গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল, ঢাকা (৭) ড. নজরুল ইসলাম
নবম শ্রেণীতে ওঠা ছিল আমার স্কুল জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আমরা সিনিয়র ক্লাসে উঠে গেলাম। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত আমাদের ক্লাসের দুটি শাখা সমান্তরাল পথে এগুচ্ছিল। দৈনিক এসেম্বলি সহ নানান অনুষ্ঠানে যোগাযোগ হলেও দুই শাখার ছাত্রদের মধ্যে তেমন ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেনি। নবম শ্রেণীতে ক্লাস আবার নতুন ভাবে ভাগ হয়ে গেলো – 'ক' শাখাতে কলা ও বাণিজ্য বিভাগের ছাত্ররা আর 'খ' শাখাতে বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্ররা। আমি বিজ্ঞান বিভাগে চলে গেলাম। তৃতীয় শ্রেণীতে যাদের সঙ্গে স্কুল শুরু করেছিলাম তাদের অনেককে ছেড়ে যেতে হলো। অন্যদিকে, ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভিন্ন শাখায় যোগদানকারী অনেকের সাথে একসঙ্গে ক্লাস করার সুযোগ পেলাম। তাই নবম শ্রেণীতে ওঠাটা আমাদের সকলের জন্য ছিল একই সাথে আনন্দদায়ক এবং দুঃখজনক। তবে আমাদের উৎসাহের কমতি ছিল না। মনে হচ্ছিল আমরা নতুন স্কুল জীবন শুরু করছি।
হঠাৎ করে পড়াশুনার চাপ অনেক গুন বেড়ে গেলো। যোগ হলো চারটা নতুন বিষয়। সাধারণ বিজ্ঞান ভাগ হয়ে হলো – পদার্থবিদ্যা, রসায়ন এবং জীববিজ্ঞান। আর সাধারণ গণিতের সঙ্গে সাথে যোগ হলো ঐচ্ছিক গণিত। নতুন বিষয়গুলো বেশ কঠিন লাগতে লাগলো, কারণ অষ্টম এবং নবম শ্রেণীর বিজ্ঞান বিষয়গুলোর মধ্যে মানের বড় পার্থক্য ছিল। ঐচ্ছিক গণিত আয়ত্ত করতে আমরা রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছিলাম। ঐচ্ছিক গণিত পড়াতেন আমাদের শ্রেণী শিক্ষক হালদার স্যার। আমরা তাঁর তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হই। নবম শ্রেণীর অর্ধ বার্ষিক পরীক্ষায় ঐচ্ছিক গণিতে ক্লাসের প্রায় অর্ধেক ছাত্র ফেল করেছিল। আমি শতকরা ৫১ নম্বর পেয়ে কোনোমতে পাশ করেছিলাম। এতে অবশ্য ভালোই হয়েছিল। জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর আমাদের মাঝে যে একটা “ভাল ও মেধাবী“ ছাত্র-সুলভ অহংকার জন্মেছিলো তা সমূলে উৎপাটিত হয়েছিল। আমাদের দুই সহপাঠী অর্ধ বার্ষিক পরীক্ষার পর নিজের দুর্বলতা বুঝতে পেরে বিজ্ঞান বিভাগ ছেড়ে চলে যায়।
বিজ্ঞান বিষয়গুলো কঠিন মনে হলেও আমরা ব্যবহারিক ক্লাসগুলো খুব উপভোগ করছিলাম। বিশেষ করে রসায়নের ব্যবহারিক ক্লাস। রসায়নের ব্যবহারিক ক্লাস নিতেন মতিউল্লাহ স্যার। দু-চারটা রসায়নের ব্যবহারিক ক্লাস করার পর হঠাৎ আমাদের অনেকে “আল-কেমিস্ট” হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করি! অনেকে বাড়িতে ছোটোখাটো গবেষণাগার গড়ে তুলি। এলিফ্যান্ট রোডে এরোপ্লেন মসজিদের বিপরীতে কম্পালা হোটেলের কাছে একটা বৈজ্ঞানিক সরঞ্জামের দোকান ছিল। আমরা সেখান থেকে সরঞ্জামগুলো কিনতাম। সরঞ্জামের মধ্যে ছিল – বুনসেন বার্নার, ট্রাইপড, ফ্লাস্ক, বিকার, টেস্টটিউব এবং এই জাতীয় জিনিস যা দিয়ে বাসায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায়। জুনিয়র স্কলারশিপে পাওয়া টাকাটা সে সময় কাজে লেগে যায়। আমরা স্কুলের গবেষণাগারে যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতাম, বাড়িতে তার পুনরাবৃত্তি করে গভীর ভাবে বোঝার চেষ্টা করতাম। আর সেই সঙ্গে ছিল নিজে করার বাড়তি আনন্দ। আমাদের এসব কর্মকাণ্ডে পরিবারের সদস্যরা মোটেও সন্তুষ্ট ছিলেন না। মনে পড়ে, হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাসের গন্ধে তারা কতটা বিরক্ত হয়েছিলেন! বাড়িতে করা পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়ে আমরা সহপাঠীদের সাথে নোট বিনিময় করতাম। এ ছাড়া বাড়িতে যে সব বই এবং পত্র-পত্রিকা পড়তাম তাও বিনিময় করতাম। এই সময়ে পড়া, ১৮১৮ সালে প্রকাশিত মেরি শেলির 'ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন' উপন্যাসটা আমাদের অনেককে রসায়ন সম্পর্কে খুব অনুপ্রাণিত করেছিল। এই উপন্যাসে, বিজ্ঞানী ফ্রাঙ্কেনস্টাইন, রাসায়নিক প্রক্রিয়া এবং জীবন্ত জিনিসের ক্ষয় অধ্যয়ন করার পরে, মৃতদের পুনরুজ্জীবিত করার একটা উপায় খুঁজে পেয়েছিলেন।
আমাদের কমনরুমে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার মধ্যে ছিল কয়েকটা বিজ্ঞান পত্রিকা: বিজ্ঞান সাময়িকী, বিজ্ঞান বিচিত্রা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান। সে সময়, গবেষক ড. মুহাম্মদ ইব্রাহীম সম্পাদিত ‘বিজ্ঞান সাময়িকী’ পত্রিকাটা খুব জনপ্রিয় ছিল। বিজ্ঞানের জ্ঞানগর্ভ আলোচনা এই পত্রিকায় ফিচার আকারে ছাপা হতো। দেশ-বিদেশের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানীদের লেখা বোঝার বয়স তখনও আমাদের হয়নি। তবু সুযোগ পেলেই পত্রিকাটার পাতা উল্টে দেখতাম। ষাটের দশকের মাঝামাঝি ওয়েস্ট এন্ড স্কুল থেকে ‘টরেটক্কা’ নামে একটা মাসিক বিজ্ঞান পত্রিকার প্রকাশনা শুরু হয়; প্রকাশ কাল ১৯৬৪ থেকে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন ওই স্কুলের ছাত্র আবদুল কাদের। এটা ছিল বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম বিজ্ঞান বিষয়ক ছোটদের পত্রিকা। এতে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের লেখা ছাপা হতো। আমারও বিজ্ঞান বিষয়ক লেখার হাতেখড়ি এই পত্রিকার মাধ্যমে। আমাদের কমনরুমে না থাকলেও পত্রিকাটা আমরা নিয়মিত পড়তাম।
স্কুল দিবস উপলক্ষে দেয়াল পত্রিকা প্রকাশের ঐতিহ্য নিয়ে আগেই লিখেছি। দেয়াল পত্রিকা প্রকাশের জন্য আমাদের বেশ পরিশ্রম করতে হতো। প্রথমে লেখা বাছাই করা। তারপর নিউ মার্কেটের স্টেশনারি দোকান থেকে আর্ট পেপার, ইন্ডিয়ান ইন্ক্, আঁকার জন্য বিশেষ কলম, ইত্যাদি উপকরণ কেনা। কভার ডিজাইন সহ পত্রিকার লেআউট ডিজাইন করা। সব শেষে আর্ট পেপারের উপর সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা এবং ছবি আঁকা। আমাদের বাজেট ছিল সীমিত, তাই লেখার সময়ে কোনো ভুল করার সুযোগ ছিলোনা। খুব সাবধানে কাজটা করতে হতো। কাজটা কঠিন হলেও এতে ছিল সহযোগিতামূলক কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন এবং সৃজনশীল কাজ করার আনন্দ। নবম শ্রেণীতে আমরা বের করেছিলাম – 'স্মরণে'; বরাবরের মতো সেটা ছিল একটা সাহিত্য পত্রিকা। আমরা বিজ্ঞানের ছাত্র, বিজ্ঞান নিয়ে কিছু না লিখলে কি চলে? সে বছর বের করলাম আরেকটা দেয়াল পত্রিকা – ‘রশ্মি’। এতে ছিল ২৪ জন স্বনামধন্য বিজ্ঞানীদের অবদানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। আর সেই সঙ্গে হাতে আঁকা তাঁদের ছবি। একই বছর একই ক্লাসের পক্ষ থেকে দুটো দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ ল্যাবরেটরি স্কুলের ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম। মহান বিজ্ঞানীদের একটা টাইমলাইন তৈরির ধারণাটা দিয়েছিলো সহপাঠী হায়দার (বর্তমানে ডেনভার-বাসী)। ‘রশ্মি’ নামটাও তারই দেয়া। অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন আমাদের শ্রেণী শিক্ষক হালদার স্যার। প্রচ্ছদে ছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী পদার্থবিদ আইনস্টাইনের ছবি। আর সঙ্গে ছিল তাঁর বিখ্যাত সমীকরণ – ই ইকুয়াল টু এমসি স্কয়ার।
আমরা বিভিন্ন সেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করতাম। নবম শ্রেণীতে থাকা কালীন, বিজ্ঞান বিভাগের পাঁচজন সহপাঠী দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের এসএসসি পরীক্ষায় ‘শ্রুতি লেখক’ হিসেবে সাহায্য করেছিল। পরীক্ষার্থীরা শেরেবাংলা নগরে (তখনকার নাম ছিল আইউব নগর সেকেন্ড ক্যাপিটাল) অবস্থিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী স্কুলের ছাত্র ছিল। পরীক্ষা কেন্দ্র ছিল সদরঘাট এলাকার ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল। পরীক্ষার দিন সকালে আমার সহপাঠীরা পরীক্ষার্থীদের নিয়ে মাইক্রোবাসে সেখানে যেত। শ্রুতি লেখকের কাজ ছিল পরীক্ষার্থীদের প্রতিটা প্রশ্ন পড়ে শোনানো এবং তাদের উত্তর খাতায় লিপিবদ্ধ করা। পরীক্ষার নীতিমালা অনুযায়ী পরীক্ষার্থীদের কেউই বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিল না। তাদের মধ্যে এক জন গণিতে লেটার সহ প্রথম বিভাগে এবং বাকি চার জন দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেছিল। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী পরীক্ষার্থীদের জন্য এটা ছিল বড় অর্জন। আর আমার সহপাঠীদের জন্য ছিল দৃষ্টি প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের সাহায্য করার তৃপ্তি এবং এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা। তখনকার দিনে যক্ষ্মা নিবারণের জন্যে ডোনেশন সংগ্রহ করা হতো টি বি সিল বিক্রি করে। আমরা কয়েকজন এতে অংশ গ্রহণ করেছিলাম। ৪/৫ জনের দলে ভাগ হয়ে আমরা টি বি সিল বিক্রি করতাম। এতে সুবিধা ছিল “অনুমোদিত” ক্লাস ফাঁকি দেয়ার! তাছাড়া পাবলিক ট্রান্সপোর্টে বিনা পয়সায় চড়া যেত। আমরা নিউ মার্কেট/গুলিস্তান/মতিঝিল এলাকায় ঘুরে বেড়াতাম। একবার ট্রেনে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত গিয়েছিলাম। ১৯৬৭ সালে আমাদের স্কুলের সংগ্রহ ছিল সবচেয়ে বেশি।
আমরা ছয়জনকে বিজ্ঞান শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি – জব্বার স্যার (রসায়ন), জাফর আলী স্যার (পদার্থবিদ্যা), হালদার স্যার (ঐচ্ছিক গণিত এবং পদার্থবিদ্যা), মতিউল্লাহ স্যার (রসায়ন), জহুরুল হক স্যার (জীববিজ্ঞান) এবং ওয়াহাব স্যার (জীববিজ্ঞান)। তাঁদের মধ্যে হালদার স্যার আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছেন। তাঁকে আমরা অল্প সময়ের জন্য পেয়েছি। তিনি ১৯৬৬ সালে আমাদের স্কুলে যোগদান করেন। তখন আমি অষ্ট শ্রেণীর ছাত্র। নবম শ্রেণীর শেষ দিকে তিনি ইউনিভার্সিটি অফ রিডিং কমনওয়েলথ বার্সারি প্রোগ্রামের অধীনে উচ্চ শিক্ষার জন্য বছর খানেকের জন্য যুক্তরাজ্যে চলে যান। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি একজন ভালো শিক্ষক হিসেবে আমাদের সবার মন জয় করে নিয়েছিলেন। তিনি গণিত পড়াতেন। প্রতিটি অঙ্ক ছিল তাঁর নখদর্পণে। তাঁর অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল জটিল অঙ্কগুলো সহজ ভাবে বুঝিয়ে দেবার। আমি যখন বুলগেরিয়াতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছিলাম, তখন আমাদের চারটা গণিত বিষয় ছিল। আমি ঐ চারটা বিষয়েই ভালো রেজাল্ট করেছিলাম। গণিতে আমার দক্ষতা দেখে আমার এক প্রফেসর মন্তব্য করেছিলেন – গণিতে তোমার বুনিয়াদ খুব শক্ত। নিশ্চয়ই খুব ভাল শিক্ষকদের কাছ থেকে গণিত শিখেছো। তখন আমার হালদার স্যারের কথা মনে পড়ছিল। এ প্রসঙ্গে আমি আরও এক জন গণিত শিক্ষকের নাম উল্লেখ করতে চাই। তিনি হলেন ঢাকা কলেজের প্রফেসর লুৎফুজ্জামান স্যার। আমার সৌভাগ্য আমি এই দুই শিক্ষকের কাছে কিছুদিন প্রাইভেট পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। তাঁদের কাছে আমি চির ঋণী। আজ গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি এই দুই নিবেদিত প্রাণ শিক্ষককে। (চলবে)
আগের পর্ব পরের পর্ব
ড. নজরুল ইসলাম, কার্টিন ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া
|