bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













প্রবাসে পঞ্চাশ বছর (১২)
ড. নজরুল ইসলাম



আগের পর্ব পরের পর্ব

১৯৭৭-৭৮ শিক্ষাবর্ষ ছিল আমার পড়াশোনার শেষ বছর। এর সিংহভাগ জুড়ে ছিল ‘ফাইনাল ইয়ার প্রজেক্ট’। এটা ছিল একটা ভিন্ন ধরনের শেখার প্রক্রিয়া। এর আগে লেকচার এবং টিউটোরিয়ালে অংশগ্রহণ করে জ্ঞান অর্জন করেছি। এখন আমাদের নিজে নিজে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। এই ধরনের অধ্যয়নের সাথে আমরা মোটেও পরিচিত ছিলাম না। এই নতুন শেখার প্রক্রিয়াটি আয়ত্ত করতে আমার বেশ কিছুটা সময় লেগেছিলো। এটা ছিল আমার গবেষণা কাজের প্রথম অভিজ্ঞতা। পরবর্তীতে এই অভিজ্ঞতা আমার স্নাতকোত্তর অধ্যয়ন এবং কর্মজীবনে অনেক কাজে লেগেছিলো। বুলগেরিয়ান ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রিতে 'ফাইনাল ইয়ার প্রজেক্ট' খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সার্টিফিকেটে (বুলগেরিয়ায় যাকে ‘ডিপ্লোমা’ বলা হয়) দুটি নম্বর উল্লেখ থাকে: (১) অধ্যয়ন চলাকালীন পরীক্ষার গড় নম্বর এবং (২) থিসিসের গড় নম্বর। যারা পিএইচডি কোর্সে ভর্তি হতে চায় তাদের জন্য থিসিসের নম্বর বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যেসব ডিগ্রিতে ফাইনাল ইয়ার প্রজেক্ট নেই, যেমন মেডিসিন, ডিগ্রি অর্জনের জন্য নির্বাচিত বিষয়গুলোতে ‘স্টেট এক্সামিনেশন' দিতে হয়। এই পরীক্ষার উদ্দেশ্য হলো বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত ডিগ্রির মান বজায় রাখা।

থিসিস শুরু করার আগে প্রথম কাজ ছিল থিসিসের আলোচ্য বিষয় (টপিক) নির্বাচন করা। আমাদের শিক্ষকরা তাদের দেওয়া আলোচ্য বিষয়গুলোর তালিকা তাদের অফিসের বাইরে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। একটা বিষয় আমার আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল। সেটা হলো একটা ব্যবহারিক সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন ‘অপ্টিমাইজেশন’ পদ্ধতির তুলনা। এরপর আমি সেই শিক্ষকের সাথে দেখা করলাম যিনি বিষয়টা প্রস্তাব করেছিলেন। তার নাম ড. আলেক্সিয়েভ। তার সাথে আলোচনার পর আমার বিষয়টা পছন্দ হয়ে গেলো, বিশেষ করে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এর দিকটা। প্রসঙ্গত, বুলগেরিয়ান স্কলারশিপের জন্য নির্বাচিত হওয়ার পর আমাদের টিকিটের জন্য কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হয়েছিল। সেই সময়ে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এর ওপর মাসব্যাপী একটা কোর্স করেছিলাম। তখন থেকেই আমি কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এর প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠি। তাছাড়া, আমাদের দ্বিতীয় বর্ষে ‘কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড প্রোগ্রামিং’-এর উপর একটা বিষয় ছিল।

আমার থিসিসের কাজ শুরু হয়ে গেল। প্রথম প্রথম লাইব্রেরিতে অনেক সময় কাটাতে হতো। আমাদের ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরি ছাড়াও সিটি লাইব্রেরিতে যেতাম। তখন ফটোকপি ছিল না। প্রয়োজনীয় তথ্য খাতায় লিখে আনতাম। তখনকার দিনে গবেষণা করা বেশ কঠিন ছিল। তিন মাসের মধ্যে আমি আমার থিসিসের একটা কাঠামো তৈরি করে ফেললাম। এতে আমার সুপারভাইজারের অবদান ছিল অমূল্য। তারপর ছিল প্রোগ্রামিং। প্রোগ্রামিং-এর ভাষা ছিল ‘ফরট্রান’। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারের ‘কম্পিউটিং পাওয়ার’ আমার গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত ছিল না। তাই আমাকে ভার্নার একটা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে যেতে হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটার নাম ছিল 'সায়েন্টিফিক রিসার্চ অ্যান্ড প্রজেক্ট ডিজাইন ইন্সটিটিউট অফ শিপবিল্ডিং', বুলগেরিয়ান ভাষায় সংক্ষিপ্ত নাম 'নিপকিক'। প্রোগ্রাম লেখার পর, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কীপাঞ্চ অপারেটর’-এর কাছে নিয়ে যেতাম। কীপাঞ্চ অপারেটরদের কাজ ছিল 'পাঞ্চ কার্ড' নামে পরিচিত একটা কার্ডে হাতে লেখা প্রোগ্রাম এনকোড করা। তারপর কোডেড পাঞ্চ কার্ডগুলো নিয়ে যেতাম নিপকিক-এ। তাদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কম্পিউটার রুমে আমার ঢোকার অনুমতি ছিল না। পাঞ্চ কার্ডগুলো সেখানকার সেক্রেটারিকে দিয়ে আসতাম। পরদিন তার কাছ থেকে আমার ফলাফলের প্রিন্ট-আউট সংগ্রহ করতাম।

এরপর ছিল থিসিস লেখার কাজ। আমি ইতিমধ্যে প্রোগ্রামিং-এর ফাঁকে ফাঁকে থিসিস লেখা শুরু করেছিলাম। সমস্ত ফলাফল পাওয়ার পর, থিসিসের উপসংহার লিখে ফেললাম। তারপর আমার সুপারভাইজারের সাথে দেখা করলাম। তিনি ফলাফল নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন। তারপর ছিল থিসিস টাইপ করার কাজ। কাজটা একজন টাইপিস্টকে দিয়ে করাতে হলো। থিসিসের তিন কপি সেক্রেটারির কাছে জমা দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচালাম। এরপর ছিল থিসিসের 'পাবলিক ডিফেন্স'। সেখানে যে কেউ এসে প্রশ্ন করতে পারে। আমাদের ফ্যাক্টটির ডিন, প্রফেসর আলেকজান্দ্রভ ছিলেন পাবলিক ডিফেন্স পরীক্ষা কমিটির কর্ণধার। সঙ্গে ছিলেন আমাদের ডিপার্টমেন্টের আরো দুজন প্রফেসর এবং একজন বহিরাগত পরীক্ষক। এটা ছিল একটা ভীতিকর অভিজ্ঞতা! এত মানুষের সামনে আগে কখনো উপস্থাপন করিনি। আমাকে সাহস জোগানোর জন্য হাসু এসেছিল। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে আমার পাবলিক ডিফেন্স শেষ হয়ে গেল। প্রফেসর আলেকজান্দ্রভ 'লগবুক'-এ আমার প্রাপ্ত নম্বর লিখে দিলেন। এর মাধ্যমে আমি ডিগ্রি পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করলাম।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যাপী কোনো গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠান হয়নি। আমরা সার্টিফিকেট সংগ্রহ করেছিলাম আমাদের সেক্রেটারির কাছ থেকে। গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানের বদলে ছিল ডিপার্টমেন্ট আয়োজিত ‘গ্র্যাজুয়েশন বল’। ভার্না থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে বিখ্যাত গোল্ডেন স্যান্ড বিচ রিসোর্টের শিপকা হোটেলে আমাদের গ্র্যাজুয়েশন বল অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এতে অংশ গ্রহণ করেছিল আমার সহপাঠী এবং তাদের বয়ফ্রেইন্ড/গার্লফ্রেন্ড বা স্বামী/স্ত্রী। তবে বিবাহিতের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা কয়েকজন। আরো উপস্থিত ছিলেন আমাদের শিক্ষকবৃন্দ। প্রথমে ছিল ফর্মাল ডিনার। ডিনারে খাবারের সঙ্গে ছিল প্রচুর হার্ড এবং সফট ড্রিংক। বুলগারিয়ানরা অনেক মদ খেতে পারে। আর নিখরচায় পেলে তো কথাই নেই। বুলগেরিয়ার গ্রামবাসীরা বাড়িতে 'রাকিয়া' নামে একটা মদ তৈরি করে যার প্রধান উপাদান হলো নানা ধরণের ফল, বিশেষ করে প্লাম এবং আঙ্গুর। বাড়িতে উৎপাদিত রাকিয়ায় অ্যালকোহলের পরিমাণের কোনো হিসাব নেই, সেটা ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। প্রসঙ্গত, হুইস্কিতে অ্যালকোহলের পরিমাণ ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ। খাওয়াদাওয়ার পর শুরু হলো ডান্স পার্টি। এতদিনে আমরা নাচতে শিখে গেছি। কেননা আমাদের ইউনিভার্সিটি আয়োজিত যেকোনো পার্টি, যেমন নিউ ইয়ার্স পার্টি, শেষ হতো ডান্স দিয়ে। ডান্স পার্টি চলেছিল গভীর রাত পর্যন্ত। রাতটা আমরা হোটেলই থেকে গিয়েছিলাম। গ্র্যাজুয়েশন বল ছিল আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একসাথে মজা করার শেষ সুযোগ। আমাদের সবার জন্য এটা ছিল একটা স্মরণীয় রাত।

আমাদের শিক্ষকরা ছিলেন অভিজ্ঞ এবং নিবেদিতপ্রাণ। তারা ছিলেন নিজ নিজ বিষয়ে পণ্ডিত। আমি আশ্চর্য হই তারা কীভাবে কোনো নোট ছাড়াই লেকচার দিতেন। লেকচারের প্রয়োজনীয় স্কেচ ব্ল্যাকবোর্ডে আঁকতেন; স্মৃতি থেকে জটিল সমীকরণ ব্ল্যাকবোর্ডে লিখতেন। আমি ‘পাওয়ার পয়েন্ট’ ছাড়া অচল! আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রিতে ৪৫টি বিষয় ছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন ছিল স্ট্রেংথ অফ ম্যাটেরিয়ালস, থার্মোডিনামিক্স এবং গ্যাস ও স্টিম টারবাইন। প্রফেসর ইউসুফভ আমাদের ‘গ্যাস ও স্টিম টারবাইন’ পড়াতেন। জটিল বিষয়গুলোকে সহজ ভাষায় বুঝিয়ে বলার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তার। তিনি সব সময় চেষ্টা করতেন ক্লাসের সবচেয়ে দুর্বল ছাত্রও যেন তার লেকচার বুঝতে পারে। আমার বাবা একজন শিক্ষক ছিলেন। ছোটবেলা থেকে আশা ছিল আমিও একদিন শিক্ষক হবো। ইউসুফভ স্যারের ক্লাসে বসে ভাবতাম একদিন আমি যেন তার মতো শিক্ষক হতে পারি।
বুলগেরিয়ায় আমার পড়ালেখা পড়া শেষ। সার্টিফিকেট পেয়ে গেছি। হাসুর ডিগ্ৰী পেতে আরো এক বছর বাকী। আমি আগামীতে কী করবো তাই নিয়ে ভাবছি। এর মধ্যে একটা সুখবর, ভালো রেজাল্টের কারণে আমি আমাদের ইউনিভার্সিটি থেকে স্কলারশিপ নিয়ে পিএইচডি অধ্যয়নের অফার পেয়েছি। ফলে আমার সিদ্ধান্ত আরো জটিল হয়ে গেলো। আমি যদি পিএইচডি অধ্যয়ন শুরু করি তাতে কমপক্ষে তিন বছর লেগে যাবে। তাহলে হাসু তার ডিগ্রী শেষ করে কি করবে? বুলগেরিয়ায় এতো কম বেতনে চাকরি করার কোনো মানে হয় না। অন্যদিকে, স্কলারশিপ সহ পিএইচডি অধ্যয়ন একটা দুর্দান্ত সুযোগ। আব্বার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তিনি হাসুর পড়াশুনা শেষে আমাদের দেশে ফেরার পরামর্শ দিলেন। সেই অনুযায়ী আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, হাসুর পড়াশুনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি সিঙ্গাপুরে চাকরি করবো। চাকরির জন্য সিঙ্গাপুরে যাওয়ার কারণ সিঙ্গাপুর শিপিং এবং জাহাজ নির্মাণে ভালো ছিল। তাছাড়া সিঙ্গাপুর বেছে নেওয়ার আরেকটা কারণ ছিল। যথাসময়ে তা উল্লেখ করব। ঠিক হলো, এই গ্রীষ্মের ছুটিতে আমরা তিন মাস সুইডেনে কাজ করবো। সুইডেনে কাজ করার পর আমরা বাংলাদেশ যাবো। সবাই “নতুন বউ” দেখতে চায়! সেখান থেকে হাসু বুলগেরিয়া ফিরে আসবে আর আমি চলে যাবো সিংপুর। হাসুর পড়াশুনা শেষে আমরা দুজনে এক সঙ্গে দেশে ফিরবো। এই ছিল আমাদের পরিকল্পনা।

ইতিমধ্যে, মিস্টার মেলসন গ্র্যান্ড হোটেলে কাজ করার জন্য স্পন্সরশীপ লেটার পাঠিয়েছেন। একদিন আমরা বিমানে সোফিয়া গিয়ে সুইডিশ এমবাসি থেকে ভিসা নিয়ে এলাম। আমাদের স্কলারশিপের শর্ত অনুযায়ী, বুলগেরিয়ান সরকার ২০ কেজি অতিরিক্ত লাগেজ সহ আমাদের বাংলাদেশে ফেরার টিকিট দেবে। সেই টিকেটে ভ্রমণ করার জন্য আমাকে স্টকহোম থেকে ভার্না ফিরে আসতে হবে। আমি সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিচ্ছি। দেশে নেয়ার জন্য সুটকেস গোছাচ্ছি। হাসু তার পরীক্ষা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। আমি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে দিন কাটাচ্ছি।

আমরা স্টকহোম পৌঁছলাম জুলাই মাসের মাঝামাঝি। এটা ছিল স্টকহোমে আমাদের চতুর্থ এবং শেষ সফর। গত বছর স্টকহোমে থাকাকালীন বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত একজনের সাথে আমাদের পরিচয় হয়ে ছিল। আমরা ভাড়া করা ঘরে থাকছি জেনে তিনি আমাদের আগামী বছর তার অ্যাপার্টমেন্টে থাকার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এতে তার কিছু বাড়তি আয় হবে ভাবে আমরা রাজি হয়েছিলাম। তাছাড়া স্টকহোমে পৌঁছানোর পর আমাদের থাকার জায়গা খুঁজতে হবে না। আমরা গিয়ে উঠলাম তার অ্যাপার্টমেন্টে। সিটি সেন্টার থেকে একটু দূরে দুই বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্ট। মেট্রো স্টেশনের কাছাকাছি হওয়ায় আমাদের কাজে যাতায়াতের অসুবিধা হবে না। দুদিন বিশ্রাম

নিয়ে আমরা গ্র্যান্ড হোটেলে কাজ শুরু করলাম। সেখানে অনেক পরিচিত মুখ। তারা গ্র্যান্ড হোটেলের স্থায়ী কর্মচারী। তাদের বেশিরভাগই ছিল ফিনল্যান্ডের। কিচেন চালাতো জার্মান বাবুর্চিরা। আমি কিচেনে কাজ করতাম। দেখতাম সারাক্ষণই তারা খুব ব্যস্ত।

স্টকহোমে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের প্রবেশ মূল্য ছিল খুব বেশি। তাই আমরা সেখানে বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডে খুব একটা অংশগ্রহণ করতে পারিনি। এবছর স্টকহোমের সিনেমা হলে আমাদের প্রথম সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেটা ছিল আমেরিকান মিউজিক্যাল-কমেডি ফিল্ম ‘থ্যাঙ্ক গড ইটস ফ্রাইডে’। আমাদের প্রিয় গায়িকা ডোনা সামার এই ছবিতে তার বিখ্যাত গান 'লাস্ট ড্যান্স' পরিবেশন করেছিলেন। গানটি ১৯৭৮ সালে শ্রেষ্ঠ মৌলিক গানের জন্য একাডেমী এওয়ার্ড পেয়েছিলো। আমরা আমাদের প্রিয় গায়িকাকে বড় পর্দায় গাইতে দেখে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ে ছিলাম। পিকচার এবং সাউন্ড কোয়ালিটি ছিল চমৎকার। বুলগেরিয়ায় এতো উন্নতমানের সিনেমা হল ছিল না। ৭০ দশকে ডোনা সামারের গাওয়া আর একটা গান খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। গানটার শিরোনাম হলো 'লাভ টু লাভ ইউ বেবি'। সেই গানের এলবাম আমার ছিল। বুলগেরিয়ায় থাকাকালীন গানটা বহু বার শুনেছি।

দেখতে দেখতে স্টকহোমে আমাদের তিন মাস কেটে গেলো। এখন আমাকে ট্রেনে ভার্না ফিরে যেতে হবে; সেখান থেকে মালপত্র নিয়ে আমার বিমানে মস্কো যাওয়ার কথা। আর হাসু বিমানে স্টকহোম থেকে সরাসরি মস্কো চলে যাবে। স্টকহোম থেকে ভার্না ফেরার টিকিট কাটা ছিল। তবে সমস্যা হলো আমাকে একা ভার্না ফিরতে হবে। এতটা পথ ট্রেনে একা একা যাওয়া বেশ ক্লান্তিকর। সাথে কেউ থাকলে কথা বলতে বলতে সময় কেটে যায়। প্রায় দুদিনের ট্রেন যাত্রার পর ভার্না পৌঁছলাম। মালপত্র গোছানোই ছিল। পরদিন সকালে মস্কো-গামী ফ্লাইট ধরলাম। মস্কোর শেরেমেতিয়েভো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ট্রানজিট লাউঞ্জে হাসুর সঙ্গে মিলিত হলাম। মস্কো থেকে আমাদের ভ্রমণ-সূচী ছিল মস্কো-দিল্লি-ঢাকা। দিল্লিতে দুদিনের স্টপ ওভার নিয়েছিলাম। এই সুযোগে দিল্লি দেখা হয়ে যাবে। তাছাড়া কিছু কেনাকাটা করার দরকার ছিল। ইচ্ছে করেই মস্কো থেকে রাতের ফ্লাইট নিয়েছিলাম যাতে আমাদের মস্কো-গামী ফ্লাইট বিলম্বিত হলেও আমরা রাতের ফ্লাইট ধরতে পারি।

আমরা ভোরে দিল্লি পৌঁছলাম। ট্যাক্সি নিয়ে সোজা হোটেলে চলে গেলাম। হোটেলে চেক-ইন করার পর ঘুমিয়ে পড়লাম। দুপুরের খাবারের পর আবার ঘুম। যখন ঘুম ভাঙল তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলছে। এই ঘুমের প্রয়োজন ছিল, বিশেষ করে আমার জন্য। আমি তিন দিনের বেশি সময় ধরে ভ্রমণ করছি। দিল্লিতে আমাদের প্রথম কাজ ছিল কিছু কেনা কাটা করা। হাসুর জন্য শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট ইত্যাদি কিনতে হবে। প্যান্ট শার্ট পরা বউ দেখলে সবাই চমকে যাবে! ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বললাম আমাদের একটা শপিং সেন্টারে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সে আমাদের নামিয়ে দিলো 'চাঁদনী চক' বাজারের সামনে। এটি দিল্লির অন্যতম প্রাচীন এবং ব্যস্ততম বাজার। মুঘল সম্রাট শাহজাহান এটি নির্মাণ করেছিলেন। এই বাজারে পাওয়া যায় না এমন কিছু নেই: শাড়ি, লেহেঙ্গা, সব ধরনের জামাকাপড়, গয়না, বিয়ের কেনাকাটা, ক্যামেরা, ঘড়ি, ইলেকট্রনিক আইটেম, বই, স্টেশনারি আইটেম, মশলা, ফল, মিষ্টি আরো অনেক কিছু। কেনাকাটা করার চেয়ে বাজারটা ঘুরে দেখতে আমার বেশি ভালো লাগছিলো। আরো সময় নিয়ে আসলে ভালো হয়তো। কেনাকাটা শেষে রাতে হোটেলে ফিরলাম। একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, দিল্লিতে ট্যাক্সি ভাড়া জনসাধারণের সাধ্যের মধ্যে ছিল। তখনকার দিনে বাংলাদেশে ট্যাক্সি ভাড়া ছিল খুবই ব্যয়বহুল। শুধুমাত্র বিদেশীরা সেটা বহন করতে পারতো। বাকি সময়টা আমরা দিল্লির কয়েকটা দর্শনীয় স্থান ঘুরে কাটিয়েছিলাম, যার মধ্যে ছিল লাল কেল্লা, জামা মসজিদ, ইন্ডিয়া গেট এবং কুতুব মিনার। আগামীকাল সকালে আমাদের ঢাকা-গামী ফ্লাইট ধরতে হবে। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম। (চলবে)



আমার শিক্ষকদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা



আগের পর্ব পরের পর্ব



ড. নজরুল ইসলাম, কার্টিন ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া






Share on Facebook               Home Page             Published on: 22-Dec-2024

Coming Events:

Lakemba Blacktown Money raised so far


*** মেলার তারিখ ১১ মে থেকে পিছিয়ে ১ জুন করা হয়েছে ***



Blacktown Money raised so far