bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













প্রবাসে পঞ্চাশ বছর (১৫)
ড. নজরুল ইসলাম



আগের পর্ব পরের পর্ব

ত্রিপলি-বেনগাজি হাইওয়ে ধরে আমাদের গাড়ি দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। আমাদের গন্তব্যস্থল 'বিন জাওয়াদ', ত্রিপলি থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটা উপকূলীয় শহর। হাসুর পোস্টিং হয়েছে বিন জাওয়াদ হাসপাতালে। আমাদের ড্রাইভার একজন লিবিয়ান। তিনি ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলতে পারেন। পরনে সাদাসিধা লিবিয়ান পোশাক: একটা লম্বা টিউনিক (জালাবিয়া), লম্বা ট্রাউজার (সিরওয়াল) এবং একটা ভেস্ট (সাদরিয়া)। এমনিতে লিবিয়ানরা সব কাজে ঢিলা। শুধু গাড়ি চালানোর সময়ে তাদের সময়ের দাম বেড়ে যায়; গাড়ি অত্যন্ত দ্রুত গতিতে চালাতে থাকে। ত্রিপলি-বেনগাজি হাইওয়ের বেশিরভাগ অংশই চার লেনের ডুয়েল ক্যারেজওয়ে। সেখানে বিপরীতমুখী যানবাহনের মধ্যে সংঘর্ষের কোনো সম্ভাবনা নেই। ট্রাফিক তুলনামূলক ভাবে কম। এমন রাস্তা পেলে কে না দ্রুত গতিতে গাড়ি চালাতে চায়? আমাদের গাড়ির গতি ছিল ঘণ্টায় কমপক্ষে ১২০ কিলোমিটার। এতো দ্রুত গতিতে গাড়িতে এর আগে কখনো ভ্রমণ করিনি। সিট বেল্ট বাঁধা থাকলেও খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম। রাস্তার দুই পাশে মরুভূমি। এই ছিল আমার প্রথম মরুভূমি দেখার অভিজ্ঞতা। স্কুলে ভূগোল ক্লাস থেকে সংগ্রহ করা মরুভূমির যে ছবিটা আমার মনে গেঁথে ছিল, বাস্তব মরুভূমি ছিল তার চেয়েও রুক্ষ। ভাবছিলাম এই রুক্ষ পরিবেশে মানুষ বসবাস করে কিভাবে।

এই পরিবেশেও মানুষ বসবাস করছে। কিছুক্ষণ পর পর আমাদের গাড়ি ছোট-বড় জনপদের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। সেখানে দেখলাম মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবন নিয়ে ব্যস্ত। চার ঘণ্টা চলার পর আমাদের গাড়ি থামল একটা ছোট শহরে। আমাদের ড্রাইভার দুপুরের খাবারের জন্য আমাদের একটা রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেলেন। সেখানে দেখলাম অনেক ধরেনের লিবিয়ান খাবার। সবই অচেনা, কোনটা অর্ডার করবো তা ঠিক করতে পারছিলাম না। আমাদের ড্রাইভার যেটা অর্ডার করলো আমরাও সেটা বেছে নিলাম। কিছুক্ষণ পর, ওয়েটার আমাদের জন্য তিনটা বড় প্লেট নিয়ে এলো। প্রতিটা প্লেট ছিল লাল রঙের কারিতে ভরা। তার ওপরে ভাসছিল কয়েকটা পোচ করা ডিম। সঙ্গে ছিল লিবিয়ান পিটা ব্রেড। নানা ধরণের সবজি ও মশলা দিয়ে রান্না করা কারিটা ছিল মজাদার। পরে জেনেছি এই খাবারটার নাম ‘শাকশুকা’। সকালের নাস্তা এবং দুপুরের খাবারের জন্য একটা জনপ্রিয় লিবিয়ান খাবার।

আমরা বিন জাওয়াদ পোঁছালাম বিকেলে। আমাদের গাড়ি বিন জাওয়াদ হাসপাতালের সামনে থামতেই এক দল মানুষ আমাদের গাড়ি ঘিরে ধরলো। তারা আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। আমরা গাড়ি থেকে নামার পর লোকজনের কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারলাম আমাদের ড্রাইভার আসলে এই হাসপাতালের ইন-চার্জ। লিবিয়ানরা এতই সাদাসিধা জীবনযাপন করে যে আপাতদৃষ্টিতে কে ‘বস’ আর কে কর্মচারী তা বোঝা মুশকিল। তবুও আমাদের বোঝা উচিত ছিল কারণ লিবিয়ায় খুব কম লোকই ইংরেজিতে কথা বলতে পারতো। সেই বস আমাদের নিয়ে গেলেন তার অফিসে। সেখানে দুই বাংলাদেশি চিকিৎসকের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। উনারা এই হাসপাতালে কাজ করেন। উনাদের একজনকে দায়িত্ব দিলেন আমাদের দেখভাল করার জন্য। তিনি আমাদের তার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। হাসুর পোস্টিং না হওয়া পর্যন্ত কয়েকদিন আমরা সেখানেই ছিলাম।

আমরা জানতে পারলাম, বিন জাওয়াদের আশেপাশে কয়েকটা ছোট চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে যা বিন জাওয়াদ হাসপাতালের অধীনে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হাসুকে এই রকম একটা মেডিকেল সেন্টারে পাঠানোর চিন্তা ভাবনা করছে। ইতিমধ্যে আমরা সংসারে যা লাগে সেগুলো কেনাকাটা শুরু করে দিয়েছি। অল্প নোটিশে আমাদের বিন জাওয়াদ ছাড়তে হতে পারে। দুদিন পর হাসুর বস জানালেন হাসুর পোস্টিং হয়েছে নোফালিয়া মেডিকেল সেন্টারে। শুক্রবার সকালে নোফালিয়া মেডিকেল সেন্টারের এম্বুলেন্স আমাদের নোফালিয়া নিয়ে যাবে। বিন জাওয়াদ থেকে নোফালিয়ার দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার। এটা একটা ঐতিহাসিক শহর। ইতালীয় শাসনামলে (১৯১১-৪৩) এখানে একটা দুর্গ ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯৪২ সালে) এখানে মিত্রবাহিনী এবং জার্মান সৈন্যদের মধ্যে একটা সংক্ষিপ্ত সংঘর্ষ হয়েছিল। সে সময় নোফালিয়া ছিল একটা মরূদ্যান। আর তাই সেখানে গড়ে উঠেছিল শহর। এখন নোফালিয়ার গুরুত্ব কমে গেছে। কারণ একদিন নোফালিয়ার ভূগর্ভস্থ পানি এতটাই লবণাক্ত হয়ে গিয়েছিল যে তা মানুষের ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছিল। তখন লিবিয়ান কর্তৃপক্ষ নোফালিয়ার বাসিন্দাদের বিন জাওয়াদে স্থানান্তরিত করে। এখন যারা আছে তারা বাপদাদার ভিটা ছাড়তে চাইনি। ১৯৭৯ সালে নোফালিয়ার জনসংখ্যা ছিল হাজার দুয়েক। তাই নোফালিয়াকে শহর না বলে ‘বসতি’ বা ‘সেটেলমেন্ট’ বলাই সঙ্গত।

শুক্রবার সকালে আমরা নোফালিয়া মেডিকেল সেন্টারের এম্বুলেন্সে চেপে বসলাম। কিছুক্ষণ পর আমাদের এম্বুলেন্স এসে থামলো নোফালিয়া মেডিকেল সেন্টারের সামনে। একজন মধ্যবয়সী লিবিয়ান আমাদের স্বাগত জানালেন। উনার নাম আবু বকর। উনি এই মেডিকেল সেন্টারের ইন-চার্জ। তিনি কাজ চালানোর মতো ইংরেজি বলতে পারেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে মেডিকেল সেন্টারে এতো লোক দেখে আমরা অবাক হয়ে ছিলাম। হাসু আবু বকরকে জিজ্ঞেস করলো, এতো লোকের সমাবেশ কেন? আবু বকর বললেন, এরা সবাই আপনাকে দেখতে এসেছে। নোফালিয়ার মানুষ এর আগে কখনো লেডি ডাক্তার দেখেনি! আবু বকর আমাদের মেডিকেল সেন্টারের ভিতরে নিয়ে গেলেন। ঢুকতেই রুগীদের অপেক্ষা করার জন্য একটা ঘর। তারপর ডাক্তারের ঘর। একটু এগুলেই ট্রিটমেন্ট রুম। সেখানে কয়েকটা বিছানা পাতা। পাশেই আরেকটা ঘর। এটা আবু বকরের অফিস কাম ফার্মেসি। অন্যান্য দায়িত্বের মধ্যে, আবু বকরের একটা দায়িত্ব হলো রোগীদের ওষুধ দেওয়া এবং সেগুলো কীভাবে সেবন করতে হবে তা বুঝিয়ে বলা। মেডিকেল সেন্টারের একদম পেছনে ড্রাইভের জন্য একটা ঘর। ড্রাইভের ডিউটি ২৪/৭। এরপর আবু বকর আমাদের ডাক্তারের জন্য বরাদ্দ বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সেটা ছিল একটা তিন বেডরুমের ফার্নিশড বাসা। ভেতরে একটা উঠান। এই ধরনের উঠান লিবিয়ান বাড়ির বৈশিষ্ট্য যা সারা বাড়িতে আলো-বাতাস সরবরাহ করে তাপ নিয়ন্ত্রণ করে। দেখলাম আমাদের মালপত্র ইতিমধ্যে গাড়ি থেকে নামানো হয়ে গেছে। আবু বকর আমাদের বিশ্রাম নিতে বলে চলে গেলেন।

আমরা বালতি আর মপ নিয়ে ঘর পরিষ্কারে লেগে গেলাম। সারা বাড়ি ছিল বালিতে ভরা। বাড়িটা মনে হয় বেশ কিছুদিন খালি ছিল। পুরো বাড়ি পরিষ্কার করতে অনেকটা সময় লেগে যাবে। আমরা যতটা না করলেই নয় ততটা পরিষ্কার করলাম। বাড়ি পরিষ্কারের পর একটু বিশ্রাম নিয়ে হাসু রান্নায় লেগে গেলো। আমরা বিন জাওয়াদ থেকে চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ এবং চলার মতো অন্যান্য গ্রোসারি সামগ্রী নিয়ে এসেছিলাম। সেই দিয়ে দুপুরের এবং রাতের খাবারের ব্যবস্থা হলো। কাল সকাল থেকে হাসুর ডিউটি শুরু। হাসুর ডিউটি সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। বাকি সময় কল ডিউটি। রাত বিরাতে রোগীরা হাসুর কাছে চিকিৎসা চাইতে পারে।

পরদিন সকাল নয়টার আগেই হাসু কাজে চলে গেল; প্রথম দিন তাই কাজ বুঝে নিতে কিছুটা সময় লাগবে। হাসু চলে যাওয়ার পর আমি বের হলাম জায়গাটা ঘুরে দেখতে। প্রাচীর দিয়ে ঘেরা মেডিকেল সেন্টার থেকে বেরুতেই পাকা রাস্তা। এই রাস্তা দিয়েই আমরা নোফালিয়া এসেছিলাম। সমুদ্রের ধার দিয়ে চলে যাওয়া ত্রিপলি-বেনগাজি হাইওয়ে থেকে নোফালিয়ার দূরত্ব ৮ কিলোমিটার। নোফালিয়ায় ঢুকতেই এই মেডিকেল সেন্টার। আমি পাকা রাস্তা দিয়ে শহরের দিকে হাঁটতে থাকলাম। রাস্তাটা ক্রমশ খাড়া হয়ে উঠছিল, তাই আমার হাঁটার গতি ধীরে ধীরে কমে আসছিল। প্রথমে একটা স্কুল চোখ পড়লো। তারপর কয়েকটা মুদির দোকান। দূর থেকে একটা মসজিদের মিনার দেখা যাচ্ছিলো। কিছু দূর হাঁটার পর দুটি ভবন দেখতে পেলাম। পরে জানতে পেরেছি, এর মধ্যে একটা হলো নোফালিয়া পৌরসভা ভবন, আরেকটা স্থানীয় কন্সস্ট্রাকশন কোম্পানি ভবন। রাস্তার দুই পাশে ছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লিবিয়ান বাড়ি। তবে সেখানে আমি কোন মানুষের কার্যকলাপ দেখতে পাইনি। সম্ভবত যারা বিন জাওয়াদে কাজ করে তারা ইতিমধ্যে কাজে চলে গেছে। ফেরার পথে একটা বাড়ির সামনে পানির ট্রাক দেখলাম। আমি ইতিমধ্যে জেনেছি, লিবিয়ান কর্তৃপক্ষ ট্রাকে করে বিন জাওয়াদ থেকে নোফালিয়ার প্রতিটা বাড়িতে পানি সরবরাহ করে। আমি ট্রাক ড্রাইভারকে সালাম জানালাম। আমি অবাক হলাম জেনে যে ট্রাক ড্রাইভার একজন পাকিস্তানি। আমার ভাঙা উর্দুতে তাকে জিজ্ঞেস করলাম উপমহাদেশের আর কেউ এখানে কাজ করে কিনা। সে জানালো, কন্সস্ট্রাকশন কোম্পানিতে একজন ইন্ডিয়ান ইলেকট্রিশিয়ান কাজ করে। তারপর আমি মেডিকেল সেন্টারে ফিরে গেলাম। আমার এই হাঁটার অভিজ্ঞতা থেকে আমি এটুকুই বলতে পারি – লিবিয়ান সরকারের এত ছোট বসতির জনগণের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম।

বিকেল ৫টার পর হাসু বাড়ি ফিরল। ওকে খুব ক্লান্ত লাগছিলো। আমি ওকে বিশ্রাম নিতে পাঠিয়ে দিলাম। ঘণ্টা-খানেক বিশ্রামের পর আমরা বিকেলের চা খেতে বসলাম। আমি জানতে চাইলাম হাসুর কাজের প্রথম দিনের অভিজ্ঞতার কথা। ও বললো, কাজের চাপ ছিল অনেক বেশি। অনেক রুগী দেখতে হয়েছিল। অনেক দিন ধরে ডাক্তার না থাকায় রোগীদের এই ভিড়। এর মধ্যে সেদিন একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল যা নিয়ে আমরা এখনো হাসাহাসি করি। হাসু ইতিমধ্যে কয়েকজন রোগী দেখেছে। ভাষার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ও কাজ চালিয়ে নিতে পারছিল। তারপর হঠাৎ এক রোগী তার স্বজনদের সাথে নিয়ে ওর ঘরে ঢুকে পড়ে। সঙ্গে আবু বকরও ছিলেন। তিনি বলেন, এই ছেলেটাকে সাপে কামড়েছে। একই সময়ে, রোগীর সঙ্গে আসা একজন কাঁচের বয়াম থেকে একটা সাপ হাসুর টেবিলের উপর রাখল। কাঁচের বয়াম থেকে সাপটা টেবিলের উপর রাখার পর হাসুর মনে হয়েছিল সাপটা নড়াচড়া করছে। ও এতই ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে ও তার চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠে দূরে চলে গিয়েছিল। আবু বকর বললেন, ভয়ের কোনো কারণ নেই, সাপটা মৃত। সঠিক ধরনের অ্যান্টি-ভেনম শনাক্ত করার জন্য ওরা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। হাসুর কাজের প্রথম দিনে এটা ছিল একটা স্মরণীয় ঘটনা যা ছিল

একই সাথে ভীতিকর এবং হাস্যকর। প্রসঙ্গত, লিবিয়ার মরুভূমিতে সাপ ও বিচ্ছু কামড়ানোর রুগী প্রায়ই আসতো।

কোনো সমস্যা ছাড়াই আমাদের নোফালিয়ায় এক সপ্তাহ কেটে গেলো। ৯টা-৫টা হাসুর ডিউটি। বাকি সময়টা আমরা ঘর গোছানো এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করে কাটিয়ে দিলাম। হঠাৎ রাতে আমাদের দরজায় এক রোগী হাজির। হাসু রুগীকে নিয়ে মেডিকেল সেন্টারে চলে গেলো। সঙ্গে আমিও গেলাম। নিয়ম অনুযায়ী, হাসুকে সাহায্য করার জন্য ড্রাইভার গিয়ে আবু বকরকে নিয়ে আসার কথা। হাসু তা করলো না। সে নিজেই চিকিৎসা শুরু করে দিলো। ওকে সাহায্য করলাম আমি। চিকিৎসা শেষে রুগীকে বিদায় করে আমরা বাড়ি ফিরলাম। এই ধরনের কল ডিউটি মাসে ৩/৪টা হতো। আর সব সময়েই আমাকে সঙ্গে থাকতে হতো। অনেক সময়, যেমন প্রসবের ক্ষেত্রে, রোগীকে মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে আসা সম্ভব হতো না। তখন এম্বুলেন্স নিয়ে আমরা রুগীর বাসায় চলে যেতাম। গভীর রাতে মরুভূমির মধ্য দিয়ে গাড়িতে ভ্রমণ ছিল এক অনন্য অভিজ্ঞতা। আমাদের ফোর-হুইল ড্রাইভ অ্যাম্বুলেন্স বালির মধ্য দিয়ে ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে। উপরে পরিষ্কার আকাশে অসংখ্য তারা মিটমিট করে জ্বলছে। চারদিকে জন-মানবহীন নিস্তব্ধ পরিবেশ। দৃশ্যটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না, এটা কেবল অনুভব করা যায়। তবে হাসুর জন্য কল ডিউটি খুব চাপের ছিল কারণ বিভিন্ন ধরণের রুগী আসতো। অনেক সময় চিকিৎসা করতে বেশ সময় লেগে যেত। পর্যাপ্ত ঘুম ছাড়া পরদিন সকালে কাজে যাওয়া ওর জন্য কঠিন হতো।

অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা নোফালিয়ায় থিতু হয়ে গেলাম। এ ব্যাপারে আবু বকর আমাদের অনেক সাহায্য করেছিলেন। নোফালিয়ায় রুটির দোকান ছিল না। তিনি একটা লোক ঠিক করে দিয়ে ছিলেন যে রোজ বিন জাওয়াদে কাজ শেষে ফেরার সময় আমাদের জন্য রুটি নিয়ে আসতো। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে আমরা বিন জাওয়াদ যেতাম কেনাকাটা করার জন্যে। এর জন্য ড্রাইভারের ব্যবস্থা তিনিই করতেন। কখনো কখনো বড় কেনাকাটার জন্য আমরা নোফালিয়া থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত 'সিরত' শহরে যেতাম। সিরত একটা জেলা শহর। সেখানে একটা বড় সুপার মার্কেট ছিল। সেখানে যাওয়ার জন্যও আবু বকর ড্রাইভার ঠিক করে দিতেন। ড্রাইভারের কাজ ছিল আমাদের সুপার মার্কেটে পোঁছে দেয়া এবং কেনাকাটা শেষে আমাদের নোফালিয়া ফিরিয়ে আনা। মনে পড়ে সিরত সুপার মার্কেটে প্রথম কেনাকাটা করার কথা। লিবিয়ায় এত বড় সুপার মার্কেট আগে দেখিনি। কত কি কেনার ছিল। তবে সবকিছু তো আর এক দিনে কেনা যাবে না; বাজেটের প্রশ্ন আছে। হাসু অনেক কেনাকাটা করলো। আমি একটা স্টেরিও সেট কিনে ফেললাম। গান শোনা ছাড়া আমার সময় কাটছিল না। ঢাকা থেকে ক্যাসেটে অনেক গান রেকর্ড করে এনেছিলাম। তখনকার দিনে ঢাকার নিউ এলিফ্যান্ট রোডে 'গীতালি' নামে একটা মিউজিক স্টোর ছিল। তখন ছিল ক্যাসেটের যুগ। সেখান থেকে পছন্দের গান ক্যাসেটে রেকর্ড করানো যেত। গীতালি স্টোরের মালিক ছিলেন আমার পাড়ার বন্ধু খোকনের বড় ভাই। এই দোকানে রেকর্ডও বিক্রি হতো। কোনো নতুন রেকর্ড, বিশেষ করে ভারতীয় রেকর্ড, আসলেই সেটা শোনার সুযোগ পেতাম। পরে পছন্দের গানগুলো ক্যাসেটে রেকর্ড করিয়ে নিতাম। দুবছর হলো খোকন না ফেরার দেশে চলে গেছে। মহান আল্লাহতালা তাকে বেহেশত নসিব করুন।

তিন মাস হতে চললো বাসায় বসে আছি। একটা চাকরি-বাকরি করা দরকার। সমস্যা হলো চাকরি করতে হলে বিন জাওয়াদ যেতে হবে। নিজের গাড়ি ছাড়া রোজ বিন জাওয়াদ যাওয়া-আসা করা কঠিন হবে। দেরি না করে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কিনে ফেললাম। গাড়িটা ছিল ডাটসান, মডেল ১৪০জে। এটা ছিল আমাদের প্রথম গাড়ি। লিবিয়ায় জাপানি গাড়ি তেমন জনপ্রিয় ছিল না। লিবিয়ার মরুভূমির পরিবেশে চালানোর জন্য শক্তিশালী গাড়ির প্রয়োজন হতো। ফরাসি গাড়ি ‘পেজু’ ছিল তাদের পছন্দের গাড়ি, বিশেষ করে পেজু ৫০৪। সেডান এবং স্টেশন ওয়াগন মডেলগুলো জনপ্রিয় ছিল যারা শহর এলাকায় গাড়ি চালাত, আর পিক-আপ ট্রাক মডেলগুলো জনপ্রিয় ছিল যারা চালাত মরুভূমিতে। গাড়ি কেনার পর চাকরি খুঁজতে বের হলাম। আমার চাকরি হলো বিন জাওয়াদ ইলেক্ট্রিসিটি ডিপার্টমেন্টে। রোজ সকালে বিন জাওয়াদ যেতাম আর ফিরে আসতাম সন্ধ্যায়। জীবন ব্যস্ত হয়ে উঠল তবে আমি আমার জীবনে একটা ছন্দ খুঁজে পেলাম।

গাড়ি কেনার পর আমাদের নোফালিয়ার আশেপাশের এলাকা ঘুরে দেখার সুযোগ হলো। আগে বুঝতে পারিনি, সমুদ্র নোফালিয়ার এত কাছে। নোফালিয়া রোড দিয়ে যাওয়ার পর ত্রিপলি-বেনগাজি হাইওয়ে পেরুলেই একটা কাঁচা রাস্তা সমুদ্রের দিকে চলে গেছে। সামনেই ‘ভূমধ্যসাগর’! ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য নিয়ে ভূগোলে কত কি পড়েছি। সমুদ্র সৈকতে থাকতো নিরিবিলি রোমান্টিক পরিবেশ। যখনই সময় পেতাম, বিশেষ করে গরমের দিনে, তাজা ঠাণ্ডা বাতাস নেয়ার জন্য আমরা চলে যেতাম সেখানে। দুজনে বসে গল্প করতে আর সমুদ্রের অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করতে ভালো লাগতো।

এছাড়া গাড়ি কেনার পর আমাদের সিরতে যাওয়া-আসা বেড়ে যায়। নতুন সংসার সাজাতে কত কিছু কিনতে হয়! একদিন বরাবরের মতো আমরা সিরতে বাজার করতে গিয়েছিলাম। নোফালিয়ায় ফিরতেই আবু বকর আমাদের গাড়ির কাছে এসে জানালেন, মেডিকেল সেন্টারে একটা বাচ্চা চিকিৎসার জন্য অপেক্ষা করছে। বাচ্চাটা খুব অসুস্থ। গাড়ি থেকে নেমেই হাসু মেডিকেল সেন্টারে চলে গেলো বাচ্চাটাকে দেখতে। পেছন পেছন আমিও ছুটলাম। গিয়ে দেখি, একটা বছর দুয়েকের বাচ্চা মায়ের কোলে নিস্তেজ ভাবে শুয়ে আছে, তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বাচ্চার মা জানালেন, তার ছেলে গতকাল থেকে উচ্চ জ্বরে ভুগছে, সঙ্গে কাশি, অবসাদ এবং বমি। দৃশ্যটা ছিল ভয়ঙ্কর। মনে হচ্ছিলো বাচ্চাটা তখনই মারা যাবে। হাসু বাচ্চাটাকে অবিলম্বে সিরত ডিসট্রিক্ট হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলো। বাচ্চার বাবা-মা তাতে নারাজ। নোফালিয়ার মানুষ মনে করত সিরাত হাসপাতালে পাঠানো রোগী জীবিত ফিরে আসে না। এর অবশ্য কারণ ছিল, শুধুমাত্র গুরুতর রোগীদেরই সিরত হাসপাতালে পাঠানো হতো। তারা হাসুকে বললেন, এখানেই যা করা যায় তাই করতে। অগত্যা হাসু মেডিকেল সেন্টারে বাচ্চাটার চিকিৎসা শুরু করে দিলো। হাসু দিনরাত বাচ্চাটার পাশে থেকে তার চিকিৎসা করেছিল। চিকিৎসা শুরুর পর ধীরে ধীরে বাচ্চাটার অবস্থার উন্নতি হতে থকে। রাতভর হাসপাতালে থাকার পর বাবা-মা তাকে বাড়িতে নিয়ে যায়। পরে সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গিয়েছিলো। আগে জানতাম না, বাচ্চাটার বাবা ছিলেন নোফালিয়া পৌরসভার চেয়ারম্যান। আগে থেকেই হাসু তার রোগীদের কাছে জনপ্রিয় ছিল। এই ঘটনার পর হাসুর সুনাম সারা নোফালিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।

আমাদের বিয়ের চার বছর কেটে গেছে। প্রথমে পড়াশুনা তারপর ঘোরাঘুরি করে আমাদের বাচ্চা নেয়া হয়ে উঠেনি। এখন আমরা থিতু হয়েছি। আমাদের দুজনেরই চাকরি হয়েছে। তাই আমরা আমাদের প্রথম সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেই দিনটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিনগুলোর একটা, যেদিন হাসু আমাকে জানিয়েছিল সে প্রেগন্যান্ট। হাসুও খুশি কারণ সে ভুল প্রমাণ করেছিল যারা ভেবেছিল সে গর্ভধারণ করতে অক্ষম। কিন্তু আমাদের আনন্দ ছিল ক্ষণস্থায়ী। চার মাসের মাথায় হাসুর মিসক্যারেজ হয়ে যায়। এম্বুলেন্সে করে হাসুকে নিয়ে গেলাম সিরত ডিসট্রিক্ট হসপিটালে। সেখানে দুদিন চিকিৎসার পর ওকে বাসায় নিয়ে এলাম। এই ঘটনার পর হাসুর খুব মন খারাপ হয়েছিল; তাকে সান্ত্বনা দেবার কোনো ভাষা আমার ছিল না। আমরা দুজনেই বুঝতে পেরেছিলাম হাসুর গর্ভপাতের কারণ হলো তার অতিরিক্ত চাপের কাজ, বিশেষ করে তার নাইট কল। এই ট্র্যাজেডি কাটিয়ে ওঠার পর হাসু নোফালিয়া ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। ও সিরত স্বাস্থ্য বিভাগের সাথে যোগাযোগ করে তাকে সিরত হাসপাতালে বদলির জন্য আবেদন জানালো। কর্তৃপক্ষ হাসুর বদলির আবেদনের কারণ বুঝতে পেরে তা অনুমোদন করলেন। এদিকে নোফালিয়ার মানুষ হাসুকে ছাড়তে চাইছে না। অত্যন্ত জনপ্রিয় হলে যা হয়। এমনকি নোফালিয়া পৌরসভার সেই চেয়ারম্যান, যার বাচ্চাকে হাসু সুস্থ করে তুলেছিল, তিনি হাসুর সঙ্গে দেখা করে তাকে নোফালিয়ায় থাকার অনুরোধ জানালেন। হাসু তার নোফালিয়া ছাড়ার কারণ ব্যাখ্যা করার পর তিনি আর কিছু বললেন না। একদিন সকালে আমরা হাসপাতালের গাড়িতে করে সিরত রওনা হলাম। সঙ্গে নিয়ে গেলাম লিবিয়ার এক মরুভূমিতে ৮ মাস বসবাসের স্মৃতি। (চলবে)



ভূমধ্যসাগরের তীরে



আগের পর্ব পরের পর্ব



ড. নজরুল ইসলাম, কার্টিন ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া








Share on Facebook               Home Page             Published on: 3-Feb-2025

Coming Events:

Blacktown Money raised so far