bangla-sydney













গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল, ঢাকা (৫)
ড. নজরুল ইসলাম


গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার পেছনে ছিলেন ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের শিক্ষকবৃন্দ। তাঁরা ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ। তাঁদের অনেকেই ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষাপ্রাপ্ত। তাঁরা জানতেন যে জীবনে সাফল্য লাভ করার জন্য শুধু লেখাপড়াই যথেষ্ট নয়। তাই আমাদের পাঠ্যক্রমে বাংলা, ইংরেজি, অংক এবং বিজ্ঞানের পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল, যেমন শারীরিক শিক্ষা ক্লাস, ড্রয়িং ক্লাস, সিসিএ (পাঠ্যসূচী-সহায়ক কার্যক্রম) ক্লাস, এবং লাইব্রেরি ক্লাস। এ ছাড়াও ছিল পাঠক্রম বহির্ভূত বিভিন্ন কার্যক্রম - সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিজ্ঞান প্রদর্শনী, রচনা প্রতিযোগিতা, বক্তৃতা প্রতিযোগিতা এবং ক্রীড়া প্রতিযোগিতা।

শুরু থেকেই আমাদের স্কুলে লাইব্রেরি ছিল। চার হাজারেরও বেশী বই ছিল আমাদের লাইব্রেরিতে। কিন্তু লাইব্রেরিতে বসার জায়গা বা লাইব্রেরিয়ান কোনোটাই ছিল না। একটা ছোট্ট ঘরে বইগুলো রাখা ছিল। লাইব্রেরি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন সিরাজুল হক খান স্যার। বুধবার শেষ ঘণ্টা সংরক্ষিত ছিল লাইব্রেরি ক্লাসের জন্য। তখন আমরা বাসায় পড়ার জন্য লাইব্রেরি থেকে বই পছন্দ করতাম। দুই সপ্তাহ পর বইগুলো ফেরত দিতে হতো। আমাদের লাইব্রেরিতে বিভিন্ন বইয়ের একটা ভাল সংগ্রহ ছিল। স্কুল প্রতিষ্ঠার সময় আমাদের শিক্ষকরা বইয়ের দোকান ঘুরে ঘুরে এই বইগুলো কিনেছিলেন। পূর্ব বাংলার বিখ্যাত লেখকদের লেখা অনেক বই ছিল আমাদের লাইব্রেরিতে, যেমন জসীম উদ্দিনের 'বাঙ্গালীর হাসির গল্প', সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর 'লালসালু', আবু ইসহাকের 'সূর্য দিঘল বাড়ী' এবং জহির রায়হানের 'বরফ গলা নদী’। তখন থেকে আমরা অনেকেই সিলেবাসের বাইরের বই পড়ার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠি। কেউ কেউ আবার বাড়িতে ছোটোখাটো লাইব্রেরি গড়ে তুলতে শুরু করি। দুর্ভাগ্যবশত, ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি এবং লাইব্রেরিয়ানের অভাবে, ৫/৬ বছর পর আমাদের লাইব্রেরি থেকে বই নেয়া বন্ধ হয়ে যায়। তবে বই পড়ার অভ্যাসটা থেকে যায়।

আমাদের স্কুলের বাৎসরিক পত্রিকা ছিল, যার নাম 'অনুশীলন'। সত্যি যথাযথ নাম। অনুশীলন আমাদের কাঁচা হাতের অনুশীলনের সুযোগ করে দিয়েছিল। পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল তৃতীয় শিক্ষা বর্ষে (১৯৬৩)। সম্পাদক ছিলেন কাজী নূরুল হক স্যার। এতে ছাত্রদের লেখা গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি ছাপা হতো। অনেক মনীষীর জীবনী নিয়ে লেখা থাকতো। প্রথম সংখ্যায় মুসলিম বিশ্বের যে চারজন প্রখ্যাত মনীষীর নামে আমাদের হাউসগুলোর নামকরণ করা হয়েছিল তাঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ছাপা হয়েছিল। প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদটি করা হয়েছিল আমাদের চার হাউসের প্রতীকী রং, হলুদ, নীল, সবুজ এবং লাল মিলিয়ে। ছাত্রদের আঁকা ছবিও ছাপা হতো এতে। দ্বিতীয় সংখ্যায় (অনুশীলন ১৯৬৪) পিছনের পৃষ্ঠায় আমার আঁকা একটা ছবি ছাপা হয়েছিল। আর চতুর্থ সংখ্যায় (অনুশীলন ১৯৬৬) আমার একটা প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল। আমি তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। এটাই আমার প্রথম প্রকাশিত লেখা। আমার মতো আরো অনেকেরই লেখায় হাতেখড়ি স্কুল-পত্রিকার মাধ্যমে। বরাবরই আমাদের শিক্ষকরা আমাদের লেখার মাধ্যমে স্বাধীন চিন্তা প্রকাশ করতে উৎসাহিত করতেন। অনুশীলন সম্পাদকের একটা মন্তব্য আজও আমার মনে গেঁথে আছে (অনুশীলন ১৯৬৯) – “স্কুল-বার্ষিকীতে যারা লেখে, যারা সাধনা করে তারা সবাই হয়তো পরবর্তীকালে নামজাদা কবি-সাহিত্যিক হতে পারে না। আমের সব মুকুলের ফলন হয় না - মাঝ পথে অনেকেই ঝরে যায়। যারা ঝরে যায় তাদের প্রচেষ্টাকে তাই বলে বৃথা বলা যায় না।“

আমাদের স্কুলে বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। তার প্রস্তুতি চলতো অনেক দিন ধরে। রিহার্সালগুলো হতো স্কুল ছুটির পর। আমাদের বাসা স্কুলের কাছাকাছি থাকায় সুবিধা ছিল। স্কুল ছুটির পর মুখে কিছু একটা দিয়েই চলে যেতাম রিহার্সাল দেখতে। গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখতাম সেগুলো। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অংশ হিসাবে থাকতো - নাচ, গান, আবৃত্তি, হাস্যকৌতুক এবং নাটক। একটা গানের কথা আজও মনে পড়ে। গানটা ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া - শান্ত নদীটি, পটে আঁকা ছবিটি ……….। এক সিনিয়র ভাই গানটা গাইছিলেন। তার সঙ্গে দৃশ্যটা বোর্ডে আঁকছিলেন আরেক ভাই। অপূর্ব উপস্থাপনা! সবচেয়ে উপভোগ্য ছিল নাটকগুলো। প্রথম কয়েক বছরে অভিনীত নাটকগুলোর মধ্যে ছিল - নুরুল মোমেনের 'ভাই ভাই আমরা সবাই', সুকুমার রায়ের 'অবাক জলপান', রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'খ্যাতির বিড়ম্বনা' এবং ইব্রাহীম খাঁ এর 'গোলামীর বোঝা' ও 'ভিস্তি বাদশাহ'। প্রথম দিকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটা হতো স্কুল দিবসের কার্যক্রমের অংশ হিসাবে। অনুষ্ঠান শুরু হতো প্রধান শিক্ষকের বার্ষিক প্রতিবেদন পাঠ দিয়ে, তারপর পুরস্কার বিতরণ এবং সবশেষে বিচিত্রা অনুষ্ঠান। প্রত্যেক ক্লাসে প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থান অধিকারীকে পুরস্কৃত করা হতো। আর একটা বিশেষ পুরস্কার থাকতো বছরে প্রত্যেক দিন উপস্থিত থাকার জন্য। পরবর্তীতে অনুষ্ঠানটা স্কুল দিবস (৩ সেপ্টেম্বর) থেকে সরিয়ে বছর-শেষে অনুষ্ঠানের রেওয়াজ চালু করা হয়। অনুষ্ঠানটা হতো টিচার্স ট্রেনিং কলেজ মিলনায়তনে। অনুষ্ঠানে আমাদের অভিভাবকদের আমন্ত্রণ জানানো হতো। প্রথম অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন জনশিক্ষা পরিচালক শামসুল হক সাহেব। দ্বিতীয় অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন প্রবীণ শিক্ষাবিদ খান বাহাদুর আব্দুর রহমান খান। তিনি অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা দেখে মুগ্ধ হয়ে মন্তব্য করেছিলেন - অবিভক্ত বাংলায় প্রেসিডেন্সি কলেজ ছাড়া অন্য কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এতো সুন্দর প্রতিষ্ঠা দিবস অনুষ্ঠিত হতে তিনি দেখেননি। উনার হাত থেকে একটা পুরস্কার গ্রহণ করার সৌভাগ্য আমার হয়ে ছিল।

আমাদের স্কুলে বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি মাঝে মাঝে আনন্দপ্রদ অনুষ্ঠান হতো। এর মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় হলো ম্যাজিক শোগুলো। প্রথমদিকে ছাত্র সংখ্যা যখন কম ছিল, ম্যাজিক শোগুলো হতো টিচার্স রুমের সামনের খোলা বারান্দায়। সেখানে বসার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ম্যাজিক দেখতাম। তখন দেখা একটা ম্যাজিকের কথা আজো মনে পড়ে। নানা জাদুর ফাঁকে একটা ছোট জগ থেকে পানি ঢেলে হাত ধুচ্ছিলেন জাদুকর। অনেকবার পানি ঢালার পরও জগের পানি শেষ হচ্ছিলো না। যেন পানির অফুরন্ত সরবরাহ ছিল জগটাতে। পরে দেখা আরেকটা ম্যাজিকের কথা মনে আছে - জ্যান্ত মুরগি খাওয়ার ম্যাজিক। সেটা হয়েছিল টিচার্স ট্রেনিং কলেজ মিলনায়তনে। জাদুকর মন্ত্র পড়ে এক গ্লাস পানি আমাদের এক শিক্ষককে দিলেন। জাদুকরের গায়ে সেই পানি ছিটিয়ে দিতেই তিনি রাক্ষসে পরিণত হলেন। রাক্ষসটা একটা জ্যান্ত মুরগি হাতে নিয়ে তার টুঁটি ছিঁড়ে ফেলতেই ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে থেকে, গলা মুখে পুরে রক্ত খেতে থাকে, দেহটা টেনে ছিঁড়ে কাঁচা মাংস চিবিয়ে খেতে থাকে। রাক্ষসের সারা মুখে রক্ত লেপটে যায়, আর সেই সঙ্গে হা হা হা করে অট্টহাসি। সে এক বীভৎস দৃশ্য। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী, আমাদের শিক্ষক রাক্ষসের উপর মন্ত্র পড়া পানি ছিটিয়ে দেয়ার সাথে সাথে সে তার মানব রূপ ফিরে পায়। আমরা সবাই খুব ভয় পেয়েছিলাম ম্যাজিকটা দেখে।

আমাদের স্কুলে বিজ্ঞান প্রদর্শনী হতো স্কুল দিবসে। প্রসঙ্গত, আমাদের স্কুলে তিনটি বিজ্ঞান গবেষণাগার ছিল - সাধারণ গবেষণাগার, পদার্থ বিজ্ঞান গবেষণাগার এবং রসায়ন গবেষণাগার। তখনকার দিনে খুব কম স্কুলে তিনটি আলাদা বিজ্ঞান গবেষণাগার ছিল। আমরা নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞানের আনুষ্ঠানিক ছাত্র হওয়ার আগে থেকেই এসব গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতাম। বিজ্ঞান প্রদর্শনী আমাদের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান দর্শকদের সামনে তুলে ধরার সুযোগ করে দিয়েছিলো। দর্শকদের মধ্যে সহপাঠী এবং অন্যান্য শ্রেণীর ছাত্র ছাড়াও থাকতেন আমাদের অভিভাবকরা। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় বিজ্ঞান প্রদর্শনীতে আমি একটা আগ্নেয়গিরি তৈরি করেছিলাম। মাটি দিয়ে বানিয়েছিলাম আগ্নেয়গিরিটা। আর অগ্নুৎপাতের জন্য ব্যবহার করেছিলাম পটাসিয়াম ক্লোরেট, চিনি এবং সালফিউরিক অ্যাসিড। এই তিনটি উপাদান একত্রিত করলে যে রাসায়নিক প্রক্রিয়া হয়ে তাতে প্রচুর তাপ শক্তি, একটা দর্শনীয় বেগুনি শিখা এবং প্রচুর পরিমাণে ধোঁয়া সৃষ্টি করে, বিজ্ঞান ক্লাসে শেখা এই জ্ঞানটা ব্যবহার করেছিলাম। বিজ্ঞান প্রদর্শনীতে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াও থাকতো কিছু নতুন উদ্ভাবন।

বিভিন্ন পাঠক্রম বহির্ভূত কার্যক্রম আমাদের ব্যক্তিত্ব বিকাশ এবং চরিত্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এগুলো আমাদের জীবনের ভিত্তি স্থাপনে সাহায্য করেছিল। আর এই শক্ত ভিত্তির জন্যই আমি কোনো বড় বাধা ছাড়াই জীবনে এতদূর আসতে পেরেছি। (চলবে)



আগের পর্ব পরের পর্ব



ড. নজরুল ইসলাম, কার্টিন ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া






Share on Facebook               Home Page             Published on: 20-Dec-2021

Coming Events: