bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













গল্প
ফাটল ধরা পাড়
দীলতাজ রহমান



সালাম সাহেব তার স্ত্রীকে নাম ধরে ডাকেন। বাড়ির ভেতরে থেকে উত্তর না এলে প্রথম যে-কেউ সে ডাকটি শুনলে মনে মনে ভাববে চন্দনা নিশ্চয়ই এ বাড়ির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। অথচ কলেজে পড়া পিঠাপিঠি দুটি ছেলেমেয়ে আছে তাদের। অবশ্য নিজের অতটা পরিপক্বতা চন্দনা নিজেও প্রকাশ করতে চায় না। সু-গৃহিণী তো বটেই, বাইরের কাজকর্মের ক্ষেত্রেও এ যুগের অগ্রগামী নারীদের প্রথম সারিতেই চন্দনার নামটি লেখা যায়। চন্দনা অবশ্য নাম নিয়েও ভাবে না। তবে তার গ্রাম্য আত্মীয়-স্বজনরা যত্রতত্র তার গুণ নিয়ে কীর্তন করে বেড়ায়। উচ্চশিক্ষিত শহুরে স্বামীটিও তাতে কম যান না, তবে ভদ্রলোকের পরিমিতিবোধ অনুকরণ-যোগ্য।

কিন্তু একটা বদনাম চন্দনা কিছুতেই পরিহার করতে পারে না তা হলে চেঁচামেচি। হ্যাঁ, পরিবারের আরো তিনটি প্রাণী তো তাকে কোণঠাসাই করে রেখেছে। ওদের ধারণা কাজের লোকের সঙ্গে কেন এত ঘুরঘুর করতে হবে। আর দোষ ধরে চেঁচামেচিই-বা করতে হবে কেন? তাদের কাজ সম্পূর্ণ তাদের ওপর ছেড়ে দিলেই তো হলো।

এই একটি জায়গায় চন্দনা অক্ষম। সে বোঝাতেই পারে না, কোনো ধরনের ট্রেনিং ছাড়া নিত্যনতুন আসা এসব লোক দিয়ে চেঁচামেচি ছাড়া কাজ হয় না! আচ্ছা কেন ওরা বোঝে না কেউ কি ইচ্ছে করে রাগতে পারে? এদের পিছে লেগে থেকেও কাজ উদ্ধার করা মুশকিল। দুঃখটা তো সেখানেই তবু শিখিয়ে পড়িয়ে তৈরি হতে না হতে আবার তারা কেটে পড়ে। আর একজন যোগাড় করতেও তো প্রাণান্ত অবস্থা।

কিন্তু এ দায়িত্বটুকু তো তার ওই ভালো-মানুষগোছের স্বামীটিকে কোনোদিনই সে গছাতে পারলো না। তাঁর সাফ জবাব, ওটা বাপু তোমার দায়িত্ব। আরো বলবে, ‘এজন্যই তো গ্রামের ক্ষমতাশালী অবস্থাপন্ন ঘরে বিয়ে করেছিলাম। যেন শহরে বসেও কাজের লোক আর মৌসুমি ফলের অভাব না হয়।’

চন্দনা রাগে না, সে বুঝতে পারে তার স্বামীর এটুকু তামাশা করার মন আছে বলেই অন্য হাজারটা কাজে থাকে তাঁর অনেকখানি প্রশ্রয়। না হলে কি চন্দনা নিজের মতো করে সবকিছু করতে পারতো?

কিন্তু উত্তরপত্রে মা এবারো চন্দনাকে লিখেছে, গ্রামে এখন কাজের লোক মোটেই পাওয়া যাচ্ছে না। এখন আর কেউ বাসাবাড়িতে থেকে ঝি-গিরি করতে চায় না। তার কারণ গ্রামে বিভিন্ন ধরনের এনজিও হয়েছে। নতুন নতুন রাস্তা হচ্ছে। পুরনোগুলোরও সংস্কার হচ্ছে এবং তাতে গাছ লাগানো এবং পরিচর্যার কাজেও মেয়েরা নিয়োগ পাচ্ছে।
মেয়েরা বাইরের কাজে নেমেছে। এতে নিজেদের কষ্ট হলেও মেয়েদের এই বেরিয়ে আসাটাকে চন্দনা একটা শুভ সূচনা মনে করে। গ্রামের লোকের আশায় বসে না থেকে এখন সেও অন্যদের মতো বস্তি, স্টেশন অথবা আকাশের নিচে বসবাস করা মানুষ দিয়েই কাজ করিয়ে নেয়। অবশ্য এজন্য সর্বদা তটস্থও হয়েও থাকতে হয় তাকে। তবু একসময় যাদের ভয়ঙ্কর মনে হতো ক্রমে সে ভয়টা কমে আসে। তাদের দুঃখে মন বিগলিত হয়। কিন্তু একদিন দেখা যায় বিনা নোটিশে তারাই বিপদে ফেলে যায়। আবার শুরু হয় অন্য কাউকে খোঁজার পালা।

বেগম সাহেবার এহেন দুরবস্থা দেখে ড্রাইভার মজিদ আশ্বাস দিয়েছিলো তার এক মাঝবয়সী আত্মীয়া আছে। অনুমতি পেলে সে চেষ্টা করে দেখবে সেই আত্মীয়াকে এখানে আনা যায় কিনা। কোনো ঝামেলা নেই। দুটো ছেলেমেয়ে মানুষের বাড়ির থেকে কাজ করে খায়। ড্রাইভারের প্রস্তাবটি লুফে নিলো চন্দনা।

দুদিনের ছুটি শেষে ড্রাইভার নিয়ে এলো হাড্ডিসার লম্বাটে, লম্বা ঘোমটা টানা একজনকে। একটু একটু ট্রেনিং চলার মাঝপথে হলো কী, চন্দনাকে তার লম্বা ঘোমটার বুয়াটি হতাশ করে দিয়ে বললো ‘আম্মা আপনের দুইডা পায়ে ধরি আমারে পাডাইয়া দ্যান, আমার মাইয়াডার লাইগা বুকটা পুইড়া ছাই অইয়া যা-য়। পুলাডা ক্ষ্যাতে কাম করে, কে তারে রাইন্দা বাইররা দেয়! আমি ছাড়া ওগো কেউ নাই। বাপ মরছে বারোডা বছর অইয়া গেলো।

- তোমার ছেলেমেয়ে দুটোকে ঢাকায় নিয়ে এসো! ওখানে তো তারা মানুষের বাড়ি কাজ করে খায়! এখানে এলে চেনা কোনো বাসায় রেখে দেবো, তা হলে যখন তখন দেখা করতেও পারবে।
- না আম্মা, না। আমার মাইয়াডা স্কুলে যায়, স্কুলে গেলে গম পায়। পোলাডা বিয়ার লায়েক অইছে। সতরো-আডারো বছর বয়স। হ্যায় গ্রাম ছাড়তে চায় না।
- এসব কথা আগে মনে ছিলো না? - ফুঁসে ওঠে চন্দনা।
- মজিদরে জিগান, আমি আইতে চাই নাই। যারে হ্যায় আনবো ভাবছিলো তার সোয়ামি বিয়া কইরা অন্যহানে থাকে। চার মাস ছয় মাসে আইয়া একরাত্র হ্যার লগে থাইকা যায়। সে খালি ভিডায় পইড়া থাকবো তবু আইবো না। ছিঃ ভাত কাপড়ের-খবর নাই! খালি ছয়মাসে একবার সোয়ামিকে দেখার লাইগা...

চন্দনা কথা বাড়ায় না, ড্রাইভারকেই-বা সে কী বলবে। তার তো উদ্দেশ্য খারাপ ছিলো না। কিন্তু ইদানিং ঘোমটার বুয়াটি ড্রাইভারের সঙ্গে যা-তা ব্যবহার শুরু করে দিয়েছে। সম্পর্কেও সেও ড্রাইভারের দূর সম্পর্কের খালা। খালার মারমুখী অবস্থার কাছে তদুপরি তার বেগম সাহেবার ভয়ে ত্রিশ-বত্রিশের মজিদ ড্রাইভারের অবস্থা আপাতত বড় শোচনীয়। খালার গাট্টিটি গোল করাই আছে। দেশের কাউকে পেলে তার পিছ ধরিয়ে দেয়া হবে এই আশায়। কিন্তু বেগম সাহেবার জন্য কাউকে পেতেও তো হবে! পারতপক্ষে সে আর খালার মুখোমুখি হচ্ছে না। তবে বেগম সাহেবা তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন এই যা ভাগ্য।

চন্দনা নিজেই হাঁফিয়ে ওঠে সবকিছু তার মনের মতো ঠিকঠাক না চললে। অতো ভালো খাওয়া আর নিখুঁত চলার জন্য অবশ্য পরিবারের কারো হাপিত্যেশ নেই। কিন্তু চন্দনা কি থাকতে পারবে রোজ অন্তত পাঁচটি পদ তরকারি না রেঁধে! তবু সব কাজ কি নিজে হাতে করা যায়!
ঘোরতর এমন দুর্দিনে টকটকে নাইলনের শাড়িতে নিজেকে বেঢপ মুড়ে ঝিলিক দিলো বছর খানেক আগে বিদেয় হওয়া দশ-এগারো বছরের মেয়েটি। হুসনা বানু ওরফে হাসু। তাকে দেখে চন্দনার ছেলে মুকুল আর মেয়ে পারুল হেসে কুটি কুটি হলো কিছুক্ষণ। চন্দনার বিগড়ানো মেজাজও পানসে হলো, দূর দূর না করে সে এগিয়ে বললো, ‘কীরে, বেড়াতে এসেছিস?’
- না, আমি আবার আপনের কাছে থাকুম।
- তোকে না তোর মা বিয়ে দিতে নিয়ে গেলো!
- হ কিন্তু সোয়ামির গরে আমি আর যামু না।
- তাহলে অন্য সোয়ামির ঘরে যাবি এবার?
রসিকতা করে বললো চন্দনা। হাসু কোনো কথা না বলে চোখ নিচু করে নিজের ডান হাতের তর্জনী কামড়াচ্ছিলো।
চন্দনা আর কিছু বললো না কিন্তু হাসু আগের মতোই তার সব কাজ করে যাচ্ছে। মেয়েটির শরীরে এই একবছরে মাংস তেমন বেড়েছে বলে মনে হয় না। বরং চোখদুটো কোটরাগত হয়েছে এবং তাতে কিশোরীর কোনো সরলতা তো নেই-ই, চন্দনা টের পাচ্ছে মেয়েটির মেজাজে সারাক্ষণ বিরক্তি ঝরছে। এর মধ্যে বার-দুয়েক তার মা এসেছিলো। মা-মেয়েতে মিলে গেটের এক কোণায় কীসব বচসাও হয়। চন্দনা বোঝে স্বামীর ঘরে ফিরে যেতে ওর মা ওকে চাপ দিচ্ছে। সে তাই নিজে পড়েছে দোটানায়। বলছেন ‘তুই বাপু চলে যা! কখন আবার তোর স্বামী আসে, হাঙ্গামা হবে।’
- আইবো না দেইখেন। থাকুক তার বড় বউ নিয়া!
- তোর স্বামীর আরো বউ আছে?
- হ! আইছি কি আর সাদে?

