অস্ট্রেলিয়ার বয়স্ক পরিচর্যা ব্যবস্থা ড. নজরুল ইসলাম
আয়ু বৃদ্ধি এবং প্রজনন হার হ্রাসের কারণে অস্ট্রেলিয়ান সমাজে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। ২০১৬ সালের জন-শুমারি অনুসারে, অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ বা ছয়জনের মধ্যে একজন ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী। ২০৬৬ সালের মধ্যে, অনুমান করা হয় যে অস্ট্রেলিয়ার বয়স্ক মানুষ মোট জনসংখ্যার ২১ থেকে ২৩ শতাংশ হবে। এসব প্রবীণ নাগরিকদের পর্যাপ্ত বয়স্ক পরিচর্যা পরিষেবা প্রদান করা অস্ট্রেলিয়ান সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ সমাজে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে একদিকে করদাতার সংখ্যা কমে যায় অন্যদিকে সরকারের পেনশন এবং অনুসঙ্গিক খরচ বেড়ে যায়। অস্ট্রেলিয়ার বয়স্ক পরিচর্যা ব্যবস্থা সরকার (ফেডারেল, রাজ্য এবং স্থানীয় সরকার), বেসরকারি সংস্থা (দাতব্য, ধর্মীয় এবং কমিউনিটি গ্রুপ) এবং পরিষেবা গ্রহণকারীদের কাছ থেকে ব্যক্তিগত অবদান দ্বারা অর্থায়ন করা হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে, অস্ট্রেলিয়ান সরকার বয়স্ক পরিচর্যা খাতে ২১.৫ বিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার ব্যয় করেছে, যা মোট ব্যয়ের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ।
অস্ট্রেলিয়ার বয়স্ক পরিচর্যা ব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্ব ফেডারেল সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। এই মন্ত্রণালয়ের অধীনে 'মাই এজড কেয়ার' নামে একটি বিভাগ রয়েছে যারা এই দায়িত্ব পালন করে থাকে। কেউ বয়স্ক পরিচর্যা পরিষেবা পেতে চাইলে প্রথমে এই বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। মাই এজ কেয়ার সেন্টারের কর্মীরা ফোনে ক্লায়েন্টদের প্রাথমিক মূল্যায়ন করে এবং যদি তারা মনে করে যে ক্লায়েন্ট যোগ্য সেক্ষেত্রে মুখোমুখি মূল্যায়নের ব্যবস্থা করে। এজড কেয়ার অ্যাসেসমেন্ট টিমের একজন সদস্য (সাধারণত একজন নার্স) বাসায় এসে মুখোমুখি মূল্যায়ন করে এবং বয়স্ক ব্যক্তির অসুবিধা, লক্ষ্য এবং তিনি কি অর্জন করতে চান তা বিবেচনা করে উপযুক্ত পরিষেবা অনুমোদন করে। অস্ট্রেলিয়ান বয়স্ক পরিচর্যা ব্যবস্থা ‘কনজিউমার ডাইরেক্টেড কেয়ার’ নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। কাজেই বয়স্ক ব্যক্তি তার পছন্দের সেবা প্রদানকারীকে বেছে নিতে পারেন। বয়স্ক পরিচর্যা পরিষেবাগুলো প্রধানত বেসরকারি খাত দ্বারা সরবরাহ করা হয়, বেশিরভাগ পরিষেবা প্রদানকারী অলাভজনক সংস্থা, যেমন ধর্মীয়, দাতব্য এবং সম্প্রদায়-ভিত্তিক সংস্থা। অস্ট্রেলিয়ায় তিন হাজারেরও বেশি বয়স্ক পরিচর্যা প্রদানকারী সংস্থা রয়েছে যারা প্রায় ৯ হাজার আউটলেটের মাধ্যমে পরিষেবা প্রদান করে। সরকার ভর্তুকির টাকা সরাসরি পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাকে প্রদান করে। বেশিরভাগ সরকারি ভর্তুকি পাওয়ার জন্য ‘মিন্স টেস্টিং’ নামে একটি আর্থিক মূল্যায়ন অপরিহার্য। মিন্স টেস্টিং এর উদ্দেশ্য হলো যারা প্রচুর সম্পদের মালিক বা যাদের পর্যাপ্ত আয় রয়েছে তারা যাতে ভর্তুকি না পায়।
অস্ট্রেলিয়ার বয়স্ক পরিচর্যা ব্যবস্থা প্রধানত তিন ধরনের পরিষেবা প্রদান করে - হোম সাপোর্ট, হোম কেয়ার এবং রেসিডেন্সিয়াল কেয়ার। ‘হোম সাপোর্ট’ পরিষেবা হলো এমন বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য যাদের যত্নের প্রয়োজন কম, কিন্তু বাড়িতে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করার জন্য কিছু সাহায্যের প্রয়োজন। এটি ফেডারেল সরকার দ্বারা পরিচালিত প্রবেশ-স্তরের পরিষেবা যা ‘কমনওয়েলথ হোম সাপোর্ট প্রোগ্রাম’ নামে পরিচিত। ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রায় ৮ লক্ষ ৪০ হাজার মানুষ এই পরিষেবা পেয়েছেন। মাথাপিছু গড় বার্ষিক ভর্তুকি ছিল প্রায় ৩ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলার। এই ভর্তুকি প্রাপকের আয় বা সম্পদের উপর নির্ভর করে না, অর্থাৎ যেকোনো অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক প্রয়োজনে কমনওয়েলথ হোম সাপোর্ট পরিষেবা পেতে পারেন। পরিষেবাগুলোর মধ্যে রয়েছে - ঘরের কাজে সাহায্য (যেমন ঘর পরিষ্কার করা, কাপড় ধোয়া), রান্নাবান্নায় সাহায্য অথবা রান্না করা খাবার সরবরাহ, ব্যক্তিগত যত্ন (যেমন গোসলে বা কাপড় পরায় সাহায্য), নার্সিং (যেমন ড্রেসিং পরিবর্তন, সেলাই অপসারণ), সহযোগী স্বাস্থ্য পরিষেবা (যেমন পডিয়াট্রি, ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, ডায়েটিশিয়ান), বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ (যেমন জানালা এবং নর্দমা পরিষ্কার করা, বাগান করা), বাড়ির ছোটখাটো পরিবর্তন (যেমন বাথটব সুরক্ষা গ্র্যাব রেল লাগানো), সরঞ্জাম সরবরাহ (যেমন হুইলচেয়ার সরবরাহ), সামাজিক সহায়তা (যেমন সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদানে সহায়তা করা), পরিবহন সাহায্য (যেমন ডাক্তার দেখানো জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করা) এবং যিনি বয়স্ক ব্যক্তির নিয়মিত দেখাশোনা করেন তাকে বিরতি দেয়ার জন্য স্বল্পমেয়াদী বিকল্প ব্যবস্থা করা।
‘হোম কেয়ার’ পরিষেবা হলো এমন বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য যাদের বাড়িতে থাকার জন্য আরও বেশি মাত্রার সহায়তা প্রয়োজন। এই প্রোগ্রামের অধীনে, ব্যক্তির চাহিদা অনুযায়ী যত্নের একটি সমন্বিত প্যাকেজ তৈরি করা হয় যা ‘হোম কেয়ার প্যাকেজ’ নামে পরিচিত। হোম কেয়ার প্যাকেজের চারটি স্তর রয়েছে - লেভেল ১ (প্রাথমিক যত্নের চাহিদাযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য) থেকে লেভেল ৪ (উচ্চ যত্নের চাহিদাযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য) পর্যন্ত। অস্ট্রেলিয়ান সরকার প্রদত্ত বার্ষিক ভর্তুকি - লেভেল ১ প্যাকেজের জন্য প্রায় ৯ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলার থেকে শুরু করে লেভেল ৪ প্যাকেজের জন্য প্রায় ৫২ হাজার ডলার পর্যন্ত। ভর্তুকির পরিমাণ ব্যক্তির ব্যক্তিগত পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে আরো বেশি হতে পারে, যেমন ডিমেনশিয়া রোগী, যাদের অক্সিজেন থেরাপির প্রয়োজন, যাদের টিউবের মাধ্যমে খাওয়াতে হয়, বা যারা আর্থিক সংকটে রয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রায় ১ লক্ষ ৪২ হাজার মানুষ এই পরিষেবা পেয়েছেন। হোম কেয়ার প্যাকেজগুলো একটি জাতীয় অগ্রাধিকার ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে যোগ্য ক্লায়েন্টদের জন্য বরাদ্দ করা হয় যা ‘হোম কেয়ার ওয়েটিং লিস্ট’ নামে পরিচিত। বর্তমানে লেভেল ২, ৩ এবং ৪ প্যাকেজের জন্য আনুমানিক অপেক্ষার সময় ৬-৯ মাস। প্যাকেজ বরাদ্দ না হওয়া পর্যন্ত কমনওয়েলথ হোম সাপোর্ট প্রোগ্রামের পরিষেবাগুলো পাওয়া যায়।
‘রেসিডেন্সিয়াল কেয়ার’ পরিষেবা হলো এমন বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য যারা তাদের নিজের বাড়িতে স্বাধীনভাবে বসবাস করতে অক্ষম। যদিও অস্ট্রেলিয়ায় অবসরের কোনো বয়স নেই, বেশিরভাগ অস্ট্রেলিয়ান ৬৫/৬৭ বছর বয়সে অবসর গ্রহণ করে। তারা যত দিন সম্ভব নিজ বাড়িতে অবসর কাটায়। অনেকে আবার নিঃসঙ্গতা এড়াতে 'রিটায়ারমেন্ট ভিলেজ'-এ চলে যায়, যেখানে তারা তাদের সমবয়সীদের সাথে সময় কাটাতে পারে এবং একটি ব্যক্তিগত বাড়িতে স্বাধীনভাবে বসবাস করতে পারে। পরে যখন তারা স্বাধীনভাবে থাকতে পারে না, তখন এজেড কেয়ার হোমে চলে যায়, যাকে বাংলাদেশে 'বৃদ্ধাশ্রম' বলা হয়। এজেড কেয়ার হোমে প্রবেশের গড় বয়স, পুরুষদের ৮২.৫ বছর এবং মহিলাদের ৮৪.৮ বছর। ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রায় ১ লক্ষ ৮৪ হাজার মানুষ রেসিডেন্সিয়াল কেয়ার পরিষেবা পেয়েছেন। মাথাপিছু গড় বার্ষিক ভর্তুকি ছিল প্রায় ৭০ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলার। প্রতিটি এজেড কেয়ার হোমের আবাসিককে যত্ন এবং বাসস্থানের জন্য অর্থ প্রদান করতে হয়, পরিমাণটি নির্ভর করে তার অর্থ প্রদানের ক্ষমতার উপর। সরকারি ভর্তুকি-প্রাপ্ত এজেড কেয়ার হোমে ভর্তি হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। বর্তমানে গড় অপেক্ষার সময় ১৫২ দিন। ভর্তুকি-প্রাপ্ত এজেড কেয়ার হোমের পাশাপাশি প্রাইভেট এজেড কেয়ার হোম রয়েছে যেখানে বাসিন্দারা সরকারী ভর্তুকির জন্য অপেক্ষা না করে সমস্ত খরচ নিজেরাই বহন করে।
অস্ট্রেলিয়ান জনসাধারণ তাদের বয়স্ক পরিচর্যা ব্যবস্থার গুণমান নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। এই অসন্তোষের কারণ অনুসন্ধানের জন্য সম্প্রতি একটা গুরুত্বপূর্ণ তদন্ত (রয়্যাল কমিশন ইনটু এজেড কেয়ার কোয়ালিটি অ্যান্ড সেফটি) হয়ে ছিল। রয়্যাল কমিশনের প্রতিবেদন অনুসারে, অস্ট্রেলিয়ান বয়স্ক পরিচর্যা ব্যবস্থা বেশ কিছু ঘাটতিতে ভুগছে, যার মধ্যে রয়েছে অর্থায়নের অভাব, দীর্ঘ অপেক্ষার তালিকা এবং বয়স্ক পরিচর্যা খাত কর্মীদের নিয়োগ এবং ধরে রাখার সমস্যা। প্রতিবেদনে অস্ট্রেলিয়ার বয়স্ক পরিচর্যা ব্যবস্থার পুনর্গঠন করার জন্য ১৪৮ টি সুপারিশ করা হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা সরকার সুপারিশগুলো গ্রহণ করে অস্ট্রেলিয়ান বয়স্ক পরিচর্যা ব্যবস্থাকে সত্যিকারের জন-কেন্দ্রিক ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করবে।
এই নিবন্ধটি সম্প্রতি 'আমাদের অর্থনীতি' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
ড. নজরুল ইসলাম, কার্টিন ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া
|