bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল, ঢাকা (৮)
ড. নজরুল ইসলাম


বছরের পর বছর ল্যাবরেটরি স্কুলের ছাত্ররা যখন এসএসসি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে থাকে তখন অনেকের মনে ধারণা জন্মায় – নিশ্চয়ই ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষকরা ছাত্রদের প্রশ্ন বলে দেন, তা নাহলে এতো ভালো রেজাল্ট করা সম্ভব নয়। আসলে কিন্তু তা মোটেও সত্যি নয়। প্রশ্নপত্র তৈরি হতো বোর্ডের পক্ষ থেকে। কাজেই আমাদের শিক্ষকদের প্রশ্নপত্র জানার কোনো সুযোগই ছিলোনা। বরঞ্চ আমাদের পরীক্ষার জন্য তৈরি করা হতো কঠিন অনুশীলনের মাধ্যমে। তিন ঘণ্টার পরীক্ষা আমরা দিতাম আড়াই ঘণ্টায়। ফলে ফাইনাল পরীক্ষায় আমাদের সময়ের অভাব হবার কথা নয়। খাতা দেখা হতো খুব কড়া করে। টেস্ট পরীক্ষায় আমি পেয়ে ছিলাম সর্বমোট ৬৬৬ নম্বর। ফাইনালে গিয়ে যোগ হলো ১০০ নম্বরেরও বেশি। আমার সহপাঠীদের সবারই নম্বর ফাইনাল পরীক্ষাতে এরকম বেড়ে গিয়েছিলো। আমাদের খাতা কঠিন করে দেখার উদ্দেশ্য ছিল আমরা যেন আরো ভালো রেজাল্ট করার চেষ্টা করি।

ল্যাবরেটরি স্কুলের ছাত্রদের ভালো রেজাল্টের প্রধান কারণ ছিল তিনটি – শিক্ষকদের দক্ষতা, ছাত্রদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং ভাল শিক্ষার পরিবেশ। ল্যাবরেটরি স্কুল প্রতিষ্ঠার পিছনে ছিলেন ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের শিক্ষাবিদরা। তাঁরা শিক্ষকের শিক্ষক। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষকরা ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে আসতেন ‘ব্যাচেলর অফ এডুকেশন (বিএড)’ ট্রেনিঙের জন্য। কাজেই টিচার্স ট্রেনিং কলেজের শিক্ষাবিদরা জানতেন সুযোগ্য শিক্ষক কোথায় পাওয়া যাবে। বিভিন্ন জায়গা থেকে ভালো ভালো শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল ল্যাবরেটরি স্কুলে। আমাদের হেডমাস্টার সালেক স্যারকে আনা হয়ে ছিল বরিশাল থেকে। তিনি বরিশাল জিলা স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। ল্যাবরেটরি স্কুলে যোগদানের পূর্বে তাঁর ২৫ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ছিল। তিনি ১৯৪৩ সালে ঐতিহ্যবাহী ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে ‘ব্যাচেলর অব টিচিং (বিটি)’ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯০৯ সালে ব্রিটিশ আমলে সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ক্যাম্পাস ছিল আরমানিটোলা। ট্রেনিং কলেজের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল আরমানিটোলা স্কুল, অবিভক্ত বঙ্গদেশের সেরা স্কুল। বিটি ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি ১০ বছর আরমানিটোলা স্কুলে কর্মরত ছিলেন। এসিস্টেন্ট হেডমাস্টার মফিজউদ্দিন স্যারকে নেয়া হয়ে ছিল সরাসরি আরমানিটোলা স্কুল থেকে। এই দুই শিক্ষকের আরমানিটোলা স্কুলের অভিজ্ঞতা ল্যাবরেটরি স্কুলের রূপায়ণে ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছিল।

ল্যাবরেটরি স্কুলে ভর্তির সময়ে বেছে বেছে ভালো ছাত্রদের ভর্তি করা হয়ে ছিল। কাজেই তাদের ভালো রেজাল্ট করাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভালো ছাত্র হলেই যে ভালো রেজাল্ট করা যায় না তার প্রমাণ পেয়েছি ঢাকা কলেজে গিয়ে। এসএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করা ছাত্র, এইচএসসি পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগ পেয়ে যায়। ভালো রেজাল্টের জন্য দরকার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং ভাল শিক্ষার পরিবেশ। দুটোই আমাদের ছিল। আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল কিন্তু কোন শত্রুতা ছিল না। বরঞ্চ আমাদের মাঝে একে অপরকে সাহায্য করার প্রবণতা ছিল। ল্যাবরেটরি স্কুলে অনেক নামি দামি লোকদের সন্তানরা পড়াশুনা করতো। সেই সঙ্গে মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা অনেক ছাত্র ছিল। আমাদের মাঝে শ্রেণীগত কোন ভেদাভেদ ছিলো না। কার বাবা কী করেন তা নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথা ছিল না। আমাদের শিক্ষকরাও আমাদের সবাইকে এক চোখে দেখতেন। আমরা কখনো কোনো ধরনের বৈষম্য অনুভব করেনি। পড়াশোনার ব্যাপারে আমাদের শিক্ষকরা অভিভাবকদের চেয়ে বেশি খেয়াল রাখতেন। এমনকি স্কুলের বাইরে দেখলেও জানতে চাইতেন পড়াশোনা কেমন চলছে। আমরাও আমাদের শিক্ষকদের অত্যন্ত শ্রদ্ধা এবং সম্মান করতাম। আমাদের শিক্ষকরা ছিলেন নিজ নিজ বিষয়ে পণ্ডিত। আর তাঁদের ছিল ল্যাবরেটরি স্কুলকে একটা আদর্শ স্কুল রূপে গড়ে তোলার স্বপ্ন।

দশম শ্রেণী ছিল আমাদের স্কুল জীবনের শেষ বছর (১৯৬৮)। বছরের শুরু থেকেই শিক্ষকরা বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন যে এসএসসি পরীক্ষা আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা, আমাদের ক্যারিয়ার বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই পরীক্ষায় ভালো করতেই হবে। আমরাও সেই ভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তাই দশম শ্রেণীটা কাটিয়াছি খুব ব্যস্ততার মাঝে। একদিকে ছিল দশম শ্রেণির পাঠ্যক্রমের বিষয়গুলো আয়ত্ত করা, অন্যদিকে ছিল এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি। তখনকার দিনে “নোট” করে পড়ার রেওয়াজ ছিল। পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য আমরা নোট আকারে পূর্ববর্তী কয়েক বছরের পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে আসা প্রশ্নের উত্তর তৈরি করতাম। আমাদের সবার আলাদা আলাদা নোট ছিল। নোটগুলো আমাদের শিক্ষকরা সংশোধন করে দিতেন। আমাদের বছরে পরীক্ষা হতো দুটি – জুলাই মাসে অর্ধ-বার্ষিক পরীক্ষা এবং ডিসেম্বরে বার্ষিক পরীক্ষা। দশম শ্রেণীতে আমাদের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল তিনটি – জুনে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা, আগস্টে অর্ধ-বার্ষিক পরীক্ষা এবং ডিসেম্বরে নির্বাচনী (টেস্ট) পরীক্ষা। প্রতিটি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের বিন্যাস ছিল এসএসসি পরীক্ষার অনুরূপ। উদ্দেশ্য ছিল এসএসসি পরীক্ষার সাথে আমাদের পরিচিত করা যাতে আমরা আমাদের এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করতে পারি।

আমাদের স্কুলে প্রতি বছর টেস্ট পরীক্ষা পর পরই পরীক্ষার্থীদের নিয়ে পিকনিক করা হতো। আমাদের শিক্ষকরাও এতে আমন্ত্রিত থাকতেন। সেটাই ছিল আমাদের স্কুল জীবনে সবাই একসাথে মজা করার শেষ সুযোগ। পিকনিক আয়োজনের দায়িত্ব ছিল স্কুল কর্তৃপক্ষের। আগের বছরগুলোতে ঢাকার আশেপাশের কাওরাইদ, সাভার, টঙ্গীসহ বিভিন্ন স্থানে পিকনিক হয়ে গেছে। আমাদের সবার কৌতূহল আমাদের পিকনিক কোথায় হবে। আমাদের পিকনিকের আয়োজন করা হয়েছিল স্কুল থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে মৌচাক স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। এটা ছিল সেই সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় পিকনিক স্পট; শাল-গজারী বনে ঘেরা একটা সুন্দর জায়গা। আমরা ভাড়া করা তিনটা ‘মুড়ির টিন’ বাসে করে সেখানে গিয়েছিলাম। সেসময় ঢাকার প্রধান গণ-পরিবহন ছিল এই মুড়ির টিন বাস। প্রাকৃতিক পরিবেশে আমাদের সবার দিনটা খুব ভালো কেটেছিল। প্রচুর খাওয়া-দাওয়া ছাড়াও ছিল নানারকম হাস্য-কৌতুক, খেলাধুলা ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতা: পর্যবেক্ষণ প্রতিযোগিতা, স্মৃতি প্রতিযোগিতা, কবিতা রচনা প্রতিযোগিতা এবং সংবাদ পাঠ প্রতিযোগিতা।

আমাদের এসএসসি পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল ১৯৬৯ সালের এপ্রিলে মাসে। ২৫ মার্চ সামরিক আইন জারি হওয়ার পর আমাদের পরীক্ষা মাস খানেক পিছিয়ে যায়। অবশ্য এতে ভালোই হয়েছিল, প্রস্তুতির জন্য অতিরিক্ত সময় পেয়েছিলাম। আমাদের পরীক্ষা কেন্দ্র ছিল আজিমপুর এলাকায় অবস্থিত ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুল। কাকতালীয় ভাবে সেটাই ছিল আমার প্রথম স্কুল। এখানে ১৯৫৯ সালের জুলাই মাসে আমার স্কুল জীবনের শুরু। বরাবরের মতন আমাদের পরীক্ষা শুরু হয়েছিল বাংলা ভাষার দুটি পৃথক পত্র দিয়ে। আব্বা ড্রাইভ করে স্কুল গেটের সামনে নামিয়ে দিলেন। ইনভিজিলেটরকে ‘এডমিট কার্ড’ দেখিয়ে পরীক্ষার হলে ঢুকলাম। প্রথমে কিছুটা নার্ভাস লাগলেও সহপাঠীদের উপস্থিতিতে স্বস্তি বোধ করলাম। পরীক্ষা চলাকালীন ইউনিফর্ম পরা দুই সেনা অফিসার আমাদের পরীক্ষার হল পরিদর্শন করতে এসে ছিলেন। প্রথম পত্র পরীক্ষার পর ছিল এক ঘণ্টার বিরতি। সেই সময়ের একটা দৃশ্য এখনো মনে গেঁথে আছে। ওয়েস্ট এন্ড স্কুলের লোহার গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন অসংখ্য অভিভাবক। আর ভিতরে দাঁড়িয়ে আছে পরীক্ষার্থীরা। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের পরীক্ষা কেমন হয়েছে তা জানার চেষ্টা করছেন। গেট সামাল দিচ্ছেন ওয়েস্ট এন্ড স্কুলের হেডমাস্টার শামসুদ্দিন স্যার।

আমাদের পরীক্ষা ভালোই চলছিল; অপ্রত্যাশিত তেমন কিছু ঘটেনি। মাঝপথে এসে ধাক্কা খেলাম! আমাদের এসএসসি পাঠ্যক্রমে ভাষা (বাংলা ও ইংরেজি), গণিত (সাধারণ ও ঐচ্ছিক) এবং বিজ্ঞান (পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও জীববিদ্যা) ছাড়া 'সমাজবিদ্যা' নামে একটা বিষয় ছিল। মূলত সমাজবিদ্যা ছিল তিনটি বিষয়ের সমন্বয়: ইতিহাস, পৌরনীতি ও ভূগোল। বিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে বিষয়টা আমাদের জন্য ছিল অন্য ধরনের, তাই প্রয়োজন ছিল ভিন্ন ধরনের প্রস্তুতির। সমাজবিদ্যা পড়াতেন নূরুল ইসলাম স্যার। তিনি একজন অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ছিলেন; আমাদের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। তখন আমরা কত প্রশ্নের জন্যই না প্রস্তুতি নিয়ে ছিলাম! উত্তর মনে নেই তবে কিছু প্রশ্ন এখনো মনে আছে – রুশ বিপ্লবের কারণ ও ফলাফল; ১৯৬২ সালের সংবিধানের বৈশিষ্ট্য; রাষ্ট্র কাহাকে বলে; এবং আরো অনেক। আমরা আত্মবিশ্বাসী ছিলাম যে বিষয়টাতে আমরা ভালো করব। কিন্তু পরীক্ষার পর আমরা আমাদের পারফরম্যান্স নিয়ে খুবই হতাশ হলাম। প্রশ্নপত্র খুব কঠিন ছিল; প্রশ্নপত্রের বিন্যাস সম্পূর্ণ পরিবর্তন করা হয়েছিল। ফলে অনেক পরীক্ষার্থী বিষয়টাতে ফেল করে ছিলো। তাই বোর্ড কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে সবার ১০ নম্বর বাড়িয়ে দিয়েছিলো। বাকি পরীক্ষাগুলোতে কোনো অসুবিধা হয়নি। দশটা বিষয়ের পরীক্ষা শেষ করতে আমাদের প্রায় এক মাস লেগেছিল। এর পর ফলাফলের জন্য অপেক্ষা।

১৯৬৫ সাল থেকে পর পর চার বছর মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকারের পর আমাদের সময়ে এর ছন্দপতন ঘটে। আমাদের ফার্স্ট বয় হায়দার চতুর্থ স্থান পেয়েছিলো। তবে সামগ্রিক ভাবে আমাদের রেজাল্ট অন্যান্য ব্যাচের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। তখন স্টার মার্ক আর লেটারের যুগ ছিল। স্টার মার্ক মানে সামগ্রিক ভাবে ৭৫% নম্বর আর লেটার মানে কোনো একটা বিষয়ে ৮০% নম্বর। আজকাল জিপিএ ফাইভের যুগ। তবে স্টার মার্কের সঙ্গে আর জিপিএ ফাইভের তুলনা চলে না। আমরা বিজ্ঞান বিভাগে ৪৩ জন ছাত্র ছিলাম। আমাদের সবাই সাধারণ গণিতে লেটারসহ প্রথম বিভাগে পাস করে ছিল। সব মিলিয়ে লেটারের সংখ্যা ছিল ১৪৮, অর্থাৎ জনপ্রতি গড়ে ৩.৩টা লেটার। স্টার মার্ক পেয়ে ছিল ১৩ জন। ওই বছর ঢাকা বোর্ডে স্টার মার্ক প্রাপ্তের সংখ্যা ছিল জনা চল্লিশেক। প্রসঙ্গত, ঢাকা বোর্ডে এ বছর জিপিএ ফাইভ পেয়েছে ৬৪ হাজার ৯৮৪ জন শিক্ষার্থী। এছাড়া কলা ও বাণিজ্য বিভাগে আমাদের সহপাঠীদের ফলাফলও উল্লেখযোগ্য। কলা ও বাণিজ্য বিভাগে মেধা তালিকায় যথাক্রমে তিন ও দুইজনসহ প্রথম বিভাগে ২৩ জন এবং দ্বিতীয় বিভাগে ৯ জন পাস করে ছিল। কেউ ফেল করেনি বা তৃতীয় বিভাগে পাস করেনি। (চলবে)



আগের পর্ব পরের পর্ব


ড. নজরুল ইসলাম, কার্টিন ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া






Share on Facebook               Home Page             Published on: 8-Jan-2023

Coming Events:



A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far