জল যে পিপাসা পায় না নাগাল / দীলতাজ রহমান
আগের অংশ
তারাবানুর গা গুলাতে থাকে। নিজেকে ধমকান তিনি, পৃথিবীতে কতকিছু আছে ভাববার। এই যে নিজের দেশ ছেড়ে এমন একটি উন্নত দেশে তার আসার সুযোগ হয়েছে। তার উচিৎ এখানকার ভাল ভাল ঘটনায় স্মৃতির ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে নিয়ে যাওয়া। ভালই তো তার দিন কাটছিল এখানে এসে। আগে ওই ফ্ল্যাটে ক’জন ছাত্রছাত্রী মেস বানিয়ে থাকতো। ছেলেমেয়েগুলোর কলহাস্যে বাড়িটি মুখর হয়ে থাকতো। আগে তো তিনি ভাবতেই পারেননি, উন্নত দেশ হলেও ছাত্রছাত্রীরা একসাথে এভাবে থাকতে পারে। তাদেরকে তুলে বাড়িটা বিক্রি হয়ে রীটা এসে তারাবানুর মনে এই সঙ্কটে তৈরি করেছে!
আর রীটার সূত্র ধরে একের পর এক ফেলে আসা বিস্মৃত অনেকগুলো মুখ তারাবানুর মনে পড়ে যেতে থাকে। তারাবানু যে স্কুলে পড়েছে, সেই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা, সেক্রেটারির এক মেয়ে আদিলা আর তারাবানু একসাথে পড়তো! বড়লোক আদিলাদের বাড়ির কাছেই ছিল, খানদানি কিন্তু নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্মানো তারাবানুদের বাসা। দু’জনের খুব ভাবও ছিল। তাই দিনে দুএকবার দুই বাড়ির মাঝখানের মাঠের ভেতর দিয়ে আড়াআড়ি ওরা যাওয়া আসা করতো। একদিন তারাবানু ওরকম পিছনের পথ দিয়ে আদিলাদের বাড়িতে ঢুকছিল, আর ওর কানে চলে এল, ‘বুবু, আইজকার রাইতটা আমি হ্যার ঘরে শুই?” কথাটা বলছেন, আদিলার নিজের মা তার বড় সতীনকে। মানে আদিলার সৎমাকে! কুয়োর প্রায় পনের ফুট কিম্বা তার চেয়ে বেশি নিচে থেকে পানি তুলতে হত। আদিলার মা দড়িতে ছোট বালতি বেঁধে, সেই দড়ি টেনে টেনে পানি তুলে বিশাল দুই বালতি ভরে প্রতিদিন পানি তুলে দিয়ে সাংসারিক অন্য কাজে চলে যায়। আর আদিলার বড় মা ডলে ঘষে স্বামীকে গোসল করিয়ে, গা মুছিয়ে সাথে করে নিজের ঘরে নিয়ে যান। এর ভেতর টু-শব্দ করার অবকাশ থাকে না আদিলার নিজের মা’র। তারাবানুর বয়স কম হলেও তার মন প্রমাদ গুণতে শুরু করে দেয়। তিনি তখনি ভেবেছিলেন, মেঘ কতটা ভারী হলে আকাশে ফিরে না গিয়ে সে পৃথিবীতে এসে ঢেলে পড়ে। তেমনি আদিলার মার শরীর তাকে কতটা আলোড়িত করলে তিনি প্রভুর মতো সতীনের কাছে স্বামীর ঘরে একটি রাত কাটানোর প্রার্থনা জানাতে পারেন! তারাবানু তার নিজের চোখে আরো দেখেছেন, বড় বড় সংসারে শুধু কাজ করানোর জন্য দরিদ্র ঘর থেকে পরিশ্রমী মেয়ে দেখে বিয়ে করিয়ে আনা হতো! আদিলার মাও যে ওই ঐতিহ্যবাহী পরিবারটিতে তেমন ছিল, তা কিশোরী তারামন আগেই আঁচ করতে পেরেছিল।
শহরের বড় বাজারে শাড়ি-কাপড়ের বিশাল দোকান ছিল আদিলাদের। তার বাবা সকালে গিয়ে সেই দোকানে বসতেন। দুপুরে নেয়ে-খেয়ে, বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে আবার হেঁটে হেঁটে দোকানে চলে যেতেন। আসতেন গভীর রাতে।
সেদিন আদিলার মার প্রশ্নের জবাবে আদিলার বড় মা যে ঝামটা মেরে ‘না!’ বলেছিলেন, নাটকের খণ্ডাশেংর মতো সে বিষয়টি তারাবানুর চোখের সামনে পড়ে গিয়ে, তখন তারাবানুর ফুপুর সেই ভাসুরের ছেলের বড় বউটির পর সরাসরি তারাবানু দেখলেন আরেক চরম নিগৃহীতাকে। সেই থেকে তারাবানু দীর্ঘদিন ভেবেছে, এই যে আদিলার মায়ের পেটে যে ওরা ছয় ভাইবোন জন্ম নিয়েছে, তাদের সবার শুক্রাণু কি তার বড় মা ভায়া হয়ে তারই অনুগ্রহ নিয়ে তার বাবার কাছ থেকে তার মাকে গ্রহণ করতে হয়েছে! আদিলা খুব সুন্দরী ছিল। কারণ তার মাও খুব সুন্দরী ছিলেন। সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকে, আদিলাকে দেখলেই তারাবানুর মনে হত, একজন সন্তানের কাছেও ছাইচাপা থেকে যায়, কত মায়ের কত বঞ্চনার আগুন। তারাবানু আদিলার উদ্দেশ্যে মনে মনে বলতেন, আদিলা তোমার জীবনের গরলে আমি প্রতি মুহূর্তে কতটা ফেনায়িত হচ্ছি, তুমি তা কোনোদিন জানবে না!
রীটার উঠোন থেকে এসে তারাবানুর মনের বয়স পিছিয়ে সেই তার স্কুলের শেষের দিনগুলোতে নিয়ে যায়! সে যেন পথ পায় না আর বেরোতে। আর সেখানে এসে ভেড়ে আরো অসংখ্য অসংখ্য নারীমুখ।
আরেকবার, সেও ওই আদিলাদের বাড়ির কাছের বাড়িটিতে থাকাকালীন কোনো এক গ্রাম থেকে তাদের প্রতিবেশীর একবোন এসেছিল রাজধানী ঢাকাতে চিকিৎসা করাতে। বছর পয়ত্রিশের মতো হবে তার বয়স। ক’দিনে একটু পরিচয় জমে উঠতেই সে এক গভীর রাতে এসে তারাবানুর মাকে বলছে, ‘আপা, আমার নিজের মা নেই। আর যাকে বলি, সে-ই আমাকে বুঝ দেয়। সবাই বলে, ‘বাদ দাও। তোমার ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেছে তুমি তাই নিয়ে থাকো।‘ ছেলেমেয়ে নিয়েই তো আছি আপা। কিন্তু সারারাত ঘুম আসে না। আপনার জানাশোনা কেউ থাকলে তার কাছ থেকে আমাকে একটা তাবিজ এনে দেন…। আমার স্বামী যেন আমার কাছে আসে!’
শীতের ঋতু ছিল তখন। লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমের ভান করে পড়ে ছিলেন তারাবানু। তখন বয়সটা তারাবানুরও এমন এক সন্ধিক্ষণে, যখন তাদের সমবয়সী দু’একজন করে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। হোক না তা অকাল বিয়ে। আকলিমা নামের একজন তো বাচ্চা পেটে নিয়ে স্কুলেই আসে। নবম শ্রেণির পরীক্ষাটা শেষ পর্যন্ত তার দেয়া হবে না বলে সে মনে করছে। তারাবানু যখন আরো দুই ক্লাস নিচে পড়তেন, তখন একদিন বিকেলে কানামাছি খেলতে গিয়ে দীপু নামের পাশের বাড়ির ধেড়ে ছেলেটি তাকে ছুঁয়ে দেয়ার নামে পিঠ বা অন্য কোথাও না ছুঁয়ে সে তার বুকে এমনভাবে ছুঁয়েছে, যে তাতে তিনি যেমন ব্যথা পেয়েছিলেন, তেমনি খুব অপমানিতও বোধ করেছেন। দীপুর মা-বাবা অন্য কোথাও থাকতো। আর সে থাকতো তার দাদা-দাদির কাছে। অপমানবোধে সেদিন নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে, পরে তারাবানু দীপুর দাদা-দাদির কাছে গেলেন বিচার দিতে। চোখ ফেটে বেরিয়ে আসা জল নিয়ে মনে মনে পণ করলেন তারাবানু, যে গিয়ে বলবেন, দীপু তাকে পিঠে খুব জোরে কিল দিয়েছে। ব্যথায় তার দম আটকে আসছে…।
মায়ের কাছে তাবিজের জন্য আসা প্রায় তার মায়ের সমবয়সী নারীটিকে মা খুব মমতা নিয়ে বলেছিলেন, তোমার নাম কি? নারীটি বলেছিল, আয়েশা! মা বললেন, শোনো আয়েশা, এসব তাবিজ-কবজে আসলে কিছু হয় না। আমি তোমাকে বুদ্ধি দিই, তুমি নিজে তার গায়ের ওপর পড়ো না কেন? তুমি কেন তাকে টেনে ধরো না?
আয়শা বললো, কেমনে ধরি আপা। কাছে তো আসতে হবে। চার বাচ্চার বাপ সে, কোনো এক কারণে মামলা খাইছিল, কোনখানে কোন বন্ধুর বাড়ি পালাতে গিয়ে বন্ধুর অবিবাহিত কুমারী বোনকে বিয়ে করে বাড়ি তুলেছে। সেই থেকে সে আর আমার মুখোমুখি হয়নি। এখনো দিনরাত সারাক্ষণ তার কাছে পড়ে থাকে। দিনেরবেলাও আরেক ঘরের থেকে তার খাটের মচর মচর শব্দে আমি টিকতে পারি না। দিনভর হাসিঠাট্টা আর খিল এঁটে যা করে সব আমি টের পাই। আমার শেষে মনে হয়, পাগল হয়ে একদিকে হেঁটে চলে যাই। কিন্তু ছেলেমেয়ের জন্য পারি না!
তারাবানুর মা বললেন, তোমার স্বামীর পেশা কি? সংসার চলে কি করে?
আয়েশা বললো, শ্বশুরের বংশের নামডাক আছে। অবস্থা ভাল। জমিজমা মানুষের কাছে বর্গা দেয়া। তারা যা দেয়, তাতে সংসার ভালভাবে চলে যায়…।’
তারাবানুর মা বললেন, তোমার শরীরের কি হাল করেছ তুমি! মন শক্ত করো। শরীরের যত্ন নাও। লোকটা মহাঘোরে আছে। তুমি একটু সেজেগুজে থাকার অভ্যাস করো।
আয়েশা বললো, আপা, দাবানলে বনের কি থাকে? এই দুই বছরে আমি ছাই হয়ে গেছি। এত লজ্জার কথা কাউকে তো বলাও যায় না! নাহলে দেখতে তো আমিও সুন্দরী ছিলাম। শ্বশুর-শাশুড়ি আমাকে খুব পছন্দ করে এনেছিলেন। সেও তো কম ভাল বাসতো না!
এইসব কথপোকথন শোনার পর তারাবানুর মা’য়ের ওপর তারাবানুর খুব রাগ হল। মনে পড়লে এখনো হয়। মার ভাবা উচিৎ ছিল, তার চৌদ্দ/ পনেরো বছরের মেয়ে তারাবানু ঘুমিয়েছে না সজাগ! সজাগ থাকলেও তো তাদের দুজনের এধরণের কথা ওঁৎ পেতে তার শোনারই বয়স! নিজের শরীরের ভেতর সেই তখন থেকে অস্বস্তি ভাব এসে যায় তারাবানুর। নারী-পুরুষ সম্পর্কের এই বিষয়টি মানুষের জীবনের এত ঘনিষ্ঠ, সেদিন ওই আয়েশা নামক নারী আর মা’র কথপোকথনে তারাবানু আরো স্পষ্ট করেই বুঝেছিলেন। আর সেই থেকে বিধাতাকে তার পুরুষই মনে হয়। নারীর এই অসহায়, বোবা বেদনা তিনি নিজে নিশ্চয় পরখ করে দেখেননি।
সমাজের ঘেরাটোপ সরে গিয়ে দিনে দিনে তারাবানুর দেখা এইসব নারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। আর তারা তার অভিজ্ঞতার অংশ হয়ে যায়। এইসব নারীরা তার সত্তারও একেকটা অংশ হয়ে যায়। তিনি কোনোদিনই এদেরকে আর মন-মগজ থেকে নামাতে পারেননি। সেই সাত সমুদ্র পার হয়ে এত দূর অস্ট্রেলিয়া এসেও, এত বছর পরও তারা একেকজন তেমনি তার মনে জ্বলে আছে। আদতে তারা অনেকে হয়ত এখন পৃথিবীতেই নেই। তবু তার আঁকা আকাশে ধূসর সেই তারাদের ভেতর এখন শুরু হলো প্রবল দাহ নিয়ে রীটার গনগন করে জ্বলে থাকা!
তারাবানু ভাবেন, মেয়েটি যা খুশি তা করুক। অনেক বন্ধু-বান্ধব আসুক তার ঘরে। তার যাকে পছন্দ হয়, তার সাথে সে দৈহিক সম্পর্কে মিলিত হোক! এছাড়া নারীমুক্তি ধুয়ে কি নারীরা পানি খাবে? তারাবানু আবার ভাবেন, কিন্তু রীটা বিয়ে করছে না কেন? ওর শরীরের বাঁধন ভাল। কাজ জানে। নিজে বাড়ি কিনলো। দামি গাড়ি আছে। তাহলে কেন যোগ্য কেউ তাকে বিয়ে করে সুখি করছে না!
বাড়ির সামনে দিয়ে হাঁটাহাঁটি করার সময়ে তারাবানুর চোখের দৃষ্টি নিজের অগোচরে সুচালো হয়ে রীটার ঘরের জানালার ঘোলা কাচ ভেদ করে ঢুকে চলে যায়। তার চেতন-অবচেতন মন ওই ঘোলা কাচ ফুঁড়ে জানতে চায়, গাড়ি যখন বাড়ির সামনে এবং আর কোনো একটি গাড়িও যখন ধারেকাছে নেই, তাহলে এমন ভারী সন্ধ্যায় একা ওই নারীটি কি করছে? তারাবানু প্রবল চেষ্টায় অনুমান করেন, ছায়ার থেকেও আবছা কায়াটির বইয়ের পাতা উল্টনোর আভাস ভাসছে পর্দা-হীন জানালার ধূসর কাচে।
এমনাবস্থায় তারামনের পানির পিপাসা পায়। ঘরে ঢুকে প্রতিদিনই ঢকঢক করে পুরো গ্লাস পানি তিনি খেয়ে ফেলেন। এখানকার পানি তার কাছে অত্যধিক ঠাণ্ডা মনে হয়। তবু যেন এমন সব সময়ে পিপাসা মেটে না। নাকি পানি তার সে পিপাসা ছুঁতেই পারে না! তিনি ভাবতে থাকেন রীটার স্বামী সেই মেয়েটিকেও তো বিয়ে করেনি। আবার রীটার কাছেও আসে। একটা, ডিভোর্সি বা বিপত্নীক পুরুষ যদি একটি কুমারী মেয়ে বিয়ে করতে চায়। সেটা তার দ্বারা অসম্ভব হয় না। আর তাই ছেলেমেয়ের মা হয়ে যাওয়া নারীকে সে কেন গ্রহণ করবে? তার যত যোগ্যতাই থাকুক, অর্থ-বিত্ত থাকুক সেটার সাথে শরীরের টানটান মাংস পেলে শিথিল মাংসের নারীকে তারা কেন বিয়ে করে জীবনসঙ্গী করবে? রীটা কি তবে তার পাশে মাছের মতো ভনভন করা পুরুষদের সেইরকম মনোভাবের শিকার?
কিন্তু একজন নারী দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে গেলে সে দেখে, অগেরজনের চেয়ে দ্বিতীয়জন যেন কোনো অংশে যোগ্যতায় খাটো না হয়! তাহলে এই পরাজয়টা তার নিজের কাছেই অপমৃত্যুর সমান।
ভিন্ন ভাষাভাষী, ভিন্ন ভূখণ্ডের, ভিন্ন ধর্ম-সংস্কৃতির প্রায় পৌঢ়া এই নারীও অবশেষে তারাবানুর অতীতে দেখা সব অতৃপ্ত ও স্বামী দ্বারা নিগ্রহের শিকার নারীদের সাথে একত্র হয়ে তারাবানুকে ঘিরে কোনো কুয়াশাছন্ন নির্জন জায়গায় শীতের প্রবল হীমে প্রতিদিন বারবার জমিয়ে তোলে। আর বারবারই তার একার সে আড়ষ্টতা ভাঙতে সময় লাগে।
আগের অংশ
দীলতাজ রহমান, ব্রিজবেন, অস্ট্রেলিয়া
|