bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













প্রবাসে পঞ্চাশ বছর (৮)
ড. নজরুল ইসলাম



আগের পর্ব পরের পর্ব

মস্কো থেকে টেলিগ্রামের মাধ্যমে হাসুকে আমার ভার্না পৌঁছানোর দিনক্ষণ জানিয়েছিলাম। আমার ট্রেন ভার্না পৌঁছবে রাত ১১টায়। এত রাতে একা একা স্টেশনে আসাটা হাসুর পক্ষে সহজ হবে না। তাই ওকে স্টেশনে আসতে বারণ করেছিলাম। স্টেশনে নেমে দেখি হাসু তার বুলগেরিয়ান রুমমেটকে নিয়ে হাজির। প্রায় চার মাস আমাদের দেখা হয়নি, তাই হাসুর মন মানে নি। রাতে আর তেমন কথা হলো না। ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেলাম হোস্টেলে। পরদিন সকালে আমরা আবার মিলিত হলাম – অনেক কথা হলো, গল্প হলো। চার মাসে জমানো কথা কি সহজে শেষ হয়? তবে ওর সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, ও যতটা আমাকে মিস করবে ভেবেছিলাম ততটা মিস করেনি। তার কারণ হলো হাসু অত্যন্ত মিশুক মেয়ে। সে অতি সহজে মানুষকে আপন করে নিতে পারে। ও ক্লাসে যেতো পায়ে হেঁটে। রাস্তার দুই পাশের বাড়ির অনেক বাসিন্দাই হাসুকে কমবেশি চিনতো। তাদের মধ্যে হাসুর বয়সী তানিয়া নামে একটা মেয়ে ছিল। সে ছিল হাই স্কুলের শেষ বর্ষের ছাত্রী, আগামী বছর থেকে ইউনিভার্সিটি শুরু করবে। তাই সে হাসুর কাছ থেকে ইউনিভার্সিটি জীবন সম্পর্কে জানতে আগ্রহী ছিল। ক্রমশ তানিয়ার সঙ্গে হাসুর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তানিয়াদের বাসায় হাসুর আসা যাওয়া শুরু হয়। তানিয়া ছিল বাবামার একমাত্র সন্তান। ওর বাবামা হাসুকে খুব পছন্দ করতেন। ছুটিতে হাসু তানিয়ার সাথে অনেকটা সময় কাটিয়েছিল।

আরেকটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, গ্রীষ্মের ছুটিতে হাসু একটা জার্মান ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিল। রোলটা ছিল একটা উন্নয়নশীল দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অংকের শিক্ষকের। অভিনয় তেমন কঠিন ছিল না। তবে ডায়ালগ বলতে হবে জার্মান ভাষায়। বেশ কষ্ট করে ওকে সেই ডায়ালগ মুখস্থ করতে হয়েছিল। অভিনয় নিয়ে ব্যস্ততার মাঝে হাসুর দিনগুলো কেটেছিল। আর সেই সঙ্গে পেয়েছিল মোটা অংকের পারিশ্রমিক।

গ্রীষ্মের ছুটিতে আমার রুমমেট আনোয়ার ও কামরুল স্টকহোম ঘুরে এসেছে। আমরা যখন সোফিয়ায় দারভেনিৎসা স্টুডেন্টস সিটিতে ছিলাম তখন শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান এবং অন্যান্য দেশের সিনিয়র ছাত্রদের কাছ থেকে শুনেছিলাম, তারা গ্রীষ্মের ছুটিতে পশ্চিমা দেশে যেতেন। উদ্দেশ্য কিছু বাড়তি অর্থ উপার্জন। পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে ছিল: যুক্তরাজ্য,পশ্চিম জার্মানি এবং সুইডেন। এই তিনটি দেশের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল সুইডেন। সুইডেনে মজুরি ছিল বেশি এবং শক্তিশালী ইউনিয়নের কারণে বিদেশী শ্রমিকদের শোষণ ছিল কম। সুইডেন একটা শীত প্রধান দেশ। সেখানে প্রায় নয় মাস শীত থাকে। জুন মাস থেকে গরম পড়া শুরু হলে সুইডিশরা বেরিয়ে পড়ে গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে। ফলে সেই সময় সুইডেনে শ্রমিকের অভাব দেখা দিতো। এই কারণে, সুইডিশ সরকার সারা বিশ্বের শিক্ষার্থীদের জন্য গ্রীষ্মকালে ওয়ার্ক পারমিটের শর্ত শিথিল করেছিল। তবে সুইডেনে প্রবেশের জন্য বৈধ ভিসার প্রয়োজন হতো। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সুবিধা ছিল তখন সুইডেন ভ্রমণের জন্য বাংলাদেশি নাগরিকদের ভিসা লাগতো না। টুরিস্ট হিসেবে প্রবেশ করার পর কাজ খুঁজে পেলে তারা ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্টে আবেদনের মাধ্যমে ওয়ার্ক পারমিট পেয়ে যেত। আনোয়ার, কামরুল এবং সোফিয়ায় বসবাসরত আমাদের ব্যাচের কয়েকজন এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ছিল। ওরা তিন মাস স্টকহোমে কাজ করে বেশ অর্থ সঞ্চয় করতে পেরেছিল। এছাড়া পশ্চিমা দেশে বসবাসের অভিজ্ঞতা ছিল বাড়তি বোনাস।

আমাদের দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস শুরু হলো ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি। পড়াশুনা ধীরে ধীরে কঠিন হতে লাগলো। প্রথম বর্ষে পড়া কিছু বিষয়, যেমন গণিত, পদার্থবিদ্যা এবং রসায়ন, আমরা বাংলাদেশে কলেজে এবং বুলগেরিয়ায় ভাষা ইন্সটিটিউটে অধ্যয়ন করেছি। দ্বিতীয় বর্ষে যোগ হলো নতুন নতুন বিষয়। নতুন বিষয়গুলোর মধ্যে একটা বিষয় ছিল 'মেকানিকাল ড্রয়িং'। বিষয়টা আয়ত্ত করতে আমাদের বেশ পরিশ্রম করতে হয়েছিল। আমাদের ক্লাসে বেশির ভাগ বুলগেরিয়ান শিক্ষার্থী এসেছিল হাই স্কুল শেষ করে। আর কিছু শিক্ষার্থী এসেছিল টেকনিক্যাল কলেজ শেষ করে। যারা টেকনিক্যাল কলেজ থেকে এসেছিল তারা এই বিষয়ে পারদর্শী ছিল কারণ তারা আগে এই বিষয়ে পড়াশোনা করেছিল। আমরা তাদের সাহায্য নিলাম। আমাদের প্রথম হোম-ওয়ার্ক ছিল কালি দিয়ে ‘ক্রেন হুক’ আঁকা। ক্রেন হুক আঁকা এমনিতেই কঠিন কারণ এটি বেশ কয়েকটি স্পর্শক বৃত্ত নিয়ে গঠিত। তাছাড়া কালিতে আঁকার অভিজ্ঞতা আমাদের ছিল না। আঁকতে গিয়ে কত কাগজই না নষ্ট করেছি! তবে শেষমেশ হোম-ওয়ার্কটা জমা দিতে পেরেছিলাম। পুরো সেমিস্টার জুড়ে সহপাঠীদের সাহায্য চলতে থাকে। সহপাঠীদের সাহায্য ছাড়া বিষয়টা পাস করা কঠিন হতো।

মেডিসিনের ছাত্রী হওয়ায় হাসুর পড়াশুনার চাপ ছিল আরো বেশি। অ্যানাটমি, ফিজিওলজি এবং অন্যান্য নতুন বিষয়গুলো সামলাতে ও ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলো। অনেকটা সময় ওকে ল্যাবে কাটাতে হতো। হোস্টেলে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যেত। প্রতি সন্ধ্যায় আমাদের দেখা করা বন্ধ হয়ে গেলো। বেশ চিন্তায় থাকতাম, ও ঠিকমতো হোস্টেলে ফিরল কিনা। আমরা পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। ইতিমধ্যে আমাদের সম্পর্কের দু'বছর পেরিয়ে গেছে। আমরা একে অপরকে অনেকটাই জেনে গেছি। এখানে বিবাহিত দম্পতিদের জন্য সুন্দর থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। তাছাড়া দু'জন্যেই স্কলারশিপ পাচ্ছি। ফলে আর্থিক কোন সমস্যা হবে না। সবকিছু ভেবে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আগামী গ্রীষ্মের ছুটিতে স্টকহোমে বিয়ে করার।

আমাদের পরীক্ষা শেষ হলো জুলাই মাসের মাঝামাঝি। তারপর ছিল মাসব্যাপী কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন। আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহে আমরা চলে গেলাম সোফিয়া। সেখানে দুদিন কাটিয়ে এক দিন সকালে ট্রেনে উঠলাম স্টকহোমের উদ্দেশ্যে। আমাদের রুট ছিল সোফিয়া-পূর্ব বার্লিন-স্টকহোম। সোফিয়া-পূর্ব বার্লিন চেনা পথ। দু’বছর আগে এই পথে পশ্চিম বার্লিন গিয়েছিলাম। তখন আমি একা ভ্রমণ করেছিলাম। তাই খুব একটা মজা পাইনি। সঙ্গী ছাড়া একটানা ২৮ ঘণ্টা ট্রেনে কাটানো কঠিন। এবার সঙ্গে হাসু থাকায় গল্প করতে করতে সময়টা ভালোই কেটে গেলো। দুপুর নাগাদ আমরা পোঁছালাম বার্লিনের ‘অস্ট বানহফ’ স্টেশনে। এখন থেকে রাতে আমাদের স্টকহোম যাওয়ার ট্রেন ধরতে হবে। হাতে বেশ কিছুটা সময়। লকারে মালপত্র রেখে, আমরা বার্লিন রেপিড ট্রানজিট রেলওয়ে ধরে চলে গেলাম পূর্ব বার্লিনের সিটি সেন্টার ‘আলেক্সান্ডার প্লাজা’, পূর্ব বার্লিন-বাসী এবং পর্যটকদের জন্য একটা জনপ্রিয় মিলনস্থল। এলাকাটা অনেক দোকান, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর এবং রেস্তোরাঁয় ভরা। প্রথমে একটা রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ সেরে নিলাম। আলেক্সান্ডার প্লাজা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটা বিশাল চত্বর যেখানে যান চলাচল নিষিদ্ধ ছিল। তাই পায়ে হেঁটে জাগাটা দেখতে অসুবিধা হলো না। সেখানে দেখা একটা বিশ্ব ঘড়ির কথা মনে পড়ে। এই ঘড়ি থেকে বিশ্বের ১৪৮টা প্রধান শহরের বর্তমান সময় জানা যায়। সম্পূর্ণ যান্ত্রিকভাবে চালিত এত বড় বিশ্ব ঘড়ি আমি আর কোথাও দেখিনি।

রাতে যখন স্টকহোম-গামী ট্রেনে উঠলাম তখন আমরা খুব ক্লান্ত। ট্রেন চলতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙল ট্রেন থামার পর। ততক্ষণে আমরা এই রুটের শেষ পূর্ব জার্মান শহর 'রস্টক' পৌঁছে গেছি। এখান থেকে বাল্টিক সাগর পাড়ি দেয়ার জন্য ফেরি ধরতে হবে। ভাবছিলাম ফেরিতে ওঠার জন্য ট্রেন থেকে নামতে হবে। না, ট্রেন থেকে নামতে হলো না। আমাদের ট্রেন ফেরিতে ঢুকে গেলো। ‘ট্রেন ফেরি’তে চড়ার এটাই ছিল আমরা প্রথম অভিজ্ঞতা। কিছুক্ষণ পর আমরা চলে গেলাম ফেরির উপর তলায়। সেখানে দুটো খালি সিট দেখে আমরা বসে পড়লাম। কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করছিলাম। রাতের আঁধারে সমুদ্রের কালো পানি ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। প্রায় ৭ ঘণ্টা পর আমরা পৌঁছে গেলাম সুইডিশ বন্দর ‘ট্রেলেবোর্গ’-এ। এখন থেকে সুইডেনের তৃতীয় বৃহত্তম শহর 'মালমো' হয়ে স্টকহোম আরো ৫/৬ ঘণ্টার জার্নি।

দুপুর একটা নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম স্টকহোম সেন্ট্রাল স্টেশন, সুইডিশ ভাষায় যার নাম ‘টি সেন্ট্রালেন’। বন্ধুদের কাছ থেকে আগেই জেনে নিয়েছিলাম ট্রেন থেকে নামার পর কি কি করতে হবে। সেই অনুযায়ী, স্টেশন থেকে কিনে নিলাম স্টকহোম মান্থলি ট্রানজিট পাস। এই পাস থাকলে এক মাসের জন্য সমগ্র স্টকহোম ট্রানজিট নেটওয়ার্কে (মেট্রোরেল, বাস, ট্রেন এবং ফেরি) সীমাহীন ভ্রমণ করা যায়। তখনকার দিনে স্টকহোমে 'ফোরাম' নামে একটা স্টুডেন্টস হোস্টেল ছিল। গ্রীষ্মের ছুটিতে হোস্টেলের অনেক শিক্ষার্থী সিট খালি করে বাড়ি চলে যেত। হোস্টেল কর্তৃপক্ষ সেই সিটগুলো টুরিস্টদের ভাড়া দিতো। বন্ধুদের কাছ থেকে হোস্টেলের ঠিকানা নিয়ে এসেছিলাম। মেট্রোরেল ধরে চলে গেলাম সেখানে। ভাগ্য ভালো, থাকার জায়গা পেয়ে গেলাম সেখানে। পরদিন সকালে কাজের সন্ধানে চলে গেলাম জব সেন্টারে। প্রতিদিন সকালে সেখান থেকে চাকরির শূন্যপদের তথ্য পাওয়া যায়। সেখানে বিদেশী ছাত্রদের ভিড়। শূন্যপদের চেয়ে প্রার্থীর সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। তবে মহিলা প্রার্থীর সংখ্যা কম থাকায় হাসু একটা চাকরির সন্ধান পেলো। সেটা ছিল হোটেল ক্লিনিং জব। হোটেলে গিয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করতে হবে। পছন্দ হলে তিনি চাকরি দেবেন। হোটেলে গিয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করলাম। আমরা বুলগেরিয়া থেকে এসেছি জানার পর তিনি জানালেন তার মাতৃভূমি যুগোস্লাভিয়া (সার্বিয়া)। আমরা তখন সার্বিয়ান ভাষায় কথা শুরু করলাম। কারো সাথে তার নিজের ভাষায় কথা বলা অনেক সুবিধাজনক। হাসু চাকরিটা পেয়ে গেলো।

আমার চাকরি পেতে দেরি হলো। রোজ সকালে জব সেন্টারে যেতাম। কিন্তু কোনো চাকরি পেলাম না। শেষমেশ জব সেন্টারে পরিচয় হওয়া এক পাকিস্তানি বন্ধুর কাছ থেকে একটা চাকরির খোঁজ পেলাম। স্টকহোমে দুপুরের খাবারের জন্য কিছু ‘লাঞ্চ রুম’ ছিল। সেখানে চাকরি পেয়ে গেলাম। আমার কাজ ছিল খাবারের পর কাস্টমারদের ফেলে যাওয়া প্লেট এবং কাটলারি সংগ্রহ করা। লাঞ্চ রুমে দুবেলা খাবার পেতাম: ব্রেকফাস্ট এবং লাঞ্চ। খাবার খুব ভালো ছিল। তবে কাজের ঘণ্টা ছিল কম। কাজেই রোজগারও ছিল কম। উপরন্তু, ট্যাক্স ছিল বেশি।

ধীরে ধীরে আমরা স্টকহোমের জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে পড়লাম। রোজ সকালে দুজনে কাজে চলে যেতাম। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ঘুরে বেড়াতাম। ছবির মতন সাজানো শহরটা বাল্টিক সাগর দ্বীপপুঞ্জের ১৪টা দ্বীপ নিয়ে গঠিত। ৫০ টারও বেশি সেতু এই দ্বীপগুলোকে সংযুক্ত করেছে। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা খুব ভালো ছিল। স্টকহোমে কোন 'ট্যারিফ জোন' ছিল না। টিকিট কেটে অথবা পাস নিয়ে একবার নেটওয়ার্কে ঢুকে পড়লে, যেকোনো স্টেশনে যাওয়া যেত।

আমাদের স্টকহোম সফরের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বিয়ে করা। কিন্তু এ সম্পর্কে তথ্য কোথায় পাওয়া যাবে তা আমাদের জানা ছিলনা। স্টকহোম সেন্ট্রাল স্টেশনে একটা বড় ‘ইনফরমেশন বুথ’ ছিল। কোনো তথ্যের প্রয়োজন হলে আমরা সেখানে চলে যেতাম। সাধারণত সেগুলো ছিল ভ্রমণ সম্পর্কিত তথ্য। ভাবলাম সেখান থেকে হয়তো সুইডেনে বিদেশীদের বিয়ের নিয়মকানুন জানা যেতে পারে। আমরা একদিন সেই ইনফরমেশন বুথে চলে গেলাম। সেখানে কাজ করছিলেন একজন কম বয়সী মহিলা। তাকে বললাম – আমরা দুজন বুলগেরিয়ায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী। স্টকহোমে এসেছি ছুটি কাটাতে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখানে বিয়ে করার। এ বিষয়ে সুইডেনের নিয়মকানুন জানতে চাইছি। তার মুখ দেখে বুঝলাম আমার প্রশ্ন শুনে তিনি খুব অবাক হয়েছেন, সম্ভবত এর

আগে কখনও এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হননি। কিন্তু মুখে বললেন – হাউ রোমান্টিক! একটু অপেক্ষা কর আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি। খোঁজ নিয়ে তিনি জানালেন – সুইডেনে দুজন বিদেশী নাগরিক বিয়ে করতে পারে। এজন্য তাদের নিজ নিজ দেশের বিবাহ আইনের কপি জোগাড় করতে হবে। বিবাহ আইন অনুযায়ী তারা যদি নিজ নিজ দেশে বিয়ে করতে পারে তাহলে তারা সুইডেনেও বিয়ে করতে পারবে। কাগজপত্র জমা দিতে হবে যেখানে তারা বিয়ে করতে চায়, যেমন চার্চ বা কোর্টে। বাংলাদেশের বিবাহ আইন জোগাড় করতে কয়েকদিন লেগে গেলো। একদিন বিবাহ আইনের কপি এবং পাসপোর্ট নিয়ে আমরা হাজির হলাম স্টকহোম ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে। আমাদের কাগজপত্র যাচাই করার পর কোর্টের ক্লার্ক জানালেন – তোমরা এই আদালতে বিয়ে করতে পার, তবে সে জন্য তোমাদের এক মাসের নোটিশ দিতে হবে। হিসেব করে দেখলাম ততদিনে আমাদের ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু বিয়ে করাটা জরুরি। তখনি আমরা বিয়ের নোটিশ দিয়ে দিলাম।

১৯৭৫ সালের ১৭ অক্টোবর শুক্রবার ছিল আমাদের বিয়ে দিন। বিয়ে হবে স্টকহোম কোর্ট হাউসে দুপুর ২টায়। সেদিনও আমরা আধ-বেলা কাজ করছিলাম। কাজ শেষে মেট্রোরেল ধরে আমরা হাজির হলাম স্টকহোম ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে। সাথে না ছিলো কোনো আত্মীয়স্বজন, না ছিল বন্ধুবান্ধব! বিয়ের জন্য দুজন সাক্ষীর প্রয়োজন ছিল। তার ব্যবস্থাও করলো আদালত কর্তৃপক্ষ। বিয়ে পড়ালেন একজন জজ। সুখদুঃখে একে অপরের পাশে থাকার অঙ্গীকার করে আমরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলাম। এরপর ছিল আংটি বদল। বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর ক্লার্ক আমাদের হাতে ম্যারেজ সার্টিফিকেট তুলে দিলেন। ম্যারেজ সার্টিফিকেটটা ছিল একটা বড় আকারের খ্রীষ্টমাস কার্ডের মতন। তাতে সুইডিশ ভাষায় শুধু এক লাইন লেখা, যার ইংরেজি তর্জমা হলো – The marriage has this been solemnized of - তারপর আমাদের নাম, বিয়ের স্থান এবং তারিখ, জজ সাহেবের নাম, স্বাক্ষর এবং সিল।

বিয়ের পর, আমরা ম্যারেজ সার্টিফিকেটের ইংরেজি অনুবাদ করার জন্য চলে গেলাম সুইডিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। অফিস বন্ধ হতে ঘণ্টা-খানেক বাকি। রোববার আমাদের বুলগেরিয়া ফিরে যাওয়ার কথা। মাঝে শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। আজ বিয়ের সার্টিফিকেটের ইংরেজি অনুবাদ না পেলে আমাদের বুলগেরিয়া ফেরার তারিখ পেছাতে হবে। তাই বেশ চিন্তিত ছিলাম। তবে আশা ছিল অফিস বন্ধ হওয়ার আগে যখন সার্টিফিকেটটা জমা দিতে পেরেছি তখন আজই অনুবাদ পেয়ে যাব। হলোও তাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা আমাদের বিয়ের সার্টিফিকেটের ইংরেজি অনুবাদ পেয়ে গেলাম। এরপর কী করবো তার কোনো পরিকল্পনা আমাদের ছিল না। একটা ঘটনাবহুল দিন কাটানোর পর আমরা ক্লান্ত বোধ করছিলাম। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছেই ছিল ‘কিংস গার্ডেন’, স্টকহোম শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত সবচেয়ে সুন্দর এবং জনপ্রিয় পার্ক। আমরা সেখানে চলে গেলাম। একসঙ্গে কিছু সময় কাটিয়ে হোস্টেলে ফিরলাম। ব্যস্ততার মাঝে সেদিন কোনো ছবি তোলা হয়নি। হাসুর খুব দুঃখ, আমাদের ৫০ বছরের প্রবাস জীবনের এতো ছবি, কিন্তু বিয়ের দিনে তোলা কোনো ছবি নেই! (চলবে)



বিয়ের সপ্তাহ-খানেক পর ভার্নায় তোলা আমাদের ছবি



আগের পর্ব পরের পর্ব



ড. নজরুল ইসলাম, কার্টিন ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া








Share on Facebook               Home Page             Published on: 19-Aug-2024

Coming Events: