bangla-sydney













গল্প
হোসনেয়ারা / দীলতাজ রহমান



আগের অংশ


কলম চুবিয়ে ছোটবেলায় যেমন লিখেছি, কবিতা লিখতে গেলে মনে হয়, ওই বেদনায় কবিতা লেখার কলম আপনা থেকে চুবে আসে! কিন্তু এত ভাষা কোথায় পাবো তাকে কাজে লাগাতে। তারপর মনে হয় বেদনার কালি কলমের নিবেই শুকায়।
: আচ্ছা একটা সত্যি কথা বলো তাহলে, তোমার ওই ফাটল চুইয়ে, কখনো অন্য কারো প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করেনি?
: ইচ্ছে করেছে! ওই যে বলেছি, একটা অপেক্ষা আছে কারো জন্য...।
: তুমি চাকরি করা মানুষ। সর্বোচ্চ ডিগ্রিটি তোমার আছে...!
: সত্যি বলতে কি, বড় রাস্তার পাশে যার বাড়ি, সে আর গলির ভেতরের বাড়ি পছন্দ করবে না বসবাস করতে! যাদের সাথে আমার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করা যেতো, তারা কেউই নূরুল আমিনের থেকে বেশি নাম্বার পাওয়ার যোগ্য নয় আমার কাছে। পেলে বোধ হয়, টলে যেতাম!

সেতারার ঝিমুনি টের পেয়ে ঘুমাতে বলে হোসনেয়ারা চলে গেলেন পাশের রুমে স্বামীর কাছে। অপরিচিত বিছানায় একা শুয়ে মন্দ লাগছিলো না সেতারার। বাসায়ও তো তিনি একাই থাকেন। ছেলেমেয়েরা যে যার মতো নিজের নিজের ঘরে দরজা আটকে থাকে। সেতারার হাজবেন্ড নেই বহু বছর। বাকি রাতটুকু হোসনেয়ারার মনস্তত্ত্ব নিয়ে খেললেন সেতারা। ক্ষুদ্র একটু কাঁটার যন্ত্রণাও তো যন্ত্রণাই। তবে এমন অনেক কাঁটার ঘা যারা অহরহ খায়, তাদের বোধ আর সূক্ষ্ম থাকে না, এমন একটু সূক্ষ্ম বেদনা হীরের কৌটোয় রেখে পোষার মতো! তিনি নিজের বুক-জুড়ে তন্নতন্ন করে খুঁজেও একটু বেদনা পেলেন না, যাকে সঙ্গী করে, হাওড়ের দিকের জানালার একটি কপাট অন্তত খুলে, পর্দা সরিয়ে জলের ওপর নামা জোছনার প্লাবন দেখে রাতের বাকি সময়টুকু নির্ঘুম কাটাতে পারতেন। কিন্তু পারলেন না।

পরদিন সকালে সেতারা বেগম তার ড্রাইভারকে কল দিলেন, হোসনেয়ারা ঘুম থেকে ওঠার আগেই। কারণ ড্রাইভারেরও তো এতটা পথ আসতে সময় লাগবে। সেতারার গাড়ি হোসনেয়ারার বাসায় পৌঁছলে সেতারা নাস্তা খেয়ে, ওদের দু’জনকে শুভ বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লেন। যতক্ষণ দেখা যায়, সেতারা ফিরে ফিরে দেখলেন, হোসনেয়ারা বেগম ও নূরুল আমিন সাহেব পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছেন তার গমন পথের দিকে।

