প্রবাসে পঞ্চাশ বছর (১০) ড. নজরুল ইসলাম
আগের পর্ব পরের পর্ব
চতুর্থ বর্ষের ক্লাস শুরু হওয়ার ঠিক আগ দিয়ে আমরা ভার্না ফিরে এলাম। এ বছরের পড়াশোনা আরও কঠিন ছিল কারণ বিষয়গুলো ছিল বিশেষায়িত। বিষয়গুলো আয়ত্ত করার জন্য উচ্চতর ভাষাগত দক্ষতার প্রয়োজন ছিল যা আমাদের ছিলনা। তাই অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর আমাদের বেশি পরিশ্রম করতে হয়েছিল। হাসুর পড়াশোনার চাপও ছিল একই রকম। আমরা দুজনেই এত ব্যস্ত থাকতাম যে একে অপরের সাথে কথা বলার সময় পেতাম না। ব্যতিক্রম ছিল ছুটির দিনগুলো। ওই দিনগুলো আমরা একসঙ্গে সময় কাটাতাম। অনেকটা সময় চলে যেতো বাজার হাট করতে। বাকি সময় কাটাতাম বাইরে ঘোরাঘুরি করে যার মধ্যে ছিল পার্ক, পর্যটন আকর্ষণ এবং নানা ধরণের বিনোদন স্থান পরিদর্শন। আমরা যখন বাংলাদেশ ছেড়ে ছিলাম, তখন বাংলাদেশে বিনোদন বলতে ছিল শুধু সাদাকালো টিভি আর সিনেমা। এখানে আসার পর আমরা বিভিন্ন ধরনের বিনোদনের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম, যেমন অপেরা, মিউজিক কনসার্ট এবং আউটডোর সিনেমা। প্রথম অপেরা দেখেছিলাম ভার্না আসার পর। ভার্না অপেরা থিয়েটার ছিল একটা অর্ধ-শতাব্দী পুরানো দোতলা ভবন। ভিতরে আমরা অর্জন করেছিলাম এক অনন্য অভিজ্ঞতা। সেখানে দেখেছিলাম নাট্য শিল্পীরা নিজেরাই গান গাইছেন। তাদের গান গাওয়ার ধরনও আলাদা। শিল্পীদের পোশাকে রয়েছে চমক। সামগ্রিকভাবে অপেরা একটা নাটকের চেয়ে বেশি নাটকীয়। আমরা প্রথম মিউজিক কনসার্ট দেখেছিলাম ভার্না ইনডোর স্টেডিয়ামে। শিল্পী ছিলেন কিংবদন্তি বুলগেরিয়ান গায়িকা লিলি ইভানভা। ভার্নায় দেখা আমাদের সবচেয়ে স্মরণীয় সিনেমা হলো ক্রাইম ফিল্ম 'দ্য গডফাদার' প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব। প্রসঙ্গত, বুলগেরিয়ায় বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের প্রবেশ মূল্য খুব কম ছিল। তাই সাধারণ জনগণ এবং আমাদের মতো শিক্ষার্থীদেরও এগুলো দেখার সামর্থ্য ছিল।
আমরা স্টকহোম থেকে একটা টেলিভিশন সেট নিয়ে এসেছিলাম। সেটটা স্টকহোমে ভালোই চলছিল। ভার্নায় চালিয়ে দেখি, ছবি আসছে কিন্তু কোনো সাউন্ড নেই। সেটটা একজন টিভি মেকানিককে দেখানো দরকার। আমরা ভার্নায় কোনো টিভি মেরামতের দোকান চিনতাম না। বুলগেরিয়ান সহপাঠীদের সাহায্য চাইলাম। তারা জানালো, আমাদের ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে একজন তরুণ এসিস্টেন্ট প্রফেসর আছেন। ইলেকট্রিকাল আইটেম মেরামত করা তার হবি। এক বুলগেরিয়ান সহপাঠীকে নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তাকে আমাদের টেলিভিশনের সমস্যার কথা জানালাম। তিনি বললেন, সেটটা নিয়ে এস, দেখি কি করতে পারি। সেটটা তার অফিসে দিয়ে এলাম। কয়েকদিন পর তার অফিসে গিয়ে দেখি সেটটা ঠিক হয়ে গেছে। তিনি জানালেন, বুলগেরিয়ান এবং সুইডিশ টিভি সাউন্ড ব্রডকাস্টিং ফ্রিকোয়েন্সি ভিন্ন হওয়ার কারণে এই সমস্যা হচ্ছিলো। সেই থেকে আমাদের নিয়মিত বুলগেরিয়ান টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখা শুরু হলো। বুলগেরিয়ান টেলিভিশনে ইংরেজি অনুষ্ঠান খুব একটা দেখাতো না। সেই সময় বিবিসি টেলিভিশনের ‘দ্য প্যালিসারস’ ড্রামা সিরিজ দেখানো হচ্ছিলো। সিরিজ দেখা শুরু করলে যা হয়, রোজ রাতে অন্য কাজ বাদ দিয়ে সিরিজ দেখার জন্য বসে থাকতাম। একটা বুলগেরিয়ান অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ে, ‘স্তো মিনুতি না যৃতেলি’ (দর্শকদের একশো মিনিট)। এটা একটা কম্যুনিস্ট দেশে বিরল অনুষ্ঠান ছিল, যাতে দর্শকরা রাজনীতিবিদদের প্রশ্ন করতে পারতেন। আমার প্রিয় ছিল ফুটবল খেলাগুলো। অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ম্যাচ দেখানো হতো। পরদিন বুলগেরিয়ান সহপাঠীদের সাথে টিভিতে দেখানো ম্যাচ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হতো। জাতীয় লিগে খেলা ভার্নার দুটি ফুটবল দলের কথা মনে পড়ে: ‘চের্নো মোরে’ (কৃষ্ণ সাগর) ও ‘স্পার্তাক’ (স্পার্টাকাস)।
শুরুতে আমাদের বুলগেরিয়ান খাবার পছন্দ হয়নি, বিশেষ করে যেগুলো ছাত্রদের ডাইনিং হলে পরিবেশন করা হতো। দেশি মশলা ছাড়া রান্না কার ভালো লাগে! অবশ্য আস্তে আস্তে আমরা বুলগেরিয়ান খাবারে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। কিছু খাবার এতোই ভালো লেগে গিয়েছিলো যে আমরা অপেক্ষায় থাকতাম কবে সেগুলো ডাইনিং হলে পরিবেশন করা হবে। আমার প্রিয় খাবার ছিল টার্কির মাংসের বিরিয়ানি। যদিও এটা কিছুটা তৈলাক্ত ছিল, তবে খেতে ছিল মজাদার। আরেকটা খাবার আমার খুব পছন্দের ছিল, পালং শাক দিয়ে রান্না করা ল্যাম্বের মাংস। এটা বসন্ত কালে দেয়া হতো, সম্ভবত সেই সময়ে পালং শাক পাওয়া যেত বলে। বাংলাদেশে এই খাবারটার সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না। শুনেছি এটা নাকি একটা পাঞ্জাবি খাবার। অস্ট্রেলিয়ায় ইন্ডিয়ান/পাকিস্তানি রেস্টুরেন্টে 'শাক গোশত' নামে বিক্রি হয়। তবে আমি এর উৎপত্তি দেশ সম্পর্কে নিশ্চিত নই। বুলগেরিয়ায় আসার পর আমরা প্রথম সসেজ ও সালামির মতো সংরক্ষিত খাবার দেখেছিলাম। কিন্তু আমাদের মনে ভুল ধারণা ছিল যে এগুলো শুধুমাত্র শুকরের মাংস দিয়ে তৈরি হয় তাই অনেক দিন এগুলো খাইনি। গ্রীষ্মকালে 'তারাতর' নামে একটা ঠাণ্ডা সুপ পরিবেশন করা হতো। তারাতরের প্রধান উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে টক দই, শসা (গ্রেট করা), পানি, রসুন এবং ডিল (মৌরিজাতীয় সুগন্ধি লতা)। বুলগেরিয়া ছাড়াও, দই-ভিত্তিক এই পানীয়টা বেশ কয়েকটা বলকান এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশে জনপ্রিয়। বুলগেরিয়ানদের প্রিয় খাবার হলো ‘কিসেলো ম্লিয়াকো’, বুলগেরিয়ান ভাষায় যার অর্থ ‘টক দুধ’। আসলে এটা এক ধরণের হালকা টক-স্বাদযুক্ত দই। সাধারণত অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি পরিবেশন করা হয়। টক দই বুলগেরিয়ান ঐতিহ্যের অংশ যা কমপক্ষে ৪ হাজার বছর পুরানো। বুলগেরিয়ানদের মতে, টক দই তাদের দীর্ঘায়ুর কারণ।
আমাদের ডাইনিং হলের মেনুতে মাছ থাকতো না বললেই চলে। আমরা 'মাছে–ভাতে বাঙালি', মাছ খেয়ে অভ্যস্ত। মাছ না খেলে কী আমাদের চলে! ভার্না শহরে একটা মাছের দোকান ছিল। কখনো সখনো আমরা সেখান থেকে মাছ কিনতাম। সেগুলো ছিল সার্ডিন এবং কিছু নাম না জানা ছোট মাছ। ওই দোকানে বিশাল একুরিয়ামে রাখা একটা বড় মাছ পাওয়া যেত বুলগেরিয়ান ভাষায় যার নাম 'শারান’ (এক ধরণের কার্প)। ওজন ৩/৪ কিলো হবে। শারান একটা মিঠা পানির মাছ যা বুলগেরিয়ার নদী এবং হ্রদে পাওয়া যায়। শুনেছি মাছটা খুব সুস্বাদু কিন্তু কোনো দিন কেনার সাহস হয়নি। কারণ দোকানদাররা মাছের আঁশ ছাড়িয়ে দেবে কিন্তু টুকরো করে দেবে না। এতো বড় মাছ টুকরো করা কী সোজা। একদিন সাহস করে একটা শারান কিনে ফেললাম। তারপর পড়লাম বিপদে, কেননা মাছ কাটার জন্য সঠিক সরঞ্জাম আমাদের ছিল না। আমাদের হোস্টেলের এক বুলগেরিয়ান দম্পতির কাছ থেকে ছুরি আর হাতুড়ি ধার করলাম। অনেক কষ্টে মাছটা কাটা হলো। তবে কষ্ট সার্থক ছিল। আমরা ফ্রিজে রেখে অনেক দিন মজা করে মাছটা খেয়েছিলাম এবং ভার্নায় বসবাসকারী বাংলাদেশী ছাত্রদের দাওয়াত করে খাইয়েছিলাম।
আমাদের পাসপোর্ট ছিল ৫ বছর মেয়াদি। অগাস্ট মাসে মেয়াদ শেষ হবে। এখনই পাসপোর্ট নবায়ন করা প্রয়োজন কারণ ৬ মাস মেয়াদ না থাকলে কোনো দেশের ভিসা পাওয়া যাবে না। তখন আমাদের সবচেয়ে কাছের বাংলাদেশ এমবাসি ছিল যুগোস্লাভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেড শহরে। জানুয়ারি মাসে দুই সেমিস্টারের মধ্যবর্তী ছুটতে আমরা চলে গেলাম বেলগ্রেডে। আমাদের পরিকল্পনা ছিল সেখানে এক রাত কাটিয়ে পরদিন এমবাসির কাজ শেষ করে পশ্চিম বার্লিনে যাওয়ার। হাসু এর আগে পশ্চিম বার্লিনে যায়নি; ও পশ্চিম বার্লিন দেখতে চায়। যারা আগে বেলগ্রেড গিয়েছিলো তাদের কাছ থেকে জেনেছি, রেল স্টেশনে অনেক লোক তাদের ঘর ভাড়া দেয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। সেখান থেকে সস্তায় ঘর ভাড়া পাওয়া যায়। ‘বিএন্ডবি’-এর আদি সংস্করণ! স্টেশনে নেমে দেখি বেশ কয়েকজন ঘর ভাড়া দেয়ার জন্য চিৎকার করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। সেখান থেকে সহজেই রাত কাটানোর জন্য একটা ঘর পেয়ে গেলাম। পরদিন সকালে আমরা এমবাসিতে চলে গেলাম। তারা জানালেন, যেহেতু আমাদের ‘গ্র্যাটিস পাসপোর্ট’, তাই নবায়নের জন্য ঢাকা থেকে অনুমতি লাগবে। আমরা অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু তারা কিছুতেই রাজি হলেন না। সেই থেকে শুরু হলো গ্র্যাটিস পাসপোর্ট নিয়ে আমাদের বিড়ম্বনা। আমরা পূর্ব বার্লিন হয়ে পশ্চিম বার্লিনে যাচ্ছি। পূর্ব বার্লিনেও বাংলাদেশ এমবাসি রয়েছে। ভাবলাম সেখানে চেষ্টা করে দেখি। সেখানে কাজ হলো। এমবাসির কাউন্সিলর ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি খুব সহায়ক ছিলেন। আমাদের বসিয়ে রেখে এক ঘণ্টার মধ্যে আমাদের পাসপোর্ট নবায়ন করে দিলেন। তবে গ্র্যাটিস পাসপোর্ট নিয়ে আমাদের ভোগান্তির এখানেই শেষ নয়। ভবিষ্যতে এ বিষয়ে আরো লিখবো। আমাদের পাসপোর্ট নবায়ন করার পর আমরা ‘চেকপয়েন্ট চার্লি’ দিয়ে চলে গেলাম পশ্চিম বার্লিনে। সেখানে তিনদিন কাটিয়ে ভার্না ফিরলাম।
মার্চ মাস, আমাদের দ্বিতীয় সেমিস্টার চলছে। আমরা দুজনই পড়াশোনা নিয়ে ব্যাস্ত। আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে পড়াশোনা করছিলাম। আর হাসু পড়াশোনা করছিল চেয়ারে বসে। আরাম করার জন্য ও পা রেখেছিল বিছানার উপর। তখন রাত প্রায় ৯টা বাজে। হঠাৎ অনুভব করলাম বিছানাটা দুলছে। আমি ভাবলাম, হাসু বোধ হয় পা দোলাচ্ছে। পরে দেখি সামনে টেবিলের উপর রাখা টেলিভিশন সেটাটাও দুলছে। তখন বুঝতে পারলাম ভূমিকম্প হচ্ছে। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতে পারছিলাম না। মনো হচ্ছিলো সারা পৃথিবী দুলছে। ইতিমধ্যে হোস্টেলে হৈ চৈ পড়ে গেছে। সবাই ভূমিকম্প ভূমিকম্প বলে চিৎকার করছে। আমরা সিঁড়ি দিয়ে নেমে হোস্টেলের সামনের একটা ফাঁকা জায়গায় জড়ো হলাম। আমাদের রুম তিনতলায় থাকায় নিচতলায় নামতে বিশেষ অসুবিধা হলো না। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এটা ছিল আমার জীবনে প্রথম এবং সবচেয়ে বড় ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতা। পরে জেনেছি, উৎপত্তিস্থলে রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল ৭ দশমিক ৫। উৎপত্তিস্থল ছিল রাজধানী বুখারেস্ট থেকে প্রায় দুইশ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে রোমানিয়ার ‘ভ্রান্সিয়া’ এলাকায়। ভার্না থেকে ভ্রান্সিয়ার দূরত্ব প্রায় চারশো কিলোমিটার। এই ভূমিকম্পে প্রায় ১৬শত লোক প্রাণ হারিয়েছিল, যাদের মধ্যে ৯০ শতাংশই ছিল বুখারেস্টের বাসিন্দা। মৃতের সংখ্যার হিসাবে, এটা ছিল ১৯৭০-এর দশকে বিশ্বের বৃহত্তম ভূমিকম্প।
এ বছর আমরা আবার স্টকহোম যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। যদিও আমাদের স্টকহোম যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল কিছু বাড়তি অর্থ উপার্জন করা, এর মাঝেও আমরা যতটা সম্ভব স্টকহোম যাওয়া আসার পথে এবং স্টকহোমে থাকাকালীন আশেপাশের জায়গাগুলো ঘুরে দেখেছি। এ বছর আমাদের রুট হবে ভার্না-বুখারেস্ট-ওয়ারশ-গ্দানস্ক-স্টকহোম। গ্দানস্ক রাজধানী ওয়ারশ থেকে ৩২০ কিলোমিটার দূরে বাল্টিক সাগর উপকূলে অবস্থিত পোল্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন শহর। এটি পোল্যান্ডের প্রধান সমুদ্রবন্দর। স্টকহোম পৌঁছানোর জন্য সেখান থেকে আমাদের ফেরি ধরতে হবে। আমাদের পোল্যান্ড হয়ে যাওয়ার দুটো কারণ ছিল। প্রথমত, আমরা এর আগে পোল্যান্ড যাইনি এবং দ্বিতীয়ত, আমার এক সহপাঠী আমাদের পোল্যান্ড সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। আমাদের ক্লাসে একটা পোলিশ মেয়ে পড়তো। তার নাম এমিলা। ওরা ছিল পিঠাপিঠি দুই বোন, ছোট বোনের নাম মাওগোশা। ওদের বাবা ভার্নার একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিতে চাকরি করতেন। দুই বোনের সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। আমরা চারজন এক সঙ্গে আড্ডা দিতাম, শহরে ঘুরে বেড়াতাম, কখনো কখনো ভার্নার বাইরে ডে ট্রিপে যেতাম। ওরা জানতো ছুটিতে আমরা স্টকহোম যাবো। ওরা ছুটিতে গ্দানস্ক যাবে। পুরো ছুটি ওরা ওদের অ্যাপার্টমেন্টে কাটাবে। ওরা বললো, স্টকহোম যাওয়ার পথে আমরা অবশ্যই যেন কটা দিন ওদের সঙ্গে কাটিয়ে যাই। এটা ছিল পোল্যান্ড দেখার সুবর্ণ সুযোগ। আমরা সানন্দে ওদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম।
আমাদের ট্রেন তিনটি দেশের উপর দিয়ে যাবে: রোমানিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পোল্যান্ড। এই তিন দেশের ট্রানজিট ভিসা নিতে হলো। এই দেশগুলোর ভার্নায় কনস্যুলেট থাকায় ভিসা নেয়ার জন্য আমাদের সোফিয়া যেতে হলো না। একদিন সকালে আমরা ওয়ারশ-গামী ট্রেনে চেপে বসলাম। ট্রেনে ভার্না থেকে ওয়ারশ পৌঁছাতে প্রায় ২৭ ঘণ্টা সময় লাগে। এতো দিনে আমরা দীর্ঘ ট্রেন যাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমাদের ট্রেন বুখারেস্ট হয়ে যাবে। ভার্না-বুখারেস্ট পরিচিত রুট। দু’বছর আগে এই পথে মস্কো গিয়েছিলাম। বুখারেস্ট থেকে ওয়ারশ যাওয়ার পথে আমাদের সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমানে ইউক্রেন) উপর দিয়ে যেতে হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর দিয়ে যাওয়া মানেই বর্ডারে ট্রেনের চাকা বদলানোর ঝামেলা। এতে সময় বেশি লেগে যায়। ট্রেন চলার পর জানালা দিয়ে দেখা দৃশ্যটা ছিল খুব সুন্দর। প্রতিটি দেশের গ্রামগুলোর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে। ট্রেনে সীমান্ত পার হলে পার্থক্যটা সহজেই চোখে পড়ে। ভাবলে কষ্ট হয়, ইউক্রেনের এই জাগাগুলো যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে গেছে। ইদানীং খবরে লভিভ শহরের নাম শুনছি। আমাদের ট্রেন সেখানে থেমেছিল। লভিভ থেকে পোলিশ সীমান্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার। পোলিশ সীমান্তে ভীষণ কড়াকড়ি ছিল। পরে এ ব্যাপারে এমিলাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ও বলেছিল, অনেক পোলিশ নাগরিক তুরস্কে বিক্রি করার জন্য ছোট ছোট জিনিস নিয়ে যায় আর ফেরার পথে পোল্যান্ডে যে সব পণ্য পাওয়া যায় না, যেমন জিন্স, নাইলন স্টকিংস, সিল্ক স্কার্ফ এবং কফি, কালোবাজারে বিক্রি করার জন্য নিয়ে আসে। পোলিশ সীমান্ত অতিক্রম করার ৭ ঘণ্টা পর আমরা পোঁছে গেলাম ওয়ারশ সেন্ট্রাল রেলওয়ে স্টেশনে। স্টেশনের ভিতরে একটা রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা স্টেশনের চারপাশের এলাকা ঘুরে দেখলাম। সেখানে দেখা একটা উঁচু বিন্ডিংয়ের কথা মনে পড়ে, খুব সম্ভবত সেটা একটা মিউজিয়াম ছিল। সময়ের অভাবে ভিতরে ঢোকা হয়নি।
বিকেলের ট্রেনে আমরা গ্দানস্কের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। দুই বোন, এমিলা ও মাওগোসা আমাদের জন্য স্টেশনে অপেক্ষা করছিল। আমরা সোজা চলে গেলাম ওদের অ্যাপার্টমেন্টে। একটা বড় বিল্ডিংয়ের নিচতলায় ওদের তিন বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্ট। পিছনে একটা ঘেরা জায়গা। রাতের খাবারের পর বিশেষ কথা হলো না। দীর্ঘ ট্রেন যাত্রার পর ক্লান্ত বোধ করছিলাম। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন থেকে শুরু হলো আমাদের গ্দানস্ক এবং তার আশেপাশের দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখা। দুই লোকাল গাইড সঙ্গে থাকায় আমরা অল্প সময়ে অনেক কিছু দেখতে পেরেছিলাম। গ্দানস্কের কাছাকাছি আরও দুটি শহর রয়েছে: সপট এবং গ্দিনিয়া। বাল্টিক সাগরের তীরে অবস্থিত এই তিনটি শহরকে সম্মিলিতভাবে ‘ট্রাই-সিটি’ বলা হয়। আমাদের এই তিনটি শহর দেখার সুযোগ হয়েছিল। গ্দানস্ক শহর সম্পর্কে আমার সবচেয়ে বেশি যা মনে আছে তা হল এর শতাব্দী প্রাচীন গির্জাগুলো। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল 'সেন্ট মেরিস চার্চ'। এটি বিশ্বের তিনটি বৃহত্তম ইট-নির্মিত গির্জাগুলোর মধ্যে একটি। গির্জাটার নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ১৩৪৩ সালে এবং বেশ কয়েকটা সম্প্রসারণের পর সম্পন্ন হয়েছিল ১৫০২ সালে। এর ধারণক্ষমতা ২৫ থেকে ৩০ হাজার। গির্জায় ঢুকলেই যে জিনিসটা সবচেয়ে আগে দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেটা হলো এর ২৯ মিটার উঁচু সিলিং, সঙ্গে লম্বা সাদা পিলারগুলো। রঙিন দাগযুক্ত কাঁচের জানালাগুলো দেখতে খুব সুন্দর। এছাড়া ভিতরে রয়েছে অনেক চিত্রকর্ম ও ভাস্কর্য। সেন্ট মেরিস চার্চ গ্দানস্কের পুরানো শহর এলাকায় অবস্থিত। পুরানো শহরের সরু রাস্তা এবং পুরানো ভবনগুলো আমাদের খুব ভালো লেগেছিলো। গ্দানস্ক সফর কালে আমরা আরো অনেক কিছু দেখেছিলাম যা এই লেখার স্বল্প পরিসরে তুলে ধরা সম্ভব হলো না। এর মধ্যে রয়েছে: নেপচুনের ঝর্ণা, টাউন হল, গোল্ডেন গেট, কয়েকটা মিউজিয়াম এবং অন্যান্য। তিনদিন ব্যস্ততায় কাটানোর পর, আমরা গ্দানস্ক ফেরি টার্মিনালে দুই বোনকে বিদায় জানালাম। (চলবে)
গ্দানস্কে এমিলা ও মাওগোসার সাথে হাসু
আগের পর্ব পরের পর্ব
ড. নজরুল ইসলাম, কার্টিন ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া
|