চোরাবালি / দীলতাজ রহমান
আগের অংশ পরের অংশ
আমি এহসান ভাইকে বলেছিলাম, ট্যাক্সি চড়তে আমার ভালো লাগে না। রাত যত হোক, পথ যত দীর্ঘ হোক, আমি হুড ফেলে রিকশায় যাবো। ভাইয়া না গেলে আপনি চলেন আমার সঙ্গে। শেষে উপায় না দেখে ভাইয়া আমার প্রস্তাব মেনে নিলো। এহসান ভাই আমাদের রিকশায় তুলে দিয়ে, তারপর নিজের পথ ধরেছিলো। ঝিকাতলা একটা মেসে থাকত এহসান ভাই। ভাইয়া যেখানে যেত, সম্ভব হলে আমাকেও নিয়ে যেত। কতদিন দুপুরে ভাইয়ার সঙ্গে খাওয়ার সময়ে গিয়ে পড়লে, আমাকে দিয়ে শাক রান্না করানোর ছল করে না খাইয়ে আসতে দেয়নি। বিকেলের গড়াগড়ি রোদে কতদিন তিনজনে মিলে আমরা নিউ মার্কেটের ভেতর, লালবাগের কেল্লা, বা রমনা পার্কে, আরো অনেক জায়গায় অনেকক্ষণ ধরে হাঁটাহাঁটিও করতাম। ক’দিন এহসান ভাইদের রান্নার লোক ছিল না। মেসের সবাই রান্না শেখার কসরত চালাচ্ছিলো। রান্নার নামে হুলুস্থুল কাণ্ড চলতো ওদের। শেষে আমাকেই তরিয়ে নিতে হয়েছে সেই একবেলাও। অবশ্য ওখানে পাঁচতলার ছাদের দু’রুমে বসবাস করা চারজনই ছিলো ওরা বন্ধু। কমবেশি ওদের সবারই আমাদের বাড়িতে যাতায়াত ছিলো।
আমার ভাইয়া লেখাপড়ায় তুখোড় হওয়ায় সে তার বন্ধুদের মধ্যমণি ছিল। কিন্তু ভাইয়া এহসান ভাইকে পছন্দ করতো সবচেয়ে বেশি এবং ওকে ভাইয়ার মতো অনেকেই পছন্দ করতো। এহসান ভাইয়ের যেকোনো সিদ্ধান্ত সবাই নির্বিবাদে মেনে নিতো। এহসান ভাইয়ের সঙ্গে মুশফিকের নীরব দ্বন্দ্ব এজন্যই। আর সেটা জিইয়ে রাখতেই বুঝি মুশফিকের শেষ পর্যন্ত আমাকে বেছে নেয়া। কারণ তাদের সবার সম্পর্ক আজো অটুট আছে। দূরত্বের কারণে যারা নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে পারে না, কাছাকাছি হলে সেটুকু পুষিয়ে দেয়। তাই মুশফিকের স্ত্রী হওয়ার সুবাদে প্রায়ই সেই অন্যান্যদের সাথে পেয়ে যাই নিজের ভাই ভাবীকেও। শুধু এহসান ভাই ছাড়া। আর অন্য বন্ধুদের বাড়ির আড্ডাতে মুশফিক সময় থাকলে অবশ্যই যায়। তবে সুযোগ পেলে আমাকে দেশে বিদেশে বেড়াতে নিলেও, কখনোই কোনো বন্ধুর বাড়ির আড্ডায় নয়। আর তা কেন নয়, তাও আমাকে কৈফিয়ত দেয়ার প্রয়োজন মনে করে না মুশফিক। কিন্তু আমি জানি কেন।
রামপুরায় আমাদের নিজেদের বাড়ি। ভাইয়া এখনো সেই বাড়িতেই আছে। মা মারা যাওয়ার পর ভাইয়া মুশফিকের সঙ্গে বোঝাপড়া করে আমার ভাগের সব অংশ বুঝিয়ে দিয়েছে। কম দিলে মুশফিক যে তাকে ছেড়ে কথা বলতো না। এতেই বুঝি ভাইয়া আমাকে ঠকায়নি। সংসারে ঢুকে প্রতিটি বিষয়ে মুশফিকের টানটান হিসেবি মনের উঁকি আমাকে ওর প্রতি সব বিষয়ে আগ্রহ ক্রমে কমিয়ে দিয়েছে। আর সেই ফাঁকটুকুতে বুঝি উজ্জ্বল হতে থাকে আরেকজনের মুখচ্ছবি। তারই প্রভাবে হয়তো আমি আমার প্রতি অমোঘ করে তুলতে চাইনি মুশফিকের কোনো ধরণের দাবি, বিশ্বাস বা সহৃদয়তা।
সেদিন নদী-ভাসা আমেজ না কাটতেই বিস্বাদ উগরাতে লেগেছিলো মুশফিক। ভাইয়াকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে বলেছিলো, ‘তোমরা যদি সম্বন্ধটা করতে চাও, দেরি করা চলবে না।’ উত্তরে ভাইয়া বলেছিলো, দেরি তো তোমরা করছো, মা তো চাইছেই মৌলির বিয়েটা তাড়াতাড়ি হোক এবং তোমার সাথে হোক!’
মুশফিকের হঠাৎ ক্ষিপ্র হয়ে ওঠার কারণ এহসান ভাই। যে ওর সঙ্গে আমার বিয়েটা ঠিক করে দিয়েছিলো। আমাকে নিয়ে এহসান ভাইয়ের আগ্রহটা কখনো মুশফিকের ভালো লাগেনি। এই ভালো না লাগাটুকু আজো আমার কাছে মহার্ঘ্য হয়ে থাকতে পারতো, যদি সেদিন ওর এতটুকু অধিকার-বোধের প্রকাশ দেখতাম। তাহলে নৈমিত্তিক এই সম্পর্কটিই আজ অন্যরকম করেও তুলতে পারতাম। টানাপোড়েনের সেই সময়ে একদিন হন্তদন্ত অবস্থায় ছুটে এসে এহসান, ভাইয়াকে বলেছিলো- মুশফিকের সঙ্গে মৌলির বিয়েটা ভেঙে দিলে তোদের কি খুব অসুবিধা হবে...?
ভাইয়া কিছু বুঝে ওঠার আগেই মা ভেতর থেকে এসে ভাইয়ার দিকে গলা বাড়িয়ে বলেছিলেন- ‘আমি আগেই বলেছিলাম, মৌলিকে তোমরা তোমাদের সঙ্গে নিয়ো না! এ নিয়ে কথা হবে। তাছাড়া মানুষের মন... না, না এহসানের চেয়ে মুশফিক অনেক ভালো। এহসান এখনও ঢাকায় এককাঠা জমি কিনতে পারেনি। চাকারিটাই যা সম্বল! অথচ মুশফিকদের সব শহুরে। বাড়ি-গাড়ি, স্ট্যাটাস সব আছে! আমার মনে হচ্ছে, ওরই মনে ধরে গেছে মৌলিকে। মৌলি লেখাপড়ায় গড়পড়তা হলেও দেখতে তো ভালো। শান্তশিষ্ট। বাবার সম্পত্তি যা পাবে, তা এহসানের জন্য অনেক! না, না, আত্মীয় স্বজনের কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে এ বিয়ে ভেঙে দিলে। জামাই হিসেবে সবাই মুশফিককে পছন্দও করেছে।’
এইরকম সাদামাটা একরৈখিক বিষয়ের বাইরে আমার মা ভাবতে শেখেননি বলে, মা আমাদের কাছে সারাজীবন তেমন একটা সম্মান পেয়ে যাননি।
ভাইয়া তখনি মাকে ধমকের সুরে বুঝিয়েছিলো, এহসানকে আমি জানি মা। ওর আত্মসম্মানবোধটা কতটা প্রখর, তাও আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। ও যদি নিজের জন্য বলে থাকে, তবে তা তোমার মেয়েকে উদ্ধার করতেই বলেছে। দেখছো না মুশফিকরা কতদিন ধরে ধীরেসুস্থে সময় নিলো পুরোপুরি মত দিতে? এতদিন বাজিয়ে দেখলো, মৌলি কতটা নিয়ে ওদের ঘরে ঢুকতে পারবে। বাবা কোথায় কী রেখে গেছেন সব জেনে নিয়েছে। এখন হিসেব পুরে গেছে বলেই অন্য পাত্রকে ঠেকাতে চাইছে। আর মৌলির মতো মেয়ে খুঁজে পাওয়াও তো সহজ নয়! নিশ্চয় মৌলির সম্মানে লাগে এমন কিছু ওরা কেউ বলেছে। আর এহসান হয়তো তাই জানতে পেরেছে। তাই ও এসেছে তোমার মেয়েকে উদ্ধার করে নিজে বলি হতে। কারণ এমন অবস্থায় যে এগিয়ে আসে তার সম্মানটা দশজনের কাছে বাড়ে না।
মা’র চুপসে থাকো অবস্থার সুযোগ নিয়ে ভাইয়া একচোট যা ঝাড়লো, তাতে আমার দশা হযবরল হয়ে গেলো। ক’রাত ঘুমুতে পারিনি। ভেবেছিলাম এহসান ভাই আবার এলে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জানতে চাইবো- বলো, আমি তোমার কতটুকু সুখ? নাকি শুধু চ্যালেঞ্জে জিততে চাও? শুধু জিততে চাইলেও তোমাকে আমি কারো কাছে হারতে দেবো না!’
কিন্তু সে আর আসেনি। তাকে শুনিয়ে মায়ের বলা কথাগুলো মনে পড়ে, মেসে খোঁজ নেবো নেবো করেও নেয়ার সাহস হয়নি। তাছাড়া আমাকে কেন্দ্র করে দু’জনের কারো সঙ্গেই তো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। দু’জনই তারা ভাইয়ের বন্ধু।
সেইদিন তো আমি নৌকায় বসে মুশফিকের মনোযোগই চেয়েছিলাম! ভেবেছিলাম, ও আমার কাছে আসার ছুঁতো খুঁজবে। ইচ্ছে করে ভুলে ভুলে আঙুল ছোঁবে। ফেরার পথে আমরা তিনজন একসঙ্গে ট্যাক্সিতে ফিরতে পারতাম। মুশফিক আগেই নেমে যেতে পারতো, যেহেতু ওদের বাড়ি আগে। বাসাবো। সেই মুশফিকের একগুঁয়ে অনুদার মনোবৃত্তির কাছে আমার আমিত্বটুকু ভাস্বর করে না রাখতে পারলেও, বিলীন যে করে ফেলিনি, তাই বুঝি, সুখের জন্য কারো কাছেই আমার হাপিত্যেশ নেই বলে।
বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল এক সপ্তাহের মধ্যে। হঠাৎ সৃষ্ট হওয়া একটা শূন্যতা নিয়েই আমি একটা ভরা সংসারে ঢুকলাম। কী নেই মুশফিকদের বাড়ি? সারাদিন সবার মন রক্ষা করতে আর নিজেকে রকমারি গহনায় সাজিয়ে রাখতে সময় পার হয়ে যায়। আর্ট-কালচারের পরিপূর্ণ আবহে আমি মানুষ। গহনাপত্র-আসবাব, বাড়ি-গাড়ি, মোটকথা প্রাচুর্যের ভেতর থেকেও কখনও আমাদের কাছে প্রাণের কোলাহলের চেয়ে অর্থের প্রাচুর্য গুরুত্ব পায়নি। এখানে এসে প্রতিদিন ক্লাসের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হতে হতে ছাত্রীর আমেজটি আমার মন থেকে মুছে গেলো। এ বাড়ির বউয়েরা চাকরি করতে পারবে না। কারণ অর্থের প্রয়োজন নেই। মুশফিকের মা’ও শিক্ষিত-বনেদি ঘরের মেয়ে। দশ ভরি ওজনের সোনা পরে সারাদিন নুন-তেলের হিসেব কষেই দিন পার করেন নির্বিঘ্নে।
আবার অন্ধকার আলো করে তৃপ্ত মুখে ঘুম থেকে ওঠেন। যেন এর বাইরে একটা মানুষের আর কোনো কিছুই করার নেই। খবরের কাগজগুলোও সব বাড়ির পুরুষ-মানুষদের দখলে। বাড়ির আরো তিনটি বউয়ের সঙ্গে কাজের লোক নিয়ে আমারও সংসারের জোয়াল টানতে হয় ঘুমোতে যাবার আগপর্যন্ত। সংসারের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে জীবনের মণি-মুক্তা সব অলক্ষ্যে ফুরিয়ে যায়। মা’র কাছে যেতে দেরি হলে মা’ই চলে আসতেন। এখনো ভাইয়া ভাবী বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার দিনগুলো ছাড়াও আসে। আমিও যাই না, তা নয়। এখনো এহসান ভাইকে নিয়ে মুশফিকের তাচ্ছিল্য-পূর্ণ কথাবার্তা এমন হয় যে, তা এমন ক্ষীণ নয় যে এড়িয়ে যাওয়া যায়। আবার এমন জোরালো নয় যে একদিন গলদ ভেঙে হেস্থনেস্থ করি। তবে একটা বিষয় লক্ষ করেছি, এহসান ভাইয়ের নামটি উচ্চারণ করতে মুশফিকের কণ্ঠ ফোটে না। আর সেটুকুতে ভর করে আমারও একটা শক্তি জমতে থাকে। ধুলোবালির মতো স্মৃতিগুলো ক্রমে মণি-রত্নের মতো দামি হয়ে ওঠে। প্রতি মুহূর্তে যেন তা জীবনকে আরো তেজী, আরো গূঢ় করে তোলে।
তিনদিন হলো মুশফিক অফিসিয়াল ট্যুরে দিল্লি গেছে এক সপ্তাহের জন্য। এরকম ট্যুরে সে আগেও একা বহুবার বহু দেশে গেছে। কিন্তু তখন একান্নবর্তী পরিবারে ছিলাম। মাস খানেক হলো আমরা আলাদা ফ্ল্যাটে উঠেছি। তূর্য’র এখন অনেক বন্ধু জুটে গেছে। সারাদিন সে লেখাপড়া, স্কুল আর বন্ধুদের নিয়ে হৈচৈ-এ মেতে থাকে। ছেলেটা দেখতে যেমন বাবার মতো, স্বভাবেও। একরোখা কিন্তু তৎপর। যেকোনো কাজেই নিজেকে একাই এক’শ মনে করে। তাছাড়া ছেলে যত বড় হয়, তত বাইরের দিকে ধাবিত হয়। মেয়ে বড় হলে ক্রমে হতে হয় ঘরমুখো। এ আমার মায়ের দর্শন। মা উঠতে বসতে এভাবে বলে বলে অবদমিত করে দিয়েছিলেন আমার বলয় ভাঙার তেজ। না হলে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েও কেন এমএ পরীক্ষা দেয়ার চেষ্টা করলাম না! কেন জীবন ছেঁকে অমৃত পরের জন্য বিলিয়ে, আকণ্ঠ গরলে নিজে ডুবে থাকি!
আগের অংশ পরের অংশ
|