অস্ফুট কলির ঘ্রাণ / দীলতাজ রহমান
আগের অংশ
ততদিনে নাহার বুঝে গেছেন আজকালকার শহুরে মা-শাশুড়িদের দেখে এসে, নিজের আনস্মার্ট, গেঁয়ো শাশুড়িকে সবার সামনে পরিচয় করিয়ে দিতে তার ছেলের বউটি ঠিক যুৎ পায় না। তাই বলে এ বয়সে রূপ-সাধন? নাহার তাই হেসেই বলেন- জঙ্গুলে লতার একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে বউমা!’ বলে বিষয়টি কাটিয়ে গেছেন। কিন্তু সেই দুপুরের পর থেকে খুব ইচ্ছে করছে পিউ তাকে আবার বিউটি পার্লারের কথাটি বলুক। এবার বললেই প্রস্তাবটা লুফে নেবেন।
কিন্তু দিন কাটতে চায় না নাহারের। একদিন ছুটির আগের দিন নিজেই বলে বসলেন-আমার মুখে বোধ হয় মেসতা পড়ে যাচ্ছে বউমা। কোথায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলে...।’ পিউ প্রস্তাবটি সত্যিই লুফে নিলো। প্রথমে আয়নার সামনে যেতেও বিব্রত বোধ করছিলেন নাহার। কিন্তু ছেলের সামনে পড়ার আগেই পিউয়ের নিজস্ব গলগলে তারিফে বিষয়টির হোতা যে সে নিজেই, স্বামীর কাছে তা প্রমাণ করে শাশুড়িকে বড়ধরণের বিড়ম্বনা থেকে রক্ষে দিলো। পিউ একটু প্রশ্রয় পেয়েই শাশুড়ির জন্য কেনা শুরু কওে দিলো, চওড়া পাড়ের শাড়ি। রঙের তারতম্যে যেন তাতে জীবনের সব ধূসরতাকে ঢেকে দেয়ার তীব্র একটা প্রয়াস থাকে বউয়ের। তারপর ক্রমে প্রতিদিন সকালে ছেলে, বউমাকে বিদায় অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে যাওয়া শুরু হলো কয়েক কদম করে। সকাল-সন্ধ্যা কিম্বা রাতে দরজা যখন খুলতে হয়, যেন আরও একটু বেশি গেলে ক্ষতি কী? কিন্তু ফেরার ক’পায়ে তিনি ধন্দে পড়ে যান- এ আমার কী হলো? আর এই আত্ম-জিজ্ঞাসাই নাহারের অভিনবত্বকে উস্কে দেয় প্রতিদিন। মুখের কঠিন রেখাগুলো ক্রমশ মিইয়ে এসে শরীরের ভাঁজগুলো ফুটে ওঠে তার নিজেরই চোখে। এতে বড় অস্থির লাগে তার।
কত মানুষের আনাগোনা। লিফট, সিঁড়ি সমান চলে মানুষের পদচারণায়। কিন্তু দোলার সে সুবাতাস রহিত হলো কোথায়? তিনি কি তাহলে নিচের কোনো ফ্ল্যাটে থাকেন? নাহাররা থাকেন আট তলাতেই। হয়ত ভুল করেই তিনি লিফটে নিজের ফ্ল্যাট পার হয়ে আরো ওপরে চলে এসেছিলেন।
নাহার নিজেও জানেন, তার এ সাজসজ্জা সবই ভুল। তবু সেই ভুল হাওয়ার পরশ চাইছেন তিনি! তার বিয়াল্লিশ বছরের জীবনে এই প্রথম কারো জন্য অপেক্ষা। এ অপেক্ষার আলোতেই এই বাড়ি এখন তার কাছে গুমোট, স্যাঁসস্যাঁতে মনে হয় না। এখন আর সামিউল বা পিউ, কাউকেই বলেন না- জানালায় দাঁড়ালিই ঝাঁপায়ে আসে আরেকটা বাড়ির দেয়াল। দিনির ব্যালাও বিদ্যুৎ না থাকলি চোখে দেহা যায় না। দম বন্ধ অয়ে আসে এহানে। আমারে ঢাকা শহরে রাখতি অলি আলো-বাতাসের বাসা নেও। না অলি যশোরের মানুষ আমি যশোরেই গিয়ে থাহি। মাঝে মাঝে আইসে বেড়াবো, সেই বালো বাড়ির গরু-ছাগলগুনো বেইচে ভুলই অলো।
মায়ের কথা হয়ত মনে ধরেই ছিলো সামিউলের। হয়তো তারা দুজনে মিলে বাসার খোঁজও করেছে। না হলে হঠাৎ করে বললো কীভাবে- তোমার জন্য বাসা দেখে এলাম মা। কলাবাগান মাঠের কাছে। আমরা আগামী মাসেই চলে যাবো। ও বাড়িটা এতটুকুই। কিন্তু একেবারে নতুন। আমারই হবো ওটার প্রথম বাসিন্দা।
নাহার থতমত খান। কী বলবেন ভেবে পান না। আমতা করেন-আমি কইছি, তাই বাসা পাল্টাতি অবে? তোমাগের দুইজনের যেহানে সুবিধা সিহানেই তোমরা থাকপা।’
- আপনার ইচ্ছে পূরণই আমাদের আনন্দ মা। আজই আমরা এ্যাডভান্স দিয়ে এলাম। নাহারের কথা সরে না বউমার কথায়। কিন্তু একটা কিছু বলা দরকার! তাই যা বললেন-দ্যাখো এ্যাডভান্স ফেরত আনা যায় নাকি! কিন্তু তার কথা ওদের কান পর্যন্ত পৌঁছে না।
আর মাত্র কদিন বাকি এ বাড়ি ছেড়ে যেতে। সব বাঁধাছাঁদার তোড়জোড় চলছে। সামিউলের বারবার ঘর-বার করা বেড়ে গেছে। শিথিল হাতে আরো আগে থেকে নাহারই সব গুছিয়ে প্যাকেট করছেন। পিউও ইচ্ছে হলে তার মতো করে হাত লাগায়। অনিচ্ছের সব শাশুড়ির ওপর গড়ায়।
বাড়িটি ছেড়ে যাওয়ার ঠিক আগে দোকান থেকে কিছু একটা আনতে হবে। সন্ধ্যার পরে শাশুড়িকে নিয়ে বের হয় পিউ। ক’দিন ধরে এরকম হয়ে যাচ্ছে। বাটন চাপ দিতে দশতলা থেকে কয়েক সেকেন্ডে নেমে আসে লিফট আটতলায়। ওরা নামতে নামতে বোঝে, পাঁচতলায় কেউ উঠবে। খোলামাত্র ঢিলেঢালা হাফ হাতা গেঞ্জি আর ট্রাউজার পরা, সরু চশমা চোখে একজন উঠে দাঁড়াতেই নাহার চমকে বলে উঠলেন-আপনি এক দুপুরে আমাদের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়েছিলেন, মনে আছে...!’
ভদ্রলোক ভ্রুতে এমনভাবে ভাঁজ তুললেন, যার মানে দাঁড়ায়- তিনি কি আপনি ছিলেন, যাকে আমি দেখেছিলাম? যাকে দেখেছিলাম সেতো অতি আটপৌরে, বিধ্বস্ত এক গ্রাম্য মহিলা। যে আমাকে দেখে চমকে উঠে আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলো...!’
তারপর পিউয়ের দিকে তিনি স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে হেসে বললেন? সত্যি আমার গিয়ে ক্ষমা চেয়ে আসা উচিৎ ছিলো আপনাদের কাছে। কিন্তু যিনি বাসায় ছিলেন, তিনি যেভাবে চমকে উঠেছিলেন, আমি তো সেই অবধি ভয়েই আছি। কোথাও ধরা পড়ে নাজেহাল হই। কারণ তিনি ঠিক কীভাবে এর ব্যাখ্যা করবেন আপনাদের কাছে...।’
ভদ্রলোকও ঘটনাটি ভোলেননি ভেবে নাহার চমকিত হতে গিয়ে দমিত হয়ে গেলেন। কারণ নাহার এখানে আলোচনার লক্ষ্য নয়। সম্মানজনক উপলক্ষও ভাবছেন না উনি তাকে।
নাহারের করা প্রশ্নের উত্তর কৈফিয়তের স্বরে ব্যক্ত করলেন পিউয়ের কাছে। আর পিউও লোকটির কথায় বহুদিনের চেনা মানুষের মতো অকপট হেসে বলতে লাগলো- এমন হতেই পারে। আমাদের হয় না? মানুষের মন এবং চোখ কি আর সারাক্ষণ একসঙ্গে জাগরুক থাকতে পারে?’ এটুকু কথা শেষ হওয়ার আগেই পথ বেঁকে যাওয়ার কথা। তাই কথা শেষ হতেই যার যার পথে ঢিমে তাল কেটে পদচারণা দ্রুত হলো।
বিয়ের আগে থেকে দেখা প্রায় দুই বছরের বিবাহিত জীবনে এই প্রথম শাশুড়ির মুখে একটি সম্পূর্ণ বাক্যের শুদ্ধ উচ্চারণ ‘আপনিই তো এক দুপুরে আমাদের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়েছিলেন...।’ প্রসঙ্গক্রমে শাশুড়ির জীবনের সব অধ্যায় থেকেই তাঁর নিজের মুখে যতটুকু শুনেছে, তাতে একটা নিটোল গল্পের নায়িকায় পরিণত হয়ে আছেন তিনি বউয়ের মনে। যদিও সামিউলের কোনো উৎসাহ সে কখনো লক্ষ্য করেনি মায়ের কোনো বিষয় নিয়ে কিছু বলতে বা শুনতে। তবু কোনো সংঘাত জয়ের অবসাদ বা আনন্দের রেশ নয়, যেন একটি শীতার্ত নদীর একা বয়ে চলার চিহ্ন কপাল জুড়ে প্রকট হয়ে আছে শাশুড়ির। তাই সামিউলের শীতল মনোভাবকে সে কখনো সমর্থন করতে পারে না।
নতুন বাড়িতে শাশুড়িকে সবতাতে ক্ষুণ্ণ থাকতে দেখে, এবং সেদিনের লিফটের ঘটনার রেশ ধরে পিউ খুব ঘনিষ্ঠ স্বরে এক সময় বললো-মা আপনি বাবার কাছে ফিরে যেতে পারেন না? অথবা তাকে এখানে আনতে...।’
বহু বছর পর এই প্রথম নাহার আবার গুলিয়ে ওঠেন। কারণ এখনো তিনি মাত্র ত্রিশ হাজার টাকার কাবিননামায় ঝুলে আছেন। যা ছিন্ন করতেও প্রসঙ্গের অবতারণা করতে হতো বলে ছিন্ন করা হয়নি। আর সে জন্য আজো ধুলো জমে সুতোর শক্ত হয়ে থাকার মতো কোনো অনুভূতিই মগজে শিরায় কাজ করছে না। তিনি অবচেতনেই বিড়বিড় করে বললেন- আশ্রয় হারা নাহলে কেউ কারোর কাছে যাতি চায় না বউমা! সবাই কেবল সবার নিজির স্বপ্নের কাছেই যাতি চায়। সেরকম স্বপ্ন কখনি আমারে হাতছানি দেয় নাই। শুধু একটাই ভয় আমার। আমি যেন তোমাগে কোনো অ-সুখের কারণ না অই। এইটুকুরতে রেহাই পাওয়া ছাড়া, কারো কাছেই আর আমার কিছু চাওয়ার নাই!’
আগের অংশ
দীলতাজ রহমান, ব্রিজবেন, অস্ট্রেলিয়া
|