bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













প্রবাসে পঞ্চাশ বছর (৯)
ড. নজরুল ইসলাম



আগের পর্ব পরের পর্ব

আমরা যখন ভার্না পৌঁছলাম তখন আমাদের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। আপাতত আমরা যে যার রুমে চলে গেলাম। সেখানে মালপত্র রেখে প্রথমে দেখা করলাম আমাদের হোস্টেল সুপারের সঙ্গে। তাকে বললাম – আমরা বিয়ে করেছি। আমাদের বিবাহিত দম্পতিদের জন্য সংরক্ষিত একটা রুম চাই। প্রথমে তিনি আমাদের অভিনন্দন জানালেন। তারপর বললেন – দুঃখিত, বিবাহিত দম্পতিদের জন্য সংরক্ষিত সব রুম সেমিস্টার শুরু হওয়ার আগেই বরাদ্দ করা হয়ে গেছে। আমি তোমার নাম ওয়েটিং লিস্টে লিখে রাখছি। কোন রুম খালি হলে তোমাকে জানাব। তারপর দেখা করলাম হাসুর হোস্টেল সুপারের সঙ্গে। উনারও একই উত্তর। কি আর করা! হাসুদের হোস্টেলের ওয়েটিং লিস্টে নাম লিখিয়ে আমরা চলে এলেম। আমরা যার যার রুম থেকে ক্লাস করতে লাগলাম। এর মধ্যে, আমি আমাদের হোস্টেল ব্যবস্থাপনা কমিটির ছাত্র প্রতিনিধির সাথে দেখা করলাম। তাকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। তাকে আমাদের সমস্যার কথা জানালাম। সে বললো – একটু ধার্য ধরো, দেখি আমি কি করতে পারি। কয়েকদিন পর সে জানালো – আটতলায় (সবচেয়ে উপরের তলায়) একটা রুম খালি আছে। রুমটা ছোট। আপাতত ওটাতেই কাজ চালিয়ে নাও। যখন বিবাহিত দম্পতিদের জন্য সংরক্ষিত রুম খালি হবে তখন সেখানে শিফট করবে। হাসুকে নিয়ে রুমটা দেখতে গেলাম। আমাদের হোস্টেলে যে এতো ছোট রুম আছে তা জানতাম না। দুটি সিঙ্গেল বেড, একটা পড়ার টেবিল আর একটা ছোট ডিসপ্লে কেবিনেট রাখার পর হাঁটাচলা করতে অসুবিধা হচ্ছিলো। তবে রুমটার একটা বাড়তি আকর্ষণ ছিল, সংলগ্ন একটা বারান্দা। সেখানে দাঁড়িয়ে বাইরের দৃশ্য দেখা যেত আর তাজা বাতাস নেয়া যেত। আমরা রাজি হয়ে গেলাম।

শুরু হলো পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে হাসুর সংসার গোছানো। এটা ছিল আমাদের প্রথম সংসার। সেদিন থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম এই মেয়ে ভবিষ্যতে খুব সংসারী হবে। একটা সংসারে কত কিছু লাগে: প্লেট, কাপ, গ্লাস, কাটলারি, হাড়ি পাতিল, আরো কত কী। আস্তে আস্তে সব কেনা হলো। হাসুর ইউনিভার্সিটির ডাইনিং হল ওর ক্লাস থেকে একটু দূরে ছিল। বেশিরভাগ সময়, লাঞ্চ করার জন্য ডাইনিং হলে না গিয়ে ও হোস্টেলে চলে আসতো। পথে হোস্টেলের সামনের ক্যাফেটেরিয়া থেকে ওর প্রিয় খাবার কাবাব আর রুটি কিনে আনতো। ডিনারেও তাই। এখন নিজে রান্না করার সুযোগ হয়েছে। ও রান্না শুরু করে দিলো। একটা ফ্রিজের বড় প্রয়োজন ছিল। রাখার জায়গা না থাকায় ফ্রিজ কিনতে পারছিলাম না। তখন শীতকাল ছিল। তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির কাছাকাছি থাকতো। রান্না খাবার বারান্দায় রেখে দিতাম। ছোটবেলা থেকেই আমার একটা একুরিয়ামের শখ ছিল। আজ সেই শখ পূর্ণ হলো; একটা ছোট একুরিয়াম কিনে ফেললাম। সঙ্গে দুটো গোল্ডফিশ। একুরিয়ামে মাছগুলো দেখতে খুব সুন্দর লাগতো। মাঝেমাঝে চুপচাপ বসে মাছগুলোর সাঁতার কাটা দেখতাম। হাসুর গাছের শখ ছিল। ওর জন্য একটা ফুল গাছ কিনে ফেললাম। একুরিয়াম এবং ফুল গাছের টব রাখা হলো ডিসপ্লে কেবিনেটের উপর।

তৃতীয় বর্ষে আমাদের পড়াশুনা আরো কঠিন হতে লাগলো। প্রতি সেমিস্টারে যোগ হলো একটা নতুন ধরণের বিষয় যার নাম 'প্রজেক্ট'। প্রজেক্ট ছিল পূর্বে শেখা একটা বিষয়ের ব্যবহারিক প্রয়োগ। প্রজেক্ট বিষয়গুলোতে আমাদের ডিজাইনের কাজ করতে হতো। যেমন, আমাদের ‘মেরিন ডিজেল ইঞ্জিন’ নামে একটা বিষয় ছিল। সঙ্গে ছিল ‘মেরিন ডিজেল ইঞ্জিন (প্রজেক্ট)’ নামে আরেকটা বিষয়। প্রজেক্ট বিষয়টাতে আমাদের একটা মেরিন ডিজেল ইঞ্জিন ডিজাইন করতে হয়েছিল। প্রতিটি শিক্ষার্থীর ইনপুট ডাটা ছিল আলাদা। তাই একে অপরকে কপি করার সুযোগ ছিল না। প্রজেক্টের কাজে সারা সেমিস্টার ব্যস্ত থাকতে হতো। আরেকটা সমস্যা ছিল, সেই সময়ে বুলগেরিয়ায় কোনো সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর পাওয়া যেত না। একটা বেসিক ক্যালকুলেটর পাওয়া যেত যেগুলোর ফাংশন যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ, বর্গমূল এবং শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। মেমরির ফাংশন পর্যন্ত ছিল না। প্রজেক্ট নিয়ে একটা ঘটনা মনে পড়ে। সারারাত জেগে প্রজেক্টের কাজ শেষ করে সকালে আমি ইউনিভার্সিটি চলে গেলাম। হাসু তখনও ঘুমাচ্ছে। ওর ইউনিভার্সিটি কাছে হওয়ায় ও দেরি করে উঠতো। প্রজেক্ট জমা দেয়ার পর ডাইনিং হলে দুপুরের খাবার খেয়ে আমি হোস্টেলে ফিরে এলাম। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা। ৫/৬ ঘণ্টা পর হাসুর ডাকে আমার ঘুম ভাঙলো। ও বলছিলো – কী মরার মত ঘুমচ্ছ, বাইরের জামা-জুতো পর্যন্ত খোলো নি। এই ছিল আমার অবস্থা!

প্রথম সেমিস্টার শেষ হওয়ার সপ্তাহ-খানে আগে হাসুর হোস্টেল সুপার জানালেন, সেমিস্টার শেষে উনাদের হোস্টেলে বিবাহিত দম্পতিদের জন্য সংরক্ষিত একটা রুম খালি হবে। আমরা চাইলে সেই রুমটা পেতে পারো। আমরা খুব ভাগ্যবান ছিলাম কারণ শিক্ষাবর্ষের মাঝামাঝি বিবাহিত দম্পতিদের জন্য সংরক্ষিত রুম পাওয়া খুবই বিরল ছিল। পরীক্ষার পর আমরা নতুন রুমে চলে গেলাম। এই রুমটা অনেক বড়। সঙ্গে ফার্নিচারও বেশি। ডিসপ্লে কেবিনেটটা আগেরটার চেয়ে চার গুণ বড়। পড়ার টেবিলটাও বড়। আগের টেবিলে আমার ড্রয়িং বোর্ড রাখতে অসুবিধা হতো। শুরু হলো নতুন করে সংসার সাজানো। প্রথমেই একটা ফ্রিজ কিনে ফেললাম। তাতে খাবার সংরক্ষণের সমস্যার সমাধান হলো। এর মধ্যে বসন্তকাল এসে গেছে। এতে বাইরে ঘোরাঘুরি করা সহজ হয়ে গেলো। মাঝে মাঝে সানডে মার্কেটে চলে যেতাম। সেখান থেকে তাজা শাকসবজি কিনতাম। নজর রাখতাম নতুন কিছু পাওয়া যায় কিনা। একদিন সেখানে ছোলা পেয়ে গেলাম। ছোলা ভাজা আমার খুব প্রিয়। অনেকদিন পর ছোলা ভাজা খেলাম। অনেকে হয়তো ভাবছেন, এইসব সামান্য ঘটনা নিয়ে কেন লিখছি। প্রবাস জীবনের এইসব সামান্য ঘটনাও যে কতটা আবেগময় তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না।

জানি না আমার পোস্ট করা ছবি থেকে লক্ষ্য করেছেন কিনা, বুলগেরিয়ায় থাকাকালীন আমার এবং অন্যান্য বাংলাদেশী ছাত্রদের লম্বা চুল ছিল। লম্বা চুল রাখা তখন ফ্যাশন ছিল। পশ্চিমা বিশ্বের অনেক রক গ্রুপের সদস্যদের লম্বা চুল ছিল, যেমন বিটলস এবং দ্য রোলিং স্টোনস। ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্সটিটিউটে থাকাকালীন আমরা তাদের অনুকরণ করে লম্বা চুল রাখতে শুরু করি। তাছাড়া প্রথম প্রথম চুলকাটার খরচও বেশি মনে হয়েছিল। তখন সবকিছু হিসাব করতাম বাংলাদেশী টাকায়! ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে আমাদের লম্বা চুল রাখার কারণ বদলে যায়। বুলগেরিয়ান ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের কঠোর শৃঙ্খলা মেনে চলতে হতো। 'কমসোমল' নামে বুলগেরিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির যুব শাখার দায়িত্ব ছিল এই শৃঙ্খলা বজায় রাখার। প্রত্যেক ইউনিভার্সিটিতে কমসোমলের শাখা ছিল। এই সংগঠনের নেতারা শিক্ষার্থীদের ওপর নজরদারি করতো যাতে তারা পশ্চিমা সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত না হয়। তারা মনে করতো লম্বা চুল রাখা পশ্চিমা সংস্কৃতির অংশ। তাই লম্বা চুল রাখা নিষিদ্ধ করেছিল। আমরা কমসোমলের কঠোর নিয়ম মানতে বাধ্য ছিলাম না। তাই প্রতিবাদ হিসেবে আমরা লম্বা চুল রেখেছিলাম।

আবার জুলাই মাস এসে গেলো। আমাদের ক্লাস শেষ। ফাইনাল পরীক্ষার আগে এক সপ্তাহের ছুটি চলছে। ইতিমধ্যে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, গ্রীষ্মের ছুটিতে আমরা আবার স্টকহোম যাব। কিছু সঞ্চয়ের প্রয়োজন। দেশের সবাই মনে করে স্কলারশিপ নিয়ে ৬/৭ বছর বিদেশে পড়াশোনা করার পর দেশে ফেরার সময় টিভি, ফ্রিজ, ইলেকট্রনিক আইটেমের মতো অনেক বিলাসবহুল জিনিস সঙ্গে নিয়ে আসবে। তারা জানে না, সমাজতান্ত্রিক দেশ এবং পশ্চিমা দেশগুলোতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের আর্থিক পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে বৃত্তির পরিমাণ কম; জীবনযাত্রার খরচ কম বলে দিন চলে যায়। কিন্তু সঞ্চয় খুব কম। পরীক্ষার পর আমাকে আবার মাসব্যাপী কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। হাসুর তা নেই। লেখাপড়া শেষ করার পর ওদের এক বছর ইন্টার্নশিপ করতে হবে। হাসু একমাস বসে থাকতে চাইলো না। সে একাই স্টকহোমে গিয়ে কাজ শুরু করতে চায়। এতটা পথ আমি ওকে একা ছাড়তে নারাজ। পরে ঠিক হলো, ভার্না থেকে ও বিমানে পূর্ব বার্লিন যাবে। সেখান থেকে ট্রেনে স্টকহোম। পরের ঘটনা হাসুর কাছ থেকে শোনা।

পূর্ব বার্লিন হয়ে হাসু নিরাপদে স্টকহোমে পৌঁছেছিলো। প্রথমে ওকে একটা থাকার জায়গা খুঁজে নিতে হবে। স্টকহোম সেন্ট্রাল স্টেশনের কাছেই একটা রিয়েল এস্টেট এজেন্টের অফিস ছিল। এজেন্টের নাম 'অল রুম'। হাসু বন্ধুদের কাছ থেকে আগেই এই তথ্য সংগ্রহ করেছিল। লকারে মালপত্র রেখে, ও চলে গেলো সেই এজেন্টের অফিসে। সেখানকার সেক্রেটারিকে ও জানালো, থাকার জন্য ওর একটা রুম সাবলেট দরকার। আপাতত ও একা থাকবে, মাস-খানেক পর ওর স্বামী যোগ দেবে। ভেকান্সি লিস্ট দেখে সেক্রেটারি বললেন, একটা ঘর খালি আছে। ঘরটা একজনের জন্য, তবে তুমি চাইলে তোমার স্বামীকে নিয়ে থাকতে পারো। হাসু ঘরটা সম্পর্কে আরও জানতে চাইল। বিশেষ করে সে তার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিল। সেক্রেটারি বললেন, এটা ক্রিস্টিনবার্গ মেট্রো স্টেশনের কাছে একটা দুই বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্ট। সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে মেট্রোরেলে ১৫ মিনিটের পথ। মালিক একা থাকেন। তিনি অব্যবহৃত বেডরুমটা সাবলেট দিতে চান। আমি তাকে অনেক দিন ধরে চিনি। তিনি একজন জেন্টলম্যান। তোমার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করো না। হাসুর মাথা গোঁজার জন্য একটা ঘর দরকার। তাছাড়া ভাড়াও ছিল কম। ও রাজি হয়ে গেলো।

সেক্রেটারি বলে দিয়েছিলেন, অ্যাপার্টমেন্টের মালিক ৫টা পর্যন্ত কাজ করেন। বাসায় ফিরতে ফিরতে হয়তো ৩০/৪০ মিনিট লাগবে। তখনও ৫টা বাজতে অনেকটা সময় বাকি। সেন্ট্রাল স্টেশনের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে হাসু ৪টা নাগাদ চলে গেলো ক্রিস্টেনবার্গের সেই অ্যাপার্টমেন্টে। মালপত্র নিয়ে বসে রইলো অ্যাপার্টমেন্টের সামনে। সাড়ে ৫টার দিকে এলেন অ্যাপার্টমেন্টের মালিক। কিন্তু সমস্যা হলো তিনি শুধুমাত্র সুইডিশ ভাষায় কথা বলতে পারেন। হাসু তো সুইডিশ ভাষা জানেনা, তাই আকার ইঙ্গিতে কথা চলছিল। তিনি হাসুকে অ্যাপার্টমেন্টের যে অংশটা সে ব্যবহার করতে পারবে সেটা দেখিয়ে দিলেন (রুম, বাথরুম এবং কিচেন)। অ্যাপার্টমেন্টের লেআউট ডিজাইন এমন ছিল যে সাবলেট অংশটা ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন। শুধুমাত্র কিচেন শেয়ার করতে হবে। পরদিন সকালে হাসু চলে গেলো জব সেন্টারে। ভাগ্য ভালো, সেখানে একটা ভালো চাকরির সন্ধান পেয়ে গেলো। চাকরিটা ছিল স্টকহোম গ্র্যান্ড হোটেলে। ১৮৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত, গ্র্যান্ড হোটেল হলো স্টকহোমের সবচেয়ে বনেদী হোটেল। ওই দিনই ও দেখা করলো গ্র্যান্ড হোটেলের হিউমান রিসোর্স ম্যানেজার মিস্টার মেলসনের সঙ্গে। গত বছর হোটেলে কাজ করার অভিজ্ঞতার কারণে কিনা জানিনা, হাসু চাকরিটা পেয়ে গেলো। গ্র্যান্ড হোটেলে কর্মরত কর্মচারীদের জন্য একটা রেস্টুরেন্ট ছিল। হাসুর চাকরি হলো সেই রেস্টুরেন্টে। সেখানে দুই শিফটে ৮ জন কাজ করতো। তাদের সবাই ছিল বিদেশী ছাত্রী। তাদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া থেকে আগত (সিডনি-বাসী) দুই জন সহকর্মীও ছিল। এটা ছিল কোনো অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকের সাথে আমাদের প্রথম যোগাযোগ।

এক মাস পর আমি স্টকহোম পৌঁছলাম। হাসু মিস্টার মেলসনের সাথে আমার চাকরির ব্যাপারে আগেই কথা বলে

রেখেছিলো। পরদিন উনার সঙ্গে দেখতে করতে গেলাম। অত্যন্ত অমায়িক মানুষ তিনি। এত বড় হোটেলের হিউমান রিসোর্স ম্যানেজার মনেই হয় না। তিনি আমার চাকরির ব্যাপারে আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন। ফোনে একজনকে ডেকে পাঠালেন। তিনি আসার পর মিস্টার মেলসন আমাকে বললেন, ইনি হচ্ছেন আমাদের ‘হেড শেফ’। তোমার কাজ কিচেনে। তুমি উনার সঙ্গে যাও। উনি তোমার কাজ বুঝিয়ে দেবেন। আমরা চলে গেলাম গ্র্যান্ড হোটেলের বেসমেন্টে যেখানে কিচেন অবস্থিত। সেই প্রথম দেখলাম একটা বড় হোটেলের কিচেন কি ভাবে চলে। বিভিন্ন বিভাগে বিভক্ত কিচেন: মেইন কিচেন (গরম এবং ঠাণ্ডা), সুপ বিভাগ, প্যান্ট্রি বিভাগ, পেস্ট্রি বিভাগ, বেকিং বিভাগ এবং ডিশওয়াশিং বিভাগ। আমার চাকরি হলো ডিশওয়াশিং বিভাগে। কাজটা কঠিন ছিল না। ব্যবহৃত প্লেটগুলো কনভেয়ার ডিশওয়াশারের একপাশে সারিবদ্ধ করে রাখতে হবে আর ধোয়া প্লেটগুলো অন্যপাশ থেকে উঠিয়ে নিতে হবে। পরদিন থেকে আমি কাজে লেগে গেলাম। হাসুর বসকে বলে আমরা একই শিফটে কাজ করতাম। আমাদের কাজ ছিল ইভনিং শিফটে, বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে রাত দেড়টা পর্যন্ত। রাতে যখন কাজ থেকে বের হতাম, তখনও আকাশে আলোর আভা থাকত।

ব্যস্ততার মাঝে দিন চলে যাচ্ছে। এর মাঝেও, সুযোগ পেলেই স্টকহোমের আকর্ষণীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখতাম। স্টকহোম সিটি সেন্টার এলাকাটা আমাদের খুব ভালো লাগতো। সেখানে প্রায়ই যাওয়া হতো কেননা স্টকহোম ট্রানজিট নেটওয়ার্কের কেন্দ্রস্থল সেন্ট্রাল স্টেশন ছিল সিটি সেন্টারের খুব কাছাকাছি। স্টেশন থেকে বেরুলেই রাস্তার একপাশে স্টকহোমের সবচেয়ে বড় ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর 'অলেন্স সিটি'। সুযোগ পেলেই যেতাম সেখানে। নজর রাখতাম আমাদের কেনার মতো কিছু ‘সেলে’ বিক্রি হচ্ছে কিনা। ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোরের নিচ তলায় ছিল গ্রোসারি ডিপার্টমেন্ট। সেখান থেকে কিনতাম প্রয়োজনীয় গ্রোসারি সামগ্রী। একটু এগুলেই সার্গেলস স্কয়ার। বিখ্যাত সুইডিশ ভাস্কর জোহান টোবিয়াস সার্গেল (১৭৪০-১৮১৪) এর নামানুসারে স্কয়ারটার নামকরণ করা হয়েছে। মূলত এটা হচ্ছে একটা বড় রাউন্ড এবাউট। এখন থেকে তিন দিকে চলে গেছে স্টকহোমের তিনটি প্রধান রাস্তা। রাউন্ড এবাউটের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে ৩৭ মিটার উঁচু একটা কাঁচের স্মৃতিস্তম্ভ। স্মৃতিস্তম্ভটা ঘিরে রয়েছে অনেকগুলো ফোয়ারা। এই অপূর্ব সুন্দর দৃশ্যটা দিন এবং রাত উভয় সময়ই দেখতে ভালো লাগতো। কাছাকাছি একটা ব্যাংক ছিল। সেখানে অবাক হয়ে দেখতাম, লোকজন ব্যাংকের বাইরে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে টাকা তুলছে। তখন অটোমেটেড টেলার মেশিন (এটিএম) সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না।

