গল্প জল যে পিপাসা পায় না নাগাল দীলতাজ রহমান
খুব সকালে প্রাচীরের ওপাশে মাটি কোপানোর শব্দ শুনে তারাবানু রাস্তা দিয়ে ঘুরে সেখানে চলে গেলেন। তারাবানু গিয়ে দেখেন তাদের পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী একমাত্র সদস্য চল্লিশোর্ধ রীটা প্রায় হাঁটু সমান এক গর্ত করে ফেলেছে। পাশে সেই বিশাল স্তূপ মাটিসহ বাংলাদেশের শন-আকৃতির একবোঝা গুল্ম। যা খুব সাবধানে বেঁধে আনা।
তারাবানু রীটার খুঁড়ে তোলা মাটি প্রায় ডিঙিয়ে গুল্মগুচ্ছের কাছে চলে গেলেন। পরখ করে দেখলেন, ওটা আসলে শন নয়। এখানে আশেপাশের আরো বাড়িতে তিনি ওটা দেখেছেন। এটা অন্যরকম এক গুল্মজতীয় ফুলগাছ। এর প্রতিটি ডগায়ই গাড় গোলাপি রঙের সরু সরু ফুল ফোটে। দেখতে তখন বেশ লাগে।
অত সকালে রীটার অমন ভজঘট সময়ে তারাবানুর উপস্থিতিতে রীটা খুশি হলো কিনা, তারাবানু সে ভাবনার ধারেকাছেও গেলেন না এবং তিনি আগবাড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন রীটাকে সহযোগিতা করতে। আর রীটাও শাবলখানা আস্তে করে ছেড়ে দিল পঞ্চাশোর্ধ তারাবানুর হাতে। তারাবানুর প্রতি রীটার তখন ভাবখানা, ‘দেখ, পারো কি না!’
তারাবানু চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। এ সব কাজে অভ্যস্ত তিনি দেখলেন, এ মাটি খুবই শক্ত। রীটাকে আবার শাবলখানা ফিরিয়ে দিয়ে গায়েপড়া মানুষের মতো তিনি সেখানে দাঁড়িয়েই থাকলেন। রীটা জানে না, যে রীটা তারাবানুর সত্তার আরেকটি অংশ! রীটা যে তারাবানুর ভেতরে বেজেচলা বিষণ্ণ সেতারেরই আরেকটি তার তা কি তারাবানু নিজেও আগে অতটা বুঝেছেন? রীটা গর্তটা মসৃণ করতে করতে তারাবানুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, এই গাছ সে তার এক্স হাজবেন্ডের বাড়ি থেকে এনেছে।
রীটা ফ্যাশন ডিজাইনার। স্বামীর সাথে ডিভোর্স হয়ে গেছে বেশ কয়েক বছর হলো। রীটার দুটি ছেলে আছে। এখন তাদের একটির বয়স আঠারো আরেকটির বারো। রীটার নিজের থাকার জায়গা ছিল না বলে ছেলেরা তার সাথে আসেনি। বাবার কাছে থেকে গেছে। সে শুধু স্কুল হলিডেগুলোতে ছেলেদেরকে কাছে পেত। তাও তাদেরকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, রেস্টুরেন্টে খাইয়ে আবার তাদের বাবার কাছে রেখে আসতে হত।
রীটা ফ্ল্যাটটি যে কিনেছে, সে নিজেই জানে এর দাম অনেক বেশি পড়েছে। তবু এই ফ্ল্যাটটি তার কেনার কারণ, এই লাইনের কোনো এক বাড়িতে তার সুখের দাম্পত্য অতিবাহিত হয়েছে। সে সেই স্মৃতির কাছাকাছি থাকতে চায়। তারাবানু দেখেছেন, যতবারই রীটা তার পরিবারের কথা বলতে যায়, প্রতিবারই সে অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। একেটি বাক্য শেষ করতে কয়েকবার তাকে ঢোক গিলতে হয়। রীটার সাথে পরিচয় হয়ে আটপৌরে ধ্যান-ধারণার তারাবানুর সমস্ত জীবনের ধারণা পাল্টাতে থাকে। তিনি ভাবতে থাকেন, সারাজীবন শুনে এসেছেন, উন্নত দেশের নারীরা পুরুষের ছেড়ে যাওয়ার তোয়াক্কা করে না। স্বামী একজন নিয়ে গেলে স্ত্রীও আরেকজন খুঁজে নেয়। এসব নিয়ে খুব বেশিদিন তারা দুঃখবোধ পোষে না!
প্রথম পরিচয়েই রীটা কোনো রাখঢাকের ধার না ধেরে বলেছিল, ওর স্বামী আরেক নারীর প্রেমে পড়ে ওকে ডিভোর্স দিয়েছে। তারাবানু সেদিন জানতে চেয়েছিলেন, তোমার প্রাক্তন স্বামী পরে তাকে বিয়ে করেছে? রীটা বলেছিলো, না। তবে তারা নিয়মিত ডেটিং করে।
তারাবানু বুঝেছিলেন, ও লোক আর ও মেয়েকেও বিয়ে করছে না! শুধু মুক্ত বিহঙ্গের মতো ওড়ার সাধ মিটাচ্ছে। খোলা মাঠে ঘাস খাওয়া পশুকে পোষ মানাতে মানুষের বেগই পেতে হয়েছিল। তারপরই তো তারা বংশানুক্রমে পোষ মানতে শুরু করেছে! মানুষের বেলায় নিশ্চয় এরকম হেরফের থেকে থাকবে।
তারাবানুর ছেলে আর রীটা, দুজনের একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি। কিন্তু বাড়িটি মাঝামাঝি ভাগ হয়ে সামনে পিছনে দু’পাশে মোট চারখানা উঠোন। দু’দিকের উঠোনেই মাঝখানে কাঠের প্রাচীর। সে প্রাচীর ফুঁড়ে এপাশ থেকে ওপাশে, আর ওপাশ থেকে এপাশে দেখা যায় না কিছুই। কিন্তু হাঁটাচলা এমন কি নিঃশ্বাস দীর্ঘ হলে তারও শব্দ শোনা যায়। আর এভাবেই পঞ্চাশ অতিক্রান্ত তারাবানু রীটার অনেকটাই জেনে যায়। রীটা বাসায় থাকলে কে আসছে, কে যাচ্ছে, কখনো একজন দুজন, বা অনেকের মিলিত হৈচৈও কখনো ভেসে আসে। এতে তারাবানু খুশিই হন। এতবড় বাড়িটাতে মেয়েটিকে বিষণ্ণ একটি প্রদীপের মতো মনে হয় তারাবানুর। অবশ্য মাঝারি গড়নের শক্ত-পোক্ত শরীরের রীটার বয়সও পঁয়তাল্লিশের কম হবে না। তবু সে তারাবানুকে মম বলে ডাকে। কারণ এপাশে তারাবানুর ছেলে-বউমা, নাতি-নাতনি নিয়ে এক ভরা সংসার। তাই তাকে মায়ের স্থান না দিয়ে সেও পারেনি। তারাবানু ইংরেজি জানে না তবু ভাঙাচোরা যা বলে তা রীটা বুঝে নেয়। আবার রীটার কথার পুরোটা না বুঝলেও তারাবানু নিজের মতো করে যা বোঝার বুঝে নেন।
পাশের ফ্ল্যাটটি বিক্রির আগে খুব যখন ঘষা-মাজা রঙ-পলিস করার কাজ চলছিল, তাতেই তারাবানুর পরিবার বুঝতে পেরেছিলেন, যে ওপাশটা বিক্রির আয়োজন হচ্ছে। তারপর একদিন রীটা কতগুলো কামরাঙা নিয়ে এলো, এপাশের মানুষের সাথে পরিচিত হতে। বিদেশী রীটার হাতে অনেকগুলো কামরাঙা দেখে চমকে ওঠে তারাবানুসহ ঘরের সবাই। তারাবানুই আশ্চর্য হয়ে বললেন, কুইন্সল্যান্ডে কামরাঙা হয়? আমি তো ভেবেছিলাম, পুরো অস্ট্রেলিয়ার কোথাও এ ফল নেই।
রীটা বললো, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, চীনে যা হয়, তার স-বই কুইন্সল্যান্ডে হয়। পেঁপে, পেয়ারা, এমন কি গ্যাণ্ডারিও। কুইন্সল্যান্ডের আবহাওয়া অনেকটা ভারত উপমহাদেশের মতোই!
তারাবানু বললেন, কি জানি মেলবোর্নে থাকতে তো অনেক রকম চারা কিনে লাগিয়ে দেখেছি। যে কোনো চারা একটু বাড়ে, তারপর সব পাতা শীতে এমনভাবে পুড়ে যায়, মনে হয় আগুনে পুড়ে গেছে। তবে ওখানকার নিজস্ব কিছু ফল-ফসল আছে, যা শীত এলে বাড়ে। যেমন পালংশাক, ধনেপাতা, জুকিনি। তাছাড়া অনেক গাছই মরে যায়। মেলবোর্নে আমার ছেলের নিজের বাড়ি আছে। সেখানে তো আমি গাছ-গাছালি নিয়ে এতো এক্সপেরিমেন্ট করেছি, কিন্তু নিজের দেশে যা কখনো করা হয়নি!
উঠোনের খালি জায়গা দেখিয়ে রীটা সেই প্রথম দিন এসেই বলেছিল, এখানে কি কি গাছ লাগালে ভাল হবে। রীটার কথার উত্তর তারাবানুর বউমা দিয়েছিল। বউমা বলেছিল, আমরা দু’জনই কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটির টিচার। দু’বছরের জন্য এখানে এসেছি। আবার মেলবোর্ন নিজের বাড়ি ফিরে যাবো। তাই এসব নিয়ে খুব বেশি পরিকল্পনা নেই। এখানে এই অল্প বিস্তর যা করেছেন, আমার শাশুড়িই করেছেন। উনি কারো নিষেধ শোনেন না! দেখা যাবে এটুকু খোঁড়াখুঁড়ির জন্য বাড়িভাড়া বাবদ যা টাকা এডভান্স করেছি, বাড়িওয়ালা পুরোটাই কেটে রেখেছে।
রীটার গর্ত করা শেষ হলে তার ভেতর লম্বা শনের মতো সে ফুলগাছ সে খুব সাবধানে একাই নামিয়ে দিল। তারপর তার গোড়ায় আর আগের মাটি না দিয়ে আলাদা করে করে রাখা কিছু শুখনো পাতাযুক্ত মাটি, কিছু বালি আরো কি কি সব প্রতি পরতে পরতে সাজিয়ে দিতে দিতে সে নিজে থেকেই বললো, তার এক্স হাজবেন্ডের বাগানে আরো কতরকম গাছ আছে। ধীরে ধীরে সে দু’একটি করে আনবে। তার গাছ-গাছালির খুব শখ।
রীটার এই কথায় তারাবানুর চোখের সামনে কেমন এক গল্পের চোখ খুলে যায়। তারাবানুর অনেকদিন কাঠের প্রাচীরের এপাশ থেকে মনে হয়েছে, এই রীটার বাসায় এত মানুষ আসা-যাওয়া করে। এদের ভেতর ওর স্বামীও আসে না কখনো! অথবা কখনো একা? যা আমাদের ধর্মে গর্হিত অপরাধ। একদিন তারাবানু দুপুরের খাওয়া সেরে একটি বাংলা পত্রিকা নিয়ে তাদের সামনের উঠোনে গিয়ে বসছেন। পত্রিকার পাতা ওল্টানোর আগেই ওপাশে ক’জনের কলহাস্য করতে করতে বেরিয়ে যাওয়া অনুমান করলেন। কিন্তু সবাইকে বিদায় দিয়ে ঘরে ঢোকার আগেই রীটার বমির শব্দ কানে এল। তারাবানু বুঝলেন, মদ বেশি খাওয়া হয়ে গেছে! তবু তারাবানু রীটাকে এতটুকু ঘৃণা করতে পারলেন না। কারণ রীটার যে প্রবল মাতৃত্ব তিনি টের পেয়েছেন, তা এরকম কিছু তুচ্ছ ঘটনা কোনোভাবেই ম্লান করে দিতে পারবে না!
কিন্তু তিনি তখন গভীরভাবে ভাবতে লাগলেন, রীটা যদি স্বামীর বাড়ির মাটি খুঁড়ে গাছ আনতে পারে আর এমন অকপটে তা স্বীকারও করতে পারে এবং যদি তার প্রাক্তন স্বামী তার এখানে কখনো আসে, একা বা দলের সাথে তাহলে রীটা হারালোটা কি?
বাড়ির সামনে দিয়ে এতটুকু রাস্তা পেরিয়ে যে পথে তারাবানু গিয়েছিলেন, ঠিক সেই পথে ফিরে আসতে আসতে তার মনে হলো, রীটা যা হারিয়েছে, তা শুধু স্বামীত্বের অধিকার! কারণ স্বামীর সাথে সংসার করা কালীনও তো এসব দেশে কেউ শুধু সংসার নিয়ে থাকে না। সব নারীই পুরুষের মতো একইভাবে রোজগার করে। তাহলে রীটাও নিশ্চয় তখনো রোজগার করতো! স্বামী স্বেচ্ছাচারী হলে স্ত্রী তাকে বাঁধা দিতে পারে। কিন্তু স্ত্রী’কে ডিভোর্স দিলে তো তার আর অধিকার থাকে না তার ব্যাভিচার ঠেকাতে। বা তা নিয়ে তাকে কিছু বলার! তাই রীটার সব বোবা অভিমান ওই অধিকারটুকু হারানোতেই!
কিন্তু রীটার নিজের অর্জিত যে ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তা তাকে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করেছে বটে। কিন্তু আদতে ও তো এক আহত পাখির মতো বেঁচে আছে। স্বামী-সন্তান-সংসার নিয়ে এই একই মনোভাব নিশ্চয় পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের প্রতিটি নারীর। যদিও তারাবানু খুব বেশি কিছু দেখেননি জীবনে। খুব বেশি রকম মানুষকে তিনি জানেনও না। তবু এরকম বিন্দু-বিসর্গ ঘটনা চোখে পড়ে তার ইদানীং এরকমই মনে হয়!
তারাবানুর নিজের চোখে দেখা, তাও সেই শিশু বেলায়। তবু তিনি তা আজো ভুলতে পারেন না। তারাবানুর এক ফুপুর ভাসুরের ছেলে স্ত্রী এবং দুটি ছেলে রেখে আবার বিয়ে করেছে। দ্বিতীয় বউটি ততদিনে বছর পাঁচেকের এক কন্যাসন্তানের জননীও হয়ে গেছে। দ্বিতীয় বউটির বয়স কম এবং সুন্দরী হলেও নিচু ঘরের তা তার আচরণে বোঝা যায়। শিক্ষা-দীক্ষা আছে বলেও সেই তখনি শিশু তারাবানুর তা মনে হয়নি। ফুপুর ভাসুরের সে ছেলে খুলনা একটি জুটমিলে চাকরি করতো। সেখানে সে একাই দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিল। সে সে বউ-কন্যা নিয়ে মাঝে মাঝে বাড়িতে এলেও সে ওই দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়েই পড়ে থাকতো। একদিন ওরকম দ্বিতীয় স্ত্রীসহ ফুপুর ভাসুরের ছেলে আবার বাড়িতে এসে আবার সেই ছোট বউকে নিয়েই শোয়ার আয়োজন করতে করতে তারাবানুর ফুপু তার ভাসুরের সেই ছেলের কাছে গিয়ে খুব অনুনয় বললেন, ‘বাবা, আমজাদ, তুমি আজ পাশের ঘরে গিয়ে তোমার ছেলে দুটোর কাছে ঘুমাও। ছোট বৌমা আর নাতনিকে আজ আমি আমার ঘরে আমার কাছে নিয়ে রাখি…।’
ছোট বউ আমার ফুফুর থেকে অতখানি মান্যতা পাওয়ার মতো নয়। সে মান্যতা তাকে ও বাড়ির কেউ কোনোদিন দেয়ওনি। কিন্তু দীর্ঘদিন স্বামীর সাহচর্য ছাড়া বড় বউটির প্রতি সমব্যথী হয়ে ফুপুর যারপর নেই ওই চেষ্টাটুকু ছিল। কিন্তু ফুপুর ভাসুরের ছেলে কিছুতেই রাজি হলো না, বরাবর তাদের অত্যন্ত সম্মান পাওয়া, থানার বড় দারোগা তাদের ছোট চাচার স্ত্রী, আমার ফুপুর সে প্রস্তাবে। এক ঘরের ভেতর পার্টিশন দিয়ে করা দুটি রুম। তারই একটাতে বড় বউ থাকে। আর তার স্বামী এলে শ্বশুর-শাশুড়ি আরেকটি রুম ছেড়ে দিয়ে বারান্দার ছোট রুমটিতে যায়। দূরত্ব শুধু এটুকু। কিন্তু সেই দূরত্ব কোনোদিন আর বড় বউয়ের জীবন থেকে ঘোচেনি।
তারাবানুর আজো মনে আছে, ফুপুর ভাসুরের ছেলেকে ফুপুর অনুনয়-বিনয়ের সময়ে ঘরের ভেতর লম্বা ঘোমটা আড়ালে বড় বউটি লজ্জায় মরিয়া হয়েছিল। কারণ তার বাড়ন্ত ছেলে দু’টি সেখান দিয়ে ঘোরাফেরা করছিল। বারান্দায় তারাবানুর ফুপুর সাথে ছিল সে বড় বউটির নিজের শ্বশুর-শাশুড়ি ছাড়াও বাড়ির ওই শ্রেণির আরো মুরুব্বিরা। ছিল সেই কচি মাংসের তাল জাত-গোত্রহীন তার স্বামীর দ্বিতীয়বার বিয়ে করে আনা সেই অকর্ষিত নারীও, যার কাছে মাটি হয়ে গেল কর্ষিত মৃত্তিকার মতো বউটির স-ব অহংকারের গুণ।
তারাবানুর বয়স তখন সাত-আটের বেশি হবে না! তবু তার মনে হচ্ছিল, কি লজ্জা। কি অপমান, স্বামীকে তার কাছে শোয়ানোর জন্য মুরুব্বিরা অনুরোধ করছে। তবু স্বামী তার কাছে যাবে না! যায়নি গত দীর্ঘ আট বছর। তবু সে বউয়ের মুখে হাসি ফুটে থাকতো। সংসারের প্রতিটি কাজ সে-ই করতো। বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ির খেদমতও কম করতো না। গালভরে তাদেরকে আব্বা-আম্মাও ডাকত! কেন বউটি অত ভাল ছিল, তারাবানুর বয়স বউটির কাছাকাছি হলে তখন ঠিকই তার কাছে জানতে চাইত। ফুপুর ভাসুরের ছেলেকে তার প্রথম স্ত্রী’র কাছে মাত্র একটি রাত কাটানোর সেই নিষ্ফল আকুতির বছর পাঁচেক পর যখন বউটি এমনি এমনি ক’দিনের জ্বরে মরে গেল, তখন তারাবানু কিশোরী। খবরটা শোনার পর সেই পাঁচ বছর আগে, তার কাছে তার স্বামীকে মাত্র একটি রাত যাপনের জন্য ফুপুর যে অপারগতা তিনি নিজের চোখের সামনে ঘটতে দেখেছিলেন, তার সব সুদে আসলে বেড়ে বহুগুণ হয়েছিল। ততদিনে তারামনের নিজেরও তো বয়স বেড়েছে। তিনি সেই বড় বউটিকে এবার কল্পনায় মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে বলতে লাগলেন, কেন এমনিই মরতে গেলি! কেন বিষ খেয়ে মরলি না? গলায় দড়ি জোটেনি তোর? জগতের বুকে কেন ক্রুশের মতো একটি কঠিন চিহ্ন এঁকে দিয়ে গেলি না? কেন তোর নিজের মরণটা এমন অভিযোগহীন রেখে গেলি!
পরের অংশ
|