bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













ক্যান্সার রোগীর সাথে বসবাস (৩)
ড. নজরুল ইসলাম



আগের পর্ব


দেখতে দেখতে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় এক যুগ কেটে গেলো। মেয়েদের ছেড়ে যখন এখানে এসেছিলাম, তখন আমাদের পরিকল্পনা ছিল ৩/৪ বছর থেকে আবার পূর্ব উপকূলে ফিরে যাবো। কিন্তু জায়গাটা এতোই ভালো লেগে গিয়েছিলো যে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি। তাছাড়া মেয়েরা বছরে দু’বার ছুটি কাটাতে আসায় আমরা ওদের তেমন মিস করিনি। তার চেয়ে বড় কথা, আমরা দুজনেই আমাদের চাকরিতে সন্তুষ্ট ছিলাম। সিডনি/মেলবোর্নের তুলনায় পার্থ একটা ছোট শহর। দুই মিলিয়নের কিছু বেশি লোক বাস করে এখানে। জীবন চলে অপেক্ষাকৃত ধীর গতিতে। তবে একটা রাজ্যের রাজধানী হওয়ায় এখানেও একই ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। অর্থাৎ এখানে আছে সব সুযোগ-সুবিধা সহ একটা রিলাক্সিং লাইফ-স্টাইল। পার্থ ভারত মহাসাগরের উপকূলে অবস্থিত একটা সুন্দর শহর। এখানকার সৈকতগুলো বিশ্বের সেরাগুলোর মধ্যে অন্যতম। শহরের ভিতর দিয়ে বয়ে গেছে অপূর্ব সুন্দর সোয়ান নদী। এখানে আছে শহরের মধ্যে অবস্থিত বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম এবং সবচেয়ে সুন্দর পার্ক, কিংস পার্ক। সামগ্রিকভাবে পার্থ থাকার জন্য একটা সুন্দর জায়গা।

২০০২ সালে ‘লিঞ্চ সিনড্রোম’ ধরা পড়ার পর, হাসুর প্রতি বছর কোলোনোস্কোপি এবং এক বছর পর পর গ্যাস্ট্রোস্কোপি চলছিল। ২০১১ সালে তৃতীয় ক্যান্সার অপারেশনের পর যোগ হলো আরেকটা ডায়াগনস্টিক টেস্ট - পজিট্রন এমিশন টমোগ্রাফি (সংক্ষেপে পেট) স্ক্যান। আর সেই সঙ্গে কম্পিউটেড টমোগ্রাফি (সংক্ষেপে সিটি) স্ক্যান। সম্মিলিত 'পেট-সিটি স্ক্যান' প্রাথমিক পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার সনাক্ত করতে পারে। হাসুর তৃতীয় ক্যান্সার অপারেশনের পর আমাদের পারিবারিক জীবনে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। কেমোথেরাপির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথির কারণে হাসু আর চাকরিতে ফিরে যেতে পারলো না। হাতের এবং পায়ের আঙ্গুলে অসাড়তা বোধের কারণে গাড়ি চালাতে অসুবিধা হতো। ব্যথা নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিত শক্তিশালী ব্যথানাশক ওষুধ খেতে হতো। আমরা ১৮ বছর বয়স থেকে পাশাপাশি বেড়ে উঠেছি। প্রথমে লেখাপড়া এবং পরে কাজ নিয়ে যে যার মতন ব্যস্ত। হাসুর অবসর গ্রহণ আমাদের জীবনধারা সম্পূর্ণ বদলে দেয়। তবে হাসু বসে থাকার মতন মেয়ে নয়; বাসায় খুঁজে খুঁজে কাজ বের করতে অভ্যস্ত। তাছাড়া বাগান করার নেশা তো আছেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে বাগানে কাটিয়ে দিতে পারে।

হাসুর অবসর গ্রহণের পর আমাদের পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া দেখার সুযোগ আরো বেড়ে যায়। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া হলো অস্ট্রেলিয়ার বৃহত্তম অঙ্গ রাজ্য; আয়তন অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের এক তৃতীয়াংশ। এই বিশাল রাজ্যের আকর্ষণীয় স্থানগুলো রাজধানী পার্থ থেকে বেশ দূর দূরে। এখানে বসবাস না করলে সময় নিয়ে জায়গাগুলো দেখার সুযোগ হতো না। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার আকর্ষণীয় স্থানগুলো নিয়ে লিখতে গেলে অনেক কিছু লিখতে হয় যা এই লেখার স্বল্প পরিসরে তুলে ধরা সম্ভব হবে না। আমাদের সবচেয়ে ভালো লেগেছে এখানকার বুনোফুল। প্রতি বছর বসন্ত কালে এখানকার বুনোফুলগুলো পুরো ল্যান্ডস্কেপকে বদলে দেয়। ১২ হাজারেরও বেশি প্রজাতির বুনোফুল রয়েছে এখানে যা কিনা বিশ্বের বৃহত্তম সংগ্রহ। এখানকার ৬০ শতাংশ বুনোফুল পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায় না। সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়তাম বুনোফুল দেখতে। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার বুনোফুল নিয়ে আমার একটা লেখা এই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে। উৎসুক পাঠকরা পড়ে দেখতে পারেন।

২০১৮ সালের অক্টোবর মাস। ইউনিভার্সিটির কাজে আমি খুব ব্যস্ত। সেমেস্টার শেষ হতে আর কয়েক সপ্তাহ বাকি। এই সময়টা ছাত্ররা পড়াশুনায় বেশ মনোযোগী হয়ে উঠে। আমি আমার অফিসে এক ছাত্রের সাথে কন্সালটেশনে ব্যস্ত। হঠাৎ আমার মোবাইল ফোনে একটা টেক্সট মেসেজ- হাসু তার প্রস্রাবের গোলাপি রঙ দেখে খুব ঘাবড়ে গেছে। এটা একদমই অপ্রত্যাশিত, কেননা ‘টোটাল হিস্টেরেক্টমি’ ছাড়া হাসুর যত সমস্যা ছিল সব ডাইজেস্টিভ সিস্টেমে। এবার মনে হয় ক্যান্সার অন্য আরেকটা সিস্টেমে ছড়িয়ে পড়েছে । কিছুক্ষণ পর হাসুর আরেকটা মেসেজ- চিন্তা করোনা, আমি সিটি স্ক্যান করার জন্য বেন্টলি হাসপাতালে যাচ্ছি। বেন্টলি হাসপাতাল হলো আমাদের বাসার কাছে একটা ছোট হাসপাতাল। পরে জানতে পারলাম যে আমাকে মেসেজ করার পর, হাসু রয়েল পার্থ হাসপাতালে তার ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে। তিনি তখনি বেন্টলি হাসপাতালে সিটি ইন্ট্রাভেনাস পাইলোগ্রাম (সংক্ষেপে সিটি আইভিপি) করার ব্যবস্থা করেন। উল্লেখ্য যে ২৬ বছর ধরে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে, হাসুর চিকিৎসা সর্বদা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পেয়েছে। ডাক্তাররা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছেন তাকে ভালো করার। তাঁদের সহযোগিতা ছাড়া হাসু এতদূর আসতে পারতো না। এজন্য আমি তাঁদের কাছে চির ঋণী।

‘সিটি আইভিপি’ হল একটা পরীক্ষা যা কিডনি, ইউরেটার (কিডনি এবং মূত্রাশয়কে সংযুক্ত করে এমন নল) এবং মূত্রাশয় মূল্যায়নের জন্য ব্যবহৃত হয়। পরীক্ষার আগে, অঙ্গগুলোকে হাইলাইট করার জন্য ইন্ট্রাভেনাস ড্রিপের মাধ্যমে শিরায় কনট্রাস্ট রং দেওয়া হয়। সিটি ইভিপিতে ইউরেটারে ৭ মিলিমিটার লম্বা 'ফিলিং ডিফেক্ট' ধরা পড়লো। এবার রয়েল পার্থ হাসপাতালের ইউরোলজি টিমের সঙ্গে কন্সালটেশন। তারা ‘ইউরেটেরোস্কোপি’ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। অর্থাৎ ইউরেটেরোস্কোপ নামের একটা ছোট টেলিস্কোপ দিয়ে তারা জায়গাটা দেখবেন। ইউরেটেরোস্কোপিতে ক্যান্সার ধরা পড়লো। বাউল, এন্ডোমেট্রিয়াল এবং স্মল ইনটেস্টাইনের পরে এটা ছিল হাসুর চতুর্থ ধরণের ক্যান্সার (ইউরেট্রাল ক্যান্সার)। তবে ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল। ইউরেটেরোস্কোপির সময় ডাক্তাররা লেজার রশ্মি দিয়ে তা অপসারণ করতে সক্ষম হন। এ যাত্রায় বাঁচা গেলো! ছয়মাস পর আবার ফলো-আপ ইউরেটেরোস্কোপি।

ফলো-আপ ইউরেটেরোস্কোপিতে একই সঙ্গে ভাল খবর এবং খারাপ খবর। ভাল খবর হলো যে ইউরেট্রাল ক্যান্সার ফিরে আসেনি। আর খারাপ খবর হলো যে মূত্রাশয়ে ক্যান্সার ধরা পড়লো (ব্লাডার ক্যান্সার)। ডাক্তাররা জানালেন যে ইউরেট্রাল ক্যান্সারে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মূত্রাশয় ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি কারণ দুটি অঙ্গ একই ধরণের কোষ দ্বারা গঠিত। এবারো ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল তাই ডাক্তাররা ইউরেটেরোস্কোপির সময় লেজার রশ্মি দিয়ে তা অপসারণ করতে সক্ষম হলেন। এরপর ডাক্তাররা ‘ইমিউনোথেরাপি’ নেয়ার পরামর্শ দিলেন। এই চিকিৎসা কেমোথেরাপি থেকে ভিন্ন, কেননা কেমোথেরাপির ওষুধ সরাসরি ক্যান্সার কোষকে আক্রমণ করে আর ইমিউনোথেরাপির ওষুধ ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করার জন্য রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে। মূত্রাশয়, কিডনি এবং ফুসফুসের ক্যান্সার চিকিৎসায় ইমিউনোথেরাপি ভাল ফলাফল দেখিয়েছে। কোনো জটিলতা ছাড়াই ইমিউনোথেরাপি হয়ে গেলো।

বছর না ঘুরতেই হাসু দু’বার ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ায় আমরা তার স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লাম। মেয়েদের অভিমত আমরা পূর্ব উপকূলে ফিরে যাই যাতে প্রয়োজনে তারা আমাদের সাহায্য করতে পারে। প্রসঙ্গত, পার্থ হলো বিশ্বের সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন শহর। নিকটতম প্রধান শহর অ্যাডিলেড থেকে বিমানে আসতে লাগে সাড়ে তিন ঘণ্টা। আর সিডনি থেকে আসতে লাগে পাঁচ ঘণ্টা। কিন্তু এই বয়সে নতুন চাকরি পাওয়া সহজ হবে না। যেতে চাইলে অবসর নিয়ে যেতে হবে। কঠিন সিদ্ধান্ত! ইউনিভার্সিটির এমন ভালো চাকরি কে ছাড়তে চায়? সেই সময়ে (অক্টোবর ২০১৯) আমাদের ইউনিভার্সিটিতে ছাঁটাইয়ের কথা শুনছিলাম। ছাঁটাইয়ে পড়লে সিদ্ধান্তটা সহজ হতো। তাছাড়া একটা ভালো অংকের ক্ষতিপূরণও পাওয়া যেত। কিন্তু আমাদের ডিপার্টমেন্টে চারজন ছাঁটায়ে পড়লেও দুর্ভাগ্যবশত(?) আমি ছাঁটায়ে পড়লাম না। কাজেই সিদ্ধান্ত আমার নিজেরই নিতে হবে। আমার পরিবার আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তাই অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বড় মেয়ে তখন ক্যানবেরাতে একটা প্রাইভেট ল ফার্মে কাজ করছে। ছোট মেয়ে মেলবোর্নে একটা হাসপাতালে মেডিকেল স্পেশালিষ্ট (নিউরোলজিস্ট)। কোথায় যাবো? ক্যানবেরা না মেলবোর্ন? হাসুর চিকিৎসার কথা বিবেচনা করে আমরা মেলবোর্নে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কেননা মেলবোর্নে আছে অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম সেরা ক্যান্সার হাসপাতাল, পিটার ম্যাককালাম ক্যান্সার সেন্টার (সংক্ষেপে পিটার ম্যাক)।

আমি আমার লাইন ম্যানেজারকে (হেড অফ স্কুল) পদত্যাগ করার এবং অবসর নেওয়ার অভিপ্রায়ের কথা জানালাম। তিনি হাসুর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। সহানুভূতির সাথে তিনি বললেন যে হিউম্যান রিসোর্সেস বিভাগের সাথে আলোচনা করে দেখি আমরা তোমার জন্য কি করতে পারি। দু'দিন পর জানালেন, পদত্যাগ না করে বরঞ্চ তুমি বেতন সহ এক বছরের ছুটি নাও। এর মধ্যে হাসুর দেখাশোনার জন্য ৭ মাসের ‘কেয়ারারস লিভ’, বাকিটা আমার জমানো বার্ষিক এবং দীর্ঘ চাকরির ছুটি। তিনি এও জানালেন যে, এতে তুমি চিন্তা করার সময় পাবে। এক বছর পরে তুমি চাকরিতে ফিরে আসতে পারো আর না চাইলে পদত্যাগ করতে পারো। তাঁর এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম যদিও মনো মনে আমি নিশ্চিত যে আর চাকরিতে ফিরে আসছি না।

এবার পার্থ ছাড়ার পালা। একটা বিশাল পদক্ষেপ। প্রচুর কাজ- বাড়ি বিক্রি, রিমুভালিস্ট ঠিক করা, মালপত্র পাঠানো এবং আরো অনেক কিছু। ১৫ বছরে সংসারে তো আর কম জিনিস জড়ো হয় নি! কোনটা রেখে কোনটা নেই তা নির্ধারণ করাও একটা সমস্যা। আর বাড়ি বিক্রি করার যে কি ঝামেলা তা এক মাত্র ভুক্তভোগীরাই জানেন। হাসুর দুঃখ তার শখের বাগান ছেড়ে যেতে হচ্ছে। কোয়ারেন্টাইনের সমস্যার কারণে একটা গাছও নিয়ে যেতে পারছে না। আমাদের মালপত্র মেলবোর্নে পোঁছাতে সপ্তাহ দুয়েক লাগবে। ভাবলাম এই সময়টা মেলবোর্নে গিয়ে বসে না থেকে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় আমাদের প্রিয় জায়গাগুলো শেষবারের মতো দেখে যাই। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ অঞ্চলটা আমাদের খুব প্রিয়। বিশেষ করে পার্থ থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত বন্দর নগর আলবানী। সেখানেই সময়টা কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। আলবানী থেকে ৪৮০ কিলোমিটার পূবে এস্পারেন্স শহর, আমাদের দেখা পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে সুন্দর জায়গা। সেখানকার মতন সুন্দর সমুদ্র সৈকত আমি আর কোথাও দেখিনি। এই সুযোগে শেষবারের মতো এস্পেরেন্স ঘুরে এলাম।

আমরা এতবার আলবানীতে এসেছি যে ইতিমধ্যে কাছাকাছি সব জায়গা দেখা হয়ে গেছে কিন্তু এখানকার সমুদ্র ঘুরে দেখা হয় নি। আলবানীর প্রিন্সেস রয়্যাল হারবার বিশ্বের বৃহত্তম প্রাকৃতিক বন্দরগুলোর মধ্যে একটা। বন্দরের চারপাশে ঘুরে দেখার জন্য নিলাম ‘আলবানী বোট ক্রুজ’। সেদিন সমুদ্র খুব উত্তাল ছিল। সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছিলো আমাদের নৌকোতে। এরই মধ্যে হাসুর মোবাইলে একটা ফোন।

এই আবহাওয়ায় সমুদ্রের মাঝখানে নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবে তা আশা করিনি। ফোনটা এসেছিলো হাসপাতাল থেকে। ডাক্তার জানালেন, পেট-সিটি স্ক্যানে আমরা তোমার পাকস্থলীতে একটা 'হটস্পট' পেয়েছি। সেটা তদন্ত করে দেখতে চাই। সেজন্য আগামী সপ্তাহে গ্যাস্ট্রোস্কোপির জন্য সময় বুক করতে চাই। হাসু আমাদের মেলবোর্ন চলে যাওয়ার কথা জানালে তিনি বললেন, মেলবোর্নে গিয়ে তোমার ডাক্তারের যোগাযোগের ঠিকানা জানাও। আমরা তোমার পেট-সিটি স্ক্যান রিপোর্ট তার কাছে পাঠিয়ে দেব। আবার ক্যান্সারের আশঙ্কা! মনটা খারাপ হয়ে গেলো। তবে পেট-সিটি স্ক্যানের উদ্দেশ্যই তো হলো প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার নির্ণয় করা; তাতে যদি কিছু করা যায়।

আমরা মেলবোর্ন এসে পোঁছালাম ২০২০ সালের ১৫ মার্চ। আমাদের জীবনের আরেকটা অধ্যায়ের শুরু। তখন মেলবোর্নে কোভিডের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়ে গেছে। ৩১ মার্চ থেকে লকডাউনের শুরু। নতুন জায়গায় জীবন শুরু করা এমনিতেই কঠিন, লকডাউনের কারণে তা আরো কঠিন হয়ে গেলো। হাসুর গ্যাস্ট্রোস্কোপি করাটা জরুরি। এদিকে কোভিডের জন্য পিটার ম্যাক হাসপাতালে নতুন রুগী নেয়া বন্ধ। কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মেলবোর্নে এসে যে জিনিসটার অভাব সবচেয়ে বেশি অনুভব করলাম, সেটা হলে হাসুর ডাক্তারদের নেটওয়ার্ক। হাসু রয়েল পার্থ হাসপাতালে তার ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করলো। তিনি পরামর্শ দিলেন একটা প্রাইভেট হাসপাতালে গ্যাস্ট্রোস্কোপি করার জন্য। সে ব্যবস্থাও তিনি করলেন। প্রাইভেট হাসপাতালে হাসুর গ্যাস্ট্রোস্কোপি হয়ে গেলো। তাতে ক্যান্সার ধরা পড়লো যা পরে বায়োপসি ফলাফল দ্বারা নিশ্চিত করা হয়। এবার পাকস্থলীর ক্যান্সার (স্টমাক ক্যান্সার), একটা মারাত্মক ধরণের ক্যান্সার। তবে আশা এই যে প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়েছে।

ক্যান্সার ডায়াগনসিস নিশ্চিত হওয়ার পর পিটার ম্যাক হাসপাতালের ডাক্তাররা হাসুকে দেখতে রাজি হলেন। হাসুর কেসটা খুবই জটিল, তাই তার চিকিৎসার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য একটা মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হলো। ডাক্তারদের দ্বিধা, অপারেশনের মাধ্যমে পুরো পাকস্থলী কেটে ফেলা হবে (টোটাল গ্যাস্ট্রেক্টমি) না পাকস্থলীর কিছু অংশ কেটে ফেলা হবে (পার্শিয়াল গ্যাস্ট্রেক্টমি)। তারা বিভিন্ন দিক, বিশেষ করে হাসুর লিঞ্চ সিনড্রোম বিবেচনা করার পর পার্শিয়াল গ্যাস্ট্রেক্টমির সিদ্ধান্ত নিলেন। অপারেশন হবে ৫ মে। অপারেশন করবেন আপার গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সার্জন ডা. ডুওং এবং তাঁর সার্জিক্যাল টীম। হাসুর জীবনে সবচেয়ে বড় অপারেশন। খুব ভোরে হাসুকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। সন্ধ্যার পর খবর এলো অপারেশন ঠিকমতো হয়ে গেছে। দুই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে হাসুকে দেখতে গেলাম। কিন্তু কোভিড বিধিনিষেধের কারণে শুধুমাত্র আমিই হাসুকে দেখার সুযোগ পেলাম। এবার হাসুকে তিন সপ্তাহ হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। কোভিড বিধিনিষেধের জন্য ওর সাথে দেখা করাটা বেশ কঠিন ছিল। প্রথম দিকে পার্সোনাল প্রোটেক্টিভে ইকুইপমেন্ট (সংক্ষেপে পিপিই) পরে দেখা করতে হতো। আমরা তিন জন ভাগাভাগি করে দেখতে যেতাম। মেয়েরা কাছে থাকার সুবিধাটা তখন বুঝতে পারলাম।

এর আগে অপারেশনের পর হাসু কম সময়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পেরেছিল। কিন্তু এবার তা হলো না। অপারেশনের দু'বছর হয়ে গেলো, এখনো সে নানা সমস্যায় ভুগছে। পাকস্থলীর অনেকটা অংশ কেটে ফেলায় এমনিতেই কম খেতে পারে। খাওয়ার পর আবার রিফ্লাক্সের সমস্যা। তা ছাড়া ব্যথা তো আছেই। ব্যথা নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিত ব্যথানাশক ওষুধ খেতে হয়। পুষ্টির অভাবে ওজন অর্ধেকে নেমে এসেছে। খুব দুর্বল শরীর। তবে আল্লার রহমতে সে বিছানায় পড়ে যায় নি। নিজের সব কাজ নিজেই করতে পারে। কোভিডের কারণে ছাত্র সংখ্যা কমে যাওয়ায়, ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে আমাদের ইউনিভার্সিটি কর্মীদের স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করার একটা সুযোগ দেয় (ভলান্টারি রিডানডেন্সি)। সেই সুযোগটা কাজে লাগলাম। তখন থেকে অবসর জীবন যাপন করছি, যদিও অ্যাডজানক্ট একাডেমিক হিসাবে এখনো উনিভার্সিটির সঙ্গে যুক্ত আছি। এখন আমার প্রধান দায়িত্ব হাসুর দেখাশোনা করা। সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা এই যে, তিনি হাসুকে ভালো রাখেন যাতে বাকি কয়েকটা দিন আমরা একে অপরের সান্নিধ্যে কাটাতে পারি।

অবসরে যাওয়ার পর, আমাদের অনেকেই ভাবতে শুরু করেছেন যে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করার সিদ্ধান্তটা সঠিক ছিল কিনা। আমার মনে হয়, তিনি বা তার পরিবারের কেউ যদি কোনো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হতেন তাহলে এমনটা ভাবতেন না। হ্যাঁ, অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করার কারণে আমরা আমাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে ঘনিষ্ঠতা হারিয়েছি। তাদের সুখে-দুঃখে পাশে থাকতে পারিনি। ছেলেমেয়েরা দেশীয় সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে গেছে। এমনকি অনেকে তাদের মাতৃভাষাও হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু তার বদলে আমরা পেয়েছি একটা সৎ ও সুন্দর জীবন যাপনের নিশ্চয়তা। ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা শেষ করে তাদের পেশায় প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে। ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে হাসুর স্বাভাবিক জীবনযাপনের পিছনে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার সার্বজনীন স্বাস্থ্য বীমা 'মেডিকেয়ার'। মেডিকেয়ার ছাড়া, আমরা হাসুর ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যয়বহুল খরচ বহন করতে পারতাম না। মেডিকেয়ার গ্যারান্টি দেয় যে কোনো অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে না। জীবনে এর চেয়ে বড় নিরাপত্তা আর কি হতে পারে? (সমাপ্ত)



আমাদের পারিবারিক ছবি



আগের পর্ব


ড. নজরুল ইসলাম, কার্টিন ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া






Share on Facebook               Home Page             Published on: 26-Jul-2022

Coming Events:
বৃষ্টির সম্ভাবনার কারণে মেলার তারিখ ১ দিন পিছিয়ে ২১ এপ্রিল ২০২৪ (রবিবার) করা হয়েছে......




A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far