তারা দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলে সেতারার সামনে চলে এলো দেলু নামের তেইশ-চব্বিশ বছরের একটি মেয়ে। তার আবার ছিলো তিন আর পাঁচ বয়সী দুটি মেয়ে। একসময় দেলু সেতারা বেগমের বাসায় ছুটা কাজ করতো। দেলুর মায়ের তিনটি মেয়ে ছিলো। দেলু ছিলো ছোট। তার বিয়ে হয়েছিলো যার সাথে, সে নারায়ণগঞ্জ একটি জুটমিলে কাজ করতো। লোকটির আগের স্ত্রী আছে। আছে আরো তিনটি ছেলেমেয়েও। তবু দেলু সেখানে খেয়েপরে ভালোই ছিলো। কিন্তু একবার দেলুকে তার মায়ের কাছে বেড়াতে পাঠিয়ে সে লোক তার খোঁজখবর নেয়া বন্ধ করে দিলো। দেলুর মা কয়েকটি বাসায় ছুটা কাজ করতো। বাপ ছিলো না দেলুর। ভাইও না। শেষে দেলু ধারেকাছে তিন বাসায় ছুটা কাজ নিলো। তার ভেতর সেতারা বেগমের বাসা একটি। তখন দেলুর থেকে সেতারা বেগমের বয়সও খুব বেশি ছিলো না। হয়তো তার থেকে বছর পাঁচেক কম হবে দেলুর বয়স। তবু দেলুর কথা তার হঠাৎ হঠাৎই মনে পড়ে যায়। মেয়ে দুটিকে গেটের ভেতরে এনে ছেড়ে দিয়ে দেলু নিজে একা বাড়িতে ঢুকতো। তারপর বাড়িময় ছুটে কাজ করতে করতে দেলুর স্বগতোক্তিগুলো আজো সেতারার প্রাণে বড়শির মতো বিঁধে আছে। দেলুকে মনে পড়লেই তিনি ভাবেন, আসলে সুখ-দুঃখ বিষয়টা যে ভীষণ আপেক্ষিক, সেটা সেই সংসারজীবনে ঢোকার কয়েক বছরের ভেতর দেলুই তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছে।

দেলুর চেয়ে দেলুর মা-ই বেশি বাসায় কাজ করতো এবং সে অভিজাত এলাকায় বড়লোক দেখে কাজ ঠিক করতো। এর জন্য রিকশায় করে যাওয়া-আসা করতে হতো দেলুর মাকে। দেলুর মা সে সব বাসা থেকে প্রতিদিন কিছু না কিছু খাবার নিয়ে আসতো। দেলু তার মায়ের ছোট মেয়ে হওয়াতে কণ্ঠে আহ্লাদ ঝরতো কথা বলতে। সে সারাক্ষণ নরম স্বরে নিজের দুর্ভাগ্য নিয়ে একাই আক্ষেপ করতো। সেতারা বেগম কেন যেন তাতে বিরক্ত হতে পারতেন না! কখনো ধমক দিয়ে বলেননি, যতক্ষণ আমার বাসায় কাজ করবি, মুখ বন্ধ করে কাজ করবি! বরং সেতারা বেগমের কাছে সুখ-দুঃখের সংজ্ঞাটা ক্রমাগত যেন পাল্টে যেতো দেলুর প্যাঁচালের সাথে সাথে। বাসায় ঢোকার পর থেকেই তার শুরু হতো নিজের সাথে নিজের কথা বলা। আর তা সেতারা বেগম যেচে শুনতে না গেলেও যেটুকু তার কানে আসতো, যেন বোধের ভেতর পরত পরত এক ভাঙাগড়ার কাজ চলতো।

দেলু ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই শুরু হতো, থাউক, আমার খুঁজ নিলে নে, না নিলে না নে! কিন্তুক তর মাইয়া দুইডার খুঁজ তো নিবি! একবার চিন্তা করবি না, তারা কী খাইতেছে। কেমুন আছে। তরই তো বাচ্চা! আমার কি বাপ বাইচ্চা আছে, নাকি আমার একটা ভাই আছে। বুড়া মা, জান পিডাইয়া মাইনষের বাড়িরতন খাওন আনে। তার একলার খাওনে আরো তিনডা মানুষ ভাগ বসাই। আর আমি ছাড়াও তো তার আরো দুইডা মাইয়া আছে। তাগো পাতেও তো কহনো চাইরডা ভাত দেওন লাগে। নাতি-নাতনি গো আব্দার মিডান করণ লাগে। তার ওপর তার বড় মাইয়া বিধবা। বাসা ভাড়া দেওন লাগে। কেমনে তুই দুইটা বাজাইয়া আমারে বাসাইয়া দিলি। দিলিই যুদি, দিতি আমি যহন একলা আছিলাম!

আবার কখনো দেলুর কণ্ঠে অন্য সুর। থাউক, খুঁজ নিলে নে। না নিলে না নে! আমিই কি না খাইয়া আছি! আল্লাহ আমারে খাওয়াইতেছে না। এই তো মায় পিত্তিদিন আনারসের ছাবাগুলান বাসাবাড়ির তন নিয়াসে সেগুন খাইয়াই সন্ধ্যারাইতে প্যাট ভইরা যায়। মাঝরাইতে উইঠা রাইতের খাওন খাওয়া লাগে! প্রায়-দিন মা’য় বড় মাছের বড় বড় টুকরার তরকারি নিয়াহে। বাসি অইলেই কি! তুই তো গুড়া মাছই পিত্তিদিন খাওয়াইতে পারতি না। আল্লাহ যা কপালে রাখছিলো মাইন্যা নিছিলাম...।

এক ঈদের পরদিন দেলু খুব ঝলমলে মুখে সেতারা বেগমের বাড়িতে ঢুকলো। ঢুকেই সেই তার নিজের সাথে কথা। ঈদটা গেলো এট্টু খুঁজ নিলি না। মাইয়া দুইডার লাইগ্যাও একগাছা সুতাও পাডাইলি না। না পাডাইলি। আমার মায় দিছে আমার মাইয়াগোরে। এই যে মায় তিন বাসার থেইকা জাকাতের তিনখান শাড়ি পাইছে, দুইহান আমারে দিয়া নিজের লাইগ্যা একখান রাখছে। তুই দেস্ নাই, কিন্তুক আল্লায় আমারে অন্যখান থেকে পাওয়াইয়া দিছে!

একটানা অনেকদিন পর্যন্ত কয়েক ঘণ্টা করে দেলুর প্যাঁচাল সেতারা বেগমের মনের অন্ধিসন্ধিতে যেন জট লাগতো আর খুলতো। অথবা দেলু তার জীবনের গল্প বলে যেতো আর সেতারা বেগমের মনে সেলুলয়েডের ফিতার মতো দৃশ্যগুলো চিত্রায়িত হতো! অভিমানের যে একটা সুখ আছে। ক্রোধের যে একটি তেজ আছে, দেলুর ভেতর তার বিন্দুমাত্র না দেখে সেতারা বেগম তার সেই বয়সে খুব হতাশ হয়েছিলো।
স্বামীর অন্যায়ের প্রতিবাদ করার মতো ওর ভেতরে দ্রোহের এতটুকু আগুন না দেখে তিনি মনে মনে ভাবতেন, সব মানুষের প্রবণতা যদি দেলুর মতো হতো, তাহলে পৃথিবীটা স্বর্গ নয়, একেবারে গোয়াল ঘর হয়ে থাকতো।
শেষমেশ একদিন দেলু সাজগোজ করা অবস্থায় এসে হেসে বললো, আমার মাইয়া গো বাপে আমাগো নিতে আইছে আপা। আমি যাইতেছি। আইজকারতন খুঁজলে কাইল পর্যন্ত কামের মানুষ আপনি ঠিকঐ পাইবেন। কিন্তু আপনি তো আইজ বিপদে পড়বেন। তাই যাওনের আগে লুকাইয়া আইছি, খালি থালাবাসনগুলা অন্তত ধুইয়া দিয়া যাই। আর খুচরা যে কয়দিন কাম করছি, টাকা কয়টা আমার মারে দিয়া দিয়েন!

সেতারা বেগম দেলুকে আর থালাবাসন পর্যন্ত যেতে দিলেন না। দু’হাতে থাবা দিয়ে তাকে প্রতিহত করলেন। আর পুরো মাসের টাকাটা তাকে তখনই ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, তোকে তো বাড়তি কিছু কখনো দিইনি। আজ পুরো মাসের টাকাটাই তোকে দিলাম। এ খুব বেশি না!
দেলু বলেছিলো, অহনো মাসের অর্ধেক অয় নাই।
সেতারা বেগম বলেছিলেন, তুই আমাকে অনেক কিছু দিয়ে গেলি। আমরা যে জীবন যাপন করি, তার সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই কোনো ধারণা নেই। আর এর নির্দিষ্ট কোনো মাপকাঠিও হয় না, মেপে চলার। কিন্তু তুই বোধ হয় সেই একখান অদৃশ্য মাপকাঠি আমার হাতে তুলে দিয়ে গেলি!

দেলু বললো, আমি জানি না আপনে কী কন। আমি কী দিলাম। তয় দোয়া কইরেন। য্যান আমার বুইড়া মায়ের ওপর আর বোজা অওন না লাগে! এইটুক ছাড়া আমি দোজখে থাকতেও রাজি আছি!

বাসায় ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে গেলো। দক্ষিণখান থেকে ধানমণ্ডি। রাস্তা কম নয়। জ্যাম লাগাতার থাকেই। বিকেলে হোসনেয়ারা বেগম সেতারা বেগমকে ফোন করে বললেন, তুমি বাসায় পৌঁছে একটা ফোন দেবে না? কেমন বন্ধু তুমি, অ্যা? তুমি চলে যাওয়ার পর বাড়িটা ফাঁকা লাগছে। অথচ থাকলে তো মাত্র একটা রাত!
সেতারা বললেন, ফোন দেবো কি! তোমার বাসা থেকে বের হওয়ার পর পঁয়ত্রিশ বছর আগের তখনকার আমার প্রায় কাছাকাছি বয়সের এক তেইশ-চব্বিশ বছর বয়সী মেয়ে আমার মনটাকে তার নাটকের মঞ্চ বানিয়ে রেখেছে। সেই যে সে কাজ করতে করতে তার যে রোজনামচা আওড়াতো, তাই মহা-জীবন্ত হয়ে উঠেছে!
: তুমি আমার সাথে এত এত গল্প করে গেলে, চাঁদ দেখতে এসে তাও দেখতে পারলে না, সে সবের কোনো রেশ তোমার মন-মাথা স্পর্শ করতে পারেনি। সেই তোমার জোয়ান-কালের কাজের মেয়ে এসে এরই ভেতর তোমাকে কব্জা করে বসে আছে?
: মনের ওপর কারো জোর চলে বলো? তাহলে তো তুমিও পারতে আলগোছে আমিন সাহেবের অসতর্ক কাঁটাখানা সরিয়ে রেখে নিজেকে নিপাট সুখী করে রাখতে!
: তোমার কাজের মেয়ের গল্পটা আমাকে শোনাও তো! নিশ্চয় আমার ওই কাঁটার সাথে তোমার কাজের মেয়ের কোনো বিষয়ের মিল আছে!
: না রে! বরং সম্পূর্ণ বিপরীত। তবে সত্যি কথা সেই বৈপরীত্যের জন্যই তাকে মনে পড়েছে! কতো ছোট্ট একটা বিষয় প্রশ্রয় পেয়ে তোমার মনের সবটুকু জায়গা দখল করে আছে। আর ওই মেয়ের মনে কোনো বেদনা-অভিমান, ক্ষুধা-তৃষ্ণাকে ঘনীভূত করে তোলার একটু জায়গা অবশিষ্ট নেই...’ বলে, সেতারা বেগম দেলুর কথাগুলো হোসনেয়ারা বেগমকে বলে যেতে লাগলেন আর মনে মনে ভাবলেন, বিষে বিষ ক্ষয় করার চেষ্টা করি আরকি!




দীলতাজ রহমান, ইয়েরোঙ্গা, কুইন্সল্যাণ্ড, অস্ট্রেলিয়া




Share on Facebook               Home Page             Published on: 8-Jul-2023

Coming Events: