অপারেশন সার্চলাইট ড. নজরুল ইসলাম
২৫ মার্চ ১৯৭১ সাল। সন্ধ্যার একটু আগে বন্ধু মামুন তার গাড়ি করে আমার বাসার সামনে নামিয়ে দিলো। আমরা গিয়েছিলাম ঢাকা কলেজের অংকের প্রফেসর লুৎফুজ্জামান স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তে। পরদিন দুই বন্ধু আবার মিলিত হবার অঙ্গীকার করে বিদায় নিলাম। তখন জানতাম না, কি ভয়ংকর কালরাত্রি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
রাত ১২টার দিকে গোলাগুলির শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। মার্চ মাস জুড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল। প্রায়ই এদিক সেদিক গোলাগুলি হতো। কিন্তু সে রাতে গোলাগুলির তীব্রতা ছিল অনেক বেশি। তখন আমাদের বাসা ছিল এডুকেশন এক্সটেনশন সেন্টারের (বর্তমানে ন্যাশনাল একাডেমী ফর এডুকেশনাল ম্যানেজমেন্ট, সংক্ষেপে নায়েম) স্টাফ কোয়ার্টারের তিন তালায়। আমাদের শোবার ঘরের সামনে ছিল বিশাল কাচের জানালা। সেই জানালা দিয়ে দেখছিলাম দূরে আকাশ অগ্নিশিখায় লাল হয়ে উঠেছে। এদিকে গোলাগুলির শব্দ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই খুব কাছাকাছি গোলাগুলির প্রচণ্ড আওয়াজ। আমাদের বিল্ডিংটা ছিল ইপিআর (বর্তমানে বিজিবি) সীমানা থেকে কয়েকশ গজ দূরে। গোলাগুলির আওয়াজ আসছিলো সেখান থেকেই। আওয়াজ শুনে বোঝা যাচ্ছিলো রীতিমতো যুদ্ধ হচ্ছে। আর আমরা সেই যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝে বন্দী হয়ে আছি। রাতের আঁধারে কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না। খালি শুনছিলাম অবিরাম মেশিনগানের গুলির শব্দ আর মাঝে মাঝে দেখছিলাম ট্রেসার বুলেটের আলো। কাচের জানালার জন্য বেডরুমে থাকা নিরাপদ মনে করলাম না। আমরা সবাই ডাইনিং স্পেসে শুয়ে পড়লাম। সারা রাত ধরে সেই গোলাগুলি চলতে থাকে। আব্বার একটা ভালো ট্রানজিস্টার রেডিও ছিল। তিনি রেডিও মারফত পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করছিলেন। ইতিমধ্যে পাকবাহিনী ঢাকা বেতার কেন্দ্র দখল করে নিয়েছে এবং নাম পরিবর্তন করে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা নামে প্রচার শুরু করেছে। প্রসঙ্গত, অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে রেডিও পাকিস্তান ঢাকার নাম পরিবর্তন করে ঢাকা বেতার কেন্দ্র রাখা হয়ে ছিল। রেডিও মারফত জানতে পারলাম, সারা পূর্ব পাকিস্তানে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়েছে।
২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তানের জাতীয় দিবস। সেই দিনটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে 'প্রতিরোধ দিবস' হিসাবে পালিত হয়। আমরা সবাই পাকিস্তানের পতাকার বদলে মানচিত্র-খচিত বাংলাদেশের পতাকা ওড়াই। সেই পতাকা তখনও আমাদের বারান্দায় উড়ছিল। পতাকা লক্ষ্য করে পাকবাহিনী গুলি চালায়। আব্বা অনেক কষ্ট করে পতাকাটা নামিয়ে নেন। ইপিআরের যুদ্ধ সকাল হবার আগেই শেষ হয়ে যায়। তবে বিভিন্ন দিক থেকে গোলাগুলি দিনভর চলতে থাকে। ২৬ মার্চ ছিল শুক্রবার। কারফিউ থাকায় জুমার নামাজের জন্য মসজিদে যাওয়া হলো না। এরই মধ্যে বিদেশী সংবাদের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশে পাকবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের খবর পেতে শুরু করেছি। বিবিসি, ভয়েস অফ আমেরিকা এবং রেডিও অস্ট্রেলিয়ার খবর শুনে যতটা সম্ভব পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছিলাম। রেডিও অস্ট্রেলিয়ার একটা বর্ণনা আজও মনে পড়ে - ঢাকায় বৃষ্টির মতো গোলাগুলি হচ্ছে!
আমাদের বিল্ডিঙে আমরা ছয় পরিবার বসবাস করতাম। বিল্ডিঙের সিঁড়ি ছিল খোলামেলা। তাই কেউ কারো সঙ্গে যোগাযোগ করার সাহস পাচ্ছিলাম না। সন্ধ্যা হতেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। আমরা বিল্ডিঙের অন্যান্যদের সাথে যোগাযোগ শুরু করি। আমাদের সামনের বিল্ডিংটা ছিল ছাত্রদের হোস্টেল। সেখানে আব্বার এক সহকর্মী থাকতেন। রাতে তিনি আমাদের বাসায় এসে হাজির। উনি বেরিয়েছেন সিগারেটের খোঁজে। তার কাছ থেকে জানলাম সেন্টারের একজন কর্মচারী পাকবাহিনীর গুলিতে মারা গেছে। তার লাশ পড়ে আছে, দাফন করার কোনও উপায় নেই। পরদিন কারফিউ উঠে গেলে সেন্টারে কর্মরত এক আমেরিকান উপদেষ্টার মাধ্যমে পাকবাহিনীর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সেই লাশ দাফন করা হয়। আব্বার সেই সহকর্মীকে নিয়ে আমরা রাত আটটায় ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণ শুনলাম। সেই ভাষণে ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিব ও তাঁর দলের অন্যান্যদের রাষ্ট্রদ্রোহী বলে অভিহিত করেন। তার ভাষায় – এ অপরাধের শাস্তি না হয়ে পারে না। সেই ভাষণ শোনার পর আব্বার সেই সহকর্মী বললেন - আজ ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণ শুনলেন, আগামীকাল শেখ মুজিবের বেতার ভাষণ শুনবেন। সম্ভবত তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রচারের কথা বোঝাতে চেয়েছিলেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার খবরটা কখন কি ভাবে পেয়েছিলাম তা স্পষ্ট মনে নেই। তবে ২৬ মার্চ আমার ডাইরিতে লেখা – গতকাল রাত সাড়ে এগারোটায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চাটগাঁর ইপিআর ওয়ারলেস ঘাঁটি ও জনাব জহুর আহমেদ চৌধুরী এমপির মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ঘোষণা করেন। আজ রাতে চট্টগ্রাম স্বাধীন (বিপ্লবী) বাংলা বেতার থেকে তাঁর এই স্বাধীনতা যুদ্ধ ঘোষণার সংবাদ প্রচারিত হয়। বিবিসির খবরে প্রকাশ - চট্টগ্রামে শেখ মুজিবের সমর্থক এবং সেনাবাহিনীর মাঝে তুমুল লড়াই চলছে। শেখ মুজিব সমর্থকরা চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র দখল করে নেয়। বস্তুত চট্টগ্রাম এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে।
পরদিন ২৭ মার্চ সকালে দুই ঘণ্টার জন্য কারফিউ তুলে নেয়া হয়। ইপিআর সংলগ্ন বাসায় থাকাটা নিরাপদ মনে করলাম না। আমরা চলে গেলাম ধানমন্ডি ঈদগাহ মসজিদের কাছাকাছি আমাদের এক আত্মীয়ের বাসায়। বাড়িটা একটু ভিতর দিকে হওয়ায় কিছুটা নিরাপদ ভেবেছিলাম। যদিও সেদিন ঢাকার কোনও এলাকাই নিরাপদ ছিলো না। ইতোমধ্যে হাজার হাজার মানুষ ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে জানতে পারলাম পাক বাহিনীর পূর্ব পরিকল্পিত গণহত্যার কথা। জানতে পারলাম রাজারবাগে পুলিশ সদর দফতর আক্রমণের কথা, শহীদ মিনার গুড়িয়ে দেয়ার কথা, দৈনিক ইত্তেফাক অফিস পুড়িয়ে ফেলার কথা, পুরাণ ঢাকায় শত শত মানুষকে পুড়িয়ে মারার কথা এবং আরও অনেক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা। ওই রাতে কতজন মারা গিয়েছিলো তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান জানা সম্ভব হয়নি। কেননা পাকবাহিনী রাতের আঁধারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে লাশ গুম করে দিয়েছিলো। সবচেয়ে মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘটেছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। পাকসেনারা ইকবাল হল (বর্তমানে জহরুল হক হল), জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল সহ শিক্ষকদের আবাসিক এলাকায় আক্রমণ করে এবং ১২ জন শিক্ষক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে। ইকবাল হল ছিল এই হামলার প্রদান টার্গেট। মার্চ মাসের অসহযোগ আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল ইকবাল হলে অবস্থিত 'সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ'। অপারেশন চলাকালে পাকসেনারা ট্যাংক, রকেট লঞ্চার, মর্টার, মেশিনগানের মতো ভারী অস্ত্র দিয়ে ছাত্রদের ওপর আক্রমণ করে এবং প্রায় ২০০ ছাত্রকে হত্যা করে। শুধু তাই নয়, পাকসেনারা ভয় দেখানোর জন্য ইকবাল হলের পেছনে পুকুর পাড়ে কিছু লাশ ফেলে রেখেছিল।
একটা তথ্য হয়তো অনেকেরই জানা নেই। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার দুই নম্বর আসামি কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে ২৬ মার্চ সকালে পাকসেনারা তার এলিফ্যান্ট রোডের বাড়িতে ঢুকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই হত্যার কারণ হলো ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর, তার ছিল এক দফা - ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করা। কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন বন্ধু মামুনের আপন খালু। আজ গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি তাঁকে এবং বাংলাদেশের সকল কৃতি সন্তানকে যারা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদ হয়েছেন।
ড. নজরুল ইসলাম, কার্টিন ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া
|