সার্গেলস স্কয়ারের কাছাকাছি ছিল 'কালচার হাউস', স্টকহোমের একটা প্রধান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। ভিতরে একটা লাইব্রেরি ছিল। আমরা সেখানে ইংরেজি পত্রপত্রিকা পড়তে যেতাম। কালচার হাউস সেন্ট্রাল স্টেশনের চেয়ে নিচু জমিতে অবস্থিত ছিল। সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে সেখানে যেতে সিঁড়ি দিয়ে নামতে হতো। আনুমানিক ২০/২৫ ধাপের এই সিঁড়ি; প্রস্থ ২০ মিটারের মতন হবে। এই সিঁড়িতে বসে আমরা আড্ডা দিতাম। তখন মোবাইল ফোন ছিল না। তাই বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা ছিল কঠিন। এখানে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়ে যেত। কাছেই ছিল 'কিংস গার্ডেন', নানা ধরণের ফুল, গাছ-গাছালি এবং মানুষে ভরা একটা সুন্দর পার্ক। এছাড়াও এখানে রয়েছে কয়েকটা সুন্দর ভাস্কর্য। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো 'মলিনের ঝর্ণা' ভাস্কর্যটি। ব্রোঞ্জে ঢালাই করা ভাস্কর্যটি ১৮৭৩ সালে উদ্বোধন করা হয়েছিল। নামকরণ করা হয়েছিল ভাস্কর জিন পিটার মোলিন (১৮১৪-১৮৭৩) এর নামে। কিংস গার্ডেনের কাছেই হলো গ্র্যান্ড হোটেল। হোটেলের সামনেই সমুদ্র। সেখানে বোট ক্রুজের জন্য টুরিস্টদের ভিড় থাকতো। সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে গ্র্যান্ড হোটেলে যাওয়ার বাস ছিল। সেটা অনেক ঘুরে যেত। আমরা সময় বাঁচানোর জন্য কিংস গার্ডেনের ভিতর দিয়ে শর্টকাট রাস্তায় পায়ে হেঁটে কাজে যেতাম। পর পর তিন বছর (১৯৭৬-৭৮) গ্রীষ্মের ছুটিতে আমরা গ্র্যান্ড হোটেলে কাজ করছিলাম। তাই এতো বছর পরেও জায়গাগুলো চোখের সামনে ভাসে।

আমাদের বুলগেরিয়া ফেরার সময় এসে গেলো। ট্রেনে আমাদের ওপেন টিকিট থাকতো। ফলে আমরা গন্তব্য স্থলের আগে যেকোনো স্টেশনে নামতে পারতাম। এই সুযোগটা বহুবার কাজে লাগিয়েছি। যেই শহর দেখতে চেতাম সেই শহরে সকাল সকাল পৌঁছে যেতাম। সারাদিন ঘোরাঘুরি করে আবার রাতের ট্রেন ধরতাম। এতে হোটেলে থাকার খরচ বেঁচে যেত। এবার ভার্না ফেরার পথে আমরা ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন ঘুরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাদের ট্রেন সুইডেনের তৃতীয় বৃহত্তম শহর 'মালমো' হয়ে যাবে। ট্রেনে মালমো থেকে কোপেনহেগেন ৪০ মিনিটের জার্নি। দিনে অনেকগুলো ট্রেন ছিল। আমরা সকালের ট্রেনে কোপেনহেগেন পৌঁছে গেলাম। মালমো-কোপেনহেগেন জার্নিটা খুবই মনোরম ছিল, বিশেষ করে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ 'ওরেসুন্ড ব্রিজ'-এর উপর দিয়ে যাওয়ার অংশটা। আমরা কোপেনহেগেনে অল্প সময়ের জন্য ছিলাম, তাই শহরটার কথা খুব একটা মনে নেই। তবে সেখান থেকে হিন্দি ছবির গানের একটা এলপি রেকর্ড কিনেছিলাম। বুলগেরিয়ায় থাকাকালীন সেই রেকর্ডের গানগুলো যে কতবার শুনেছি! সেই রেকর্ডে আশা ভোঁসলের গাওয়া ‘ঝুমকা গিরা রে’ গানটা ছিল। আজও গানটা শুনলে ইউনিভার্সিটি জীবনের সোনালী দিনগুলোর কথাটা মনে পড়ে যায়। (চলবে)



মলিনের ঝর্ণার সামনে ১৯৭৬ সালে তোলা আমাদের ছবি



আগের পর্ব পরের পর্ব



ড. নজরুল ইসলাম, কার্টিন ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া








Share on Facebook               Home Page             Published on: 16-Oct-2024

Coming Events: