bangla-sydney













গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল, ঢাকা (৩)
ড. নজরুল ইসলাম


গত পর্বে আমাদের স্কুলের নামের বানান নিয়ে লিখেছিলাম। ‘গবর্নমেন্ট’ বানানটা বেখাপ্পা লেগেছিলো। কাজেই অনুসন্ধানে লেগে গেলাম। বেশি কষ্ট করতে হয়নি। গুগল সার্চের মাধ্যমে সহজেই পেয়ে গেলাম রবীন্দ্র রচনাবলীতে একটা লেখা। শিরোনাম ‘আবদারের আইন’। লেখাটার শুরু এই ভাবে – “ভারত গবর্নমেন্ট সুদীর্ঘ গ্রীষ্মাবকাশের পর গৃহে এক উৎকট কর সংস্থাপনের উদ্দেশ্যে একটি অভিনব আইনের অনুষ্ঠান করিয়াছেন।” বুঝতে অসুবিধা হলো না রবীন্দ্রনাথ এই বানান ব্যবহার করতেন। আর তাঁকে অনুসরণ করেই প্রতিষ্ঠাতারা আমাদের স্কুলের নামের বানানটি বেছে নিয়েছিলেন।

ল্যাবরেটরি হাই স্কুল একটা পুরোপুরি বাংলা মিডিয়াম স্কুল। আমাদের স্কুল উদ্বোধনের পরদিন (৪ সেপ্টেম্বর ১৯৬১) ইত্তেফাকে ব্যানার হেডিং দিয়ে ছাপা হয়েছিল – “বাংলা ভাষার মাধুর্যমন্ডিত পরিবেশে নব-বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু।” বাংলার উপর আমাদের স্কুলে খুব জোর দেয়া হয়েছিল। স্কুলের সব কার্যক্রম হতো বাংলায়। আমাদের প্রগ্রেস রিপোর্ট ছিল বাংলায়। আমি ওয়েস্ট এন্ড স্কুল থেকে ল্যাবরেটরি স্কুলে এসেছিলাম। তখন সেখানে প্রগ্রেস রিপোর্ট হতো ইংরেজিতে। আমরা দরখাস্ত করতাম বাংলায়। দরখাস্তের কথাটা আমার বিশেষ করে মনে আছে, কেননা ক্লাস ক্যাপ্টেন হিসাবে ক্লাসের পক্ষ থেকে দরখাস্ত নিয়ে গেছি অনেকবার। যেমন টিফিনের পর খেলাধুলা করার অনুমতির জন্য দরখাস্ত নিয়ে যেতাম এসিস্টেন্ট হেডস্যারের কাছে।

কঠোর শৃঙ্খলার মাঝে আমরা বেড়ে উঠেছি। আমাদের ইউনিফর্ম ছিল সাদা শার্ট আর নেভী ব্লু প্যান্ট, দুটোই সুতির। উনিফর্মের ব্যাপারে খুব কড়াকড়ি ছিল। সঠিক ইউনিফর্ম না পরে আসলে ক্লাস করতে দেয়া হতো না। ক্লাস শুরু হতো এসেম্বলি দিয়ে। আমরা প্যারেড করে আমাদের খেলার মাঠে এসেম্বলিতে যেতাম। এসেম্বলিতে থাকতো জাতীয় পতাকা উত্তোলন, সূরা ফাতেহা পাঠ, ওয়াদা বা শপথ বাক্য পাঠ আর পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত। উর্দুতে লেখা জাতীয় সংগীতের কিছুই বুঝতাম না। তাই প্রথম দুই এক লাইনের পর আওয়াজ ক্ষীণ হয়ে আসত। আমাদের শিক্ষকরা হাতের ইশারায় আওয়াজ উঁচু করার আহ্বান জানাতেন। কোনো কোনো দিন হালকা ধরনের ব্যায়ামও করানো হতো। জরুরি ঘোষণা থাকলে তাও জানানো হতো এসেম্বলিতে। একটা ঘটনা আমার মনে আছে। কর্তৃপক্ষের একটা সিদ্ধান্তে আমরা অসন্তুষ্ট ছিলাম। কিন্তু আমাদের অসন্তোষ ব্যক্ত করার কোনো উপায় ছিলো না। তাই অ্যাসেম্বলি থেকে ফেরার সময় ধপ ধপ করে পায়ের শব্দ করতে করতে ক্লাসে ফিরছিলাম। ব্যাপারটা আমাদের হেডমাস্টার সালেক স্যারের দৃষ্টি এড়ানো না। তিনি ছিলেন কড়া ডিসিপ্লিনের মানুষ। পুরো ক্লাসের ডিটেনশন হয়ে গেলো। আর ক্লাস ক্যাপ্টেন হিসাবে আমি খেলাম অতিরিক্ত বকা। ব্যক্তিগতভাবে আরো অনেক শাস্তি পেয়েছি। আর কমবেশি শাস্তির অভিজ্ঞতা আমাদের সবারই আছে।

এতো কড়া ডিসিপ্লিনের মাঝেও আমরা অনেক দুষ্টুমি করতাম। তখন আমাদের স্কুলের পশ্চিমে এডুকেশন এক্সটেনশন সেন্টার ক্যাম্পাসের নির্মাণ কাজ চলছিল, বর্তমানে যার নাম ন্যাশনাল একাডেমী ফর এডুকেশনাল ম্যানেজমেন্ট, সংক্ষেপে নায়েম। টিফিনের সময় আমরা সেখানে খেলতে যেতাম। তার প্রধান কারণ হলো, শুরুতে আমাদের খেলার উপযোগী মাঠ ছিলোনা। পাশেই ছিল ইপিআর (বর্তমানে বিজিবি) এলাকা। কখনো কখনো তারকাটার বেড়া পেরিয়ে চলে যেতাম সেখানে। কাজটা ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা সেটা ছিল সুরক্ষিত এলাকা, জনগণের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। সেখানে রাইফেল অনুশীলন হতো। আমরা যেতাম গুলির খোসা কুড়াতে। ইপিআর ক্যাম্পাসের আরেকটা আকর্ষণ ছিল সেখানে অনেকগুলো বকুল গাছ ছিল। আমরা গাছে চড়ে বকুল ফল পাড়তাম। বকুল ফলের চেয়ে গাছে চড়াটাই ছিল বেশি রোমাঞ্চকর। এডুকেশন এক্সটেনশন সেন্টার ক্যাম্পাসের উদ্বোধনের পর সেখানে আমাদের খেলা বন্ধ হয়ে যায়। তবে আমাদের “ইপিআর অভিযান” অব্যাহত থাকে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমরা আরো দুঃসাহসী হয়ে উঠি। আর সেই সঙ্গে ধরা পড়ার পর শাস্তির মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। মনে পড়ে, একবার অপরাধীরা মেঝেতে নাকে খত দিয়ে ভবিষ্যতে ইপিআর ক্যাম্পাসে না যাওয়ার অঙ্গীকার করার পর তাদের ক্লাসে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ল্যাবরেটরি স্কুলের মেইন গেটের সামনে একটা বিরাট আম গাছ ছিল। আমের দিনে আমরা মজা করে সেই আম খেতাম। আমাদের স্কুল সীমানার কাছাকাছি আরেকটা আম গাছ ছিল। তখনকার দিনে বর্তমান নায়েম রোড থেকে ধানমন্ডি ১ নম্বর রোডে যাওয়ার একটা শর্টকাট রাস্তা ছিল। সেই রাস্তা সংলগ্ন ছিল এই আম গাছটা। সেটা ছিল প্রাইভেট প্রপার্টি। সেই বয়সে চুরি করে আম খাওয়ার মজাই ছিল আলাদা।

আমি যখন পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র (১৯৬৩) তখন আমরা আজিমপুরের বাসা ছেড়ে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ক্যাম্পাসে চলে আসি। আমাদের নতুন বাসাটা ছিল হোস্টেল সুপারিন্টেনডেন্টের বাসা। ল্যাবরেটরি স্কুলের পূর্ব সীমানার সঙ্গে লাগানো। কাজেই স্কুলের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা আরো দৃঢ় হয়ে ওঠে। স্কুলের সময়ের বাইরেও স্কুল এলাকায় আমার যাতায়াত বেড়ে যায়। মাঝে মাঝে টিফিনের সময় একদল বন্ধু নিয়ে বাসায় হাজির হতাম। আম্মা সবাইকে আদর করে নাস্তা খাওয়াতেন। কখনো তাঁকে বিরক্ত হতে দেখিনি।

একবার বর্ষায় আমাদের স্কুলের মাঠ পানিতে ডুবে যায়। সম্ভবত ১৯৬৪ সালের কথা। আমরা পানিতে অনেক খেলা করলাম। পানি যখন নেমে গেল তখন লক্ষ্য করলাম ল্যাবরেটরি স্কুল আর ট্রেনিং কলেজের মধ্যবর্তী পাকা ড্রেনে অনেক মাছ আটকা পড়ে আছে। তার মাঝে একটা মাছ ছিল খুব সুন্দর। নাম গাপ্পি মাছ। গায়ে বিভিন্ন রঙের ডোরা কাটা। লেজটাও খুব সুন্দর। আমরা অনেকেই তখন গাপ্পি মাছ পুষতে লাগলাম। একুরিয়াম কেনার পয়সা ছিলোনা। তখন বিরাট বোতলে হরলিক্স পাওয়া যেত। সেই হরলিক্সের বোতলকে একুরিয়াম বানালাম। প্রসঙ্গত, গাপ্পি মাছ একুরিয়ামে রাখা সবচেয়ে জনপ্রিয় মাছগুলোর মধ্যে অন্যতম। আমাদের স্কুলের ড্রেনে এই গাপ্পি মাছ কিভাবে এসেছিলো সে রহস্য আজও ভেদ করতে পারিনি। শুনেছি গাপ্পি মাছ মশার শূককীট খেতে পছন্দ করে। আর তাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মশা নির্মূলের জন্য গাপ্পি মাছ ছাড়া হয়ে ছিল। আমাদের স্কুলের গাপ্পি মাছগুলো সেই প্রকল্পেরই অংশ কিনা জানিনা।

যখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠে ছিলাম তখন নতুন সেকশন যোগ করার কারণে অনেক সহপাঠী পেয়ে ছিলাম। ২০ জন ছাত্র নিয়ে আমাদের তৃতীয় শ্রেণী শুরু হয়েছিল। ষষ্ঠ শ্রেণীতে দুই সেকশন মিলিয়ে ছাত্র সংখ্যা দাঁড়ায় ৮০ জন। তবে দুঃখের বিষয়, বছর শেষে আমার চার প্রিয় সহপাঠী স্কুল ছেড়ে ক্যাডেট কলেজে চলে যায়। রেখে যায় ল্যাবরেটরি স্কুলে চার বছর এক সঙ্গে বেড়ে ওঠার স্মৃতি। (চলবে)


আগের পর্ব পরের পর্ব



ড. নজরুল ইসলাম, কার্টিন ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া






Share on Facebook               Home Page             Published on: 31-Oct-2021

Coming Events: