bangla-sydney













প্রবাসে পঞ্চাশ বছর (১৪)
ড. নজরুল ইসলাম



আগের পর্ব পরের পর্ব

তেজগাঁও বিমানবন্দরে চেক-ইন করার পর আমরা ত্রিপলির ফ্লাইট ধরার জন্য লাউঞ্জে অপেক্ষা করছি। এমন দেশে যাচ্ছি যেখানে চেনা জানা কেউই নেই। কোথায় উঠবো তারও ঠিক নেই। আমরা চারদিকে চোখ রাখছিলাম এ ব্যাপারে আলাপ করার জন্য কাউকে পাওয়া যায় কি না। এক ভদ্রমহিলা কে উপযুক্ত মনে হলো। তিনি একাই ভ্রমণ করছিলেন। হাসু তার সাথে আলাপ শুরু করে দিলো। পরে হাসুর কাছ থেকে জানতে পারলাম, উনি এবং উনার স্বামী বাংলাদেশে ছুটি কাটাতে এসেছিলেন। ছুটি শেষ হয়ে যাওয়ায় উনার স্বামী লিবিয়ায় ফিরে গেছেন। ত্রিপলিতে উনার স্বামী কৃষি বিভাগে কাজ করছেন। উনারা অন্য এক দম্পতির সাথে একটা বাসা ভাড়া করে থাকেন। তিনি যা বললেন তা থেকে জানা গেলো যে, বেশিরভাগ বাংলাদেশি পরিবার উচ্চ বাড়ি ভাড়ার কারণে ত্রিপলিতে বাড়ি শেয়ার করে থাকেন। আমরা বুঝে নিলাম কোনো বাংলাদেশীর বাসায় উঠার চিন্তাটা বাদ দিতে হবে। তিনি আরো বলেন, ত্রিপলিতে পরিবার নিয়ে থাকার জন্য পর্যাপ্ত হোটেল নেই। তাছাড়া এখন লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফির শাসনের দশম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে। তাই হোটেল খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। হাসু উনার নাম-ঠিকানা টুকে নিয়ে উনাকে বিদায় জানালো।

থাকার ব্যাপারে আমাদের আরেকটা পরিকল্পনা ছিল। যেহেতু ত্রিপলিতে আমাদের রাত্রি যাপন করতে হবে আমরা বাংলাদেশ বিমানের কাছে রাত্রিযাপনের জন্য হোটেল চাইতে পারি। ত্রিপলি বিমানবন্দরে নামার পর বাংলাদেশ বিমানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। উনারা জানালেন, উনারা কিছুদিন আগে ত্রিপলি এসেছেন। এখনকার হোটেল সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তাই আমাদের রাতে হোটেলে থাকার ব্যবস্থা উনারা করতে পারবেন না। তবে আমরা চাইলে উনাদের বাসায় “কষ্ট করে” রাতটা কাটাতে পারি। আমাদের আর কোনো উপায় ছিল না। আমরা রাজি হয়ে গেলাম। উনাদের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা বিমানবন্দরে বসে রইলাম।

উনাদের কাজ শেষে আমরা যখন রওনা দিলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা হতে চলেছে। আধঘণ্টা চলার পর আমাদের মাইক্রো-বাস এসে থামল একটা বড় বাড়ির সামনে। আশেপাশের বাড়িগুলো দেখে মনে হচ্ছিল এটা ত্রিপলির একটা অভিজাত এলাকা। পরে জানতে পেরেছিলাম এই এলাকাটার নাম ‘বাব বেন গাশির’। বাংলাদেশ বিমানের বাড়িটা ছিল উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা একটা পাঁচ বেডরুমের বাড়ি। বাসায় ঢোকার পর বাংলাদেশ বিমানের একজন কর্মকর্তা আমাদের ব্যবহার করার মতো রুম ও বাথরুম দেখিয়ে দিলেন। আমরা মালপত্র নিয়ে সেই ঘরে ঢুকে পড়লাম। ঘরে ঢুকতেই বুঝতে পারলাম উনারা “কষ্ট করে থাকা” বলতে কী বোঝাতে চেয়েছিলেন। ওই ঘরে একটা ম্যাট্রেস আর দুটো বালিশ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। না একটা চাদর, না একটা কম্বল। লিবিয়ায় তাপমাত্রা দিনের বেলায় গরম থাকলেও রাতে তাপমাত্রা অনেক কমে যায়। তাই কম্বল ছাড়া বেশ কষ্ট পাচ্ছিলাম। জ্যাকেট পরেও শীত মানছিল না। আমরা খুব ক্লান্ত ছিলাম বলে ঘুমিয়ে পড়তে পেরেছিলাম।

পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে বিমানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ হলো। উনারা তিন জন দেশে পরিবার-পরিজন রেখে ত্রিপলি এসেছেন কিছুদিন হলো। বেশ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন, কেননা উনারা আরবি ভাষা জানেন না, স্থানীয় খাবারে অভ্যস্ত নন এবং নিজেরা রান্নাবান্না করতে পারেন না। আমরা আমাদের লিবিয়ায় আসার কারণ খুলে বললাম। সব কিছু শোনার পর উনারা বললেন, অন্য বাসা না পাওয়া পর্যন্ত আমরা উনাদের বাসায় থাকতে পারি। উনারা জানালেন, কাছেই একটা হাসপাতাল আছে। সেখানে বাংলাদেশী ডাক্তার থাকতে পারে। তার কাছ থেকে চাকরির খোঁজ খবর পাওয়া যাতে পারে। আমরা চলে গেলাম সেই হাসপাতালে। সেটা ছিল একটা প্রাইভেট হাসপাতাল, লিবিয়ায় যাকে ইনস্যুরেন্স হাসপাতাল বলা হয়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর এক বাংলাদেশী ডাক্তারের সন্ধান পাওয়া গেলো। সত্যি দুঃখিত আমি ভদ্রলোকের নাম ভুলে গেছি। তার সাহায্য ভোলার না। তিনি বললেন, চাকরির দরখাস্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হবে। কোন বাসে সেখানে যেতে হবে তাও বুঝিয়ে দিলেন। এ ছাড়া তিনি হাসপাতালের টাইপিস্টকে দিয়ে হাসুর দরখাস্ত টাইপ করিয়ে দিলেন। তিনি আরো বলেন, আজ দেরি হয়ে গেছে, কাল সকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গেলে ভালো হয়। উনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা চলে গেলাম ত্রিপলি সিটি সেন্টারে। এলাকাটা ছিল দোকান দিয়ে ঘেরা একটা বিশাল চত্বর। সেখানে যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ ছিল। আমরা প্রথমেই একটা কম্বল কিনে ফেললাম। তারপর কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আমাদের থাকার জায়গায় ফিরে গেলাম।

পরদিন সকালে আমরা চলে গেলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে। ওখানকার সেক্রেটারির সঙ্গে দেখা করলাম। হাসু তার দরখাস্ত উনার হাতে তুলে দিলো। দরখাস্ত পড়ে তিনি বললেন, সব ঠিক আছে। তুমি ৩/৪ দিন পর আমার সাথে দেখা করো। আশা করি ততদিনে তোমার দরখাস্তের ফলাফল পেয়ে যাবো। তিন দিন পর আমরা গেলাম সেই সেক্রেটারির সঙ্গে দেখা করতে। তিনি বলেন, আমরা তোমাকে চাকরি দিতে পারি তবে তুমি ট্রানজিট ভিসায় এসেছো তাই আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে। আমরা ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি; তাদের উত্তরের অপেক্ষায় আছি। তোমরা মাঝে মাঝে এসে খোঁজ নিও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন এসেছে কি না। আমরা এই সুসংবাদটা পেয়ে খুব খুশি হয়ে ছিলাম, যদিও কাজটা তখনো সম্পূর্ণ হয়নি।

একদিন পর পর আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিতে থাকলাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন এসেছে কি না। প্রতিবারই আমরা হতাশ হয়ে ফিরতাম। এর মধ্যে বাংলাদেশ বিমানের বাড়িতে আমরা দুই সপ্তাহের বেশি সময় কাটিয়েছি। আমাদের থাকার জন্য একটা নতুন ঘর দরকার। একদিন সন্ধ্যায় আমরা তেজগাঁও বিমানবন্দরে পরিচয় হওয়া সেই ভদ্রমহিলার বাড়িতে গেলাম। সেখানে তার স্বামীর সঙ্গে পরিচয় হলো। আমরা উনাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে হাসুর চাকরির সম্ভাবনার কথা বললাম। এও বললাম, আমরা থাকার জন্য একটা ঘর খুঁজছি। সেই ভদ্রলোক আমাদের বললেন, তার দুই বাংলাদেশী সহকর্মী একটা বাড়ি শেয়ার করে থাকতেন। তাদের ছাদে একটা অতিরিক্ত ঘর আছে। তারা সেই ঘরটা সাবলেট দিতে চান। বাড়িটা ত্রিপলির ‘শারগিয়া’ এলাকায় (পূর্বাঞ্চলীয় সাবার্বে) অবস্থিত। আগ্রহী হলে আমরা সেখানে গিয়ে ঘরটা দেখতে পারি। আমরা তাকে বললাম, আমাদের দেখার দরকার নেই। উনাদের বলবেন আমরা আগামী শুক্রবার সকালে সেখানে শিফট করবো। আমরা এতটাই মরিয়া ছিলাম যে কত ভাড়া দিতে হবে তাও জিজ্ঞেস করিনি।

শুক্রবার সকালে আমাদের মালপত্র নিয়ে আমরা চলে গেলাম শারগিয়ার সেই বাসায়। সেখানে পরিচয় হলো ড. ওয়াহিদের সঙ্গে। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। অত্যন্ত ভালো মানুষ। মনোযোগ দিয়ে আমাদের সব কথা শুনলেন। বড় দুই ছেলেকে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি করে স্ত্রী এবং ছোট মেয়েকে নিয়ে ত্রিপলিতে আছেন কয়েক বছর হলো। কাজ করছেন কৃষি মন্ত্রণালয়ে। ছোট মেয়ের নাম দিনা। সে একটা স্থানীয় স্কুলে পড়াশুনা করছে। বেশি কথাবার্তা না বাড়িয়ে তিনি আমাদের ছাদের ঘরটা দেখিয়ে দিলেন। সেখানে ছিল একটা খাট, টেবিল আর আলমারি। বাঁচা গেলো, আর মেঝেতে ঘুমাতে হবে না! হাসু ঘর গোছানোয় লেগে গেলো। প্রথম কয়েকদিন আমরা ওয়াহিদ পরিবারের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করলাম। তারপর হাসু ছাদের ঘরে রান্নাবান্না শুরু করে দিলো। নতুন থাকার জায়গায় থিতু হওয়ার পর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আমরা আবার যাতায়াত শুরু করলাম। রোজ সকালে বাসে করে চলে যেতাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে। সেখানে খবর নেয়ার পর চলে যেতাম সিটি সেন্টারে। সেখান থেকে টুকটাক বাজার করে বাসায় ফিরতাম। এই ছিল আমাদের প্রতিদিনের রুটিন। এর মধ্যে আমরা দিনার কাছ থেকে আরবি ভাষা শিখতে শুরু করেছি। আমরা ইতিমধ্যে একটা বিদেশী ভাষা শিখেছি তাই অন্য একটা ভাষা শেখা ততটা কঠিন হলো না। অল্প সময়ের মধ্যেই মোটামুটি চলার মতন আরবি ভাষা শিখে ফেললাম। কয়েকদিন পর কোরবানির ঈদ এসে গেলো। ঈদ উপলক্ষে সব অফিস-আদালত বন্ধ। ড. ওয়াহিদ এবং তার বাংলাদেশী সহকর্মীরা মিলে একটা গরু কোরবানি দিলেন। ওনাদের একজন ছিলেন ভেটেরিনারি সার্জন। নিজেরাই গরু জবাই করে, চামড়া ছাড়িয়ে মাংস ভাগ করে নিলেন। এটা ছিল লিবিয়ায় আমাদের প্রথম ঈদ। বাংলাদেশী পরিবারের সাথে আমাদের দিনটা ভালোই কেটেছিল।

ঈদের ছুটি শেষে আমরা আবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যাতায়াত শুরু করলাম। রোজকার মতন সকালে আমরা বাস স্ট্যান্ডে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। হঠাৎ প্যান্ট শার্ট পরা এক লিবিয়ান ভদ্রলোক আমাদের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা রোজ সকালে বাসে করে কোথায় যাও? আমরা বললাম হাসু একজন ডাক্তার। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তার চাকরি হয়েছে। এখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। তিনি সমস্যাটা বুঝতে পারলেন। বললেন, আগামীকাল এই সময়ে বাস স্ট্যান্ডে তার জন্য অপেক্ষা করতে। সঙ্গে হাসুর দরখাস্তের কপি নিয়ে আসতে বললেন। পরদিন সকালে ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমরা চলে গেলাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতালীয় শাসনামলে (১৯১১-৪৩) নির্মিত একটা বিশাল ভবন। দরজাগুলো উঁচু উঁচু। আমাদের ওয়েটিং রুমে বসিয়ে হাসুর দরখাস্তের কপি নিয়ে তিনি ভিতরে চলে গেলেন। ঘণ্টা-খানেক পর ফিরে এসে হাসুকে একটা কাগজ দিয়ে বললেন, এটা তোমার ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’। মূল কপি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আশা করি এরপর আর কোনো অসুবিধা হবে না। আমি অলৌকিকতায় বিশ্বাস করি না। কিন্তু এটা ছিল আমাদের জীবনে একটা অলৌকিক ঘটনা। আমার মনে হয় ওই ভদ্রলোক ছিলেন লিবিয়ান সিক্রেট সার্ভিসের লোক। একজন লেডি ডাক্তার পেলে তার দেশের ভালো হবে ভেবেই তিনি আমাদের সাহায্য করেছিলেন।

পরদিন আমরা গেলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে। দেখা করলাম ওখানকার সেক্রেটারির সঙ্গে। আমরা কিছু বলার আগেই তিনি বললেন, অভিনন্দন, আমরা তোমার কাজের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেয়ে গেছি। আশাকরি এক সপ্তাহের মধ্যেই তোমার পোস্টিং হয়ে যাবে। তোমরা মালপত্র গোছাতে থাকো। আমাদের ড্রাইভার তোমাকে তোমার কর্মস্থলে পোঁছে দেবে। এটা ছিল আমাদের জন্য অত্যন্ত খুশির খবর! মহান আল্লাহতালা আমাদের দোয়া কবুল করেছেন। বিশাল ঝুঁকি নিয়ে আমাদের লিবিয়া আসা সার্থক হয়েছে। বাসায় ফিরে সবাইকে খুশির খবরটা জানালাম। আমাদের খুশিতে উনারাও খুশি। উনারা বললেন, লিবিয়ায় এভাবে চাকির পাওয়ার কথা তারা আগে কখনো শোনেননি। (চলবে)



ত্রিপলি পৌঁছানোর পরদিন সিটি সেন্টারে তোলা ছবি



আগের পর্ব পরের পর্ব



ড. নজরুল ইসলাম, কার্টিন ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া




Share on Facebook               Home Page             Published on: 23-Jan-2025

Coming Events: