গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল, ঢাকা (৬) ড. নজরুল ইসলাম
শুরু থেকেই আমাদের স্কুলে সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ছিল। উদ্বোধনী দিনে, আমরা বিশাল স্কুল প্রাঙ্গণ, সুপরিকল্পিত নতুন ভবন এবং চারপাশে পরিচ্ছন্ন পরিবেশ দেখে আনন্দিত হয়েছিলাম। আমাদের স্কুল ক্যাম্পাসটা হলো টিচার্স ট্রেনিং কলেজের পশ্চিমে, মিরপুর রোড থেকে একটু ভিতরে। টিচার্স ট্রেনিং কলেজ এবং ঢাকা কলেজের মধ্যবর্তী একটা ছোট রাস্তা দিয়ে যেতে হয় যা এখন নায়েম রোড নামে পরিচিত। ওই রাস্তা দিয়ে স্কুলে যাওয়ার সময় ডান পাশে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ক্যাম্পাসের সারিবদ্ধ ইউক্যালিপটাস গাছগুলো চোখ কেড়ে নিতো। ষাটের দশকে ঢাকা শহরে আর কোথাও এমন ইউক্যালিপটাস গাছ দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। বা পাশে ছিল ঢাকা কলেজের টেনিস কোর্ট। একটু এগুলেই আমাদের স্কুল। আমাদের স্কুলের প্রধান ভবনের সামনে ছিল একটা বড় বৃত্তাকার বাগান। বাগানে ছিল রকমারি ফুল এবং পাতাবাহার গাছের সমাহার। গাড়ি বারান্দার ধার ঘেঁষে ছিল একটা লাল রঙের বোগেনভিলিয়া ফুলের গাছ। প্রধান ভবনে ঢুকতেই বা পাশে প্রধান শিক্ষকের ঘর। আর ডান পাশে দর্শনার্থীদের অপেক্ষা করার জন্য আরেকটা ঘর। ১৯৬১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর, এই প্রবেশপথ দিয়ে ঢোকার আগে চার হাউসের প্রতীকী রঙের ফিতা কেটে আমাদের স্কুল উদ্বোধন করে ছিলেন তৎকালীন জনশিক্ষা পরিচালক শামসুল হক সাহেব। সামনে বিশাল বারান্দা। স্কুলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল এই বারান্দায়। সেই অনুষ্ঠানে ছাত্র এবং অভিভাবকরা আমন্ত্রিত ছিলেন। আমি তখন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। অনুষ্ঠানের কথা কিছু মনে নেই। তবে অনুষ্ঠান শেষে অনেক মিষ্টি খাওয়ার কথা মনে পড়ে। সেদিন ছিল রোববার, সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তাই ক্লাস হলো না। আমরা আমাদের অভিভাবকদের নিয়ে নতুন স্কুল ভবন ঘুরে দেখলাম।
আমাদের ক্লাসরুমগুলো সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকত। স্কুলের ঝাড়ুদার শ্রীচরণ দা বরাবরই নিষ্ঠার সাথে এই দায়িত্বটা পালন করতেন। ক্লাসরুমগুলো ছিল বেশ খোলামেলা; সব সময় থাকতো আলো-বাতাসে ভরপুর। আমরা জানালা দিয়ে স্কুলের মাঠ দেখতে পেতাম। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময়, সুরক্ষার জন্য জানালার পাশে একটা ২০ ইঞ্চি ইটের প্রাচীর তৈরি করা হয়েছিল। ফলে আমরা জানালা দিয়ে দেখা সুন্দর দৃশ্য থেকে বঞ্চিত হই। আমাদের ক্লাস চলাকালীন বিরাজ করতো নিবিড় নীরবতা। আমরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত শিক্ষকদের পাঠ শুনতাম। প্রতিটি বিষয়ে তাঁরা ছিলেন পারদর্শী। ভাবতে অবাক লাগে কোনো নোট ছাড়াই তাঁরা কিভাবে জটিল বিষয়গুলো ব্ল্যাকবোর্ডে তুলে ধরতেন। আমাদের প্রধান শিক্ষক সালেক স্যার ক্লাসের শৃঙ্খলা সম্পর্কে সর্বদা সচেতন থাকতেন। সুযোগ পেলেই স্কুলে টহল দিতেন। মাঝে মাঝে পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে ক্লাস কেমন চলছে তা পর্যবেক্ষণ করতেন। উনার একটা সাদা রঙের সুট ছিল। হঠাৎ সেই বেশে উনাকে দেখে আমরা অনেকেই আঁতকে উঠতাম। যেন মূর্তিমান যম!
উদ্বোধনের দিন স্কুল ভবনে নামাজ পড়ার জন্য একটা ঘর দেখে আমাদের অভিভাবকরা আশ্বস্ত হয়েছিলেন যে উদ্বোধনী ভাষণে ঘোষিত ‘ইসলামী আদর্শের বিকাশের’ অঙ্গীকারটা খালি স্লোগান ছিল না। সুন্দর মোজাইক করা মেঝের নামাজঘর ছিল আমাদের। তখনো ওজুর জন্য আলাদা ঘর তৈরি হয়নি। সিনিয়ার ভাইরা আমাদের স্কুল প্রাঙ্গণের পুকুরের পানি দিয়ে ওজু করতেন। প্রসঙ্গত, আমাদের স্কুলের উদ্বোধন বেশ তড়িঘড়ি করে করতে হয়েছিল। তখন শিক্ষা বছর শুরু হতো জুলাই মাস থেকে। আমাদের স্কুল ভবন নির্মাণ সম্পূর্ণ না হওয়ায় উদ্বোধন দু মাস বিলম্বিত হয়েছিল। জোহরের সময় নামাজের জামাত হতো। ঘরটাতে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় নামাজ পড়া বাধ্যতামূলক ছিল না। তাছাড়া পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত আমাদের ইউনিফর্ম ছিল হাফ প্যান্ট। হাফ প্যান্ট পরে নামাজ পড়া সম্ভব ছিল না। তবে পঞ্চম শ্রেণীর কিছু সিনিয়র ভাইকে নামাজ পড়ার জন্য লুঙ্গি নিয়ে আসতে দেখেছি। নামাজ পড়ার জন্য তাগাদা শুরু হয় ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে। আমাদের দিনিয়াত স্যার এ ব্যাপারে খুব কড়া ছিলেন। দিনিয়াত ক্লাস হতো টিফিন বিরতির পর। ক্লাসে তিনি খবর নিতেন সবাই নামাজ পড়েছে কিনা। নামাজ না পড়লে কঠোর শাস্তি পেতে হয়তো।
আমাদের স্কুলের উন্নত মানের টিফিনের কথা আগেই লিখেছি। এছাড়া টিফিন বিরতির সময় স্কুলের গেটের সামনে বিক্রি হতো নানা ধরণের মুখরোচক খাবার – ঝালমুড়ি, চানাচুর, চটপটি, ফুচকা, কটকটি, শোনপাপড়ি এবং নানা ধরণের আচার। আর পাওয়া যেত ‘কাঠি আইসক্রিম’ যা অস্ট্রেলিয়ায় 'আইস পপ' এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে 'পপসিকল' নামে পরিচিত। বেবি আইসক্রিম কোম্পানির এক আনা দামের শক্ত রঙিন আইসক্রিম আর দুআনা দামের নরম দুধ-সাদা আইসক্রিম আমাদের সবার খুব প্রিয় ছিল। আমাদের শিক্ষকরা পছন্দ করতেন না আমরা এই সব “জাঙ্ক ফুড” খাই। তাই বিক্রেতাদের স্কুল গেটের সামনে থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। তারা গিয়ে অবস্থান নেয় মিরপুর রোডের কাছাকাছি। এতে অবশ্য খাবারগুলোর প্রতি আমাদের আকর্ষণ কমে যায় নি। একটা খাবার খুব জনপ্রিয় ছিল – চটপটি, ঘুগনি এবং ফুচকার কমবিনেশন। সাথে ছোট বাটি ভরা তেঁতুলের টক পানি। আমাদের এক শিক্ষক খাবারটার নাম দিয়েছিলেন “লোটা”। সেই লোটার স্বাদ আজও ভুলতে পারিনি। আচার আমার খুব প্রিয় ছিল। বিভিন্ন ধরণের আচারের মধ্যে ছিল – বারোই, তেঁতুল, জলপাই এবং চালতার আচার। আচার পরিবেশন করা হতো একটা চৌকো কাগজে। কাগজে লেপটানো সেই আচার আমরা পরম তৃপ্তির সাথে চেটে চেটে খেতাম।
আমাদের স্কুল জীবন নিয়ে লিখতে গেলে বলাকা সিনেমা হলের কথা উল্লেখ করতেই হয়। সিনেমা হলটা ছিল আমাদের স্কুলের কাছে, নিউ মার্কেটের বিপরীতে। টিফিন পিরিয়ডে আমাদের অনেকের যাতায়াত ছিল। বলাকা সিনেমা হলের উদ্বোধন হয় ১৯৬৪ সালের ১ মে 'দুই দিগন্ত' চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে। আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। তখনও আমার সিনেমা দেখার অনুমতি হয়নি। বলাকা সিনেমা হলে আমার দেখা প্রথম ছবি 'দা লংগেস্ট ডে'। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপর নির্মিত ছবিটা আমার কিশোর মনে ভীষণ দাগ কেটেছিল। মার্বেল পাথরে গড়া সিনেমা হলের ফটকটা দেখতে খুব সুন্দর ছিল। ঢুকতেই ছিল একটা বিশাল একুরিয়াম। ১৯৬৫ সালের মার্চ মাসে বলাকা সিনেমা হলে একটা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব হয়েছিল। সেই উৎসবে অন্যান্য ছবির সঙ্গে দেখানো হয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’ সিনেমাটা। পূর্ব বাংলার লোকজন সত্যজিত রায়ের ছবি দেখার জন্য ছিল পাগল! সৃষ্টি হয়েছিল এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। টিকিটের জন্য মারামারি পর্যন্ত হয়েছিল। সেই মারামারির সময়, সুন্দর একুরিয়ামটা ভেঙে গিয়েছিলো যা আর প্রতিস্থাপন করা হয়নি। শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ 'মহানগর’ সিনেমাটা ২৪ ঘণ্টা ধরে দেখানোর ব্যবস্থা করেছিলেন।
টিফিন বিরতির সময় বলাকা সিনেমা হলে যাওয়ার ঐতিহ্য আমরা আমাদের সিনিয়র ভাইদের কাছ থেকে পেয়েছি। আমাদের টিফিন শুরু হতো দুপুর একটা থেকে; ‘স্পেশাল শো’ সিনেমা দেখার জন্য সেটা ছিল উপযুক্ত সময়। তখনকার দিনে এই সময়টাতে ইংরেজি ছবি দেখানো হতো। সিনিয়র ভাইদের কেউ কেউ স্কুল ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখতেন। এই খবরটা কেমন করে যেন সালেক স্যারের কানে চলে যায়। এরপর থেকে তিনি মাঝে মাঝে টিফিনের পর নবম ও দশম শ্রেণীর ছাত্রদের উপস্থিতি পরীক্ষা করতেন। শুনেছি উনাদের কেও কেও ধরা পড়ে শাস্তিও পেয়েছিলেন। স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখার দলে মেধাবী ছাত্ররাও ছিলেন। আমাদের কিছু সহপাঠী সিনেমার প্রতি খুব আগ্রহী ছিল। টিফিন বিরতির সময় বলাকা সিনেমায় ঢুঁ মারা ছিল তাদের প্রতিদিনের রুটিন। কখনো কখনো তারা “অনুমতি” নিয়ে স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখতো। ক্লাস ক্যাপ্টেন হিসেবে আমি তাদের সেই কৌশল সম্পর্কে অবগত ছিলাম। তাদের একজন এসিসটেন্ট হেডস্যারের কাছে দরখাস্ত নিয়ে যেত – আজ দুপুরে তার জন্মদিনের পার্টি, তাই টিফিনের পর ছুটি চাই। দরখাস্ততে আমন্ত্রিত কয়েকজন বন্ধুর নাম থাকতো। তাদেরও ছুটি চাই। আমাদের এসিসটেন্ট হেডস্যার ছিলেন সরল মানুষ। ছুটি মঞ্জুর করে দিতেন।
এ রকম একটা পরিবেশে আমরা বেড়ে উঠেছি। যেখানে ছিল কঠোর ডিসিপ্লিন আর সেই সঙ্গে ছিল ডিসিপ্লিনের গণ্ডি পেরিয়ে আমাদের কৈশোরের কৌতূহল মেটানোর প্রচেষ্টা। উপরের ক্লাসে উঠার সাথে সাথে স্কুলের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। আর বাড়তে থাকে পড়াশুনার চাপ। অষ্টম শ্রেণীতে পড়াকালীন একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা। পরীক্ষার আগে মাস দুয়েক আমাদের কোচিং ক্লাস হয়েছিল। ক্লাসগুলো হতো স্কুল ছুটির পর। তখন কত কি না মুখস্থ করেছি! বাগধারা – গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল, ডুমুরের ফুল, কাঁঠালের আমসত্ত্ব; আর ছিল এক কথায় প্রকাশ – ফল পাকিলে যেই গাছ মরিয়া যায় (ওষধি), কি করিতে হইবে তাহা বুঝিতে না পারা (কিংকর্তব্যবিমূঢ়), ইত্যাদি, ইত্যাদি। তখন শেখা বাংলা ব্যাকরণ পরে অনেক কাজে দিয়েছিলো। আমাদের পরীক্ষা হয়েছিল ফার্মগেট পলিটেকনিক হাই স্কুলে ১৯৬৬ সালের ২১ এবং ২২ ডিসেম্বর। আমরা ১২ জন বৃত্তি পেয়েছিলাম। যতদূর মনে পড়ে, বৃত্তির পরিমাণ ছিল মাসে ৩২ টাকা এবং বই কেনার জন্য বছরে ৮০ টাকা। তখন টাকার মূল্য ছিল অনেক বেশি; সোনার দাম ছিল ১৪০ টাকা ভরি। কাজেই মাসিক ৩২ টাকা বৃত্তি আমাদের জন্য ছিল একটা বিরাট ব্যাপার! (চলবে)
আগের পর্ব পরের পর্ব
ড. নজরুল ইসলাম, কার্টিন ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া
|