অস্ট্রেলিয়ার অবসরকালীন আয় ব্যবস্থা ড. নজরুল ইসলাম
অস্ট্রেলিয়ায় অবসরে যাওয়ার কোনো বয়স নেই। কাজেই যার যতো দিন খুশি বা স্বাস্থ্যে যতদিন কুলায় কাজ করে যেতে পারেন। আর সরকারও তাই চায়। কেননা একজন নাগরিক যতদিন কাজ করে যাবে, ততদিন তার ট্যাক্সের টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হবে। উপরন্তু অবসরকালীন সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে না। তাই অস্ট্রেলিয়ায় অবসরে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা একান্ত ব্যক্তিগত। আর সে খানেই সমস্যা। অনেকটা খেলোয়াড়দের মতন। ফর্ম পড়ে যাচ্ছে কিন্তু মাঠ ছাড়তে চাইছে না। খেলোয়াড়দের বেলায় নিজে না ছাড়লে সিলেক্টররা বাদ দিয়ে দেবেন। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় বয়স্কদের চাকরীচ্যুত করা কঠিন। বিশেষ করে যারা এক সংস্থায় অনেক দিন কাজ করছেন। চাকরীচ্যুত করলে বিরাট অংকের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
তবে ইচ্ছা করলেই তো আর অবসরে যাওয়া যায় না। অবসরে চলার মতন আয়ের উৎস থাকতে হবে। আয়ের উৎসের ভিত্তিতে অস্ট্রেলিয়ায় অবসরপ্রাপ্তদের তিনটি দলে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম দল হলো- যাদের আয়ের প্রধান উৎস পেনশন। তারা পেনশনার নামে পরিচিত। পেনশন পাওয়ার একটা বয়স আছে। যা ছিল ৬৫ বছর। ক্রমশ বাড়তে বাড়তে ২০২৩ সালে ৬৭ বছর হবে। অস্ট্রেলিয়ায় পেনশন সেফটি নেট হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ যাদের অন্য কোনো আয়ের উৎস নেই তারা যেন পেনশনের উপর নির্ভর করে চলতে পারে। অবসর গ্রহণকারীদের প্রায় অর্ধেক পূর্ণ পেনশন পায়।
অস্ট্রেলিয়ায় বর্তমান পেনশনের পরিমাণ জনপ্রতি মাসে প্রায় ২ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলার। নিজের বাড়ি থাকলে পেনশনার টাকায় মোটামুটি স্বাচ্ছন্দ্যে দিন চলে যায়। কেননা পেনশনের সঙ্গে অনেক বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। যেমন নামমাত্র মূল্যে ওষুধ কেনা এবং ইউটিলিটি ভাতা। তাছাড়া প্রতিটি রাজ্য সরকার ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য সিনিয়র কার্ড স্কিম সরবরাহ করে। এই কার্ডের সুযোগ-সুবিধার মধ্যে রয়েছে- হ্রাস কৃত মূল্যে বা বিনা মূল্যে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ভ্রমণ, কাউন্সিল রেটে ছাড়, ড্রাইভিং লাইসেন্স ফিতে ছাড় এবং অন্যান্য। তবে সিনিয়র কার্ড সার্বজনীন। পেনশনার না হয়েও সিনিয়র কার্ড পাওয়া যেতে পারে।
অস্ট্রেলিয়ার বাজেটের বড় অংশ পেনশন খাতে ব্যয় হয়। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে এই ব্যয়ের পরিমাণ ছিলো ৪৫.১ বিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে দাঁড়াবে ৫৩.৮ বিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার। এই বৃদ্ধির মূল কারণ দিন দিন অস্ট্রেলিয়ানদের আয়ু বেড়ে চলছে। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ানদের গড আয়ু ৮৩.৫ বছর। অর্থাৎ কেউ যদি ৬৭ বছর বয়সে অবসরে যায় সরকারকে ১৬.৫ বছর পেনশন এবং আনুষঙ্গিক সুযোগসুবিধার খরচ বহন করতে হবে। ভবিষ্যতে পেনশন খাতে ব্যায় বৃদ্ধি অনুধাবন করে ১৯৯২ সালে অস্ট্রেলিয়ান সরকার বাধ্যতামূলক সঞ্চয় প্রকল্প চালু করে যা Superannuation বা সংক্ষেপে সুপার নামে পরিচিত। এই প্রকল্পের আওতায় অস্ট্রেলিয়ায় কর্মরত সকলের বেতনের ৯.৫ শতাংশ অবসরে খরচের জন্য সুপার একাউন্টে জমা হয়। কোনো কোনো পেশায় এই সঞ্চয়ের পরিমাণ আরও বেশি। যেমন সংসদ সদস্যদের ক্ষেত্রে ১৫.৪ শতাংশ এবং ইউনিভর্সিটিতে কর্মরতদের ক্ষেত্রে ১৭ শতাংশ। এ ছাড়াও কেউ ইচ্ছা করলে আরও সুপার একাউন্টে জমা করতে পারে। এ জাতীয় সঞ্চয়কে উৎসাহিত করার জন্য অস্ট্রেলিয়ান সরকার অনেক কর ছাড় দেয়। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় পেনশন তহবিলে ৩ ট্রিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার জমা রয়েছে, যা কিনা বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম পেনশন তহবিল- যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং যুক্তরাজ্যের পর। প্রসঙ্গত এই তিনটি দেশের জনসংখ্যা অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে অনেক বেশি। সুপার একাউন্টে বাধ্যতামূলক সঞ্চয় ছাড়াও অস্ট্রেলিয়ানরা স্বেচ্ছাসেবী সঞ্চয় করে থাকে। তার মধ্যে সব চেয়ে বড় হলো বাড়ির মালিকানা। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্তদের ৭৬ শতাংশ তাদের বাড়ির মালিক।
অস্ট্রেলিয়ায় অবসরপ্রাপ্তদের দ্বিতীয় দল হলো যারা সরকারের কাছ থেকে পেনশন এবং আনুষঙ্গিক কোনো সুযোগ সুবিধা পায় না। তাদের self-funded retiree বলা হয়। তারা সম্পূর্ণ নিজের টাকায় চলে। তবে সিনিয়র কার্ডের সুযোগ-সুবিধা তারা পেয়ে থাকে। তাদের আয়ের প্রধান উৎস সুপার একাউন্টে সঞ্চয়। তা ছাড়া বাড়ি ভাড়া, শেয়ার ডিভিডেন্ড-সহ অন্যান্য আয়ের উৎস থাকতে পারে। ২০০০ সালে অবসর প্রাপ্তদের ২২ শতাংশ ছিল এই দলে। ২০২৩ সালে এদের সংখ্যা ৪৩ শতাংশে দাঁড়াবে। অ্যাসোসিয়েশন অব সুপারএনুয়েশন ফান্ডস অব অস্ট্রেলিয়ার অবসর গ্রহণের স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী যাদের নিজের বাড়ির আছে, তাদের সচ্ছল অবসর গ্রহণের জন্য একক ব্যক্তির ৫ লাখ ৪৫ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলার, আর দম্পতির ৬ লাখ ৪০ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলার সুপার একাউন্টে সঞ্চয় থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে ৬৫ থেকে ৬৯ বয়স্কদের মধ্যে, পুরুষদের সুপার একাউন্টে গড সঞ্চয় ৩ লাখ ৮৪ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলার আর মহিলাদের গড় সঞ্চয় ৩ লাখ ১৩ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলার। কাজেই অনেকেই শুধু সুপার একাউন্টে সঞ্চয়ের উপর নিভর করে চলতে পারবে না। তারা হলেন তৃতীয় দলে। তারা সরকারের কাছ থেকে আংশিক পেনশন পান, বাকিটা নিজের আয় থেকে চালিয়ে নেয়। তাদের part pensioner বলা হয়। অবসর গ্রহণকারীদের প্রায় চতুর্থাংশ আংশিক পেনশন পায়।
অস্ট্রেলিয়ায় পেনশন পাওয়ার জন্য বয়স ছাড়া আরও দুটি শর্ত পূরণ করতে হয় : সম্পদ পরীক্ষা এবং আয় পরীক্ষা। সম্পদ পরীক্ষার উদ্দেশ্য হলো যারা প্রচুর সম্পদের মালিক তারা যেন পেনশন না পায়। সম্পদ পরীক্ষায় ভাড়া বাড়ির বাজারমূল্য, ব্যাংকে জমা টাকা, শেয়ার বিনিয়োগ, গাড়ি এবং আসবাবপত্রের মোট মূল্য ধরা হয়। তবে বসত বাড়ির মূল্য সম্পদ পরীক্ষায় ধরা হয় না। একক ব্যক্তির মোট সম্পদের পরিমাণ ২ লাখ ৬৮ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলার, আর দম্পতির সম্পদের পরিমাণ ৪ লাখ ১ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলারের কম হলে পূর্ণ পেনশন পাওয়া যায়। সম্পদের পরিমাণ এর চেয়ে বেশি হলে পেনশনের পরিমাণ কমতে থাকে। একক ব্যক্তির মোট সম্পদের পরিমাণ ৫ লাখ ৮৩ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলার, আর দম্পতির সম্পদের পরিমাণ ৮ লাখ ৭৬ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলার হলে কোনো পেনশন পাওয়া যায় না। আয় পরীক্ষার উদ্দেশ্য হলো যাদের পর্যাপ্ত আয় আছে তারা যেন পেনশন না পায়। আয়ের মধ্যে আছে- চাকরি থেকে পাওয়া বেতন, সুপার থেকে পাওয়া পেনশন এবং বিনিয়োগ। একক ব্যক্তির মাসিক আয় ৩৮৬ অস্ট্রেলিয়ান ডলার, আর দম্পতির মাসিক আয় ৬৮৫ অস্ট্রেলিয়ান ডলারের কম হলে পূর্ণ পেনশন পাওয়া যায়। এর উপরে প্রতি ডলার আয়ের জন্য ৫০ সেন্ট করে পেনশন কমতে থাকে। একক ব্যক্তির মাসিক আয় ৪,৪৭৭ অস্ট্রেলিয়ান ডলার, আর দম্পতির মাসিক আয় ৬,৮৫৩ অস্ট্রেলিয়ান ডলারের বেশি হলে কোনো পেনশন পাওয়া যায় না। আয় এর মধ্যে হলে আংশিক পেনশন পাওয়া যায়। তবে পেনশন যদি এক ডলারও হয় পেনশন সম্পর্কিত বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পুরোটাই পাওয়া যায়। তাই সবার প্রচেষ্টা থাকে আয় পেনশন পাওয়ার জন্য নির্ধারিত সর্বোচ্চ সীমার নিচে রাখার। এ ব্যাপারে অনেকেই অর্থ উপদেষ্টাদের পরামর্শ নিয়ে থাকে।
অস্ট্রেলিয়ার অবসরকালীন ইনকাম সিস্টেমকে বিশ্বের অন্যতম সেরা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি তিনটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে- পেনশন, বাধ্যতামূলক সঞ্চয় ও স্বেচ্ছাসেবী সঞ্চয়, যার মধ্যে বাড়ির মালিকানা অন্যতম। এর মাধ্যমে সরকার অপেক্ষাকৃত স্বল্প ব্যয়ে প্রতিটি নাগরিককে অবসরকালীন সময়ে স্বাচ্ছন্দ্যে চলার ব্যবস্থা করতে পেরেছে।
ড. নজরুল ইসলাম, কার্টিন ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া
|