bangla-sydney













গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল, ঢাকা (২)
ড. নজরুল ইসলাম


আমাদের স্কুলের নাম গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল। গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল নয়। স্কুলের সামনে বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে। স্কুল মনোগ্রামেও আছে তাই। ঠিক বেঠিক জানিনা। তবে এটা একটা নাম। তাই নাম যারা দিয়েছেন তাদের দেয়া বানান আমাদের অনুসরণ করা উচিত। প্রসঙ্গত, প্রথমে আমাদের স্কুলের নাম রাখা হয়েছিল ধানমন্ডি কলেজিয়েট স্কুল। কেননা সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে ছিল ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল ধানমন্ডিতে স্থানান্তরিত হবে। পরবর্তীতে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করে একটা নতুন স্কুল স্থাপন করার সিদ্ধান্ত হয় যার নাম রাখা হয় গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল।

শুরু থেকেই ল্যাবরেটরি স্কুলের ছাত্র সংখ্যা কম রাখার একটা প্রচেষ্টা ছিল। উদ্দেশ্য ছিল প্রতিটি ছাত্রকে আদর্শ নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলা। আর সেই সঙ্গে ট্রেনিং কলেজের প্রশিক্ষণ-রত শিক্ষকদের প্রবর্তিত নতুন শিক্ষা পদ্ধতি ছাত্রদের উপর কেমন কাজ করছে তা নিরূপণ করা। তাই শুরু হয়েছিল প্রতি ক্লাসে ২০ জন করে ছাত্র নিয়ে। ট্রেনিং কলেজের বিশাল অডিটোরিয়ামে আমাদের ভর্তি পরীক্ষা হয়েছিল। খুব সম্ভবত ১৯৬১ সালের জুলাই মাসে। সঠিক পরিসংখ্যান জানা নেই। তবে অনুমান করতে পারি, আসনের তুলনায় প্রার্থীর সংখ্যা ছিলো অনেক গুন বেশি। তারপর ছিলো কঠিন ইন্টারভিউ। অবশ্য আমার বাবা ইন্টারভিউ কমিটির সদস্য থাকায় আমাকে ইন্টারভিউ দিতে হয়নি। আব্বার দায়িত্ব ছিল প্রার্থীদের আই কিউ নির্ণয় করা। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের আই কিউ নির্ধারণের জন্য বয়স জানা জরুরি। তখনকার দিনে আমাদের সমাজে বয়স কমানোর একটা “ট্র্যাডিশন” ছিল। কাজেই সঠিক আই কিউ নির্ণয় করাটা ছিল বেশ কঠিন।

তখন আমরা থাকতাম আজিমপুর কলোনির এক নম্বর বিল্ডিঙে। পাশের বিল্ডিঙে থাকতেন মাকসুদ ভাইরা (বর্তমানে সিডনি-বাসী)। উনারা তিন ভাই ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের ছাত্র ছিলেন। তাছাড়া আশেপাশের বিল্ডিংগুলোতে আমার কয়েকজন সহপাঠী থাকতো। আমরা এক সঙ্গে স্কুলে যাওয়া আসা করতাম। বেশির ভাগ সময় বাসে, কখনো কখনো রিকশায়। হেঁটেও বাড়ি ফিরেছি অনেক সময়। বাস ভাড়া ছিল এক আনা। সেই পয়সা বাঁচিয়ে ভুট্টা পোড়া খেতে খেতে বাড়ি ফিরতাম। নিউ মার্কেটের ভিতর দিয়ে, সদস্য ভবনের পাশের রাস্তা দিয়ে। যাওয়ার পথে নিউ মার্কেট ঘুরে দেখতাম। নিউ মার্কেটে দুটো জায়গা আমার খুব প্রিয় ছিলো - পেট শপ বা পোষা প্রাণীর দোকান আর স্টেশনারি দোকান। পেট শপে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম রংবেরঙের পাখি আর মাছের দিকে। সেখানে এক ধরণের ছোট্ট টিয়া পাখি পাওয়া যেত। সবুজ, হলুদ, নীল ইত্যাদি নানান রঙের। শরীরের তুলনায় লেজটা বেশ বড়। দোকানদাররা বলতো এটা অস্ট্রেলিয়ান টিয়া। অস্ট্রেলিয়ায় যার নাম ‘বাজী’। স্টেশনারি দোকানের প্রধান আকর্ষণ ছিল সেখানে বিভিন্ন দেশের ডাকটিকেট পাওয়া যেত। জলিল ট্রেডার্স দোকানটার নাম মনে পড়ছে। আমরা অনেকেই তখন থেকে ডাকটিকেট সংগ্রহ করতে শুরু করি। হাঙ্গেরি (ডাকটিকেটের উপর লেখা থাকতো Magyar posta) এবং মঙ্গোলিয়ার ডাকটিকিটগুলো খুব আকর্ষণীয় ছিল।

প্রথম দিনগুলো কেটেছিল খুবই উত্তেজনাপূর্ণ ভাবে। নতুন স্কুল ভবন, নতুন ক্লাসরুম, নতুন চেয়ার টেবিল, নতুন সহপাঠী, নতুন পরিবেশ। আমাদের সবার আলাদা আলাদা চেয়ার টেবিল ছিল, যা কিনা তখনকার দিনে ছিল বিরল। আমাদের শিক্ষকরা ছিলেন নিজ নিজ বিষয়ে পণ্ডিত। ইংরেজির স্যার ছিলেন সিরাজুল হক খান, বিজ্ঞানে ছিলেন জাফর আলী স্যার। আমার প্রিয় বিষয় ছিল ড্রইং। আমাদের ড্রইং শিক্ষক ছিলেন সুরঞ্জন দত্ত স্যার। বেশিরভাগই জলরঙে কাজ করতাম। ভালো ড্রইংগুলো রেখে দিতাম স্কুল দিবসে প্রদর্শনের জন্য। রবিবার ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন। শুক্রবার অর্ধেক দিন ক্লাস হতো। বৃহস্পতিবার শেষ ঘণ্টা সংরক্ষিত ছিল কো-কারিকুলার একটিভিটিস (পাঠ্যসূচী-সহায়ক কার্যক্রম) ক্লাসের জন্য। আমরা সংক্ষেপে বলতাম সিসিএ। এই ক্লাসে গান, কবিতা আবৃতি, গল্প বলা, অভিনয়, কৌতুক, ধাঁধার উত্তর ইত্যাদি অনেক কিছুই হতো। এসব আমাদের সবাইকে দিতো নির্মল আনন্দ। এতদিন পরেও মাহমুদ হাসানের গোয়েন্দা কাহিনী, গোলাম মোসাদ্দেকের কৌতুক আর আব্দুল আজিমের গান ভুলতে পারিনি।

ল্যাবরেটরি স্কুলের একাডেমিক ক্যালেন্ডারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন হলো স্কুল দিবস, ৩ সেপ্টেম্বর। স্কুলের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। বেশ ঘটা করে পালন করতাম স্কুল দিবস। ছাত্রদের আঁকা ছবি, রঙিন কাগজ ইত্যাদি দিয়া ক্লাস সাজাতাম। সারা বছর ধরে এর পরিকল্পনা চলতো। ক্যাপ্টেন হিসাবে সমন্বয়ের দায়িত্ব ছিল আমার। বরাবরই আমাদের প্রচেষ্টা ছিল প্রতি বছর নতুন কিছু উপস্থাপন করা। অষ্টম শ্রেণীতে থাকাকালীন স্কুল দিবস উপলক্ষে প্রকাশ করেছিলাম দেয়াল পত্রিকা ‘কালি ও কলম’। আমাদের শ্রেণী শিক্ষক ছিলেন আবুল হোসেন মিয়া স্যার। উনি কবিতা লিখতেন। আমরা উনাকে কবি স্যার বলে ডাকতাম। উনার অনুপ্রেরণাতেই পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল। এটাই ছিল ল্যাবরেটরি স্কুলের ইতিহাসে প্রথম দেয়াল পত্রিকা। পত্রিকাটি বেশ সমাদৃত হয়েছিল। পরের বছর থেকে, অন্যান্য শ্রেণীর ছাত্ররা দেয়াল পত্রিকা বের করতে শুরু করে যা পরবর্তীতে স্কুল দিবসের একটা ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়ায়। সুন্দর সুন্দর নাম থাকতো পত্রিকাগুলোর। তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্ররা বের করেছিল ‘হাতে খড়ি’, চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্ররা বের করে ছিল ‘প্রগতি’ এবং পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্ররা বের করে ছিল ‘কাকলি’। স্কুল দিবস উপলক্ষে অন্যান্য কার্যক্রমের মধ্যে ছিল - বিজ্ঞান প্রদর্শনী, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রচনা প্রতিযোগিতা, বক্তৃতা প্রতিযোগিতা এবং ক্রীড়া প্রতিযোগিতা।

ছাত্রদের মাঝে বিভিন্ন ধরণের প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য আমাদের চারটি হাউসে ভাগ করা হয়েছিল। হাউসগুলোর নাম রাখা হয়েছিল মুসলিম বিশ্বের চারজন প্রখ্যাত মনীষীর নামে – আল-বিরুনি (পাণ্ডিত্যের প্রতীক), আল-মামুন (সুশাসনের প্রতীক), ওমর খৈয়াম (তারুণ্যের প্রতীক) এবং সালাহ্উদ্দীন (বীরত্বের প্রতীক)। প্রতিটি হাউসের আলাদা প্রতীকী রঙ ছিল - যথাক্রমে হলুদ, নীল, সবুজ এবং লাল। ভর্তির সময়কার রোল নম্বর হিসাবে ছাত্রদের হাউস নির্ধারিত হতো। স্কুলের ব্যাজ ছিল যা আমরা বিশেষ দিনে পরতাম। প্লাস্টিকের তৈরি এই ব্যাজগুলো ছিল খুবই আকর্ষণীয়। অনেকটা ক্যারামের স্ট্রাইকারের মতন। হাউসের সঙ্গে মিলিয়ে রং রাখা হয়েছিলো হলুদ, নীল, সবুজ এবং লাল। ব্যাজের উপর ছিল আমাদের স্কুলের মনোগ্রাম। মনোগ্রামের শিল্পী ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন।

ল্যাবরেটরি স্কুল ছাত্র সংখ্যা কম রাখার প্রচেষ্টায় সফল হতে পারেনি। লক্ষ্য করছিলাম ক্রমশ দুই চার জন করে আমাদের এবং অন্যান্য ক্লাসে যোগ দিচ্ছে। উদ্বোধনীর দিন যে ছাত্র সংখ্যা ছিল ১৫৭ জন, বছর শেষে তা দাঁড়ায় ২৪০ জন। দ্বিতীয় শিক্ষা বর্ষে (১৯৬২) এই সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯৭ জন এবং তৃতীয় শিক্ষা বর্ষে (১৯৬৩) ৩৫০ জন। ল্যাবরেটরি স্কুলের নাম ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে স্কুল কর্তৃপক্ষের উপর ছাত্র ভর্তির জন্য চাপ আসতে থাকে। ছাত্র বাড়ানোর জন্য ১৯৬৪ সালে দুই শিফটে ক্লাস চালু করার সরকারি হুকুমনামা জারি হয়ে গিয়েছিলো। অনেক চেষ্টা তদবির করে সে যাত্রায় ডবল শিফট চালু বন্ধ করা হয়। তবে আপোষ সমাধান হিসাবে, সেই বছর তৃতীয় থেকে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত অতিরিক্ত শাখা সংযোজন করা হয়। ফলে ছাত্র সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৩৬ জন। আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। রাতারাতি অনেক সহপাঠী পেয়ে গেলাম। (চলবে)



আগের পর্ব পরের পর্ব



ড. নজরুল ইসলাম, কার্টিন ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া






Share on Facebook               Home Page             Published on: 27-Sep-2021

Coming Events: