লিবিয়ায় ভিসিআরে প্রথম সিনেমা দেখার কথা। ছবিটার নাম ছিল 'কাভি কাভি'। গানে ভরা রোমান্টিক ড্রামা ফিল্মটা আমাদের খুব ভালো লেগেছিলো। সেই সময়ে দেখা অন্যান্য স্মরণীয় সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে: লাভ স্টোরি, সিলসিলা, নরম গরম এবং উমরাও জান।

বাংলাদেশিদের আড্ডায় আমাদের কম যাওয়ার কয়েকটা কারণ ছিল। প্রথমত, আড্ডার জায়গা দুটো আমাদের বাসা থেকে বেশ দূরে ছিল। প্ল্যান্টের অবস্থান ছিল শহরের পশ্চিম প্রান্ত ছাড়িয়ে, আর আমাদের বাসা ছিল শহরের পূর্ব প্রান্তে। আমাদের বাসা থেকে প্ল্যান্টের দূরত্ব ছিল ৩০ কিলোমিটারেরও বেশি। দ্বিতীয়ত, হাসুর গর্ভাবস্থার অগ্রগতির সাথে সাথে সে কাজের পর খুব ক্লান্ত হয়ে পড়তো। রাতে সে বাড়িতে আরাম করে ভিসিআরে সিনেমা দেখতে পছন্দ করত। তৃতীয়ত, বাংলাদেশিদের আড্ডার প্রধান আকর্ষণ ছিল তাস খেলা। ভাবীদের ভিসিআরে একটা ছবি চালিয়ে দিয়ে সবাই তাস খেলায় মেতে উঠতো। আমি তাস খেলা পছন্দ করতাম না। আমার প্রিয় খেলা ছিল দাবা। আমার দাবা খেলার সঙ্গী ছিলেন ওয়াজেদ ভাই, বর্তমানে ঢাকা-বাসী। অবশ্য ছেলেমেয়েরা উত্তর আমেরিকায় বসবাস করায় বছরের কয়েকমাস সেখানে কাটান। ওয়াজেদ ভাইয়ের পরিবারের সাথে সময় কাটানোর মধুর স্মৃতি এখনো মনে পড়ে। প্রতিযোগিতামূলক হওয়ায় খেলা চলতো অনেক সময় ধরে। খেলার মাঝে ভাবীর বানানো চা নাস্তা কত যে খেয়েছি!

দিন দিন হাসু তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সিরত আর্মি ফ্যামিলি ক্লিনিকের কর্ম-পরিবেশ নোফালিয়া মেডিকেল সেন্টারের তুলনায় ভিন্ন ছিল। সিরত আর্মি ফ্যামিলি ক্লিনিকের রোগীরা ছিল তুলনামূলক ভাবে তরুণ, শিক্ষিত এবং কম রক্ষণশীল। তারা রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কের বাইরেও ডাক্তারের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী ছিল, কেননা তারা বাইরের জগত সম্পর্কে জানতে চাইতো। সুযোগ পেলে হাসুও নার্স এবং রুগীদের সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিতো। তার উদ্দেশ্য ছিল লিবিয়ার সমাজ সম্পর্কে জানা এবং একই সাথে আরবি ভাষায় আরো দক্ষ হয়ে ওঠা। এই কথোপকথনের মাধ্যমে আমরা লিবিয়ার সমাজ সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছি যা অন্যথায় সম্ভব হতো না। অনেক লিবিয়ান মহিলার সাথে হাসুর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল যারা পরে পারিবারিক বন্ধু হয়ে ওঠেন। আমরা তাদের বাসায় যাওয়া আসা করতাম। হাসুর বন্ধুদের মধ্যে কিছু প্রভাবশালী সামরিক কর্মকর্তাদের স্ত্রীরাও ছিলেন। এমনই এক বন্ধু ছিলেন সিরত সেনানিবাসের প্রধানের স্ত্রী। লিবিয়ান সামরিক বাহিনীতে সবচেয়ে স্মার্ট ছিলেন পাইলটরা। তাদের বেশিরভাগই ছিলেন বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং ভালো ইংরেজি বলতে পারতেন। একজন পাইলট এবং তার পরিবারের সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তার নাম ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বেলগাসেম। তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্রের ভক্ত ছিলেন। আমরা তার সাথে হিন্দি ছবি বিনিময় করতাম। আমরা যখনই কোনো সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি তখনই তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এর জন্য আমরা তার কাছে চির কৃতজ্ঞ। জানি না ২০১১ সালে গাদ্দাফি সরকারের পতনের পর তিনি বেঁচে আছেন কিনা।

সেই আমলে লিবিয়ান নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি ছিল। হাসুর ক্লিনিকে অনেক মহিলা গাড়ি চালিয়ে আসতেন। প্রসঙ্গত, সৌদি আরবের নারীরা গাড়ি চালানোর অনুমতি পেয়েছে ২০১৮ সাল থেকে। লিবিয়ান নারীরা দেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে একাকী যাতায়াত করতে পারতো। তাদের সাথে পুরুষ সঙ্গী বা ‘মুহাররাম’ লাগতো না। তখন লিবিয়ান নারীদের সামগ্রিক অবস্থা বেশিরভাগ আরব দেশের তুলনায় ভালো ছিল। ঐতিহ্যগতভাবে লিবিয়ার নারীরা কৃষিকাজের কাজ করত। ১৯৬৯ সালের বিপ্লবের পর থেকেই গাদ্দাফি সরকার মেয়েদের স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে উৎসাহিত করে আসছিল। লিবিয়ায় অবস্থানকালে আমরা এই প্রচেষ্টার সাফল্য প্রত্যক্ষ করেছি। লিবিয়ান মহিলারা শিক্ষকতা, নার্সিং, ব্যাংক, সুপারমার্কেট এবং সরকারি অফিসে প্রশাসনিক এবং কেরানির কাজ সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিযুক্ত ছিল। ১৯৮৪ সাল থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া সকল ছাত্রীর জন্য সামরিক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। এই সামরিক প্রশিক্ষণ লিবিয়ান সমাজে নারীদের জন্য একটা নতুন ভাবমূর্তি এবং ভূমিকা তৈরিতে সাহায্য করেছিল।

লিবিয়ায় নারীদের পর্দা করা বাধ্যতামূলক ছিল না। সাধারণত বয়স্ক মহিলারা পর্দা করত। পর্দা করার জন্য তারা এক ধরনের চাদর ব্যবহার করত। ঐতিহ্যবাহী এই পোশাকটার নাম 'ফারাশিয়া' যা সাধারণত সাদা রঙের হয়ে থাকে। মহিলারা এই সাদা রঙের চাদর দিয়ে নিজেদের সম্পূর্ণরূপে ঢেকে রাখত, কেবল পথ দেখার জন্য চোখ খোলা থাকতো। তবে, হাসুর ভাষ্য অনুসারে, এই পর্দার নীচে তাদের সাজগোজের কমতি ছিল না। পরনে পশ্চিমা ধাঁচের পোশাক, মুখে দামি মেকআপ, সঙ্গে অনেক সোনার গয়না। একটা কথা জেনে অবাক হয়েছি, মফস্বলের মহিলারা কেবল তাদের নিজ এলাকায় পর্দা করত, ত্রিপলি বা বেনগাজির মতো বড় শহরগুলো পরিদর্শন করার সময় তারা পর্দা করত না। তাদের মতে, অপরিচিতদের সামনে পর্দা করার কোন প্রয়োজন নেই!

লিবিয়ায় বহুবিবাহ বৈধ ছিল। তবে, একজন পুরুষকে কারণ দেখিয়ে প্রমাণ করতে হত যে সে স্ত্রীদের ভরণপোষণ করতে সক্ষম এবং বিয়েতে প্রথম স্ত্রীর সম্মতি আছে। অনেক মহিলা তাদের স্বামীর চাপে পড়ে বিয়েতে রাজি হত, কিন্তু পরে তারা মানসিক সমস্যায় ভুগত। এই ধরণের রুগী হাসুর কাছে আসতো। তাদের জন্য কোন মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না তাই হাসুকেই তাদের সামলাতে হতো। বিবাহ সংক্রান্ত আরেক ধরণের রোগী ছিল যাদের নিয়ে হাসু সবসময় চিন্তিত থাকত; তারা তীব্র বিষণ্ণতায় ভুগত। লিবিয়ার ঐতিহ্য অনুসারে, বিয়ে উপলক্ষে বরকে মোটা অঙ্কের টাকা বা সোনা দিতে হতো কনের বাবাকে। টাকা বা সোনার পরিমাণ নির্ভর করতো কনের বয়স, সৌন্দর্য, শিক্ষা এবং খ্যাতির উপর। এটি ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত যৌতুক প্রথার বিপরীত, যেখানে কনের বাবাকে সংসারে ব্যাবহার করার সামগ্রী, সোনার গয়না অথবা নগদ টাকা বরকে দিতে হয়। কিছু লিবিয়ান বাবা বর পক্ষের কাছ থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে আবার বিয়ে করতো। তাদের স্ত্রীরা মেয়ের বয়সী কাউকে সতীন হিসেবে কিছুতেই মেনে নিতে পারতেন না।

আমিও আমার কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। জানতাম আমার কাজটা কঠিন হবে। কিন্তু কাজ শুরু করার পর, বুঝতে পারলাম সেটা যতটা কঠিন হবে ভেবেছিলাম, তার চেয়েও অনেক কঠিন। এর কারণ হলো, কাতকো কোম্পানির কাছে কাজটা করার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র (ডকুমেন্টেশন) ছিল না। কাগজপত্র যাও বা ছিল তাও আবার ইতালীয় ভাষায়। সেগুলো ডিস্যালাইনেশন প্ল্যান্টের ইতালিয়ান ইঞ্জিনিয়ারদের কাছে নিয়ে গেলাম তর্জমা করার জন্য, কিন্তু তাতেও সমস্যার সমাধান হলো না। কাতকো কোম্পানির কাছে মাত্র দুটি ড্রয়িং ছিল: একটি হলো ‘ফাউন্ডেশন ড্রয়িং’ এবং অন্যটি হলো প্ল্যান্টের ‘ওভারঅল ভিউ’। বিস্তারিত ‘অ্যাসেম্বলি ড্রয়িং’ ছাড়া কাজটা আমার জন্য ছিল একটা ত্রিমাত্রিক ‘জিগস পাজল’। পরে আমি জানতে পারি যে প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল প্ল্যান্টটা প্রস্ততকারক মারিনি কোম্পানি দ্বারা স্থাপন এবং চালু করার। কিন্তু সেটা ব্যয়বহুল হবে কেননা প্ল্যান্ট স্থাপন করতে অনেক সময় লেগে যাবে আর সেই সময়ে মারিনি কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ারদের বেতন এবং সিরতে থাকা খাওয়ার খরচ কাতকো কোম্পানিকে বহন করতে হবে। তাই কাতকো কোম্পানির ব্যবস্থাপনা দল ভেবেছিল যে আমার মতো একজন স্থানীয় প্রকৌশলী দিয়ে প্ল্যান্টটা স্থাপন করা অনেক সস্তা হবে; তারপর মেরিনি কোম্পানির ইঞ্জিনিয়াররা এসে সেটা পরীক্ষা করে কমিশন করবে। সেই কারণে কাতকো কোম্পানি আমাকে নিয়োগ করেছিল।

এদিকে হাসুর প্রসবের প্রত্যাশিত তারিখ ঘনিয়ে আসছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে আমাদের উদ্বিগ্নতা। হাসু নিজেই তার 'মেটার্নিটি চেকআপ' চালিয়ে যাচ্ছে। তাকে সাহায্য করছেন ক্লিনিকে কর্মরত অপর মহিলা ডাক্তার। ডেলিভারি হবে সিরত ইবনে সিনা হাসপাতালে। হাসপাতালটা আমাদের বাড়ির খুব কাছে। এটি একটি আধুনিক হাসপাতাল যা মাত্র কয়েক মাস আগে চালু হয়েছে। সেদিক থেকে আমরা ভাগ্যবান, এখানে সিরত ডিসট্রিক্ট হসপিটালের চেয়েও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। একটা পোলিশ মেডিকেল টিম হাসপাতালটা পরিচালনা করছে। হাসু ইতিমধ্যেই তাদের সাথে যোগাযোগ করেছে। তারা তাকে সর্বোত্তম চিকিৎসা সেবার আশ্বাস দিয়েছে। হাসু প্রসবের দিন পর্যন্ত কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যাতে মাতৃত্বকালীন ছুটির পর কাজে যোগ দেয়ার আগে নবজাতকের সাথে বেশি সময় কাটাতে পারে। আর তাই হাসুকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে সর্বক্ষণ প্রস্তুত থাকতে হচ্ছে। আমরা সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় আছি। (চলবে)




ক্লিনিকে পরিচয় হওয়া এক লিবিয়ান বন্ধুর সাথে হাসু



আগের পর্ব



ড. নজরুল ইসলাম, কার্টিন ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া


Share on Facebook               Home Page             Published on: 20-Mar-2025

Coming Events:

Lakemba Blacktown Money raised so far


*** মেলার তারিখ ১১ মে থেকে পিছিয়ে ১ জুন করা হয়েছে ***



Blacktown Money raised so far