আমার বিদেশ যাত্রা ড. নজরুল ইসলাম
পরের পর্ব
জন্ম থেকেই আমার ডান পায়ে একটা তিল আছে। ছোটবেলায় তাই দেখে আমার মা এবং আত্মীয়স্বজনরা বলাবলি করতেন - এই ছেলে বড় হয়ে একদিন বিদেশ যাবে। গুরুজনদের কথা যে এই ভাবে অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাবে তা কখনো ভাবিনি। সেই যে উনিশ বছর বয়সে দেশ ছাড়লাম আর ফেরা হলো না। এর মাঝে ঘোরাঘুরি তো আর কম হলো না। পাঁচ মহাদেশের চোদ্দটি শহরে বসবাস করলাম। কত লোকজনের সঙ্গে পরিচিত হলাম, বন্ধুত্ব হলো। আবার দূরে চলে গেলাম। সেই বন্ধুরা সব হারিয়ে গেল। সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে এখন বসবাস করছি অস্ট্রেলিয়ায়। তবে প্রথম বিদেশ যাত্রার ঘটনাটা কথা আজও ভুলিনি। আমার বাবা উচ্চশিক্ষার জন্য দু'বার বিদেশ গিয়েছিলেন। তাই ছোটবেলা থেকে আশা ছিল আমিও একদিন বিদেশ যাব। তবে সুযোগটা যে এতো কম বয়সে এসে যাবে আশা করিনি। কেননা তখনকার দিনে এতো কম বয়সে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাওয়ার প্রচলন বাংলাদেশে ছিলনা। আসলে তখন উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়াটা ছিল উল্লেখযোগ্য ঘটনা। খবরের কাগজে ছাপা হতো - 'উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশ যাত্রা'। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো অনেক সাহায্য করেছিল। স্বাধীনতার পর এই সাহায্য অব্যাহত থাকে। সাহায্যের অংশ হিসাবে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো বাংলাদেশী ছাত্রছাত্ৰীদের জন্য বেশ কিছু স্কলারশিপ দেয়। আমি বুলগেরিয়াতে পড়াশোনা করার জন্য এরকম একটা স্কলারশিপ পেয়ে গেলাম। প্রসঙ্গত বুলগেরিয়া ছিল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানকারী পঞ্চম দেশ - ভুটান, ভারত, পূর্ব জার্মানি এবং পোল্যান্ডের পর।
তখন সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত বাংলাদেশে এক অনিশ্চিত অবস্থা বিরাজ করছিল। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ। চারদিকে ধ্বংসের চিহ্ন। পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি বাহিনী পরিকল্পিতভাবে দেশের অবকাঠামো ধ্বংস করে দেয়। দেশকে মেধা-শূন্য করার জন্য শত শত বুদ্ধিজীবী হত্যা করে। পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পপতিরা বাংলাদেশ থেকে কোটি কোটি টাকা সরিয়ে নিয়ে যায়। আত্মসমর্পণের আগে স্টেট ব্যাংকের নগদ টাকা জ্বালিয়ে দেয়। কাজেই বাংলাদেশ সরকার অর্থশূন্য হয়ে পড়ে। আমি এই অনিশ্চিত অবস্থা থেকে বাঁচার একটা সুযোগ খুঁজছিলাম। স্কলারশিপটা সেই সুযোগ এনে দেয়।
আমরা বিদেশ যাওয়ার সময়ে বাংলাদেশ সরকার আমাদের দুটো সুবিধা দিয়েছিল - গ্র্যাটিস পাসপোর্ট এবং ৫ পাউন্ড সঙ্গে নেয়ার অনুমতি। পরবর্তীতে সেই গ্র্যাটিস পাসপোর্ট নিয়ে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল। সে কথা আজ নয়। গ্র্যাটিস পাসপোর্ট এবং অনুমোদিত ৫ পাউন্ড পেতে অসুবিধা হলো না। তখনকার বিনিময় হার অনুযায়ী ৫ পাউন্ড ছিল প্রায় ১৩ ডলার। এখন বাংলাদেশ সরকার ৭ হাজার ডলার পর্যন্ত সাথে নেয়ার অনুমতি দিয়েছে। সত্যি সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল খুবই নাজুক। এমন দেশে যাচ্ছি যেখানে চেনা জানা কেউই নেই। তাই আব্বা ঠিক করলেন আমার সঙ্গে আরও ৫ পাউন্ড দিয়ে দেবেন। আমার এক খালু ব্যাংকে কাজ করতেন। আম্মা খালুকে বললেন অতিরিক্ত ৫ পাউন্ডের কথা। খালু একদিন পাউন্ড নিয়ে আমাদের বাসায় হাজির। আমাকে কাছে ডেকে হাতে একটা নোট গুঁজে দিয়ে বললেন - এখানে ৫ পাউন্ড আছে, খুব সাবধানে লুকিয়ে নিতে হবে। তিনি এমন ভাবে বলছিলেন যেন আমি লুকিয়ে ড্রাগ নিয়ে যাচ্ছি। পরবর্তীতে এই অতিরিক্ত ৫ পাউন্ড আমার অনেক কাজে দিয়েছিল।
১৮ই অক্টোবর ১৯৭২ সাল। তখন রোজা চলছিল। ছোটবেলা থেকে আমার রোজা রাখার অভ্যাস ছিল। যাত্রার কারণে রোজা ভাঙতে হলো। আমাদের ফ্লাইট এরোফ্লোট কোম্পানির - বোম্বে, তিবলিসি হয়ে মস্কো। পরদিন মস্কো থেকে সোফিয়া। সকালে ফ্লাইট ছিল তাই বাসা থেকে রওনা দিতে হলো বেশ ভোরে। তখন বিমানবন্দর ছিল তেজগাঁয়ে। খুবই ছোট বিমানবন্দর। একটা স্বাধীন দেশের বিমানবন্দর হিসেবে একদম বেমানান। আমাদের বাসা থেকে তেজগাঁ বিমানবন্দরের দূরত্ব ছিল প্রায় ৭ কিলোমিটার। ফাঁকা রাস্তা। পোঁছাতে সময় বেশি লাগলোনা। আমার সহযাত্রী ছিল আরও তিন জন - আজিজ, আউয়াল এবং মোস্তফা। বিমানবন্দরে আমরা মিলিত হলাম। আজিজ আর আউয়ালকে আগে থেকেই চিনতাম। ওরা ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিল। মোস্তফার সঙ্গে পরিচিত হলাম। পরবর্তীতে আমাদের চার জনের তিন জন অস্ট্রেলিয়াকে স্থায়িভাবে বসবাসের জন্য বেছে নেই। আজিজ লন্ডন-বাসি। দুঃখের বিষয় মোস্তফা ছয় বছর আগে আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলা গেছে।
সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিমানে বসে আছি। ব্যস্ততার মাঝে এত দিন কিছু ভাবার সময় পাইনি। বিমান দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে। টেক অফ করার পর বিমানের জানালা দিয়ে ঢাকা শহর দেখছি। ভেতরে ভেতরে এক অদ্ভুত অনুভূতি। প্রথম বিদেশ ভ্রমণের রোমাঞ্চ। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কা। আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবদের ছেড়ে যাওয়ার বেদনা। তবে প্রত্যাশা ছিল একদিন পড়াশুনা শেষে এই দেশে ফিরে আসব।
পরের পর্ব
ড. নজরুল ইসলাম, কার্টিন ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া
|