কাজেকর্মে মেয়েটি ভালোই ছিলো। বিয়ের আগে চন্দনা ওর মাকে বলেছিলো এইটুকু মেয়ে বিয়ে দেবে কী? আরো বছর দুয়েক অন্তত যাক। কিন্তু ওর মা বলেছিলো জামাইডা ভালা পাইছি। আমরা থাহি খোলা আকশের নিচে। জামাইয়ের বস্তিতে ঘর আছে। আমার মাইয়াডা একটা চালের নিচে সংসার পাতবো। মানা কইরেন না আফা!
না, মানা আর করেনি চন্দনা। কারণ সে জানে এদের বলে কিছুই হবে না। এটাই এদের নিয়তি যে এসব ঘটনার অনিবার্য কুফল এরা ভাবে না।

হাসুকে জোর করে বের করে দিতে পারছে না কিন্তু শঙ্কিত চন্দনা বারবার তাকে চলে যেতে বললে সে না শোনার ভান করে অন্য কাজে হাত লাগিয়েছে। ক’দিন যেতেই হলোও তাই, যা চন্দনা ভেবেছিলো।

পড়ন্ত দুপুরে করাঘাতের শব্দ শুনে ছুটির দিনে ঘুম থেকে উঠে সালাম সাহেব নিজেই এগিয়ে গেলো দরজা খুলতে। হাসুর মায়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে আরো ক’জন পুরুষ। ওদের দেখে সালাম সাহেবের বিগড়ানো মেজাজ আরো চরমে উঠলো। তিনি ‘কী চাই? বলতেই হাসুর মা ভয়ার্ত স্বরে বললো ‘হাসুরে বাইর কইরা দ্যান সাব। ‘তারপর আঙুল উঁচু করে চল্লিশের কাছাকাছি ভোঁদরের মতো বেঁটে-মোটা একজন দেখিয়ে বললো, ‘ওই যে হাসুর সোয়ামি, হাসুরে নিবার আইছে।’

‘সালাম সাহেব কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভেতর থেকে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বেরিয়ে এলো হাসু। সবার মাঝাখানে দাঁড়িয়ে সে বললো, ‘আমি আর ওর গর করতাম না।’ হাসুর মা হাসুকে থাপ্পড় মারতে এগিয়ে এলে হাসু তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়!

হাসুর মা পড়ে যাওয়া থেকে উঠে কী বলতে লাগলো, তার কথা আর শোনা গেলো না। হাসুর কণ্ঠ ছাপিয়ে সবার স্বর চাপা পড়ে গেলো। অকথ্য সব কথা...
না আর শোনা যায় না। স্বামীকে একটানে সরিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো চন্দনা। তারপর বিছানার উপর বসে দু’হাতে মুখ ঢেকে হাঁফাতে লাগলো সে।

ডাইনিং টেবিলে খালি গ্লাসটি রেখে এসে স্ত্রীর ছড়ানো আঁচলে নিজের ভেজা মুখখানি মুছতে মুছতে সালাম সাহেব বললেন, ‘এটা শুভ লক্ষণ! নিজের দাবি সম্পর্কে সকলেই এমনে সোচ্চার থাকা ভালো। তাতে করে সামাজিক পটপরিবর্তনও ত্বরান্বিত হয়।’

বন্ধ দরজা ছাপিয়ে চন্দনা শুনতে পাচ্ছে হাসুর গগনবিদারী চিৎকার। সে বুঝতে পারছে ওরা টেনে-হিঁচড়ে মেয়েটিকে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ অনেকের মতো সেও জানে, বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ। কিন্তু ফাটল ধরা পাড়ের মতো এসব বিপন্ন জীবনের ধস রুখবার মতো সাধ্য তার নেই। একসময় স্বামীর মুঠোর মধ্যে নিজের হাতখানা আবিষ্কার করে নিজের একটা ভূমিকা খুঁজতে লাগলো সে। একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটির রেশ কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারলো না চন্দনা।




দীলতাজ রহমান, ব্রিজবেন, অস্ট্রেলিয়া





Share on Facebook               Home Page             Published on: 19-Jan-2021

Coming Events:



A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far