গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল, ঢাকা (৯) ড. নজরুল ইসলাম
নিউমার্কেট এবং ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার মধ্যে অবস্থিত চারটি বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: ঢাকা কলেজ, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল এবং ন্যাশনাল একাডেমি ফর এডুকেশনাল ম্যানেজমেন্ট (সংক্ষেপে নায়েম)। নগর পরিকল্পনাবিদরা এভাবেই নকশা করেছিলেন প্রায় ৪৫ একরের একটা বিশাল শিক্ষা চত্বরের। ১৯৫৫ সালে ঢাকা কলেজ বর্তমান ক্যাম্পাসে স্থানান্তরিত হয় সিদ্দিক বাজার থেকে। তারপর ১৯৫৬ সালে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ স্থানান্তরিত হয় আরমানিটোলা থেকে। ট্রেনিং কলেজ সংলগ্ন একটা স্কুলের প্রয়োজন মেটাতে ল্যাবরেটরি স্কুলের উদ্বোধন হয় ১৯৬১ সালে। অবশেষে, ১৯৬২ সালে নায়েম (তখনকার নাম ছিল শিক্ষা সম্প্রসারণ কেন্দ্র) স্থানান্তরিত হয় পাবলিক লাইব্রেরি এলাকা থেকে। নতুন ক্যাম্পাসের উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আজম খান। এই চারটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমার ছেলেবেলা জড়িয়ে আছে। ১৯৬১ থেকে ৬৯ পর্যন্ত ছাত্র ছিলাম ল্যাবরেটরি স্কুলের। তারপর দেয়াল টপকে চলে গেলাম ঢাকা কলেজে। আব্বার চাকরি সূত্রে ১৯৬৩ সাল থেকে বসবাস শুরু করি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ক্যাম্পাসে। ১৯৬৭ সালে আব্বা চাকরি বদল করে চলে যান নায়েমে। ১৯৭২ সালে বিদেশ যাওয়ার আগ পর্যন্ত নায়েম ক্যাম্পাসেই ছিলাম। যখনই ঢাকা যাই, এলাকাটা একবার ঘুরে আসার চেষ্টা করি। সকালে একা একা হাঁটতে ভালো লাগে। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই শিক্ষা চত্বরে!
১৯৬১ সালে আমরা যখন ক্লাস শুরু করি তখন স্কুল ক্যাম্পাসে ভবন ছিল তিনটি – দক্ষিণ প্রান্তে একাডেমিক ভবন, উত্তর প্রান্তে প্রধান শিক্ষকের বাসভবন আর পশ্চিম প্রান্তে (উত্তর-পশ্চিম কোনের কাছাকাছি) ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ছোট্ট একটা স্টাফ কোয়াটার। মাঝে ছিল খেলাধুলার জন্য বিরাট মাঠ। তবে পুকুর আর ডোবা ভরাট করে খেলার উপযোগী মাঠ তৈরি করতে কিছুটা সময় লেগে ছিল। মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী মাঠের উত্তর দিকে স্কুল ভবন স্থাপন করার কথা ছিল। কিন্তু ঐ দিকের জমি নিচু থাকায় সে পরিকল্পনা বাদ দেয়া হয়। ঢাকা কলেজের বিপরীত দিকে নায়েম রোডের উপর ছিল দুটি প্রধান গেট – প্রথমটি দর্শনার্থী ও শিক্ষকদের জন্য এবং দ্বিতীয়টি শিক্ষার্থীদের জন্য। এছাড়াও ছিল ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীদের স্টাফ কোয়াটারের সামনে একটা ছোট গেট; আরেকটা গেট ছিল দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে। এই গেটটা টিফিন তৈরির সামগ্রী ডেলিভারি গ্রহণের জন্য ব্যবহৃত হত। বেশিরভাগ সময়েই বন্ধ থাকতো। আমরা গেট টপকে আসা-যাওয়া করতাম। ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীদের স্টাফ কোয়াটারের সামনের গেটটাও কম গুরুত্বপূর্ণ ছিলনা। আমাদের স্কুল থেকে ধানমন্ডি যেতে অনেকটা ঘুরে মিরপুর রোড দিয়ে যেতে হয়। তখনকার দিনে নায়েম রোড থেকে ধানমন্ডি ১ নম্বর রোডে যাওয়ার একটা শর্টকাট রাস্তা ছিল। সেই রাস্তা ধরতে হলে এই গেট দিয়েই বের হতে হতো। তবে শর্টকাট রাস্তাটা ছিল প্রাইভেট প্রপার্টি। পরবর্তীতে সেটা বন্ধ হয়ে যায়।
ল্যাবরেটরি স্কুলের নকশা এখন অনেক বদলে গেছে। সেই বিরাট মাঠ অনেকটা ছোট হয়ে গেছে। এখন ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের একাডেমিক ভবন দুটি – প্রধান ভবন (দোতলা) এবং নতুন ভবন (ছয়তলা)। প্রধান ভবনটি নায়েম রোড থেকে প্রথম গেট দিয়ে ঢুকেই হাতের বা পাশে। এই ভবনে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস হয়ে থাকে। নতুন ভবনটি পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত। এই ভবনে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ক্লাস হয়ে থাকে। প্রসঙ্গত, ২০০৭ সালে ল্যাবরেটরি স্কুলকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। স্কুল মাঠের পশ্চিম প্রান্তে আছে প্রায় ৫০০ আসন বিশিষ্ট একটা সুন্দর অডিটোরিয়াম, উত্তর প্রান্তে প্রধান শিক্ষকের বাসভবন এবং পূর্ব প্রান্তে অভিভাবকদের বসার জন্য একটা বড় ঘর। মাঠের পূর্ব ও পশ্চিম পাশে আছে ফুটবল খেলার জন্য গোলপোস্ট; মাঝখানে রয়েছে একটা ক্রিকেট পিচ এবং একটা ভলিবল কোর্ট; আর দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে ক্রিকেটের অনুশীলনের জন্য একটা প্রাকটিস পিচ। ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীদের স্টাফ কোয়াটারটা ভেঙে ফেলা হয়েছে। ওই জায়গায় কর্মচারীরা নিজ খরচে কিছু কাঁচা ঘর তৈরি করে বসবাস করছে। উত্তর প্রান্তে নির্মাণ করা হয়েছে শিক্ষকদের জন্য একটা দোতালা স্টাফ কোয়াটার। ল্যাবরেটরি স্কুলের গেট এখন তিনটি। আগের মতোই ঢাকা কলেজের বিপরীত দিকে নায়েম রোডের উপর দুটি প্রধান গেট। বাকী দুটি গেট বন্ধ হয়ে গেছে। তার বদলে হয়েছে প্রধান শিক্ষকের বাসভবনের পিছনে একটা পকেট গেট যেটা দিয়ে কলেজ স্ট্রিটে যাওয়া যায়; ফলে ধানমন্ডিতে যাওয়ার পথ কিছুটা কমেছে। দুই প্রধান গেটের মাঝামাঝি আছে শহীদ মিনার। ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে গড়া এই শহীদ মিনারটি ২০০১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মাঝরাতে উদ্বোধন করেছিলেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ। এখানে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হয়।
প্রথম গেট দিয়ে ঢুকতেই অভিভাবকদের বসার ঘরের সামনে একটা নোটিশ বোর্ড চোখে পড়লো। এতে আছে প্রধান শিক্ষকের তরফ থেকে ছাত্রদের প্রতি ৭টা নির্দেশনা এবং অভিভাবকদের প্রতি ৬টা পরামর্শ। আমাদের সময়ে এতো নিয়ম কানুন ছিলোনা। যেমন ৪ নম্বর নিয়ম – “প্রত্যেক দিন ডায়েরি লিখতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট স্থানে অভিভাবক কর্তৃক স্বাক্ষর করিয়ে আনতে হবে।” জানিনা আমাদের সময়ে এই নিয়ম থাকলে কি করতাম! ডায়েরিতে প্রতিদিন স্বাক্ষর তো দূরের কথা পড়াশোনার ব্যাপারে আমাদের অভিভাবকরা কমই খেয়াল রাখতেন। স্বাক্ষর বলতে ছিল পরীক্ষার পর প্রগ্রেস রিপোর্টে অভিভাবকের স্বাক্ষর। সেই স্বাক্ষর নেয়ার সময় ভয়ে ভয়ে থাকতাম কেননা প্রগ্রেস রিপোর্টে প্রতিটি বিষয়ে প্রাপ্ত নম্বর ছাড়াও উল্লেখ থাকতো মেধানুসারে স্থান, বিদ্যালয়ের কার্যদিবস এবং ছাত্রের উপস্থিতির দিন। ৭ নম্বর নিয়মটা আরো কঠিন – “টিফিন পিরিয়ডে কোনো ছাত্র গেটের বাইরে যেতে পারবে না।” আমাদের সময়ে এই নিয়ম থাকলে টিফিনের সময় ইপিআর (বর্তমানে বিজিবি) এলাকায় গুলির খোসা কুড়াতে যাওয়া হতো না, বলাকা সিনেমায় নতুন ছবির পোস্টার দেখা হতো না, নিউ মার্কেটে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ানো হতো না। এমনকি গেটের সামনে বিক্রি হওয়া নানা ধরণের মুখরোচক খাবার – ঝালমুড়ি, চানাচুর, চটপটি, ফুচকা, আইসক্রিম, আচার ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত হতাম। টিফিন পিরিয়ডে স্কুলের বাইরে যেতে না পারলে ছাত্র জীবনর মজাটাই হারিয়ে ফেলতাম! তবে জামানা বদলে গেছে। আর সেই সঙ্গে বদলে গেছে নিয়ম কানুন। আজকাল বাবা-মা তাদের সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে বেশি চিন্তিত। নিরাপত্তার ব্যাপারে আরেকটা জিনিস চোখে পড়লো – প্রত্যেকটা বারান্দা লোহার গ্রিলে ঘেরে। আমাদের সময়কার সেই খোলামেলা স্কুল আর নেই!
গাছ-গাছালিতে ভরা একটা সুন্দর ছিমছাম ক্যাম্পাস দেখে ভালো লাগলো। আমাদের সময়ে স্কুল ক্যাম্পাসে গাছপালা ছিল না বললেই চলে। তবে সেটা ছিল একটা নতুন ক্যাম্পাসের শুরু; গাছপালা জন্মাতে সময় লাগে। তাছাড়া সে সময়ে পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে তেমন সচেতনতা ছিল না। প্রধান ভবনের সামনে গাড়ি বারান্দার উপর যোগ হয়েছে বড় বড় অক্ষরে লেখা স্কুলের নাম; প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার জন্য একটা জনপ্রিয় স্থান। সামনের বৃত্তাকার বাগানটা আরো সুন্দর হয়েছে। সিমেন্টের দেয়াল আর লোহার গ্রিল দিয়ে ঘেরা একটা পরিপাটি বাগান। বাগানের পাশ দিয়ে পথ চলে গেছে নতুন ভবনের দিকে। শিক্ষকদের কক্ষের সামনের বিশাল বারান্দাটা ঠিক তেমনই আছে। এমনকি দরজা-জানালাগুলোও আগের মতোই নীলচে সবুজ রঙের। বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা আকাশছোঁয়া গগন-শিরীষ গাছ। মাঠ থেকে প্রধান ভবনের এই দৃশ্যটা দেখতে অত্যন্ত মনোরম। শিক্ষকদের কক্ষের পেছনের ফাঁকা জায়গাটায় অনেক গাছ লাগানো হয়েছে। গাছগুলো এখনো বড় হয়ে ওঠেনি। শুরুর দিকে এই জায়গায় আমাদের এসেম্বলি হতো। পরে যখন ছাত্র সংখ্যা বেড়ে যায় (১৯৬৪ সালে) এসেম্বলির স্থান মাঠের পশ্চিম প্রান্তে স্থানান্তরিত হয়। স্কুল কম্পাউন্ডে শহীদ মিনার দেখে একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লাম। কারণ আমাদের সময়ে শহীদ দিবস উদযাপন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচিত হতো। আর আমাদের স্কুলে যেকোনো রাজনৈতিক কার্যকলাপ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। তবে একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের ছুটি থাকতো। সে সময়ে খুব কম সংখ্যক স্কুল শহীদ দিবস উপলক্ষে বন্ধ থাকতো। এই নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। নায়েম রোডের উপর একটা জাঁকজমক পূর্ণ গেট দেখে অবাক হলাম। আমাদের সময়ে শিক্ষার্থীদের গেটটা ছিল একদম সাদামাঠা। গেটের উপরের লেখাটা লক্ষণীয় – “শেখার জন্য এসেছো সেবার জন্য বেরিয়ে যাও।” জানি না পরবর্তী জীবনে আমরা এই উপদেশ কতটা মনে রাখতে পেরেছি।
স্কুল ক্যাম্পাসে এলেই পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে যায়। স্কুলের জন্মলগ্ন থেকে ৮ বছর এই স্কুলের ছাত্র ছিলাম। স্বল্প সময়ের মধ্যে আমাদের স্কুল কতটা সুনাম অর্জন করতে পেরেছিলো! নিঃসন্দেহে ল্যাবরেটরি স্কুলের এই সাফল্যের পিছনে আমাদের হেডমাস্টার সালেক স্যারের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। কড়া ডিসিপ্লিনের মানুষ ছিলেন তিনি। আমরা সবাই তাঁকে ভয় করে চলতাম। তাঁর কাছ থেকে পাওয়া শাস্তির অভিজ্ঞতা আমাদের প্রায় সবারই আছে। তবে এখন বুঝতে পারি যে এই ধরনের ডিসিপ্লিন না থাকলে, ল্যাবরেটরি স্কুল কখনই একটা আইকনিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারতো না। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৬৭ সালে সালেক স্যার প্রেসিডেন্ট পুরস্কার পেয়ে ছিলেন। পরবর্তীতে, ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক প্রদান করে। প্রসঙ্গত, আমাদের বাংলার শিক্ষক ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক আনিস সিদ্দিকী স্যার সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৮৭ সালে একুশে পদকে ভূষিত হয়েছিলেন।
ল্যাবরেটরি স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র সংখ্যা কত হতে পারে তা অনুমান করা কঠিন। আজ বাংলাদেশ এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার প্রাক্তন ছাত্র ছড়িয়ে আছে। আমরা সবাই এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছে ঋণী। কেননা আমাদের জীবনের বুনিয়াদ এখানেই গড়ে উঠেছিল। আর এর পেছনে ছিলেন 'মানুষ গড়ার কারিগর' আমাদের শিক্ষকবৃন্দ। আজ গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি ল্যাবরেটরি স্কুলের সকল প্রাক্তন এবং বর্তমান শিক্ষকবৃন্দকে। (সমাপ্ত)
স্বীকৃতি: লেখাটা আমার হলেও স্মৃতিচারণ আমাদের অনেকের। সহপাঠীদের সহযোগিতা ছাড়া লেখাটা সম্ভব হতো না।
আগের পর্ব
ড. নজরুল ইসলাম, কার্টিন ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া
|