গল্প শিল্পী দীলতাজ রহমান
জেলা শহরের এক কোণায় যাত্রা হচ্ছে। ডিশ অ্যান্টেনার বদৌলতে হিন্দি ছবির নায়িকাদের ধারালো সব অঙ্গের ভাঁজে যুবা-তরুণ এমনকি বৃদ্ধেরা আরো বেশি পাঁক খেয়ে যখন বুঁদ, তখনো যাত্রার আসনগুলোতে একটাও ফাঁকা সিট পাওয়া দুষ্কর। মসজিদের ইমাম সাহেবদের ভাষ্য, ‘যাত্রা চলাকালীন সময়ে এশার ও ফজরের নামাজের জামাতে লোক পাওয়া যায় না। বিশেষ বিশেষ রাতে নামাজ পড়াতে গেলে দেখা যায় ঘুমে যারা একজনের ওপর আরেকজন ঢলে পড়ছে, যাত্রায় তারাই শেষ পর্যন্ত টনক হয়ে বসে থাকে।’
এই শহরের ম্যাজিস্ট্রেট একজন টগবগে তরুণ। তার ব্যক্তিত্ব সব সময়েই বন্ধু হিসেবে ছেঁকে তোলে সেরা ছেলেগুলোকে। এখানেই মাহফুজের প্রথম পোস্টিং। মাত্র মাস-দুয়েক হলো সে চাকরিতে জয়েন করেছে। একদিন শহরের কিছু চৌকস তরুণ কৌতূহল বশত ঘিরে ধরলো মাহফুজকে, তাদের সঙ্গে যাত্রা দেখতে যেতে হবে বলে। রাত আটটা থেকে যাত্রা শুরু। শেষ হতে ভোর রাত।
ব্যাচেলর থাকায় মাহফুজের কদর সর্বত্র। বাধ্য হয়ে রাতের খাওয়া সারতে হলো এলাকার একজন ধনী প্রভাবশালীর বাড়িতে। খাবার পরিবেশন করছিলো প্রভাবশালীর সুন্দরী কন্যা নিজে। এমনটি অবশ্য মাহফুজের জীবনে প্রথম নয়। মুগ্ধ হতে সে জানে। ছেলেদের মতো মেয়েদের সঙ্গেও অকপটে মিশতে জানে। প্রতিটি মেয়েই মাহফুজের আচরণ দেখে মনে করে ক্ষীণ হলেও তার আঁচড়টিই প্রথম পড়েছে মাহফুজের মনে। এক মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হলে কখনো সে বলে না এর আগে কোনো মেয়ের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে।
বড়লোকের ছেলেগুলো হুট-হাট করে প্রেম করতে পারে। এমনকি একা একা বিয়েও করতে পারে। খুদ-কুড়ো খেয়ে যারা মানুষ তাদের কাছে তাদের জীবনের মতো দামি আর কিছুই নয়। এসব ক্ষেত্রে বিয়েটা তাদের উত্তরণের দ্বিতীয় সোপান। হয়তো প্রথমও। ভালো একটা চাকরির চেয়ে কোনো অংশে কম নয় বিয়েটা।
দর্শকদের প্রথম সারিতে, যাকে বলে সংরক্ষিত আসনে গিয়ে বসলো ছেলেগুলো নতুন ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়ে। যাত্রা দেখার রুচি বা আগ্রহ কোনোটাই নেই মাহফুজের। এধরনের হৈ-হুল্লোড়ে বরং তার গা গুলোয়। জীবনে তার এই প্রথম যাত্রার সঙ্গে পরিচয়। শুধু মানুষের মুখে মুখে শুনে একটা ধারণামাত্র ছিলো। তবু তাকে নিয়ে তরুণদের মেতে থাকা মন্দ লাগছে না। নতুন অভিজ্ঞতার সঙ্গে অনেককে কাছে থেকে দেখাও হয়ে যাচ্ছে। আলটিমেটলি এদেরই তো শহর! এদেরকেই তো চরতে হবে!
সংরক্ষিত আসনে যে ক’জন বসেছে তাদের কারোই মন নেই যাত্রায়। কাহিনী, নাম, পাত্র-পাত্রী কিছুতেই কারো ওদের কারো আগ্রহ নেই। বরং নিজেরা নিজেদের বুদ্ধিমত্তা ক্রিয়েটিভিটি, শিক্ষা-দীক্ষা নিয়ে মত প্রকাশে ব্যস্ত। এরাও কোনোদিন যাত্রা দেখেছে বলে মনে হচ্ছে না মাহফুজের।
দর্শকদের একত্রিত করতেই অ্যানাউন্সার বারবার কাহিনী অংশবিশেষ বর্ণনা করে যাচ্ছে ইনিয়ে বিনিয়ে, রং চড়িয়ে। অবশ্য চমকটুকু দেখে নিতে আহ্বান জানাচ্ছে। পাত্র-পাত্রীর নাম ঘোষণা করছে কণ্ঠ আরো হেঁড়ে করে। মাইকে ‘সখিনা বানু’ নামটি পেরেকের মতো এসে বিঁধলো মাহফুজের মগজে। শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেলো তাতে। তার চোখের সামনে কালো পর্দা এসে ঢেলে পড়লো। সে পর্দা সরিয়ে সে কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছে না। কারো কোনো কথাও কানে ঢুকছে না। মাহফুজের মুখের অবস্থা দেখে এক সঙ্গে সবাই ভড়কে গেলো। কেউ কেউ কেটেও পড়লো, যারা বুঝলো এখন এখানে তার থাকা না থাকা দুই-ই সমান নতুন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে।
সখিনা বানু এ যাত্রার প্রধান নারী চরিত্র। নিজের রূপ, মেধা, অধ্যবসায় এবং সুকণ্ঠী হওয়ায় অনেককে টপকে সে স্থানটি দাপটের সঙ্গে আগলে রেখেছে। শিল্পের ধ্যানে-জ্ঞানে আপাদমস্তক সে শিল্পিত। তারপর রক্তে প্রবাহিত বংশের আভিজাত্য-বোধ। আচরণে শালীনতা। বিত্তের মধ্যে বেড়ে উঠে পেয়েছে ঔদার্য। এতকিছুর পরেও দলের স্বার্থে কতখানে তাকে টোপ হতে হয়। শিল্পের খাতিরেই অগ্নিদাহ করতে হয় শিল্প-সত্তার।
মাহফুজ তখন ডিগ্রিতে পড়ে। কলেজের কাছেই সখিনাদের বাড়ি। চারপাশে পরিখা কাটা। তারপরও উঁচু প্রাচীর। সাত ভাইয়ের একটি মাত্র বোন সখিনা। তীক্ষ্ণ বুদ্ধির, চঞ্চল হৃদয়ের সুন্দরী এক মায়াবতী কিশোরী। হোস্টেলের অনেকেই সখিনাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতো। কিন্তু ও পছন্দ করেছিলো মাহফুজকে। দু’জনের চিঠি লেনদেন হতো। মাহফুজকে ভালোবেসে সখিনা যাদের স্বপ্নহীন করেছে, তাদের কেউ মাহফুজকে লেখা সখিনার একখানা চিঠি হাতে পেয়ে ওর বাবার হাতে দিয়ে যায়। আর এতেই সখিনার বাবা এবং ভাইয়েরা মিলে ওকে আধমরা করে ফেলে। ছাড়া পেয়ে সখিনা সরাসরি চলে আসে মাহফুজের কাছে। মাহফুজ ওকে মা-বাবার কাছে এনে সবকিছু খুলে বলেছিলো।
মেয়ে দেখতে সুন্দরী। জাত-পাতও মাহফুজের পরিবারের ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু এভাবে বিয়ে করলে মেয়ের বাবার কাছ থেকে কাঙ্খিত অর্থ খসানো যাবে না। একগাদা ভাইবোনের বড় মাহফুজ। বিয়ে দিয়ে তাকে এখনই কাঁধে জোয়াল চাপিয়ে দিলে বাকিগুলোর উপায় কী হবে! ছেলেকে বিয়ে দিয়ে যে বড় দানের আশায় বুক বেঁধে আছে তারা, সব মাঠে মারা আর কি!
হিসাব কষে মাহফুজের বাবা সখিনাকে বলেছিলো, ‘যাও মা, তোমার বাবা-মা চিন্তা করছেন। এভাবে হুট-হাট সিদ্ধান্ত নিতে নেই। বিয়া অনেক বড় কথা। লেহাপড়া শিখ্যা আগে বড় হও। এহনো মেলা সময় সামনে।’
ভয়ে সখিনার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। নিজের অজান্তে এদিক-ওদিক তাকালো সে। ওরা বুঝেছে সখিনা মাহফুজকে খুঁজছে। তাই বললো, ওকে জরুরি দরকারে এক জায়গায় পাঠিয়েছি। আসতে দেরি হবে। অন্য কেউ সঙ্গে গেলেও আমাদের বিপদ। কে দেখে ফেলে।
আসন্ন সন্ধ্যাকে সামনে করে আবীররাঙা আকাশ পিছনে ফেলে সখিনা নেমে গেলো মাহফুজের জংধরা নড়বড়ে টিনের খুপরি ঘরখানা থেকে। বাবার নির্দেশে পালিয়ে থাকা মাহফুজ হালটের বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে থেকে সে যাওয়া দেখেছিলো অনেকক্ষণ ধরে।
বাড়ির অন্দর মহলে মরা কান্না। বড়বাড়িতে উদ্বেগের ঘনঘটা। সখিনাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। ক’দিন পরই ওর মেট্রিক পরীক্ষা। মাহফুজের সঙ্গে যায়নি, কারণ সেতো হোস্টেলেই আছে নিরুদ্বেগ অবস্থায়। ভাগ্যিস সেদিন ওর কোনো মিত্রও দেখেনি সখিনাকে ওর সঙ্গে হেঁটে যেতে।
হন্যে হয়েও খুঁজেও যখন বাড়ির মানুষেরা সখিনাকে খুঁজে বের করতে পারলো না, তখন গ্রামবাসীর অনুমান, জিদের বশে মেয়ে খারাপ পাড়ায় গেছে। বেশি আদরে বেড়ে ওঠা মেয়েরা তো ওরকম করে বসে। ওখানে যারা আসে জিদ করেই আসে। বাকিরা আসে অভাবে আর ধড়িবাজের পাল্লায় পড়ে।
কিন্তু কিছুদিন পর আর অনুমান নয়, একেবারেই সাক্ষাৎ দেখে এসে দূর-দূরান্ত থেকে কেউ কেউ বলেছে যাত্রায়, দাসী বা সখীর চরিত্রে সখিনার মতো একজনকে দেখেছে। মুখে এত রং তবু বুঝতে কষ্ট হয় না, কণ্ঠও সেরকম। ও মেয়েকে আর খোঁজে কে? একেবারে ত্যাজ্য করে দিলেন বাবা। আইনানুগ না হলেও মুখে মুখে।
নিজের চৌদ্দগোষ্ঠির গা বাঁচাতে ঘটনাটি চাপতে মাহফুজ একেবারেই ভুলে গিয়েছিলো। প্রথম দিকে তো সারাক্ষণ রিহার্সাল দিতো। না, না সখিনাকে আমি চিনিই না। ও আমার সঙ্গে গেছে এ কথা যে বলেছে শত্রুতা করে মিথ্যে কথা বলেছে। মাথা খারাপ! আমি ও রকম একটা বাজে মেয়ের সঙ্গে হেঁটে যাবো! কিন্তু শেষ পর্যন্ত এত কিছুর আর দরকার হয়নি।
সমস্ত রাত মাহফুজের চোখের সামনে কোন কাহিনী অভিনীত হলো, সে কী পার্ট করে গেলো পুরো বিষয়টি থেকে সে কিছুই বলতে পারবে না। তবে সখিনাকে সে ঠিকই চিনেছে। কী তেজ তার সংলাপে, অভিব্যক্তিতে। যতবার ও স্টেজে উঠেছে ততবার মাহফুজের অন্তরাত্মা দুমড়ে মুচড়ে গেছে। ওকে না পাওয়া জ্বলায় কোনোদিন মাহফুজ এতটুকু পোড়েনি। ওর অন্তর্ধানের জন্য অনুতপ্ত হয়নি। একবিন্দু মমতাও কাজ করেনি ওর মনে। এর সবকিছুই কি আজ সুদেআসলে উসুল হচ্ছে!
যাত্রার শিল্পী-কলাকুশলীরা সারাদিন বিশ্রাম নেয়, ঘুমোয়। যেহেতু সারারাত তাদের কাজ করতে হয়। দুপুর পার করে সখিনা ঘুম থেকে উঠেছে। তারপর গোসল সেরে এসেছে। তখনো ভেজা চুল। টপ টপ করে পানি ঝরছে। এমন অবস্থায় যাত্রা দলের ম্যানেজার আকমল চাচা এসে বললো, তোমার সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব দেখা করতে এসেছে। খবরটি শুনে খুশি হতে পারলো না, সখিনা কপাল কুঁচকে বললো, অবশেষে ম্যাজিস্ট্রেটের ভীমরতি!
- নারে মা, সেরকম কিছু নয় বোধহয়। কারণ তিনি নিজে এসেছেন। খারাপ উদ্দেশ্যে অইলে অন্য মানুষ পাঠাইতো।
- কোথায় তোমার ম্যাজিস্ট্রেট? ওর কাছে আমাদের দলের কোনো কাজ আছে?
- আপাতত নাই, অইতে কতক্ষণ।
- আপনি যান, আমি আসি!
সখিনা আয়নায় আর নিজের চেহারা দেখলো না। যাত্রায় এসে মেকাপের পরতে এমনভাবে ঢেকে থাকতে হয়! তাই যতক্ষণ মেকাপ ছাড়া থাকতে পারে ততক্ষণই স্বস্তি। পাটভাঙা শাড়ির আঁচলটা বুকের উপর আরেকটি ভাঁজ তুলে স্যান্ডেলটা পায়ে গলিয়ে কৌতূহলী মানুষের জটলাটা একটু সরিয়ে দরজার বাইরে এসে দাঁড়ালো সখিনা। যাত্রার দলটি উঠেছে শহরের প্রাণকেন্দ্রে বিরাট এক বাড়িতে। বিরাট তার প্রধান ফটক। সারাক্ষণ লোকে লোকারণ্য থাকছে। গেটের কাছে গাড়ি। ভেতরে বসা মাহফুজের চোখে চোখ পড়তেই দাঁড়িয়ে পড়লো সে। এভাবে থেমে যাওয়ার মধ্যে এতটুকুও চমক ছিলো না। ছিলো না কোনো বিষণ্ণতা বা বিব্রতভাবও। ঠোঁটে মোনালিসার হাসি, দৃষ্টিতে করুণার রোদ, কপাল জুড়ে অবর্ণনীয় এক দ্যুতি ঢেউ ভাঙতে লাগলো মাহফুজের চোখে। সমস্ত অবয়বে প্রত্যয়ের বিচ্ছুরণ! আপাদমস্তক জুড়ে যেন সে একখণ্ড বিভূতি।
চারপাশ থমথম। দর্শকরা ভাঙছে নীরবতার হরেক অর্থ। আর দাঁড়িয়ে থাকাটা শোভন নয়। দর্শকদের চোখ বাঁচিয়ে চলতে হয় অভিনেত্রীকে। নায়িকার এমন নিরাবরণ রূপ দেখে শেষে সাধারণের মোহভঙ্গ হয়। ম্যানেজারকে তার ব্যবসার কথাই ভাবতে হয় সবকিছুর আগে।
ম্যানেজার আকমল মুখ খুললো, ‘মা কী করি কও তো? ভেতরে নিয়ে বসাই! মতলব বোঝা যাচ্ছে না ব্যাটার।’
‘আকমল চাচা, ওকে বলে দাও একজন শিল্পী কারো ক্ষমতাকে থোড়াই কেয়ার করে। নিজেকে কেটেছেনে যারা শিল্পের মহিমা স্পর্শ করে, তারা বড় বেপরোয়া হয়! ওর স্পর্ধা ক্ষমার অযোগ্য।’ তার এ কথাগুলো বলতে সখিনা যথেষ্ট সময় নিলো। সেখান থেকে প্রস্থান করলো আরো ধীরে। যেন কোনো জ্বালা নেই, অসহিষ্ণুতার প্রকাশ নেই, শুধু পেছনের সিঁড়ির মতো কাউকে অতিক্রম করে চলে যাওয়া।
দুদিনের অস্বাভাবিক আচরণে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেলো নতুন ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়ে। এমনিকি যাত্রার নায়িকার জন্য পর্যন্ত ধর্না দেয়া? নিজের অসংলগ্ন আচরণে নিজেই ক্ষুব্ধ হয়ে অবশেষে ছুটির দরখাস্ত দিলেন তিনি সপ্তাহখানেকের। অবশেষে তা-ই হয়ে উঠলো অনির্দিষ্ট সময়ের।
দীলতাজ রহমান, ব্রিজবেন, অস্ট্রেলিয়া
|