bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













তাশা ও তোকারচুক
দিলরুবা শাহানা



তাশা চলে যাচ্ছে তার জন্মের এই শহর ছেড়ে। চলে যাবে আরেক শহরে। ওখানে তার এক জ্ঞাতি বোনের কাছাকাছি থাকবে। রিটায়ারমেন্ট ভিলেজে ছোট্ট আবাস কিনেছে। থাকবে ওখানেই। বর্তমানে এখানকার বাসস্থানের জিনিসপত্র সব বিলিবন্টন করে দিচ্ছে। কিছু উপহার হিসেবে দিচ্ছে, কিছু দান করছে। তাশার দুই সন্তান। তারা থাকে দূরে। বহুদূরে। অন্য দুই মহাদেশে। ওরা ওদের জীবন নিয়ে মহা ব্যস্ত। মাঝে সাঝে খ্রীষ্টমাস, নিউইয়ার্স ডে তে দেখা সাক্ষাৎ হয়। তাশা আত্মনির্ভরশীল মহিলা। সন্তানদের কাছে তার কোন প্রত্যাশা নাই। সারাজীবন সে রোজগারপাতি যা করেছে তা যথেষ্ট ভাল। নিজের বাড়ী, মোটা অংকের সুপার এ্যানুয়েশন বা রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট নিয়ে স্বচ্ছল জীবন। বয়স হয়েছে তাই ঘনিষ্ঠ জনদের কাছাকাছি থাকতে চায়। আপন না হলেও জ্ঞাতি বোনটির সাথে তার আন্তরিকতার সম্পর্ক। ওই বোনের সন্তানরাও আশেপাশে নিজেদের ঘর-দুয়ার নিয়ে থাকে। ওরাও তাশাকে খুব পছন্দ করে। ওদের মাঝে থাকলে নিরাপত্তা ও ভালবাসার অভাব হবেনা এতে তাশা নিশ্চিত।
ওর বাড়ীতে বাড়িভাড়ার নোটিশ টাঙ্গানো দেখে খোঁজ নিতে গেলাম। কলিং বেল টিপতেই গোলগাল চেহারা, কান অব্দি ছাটা চুল নিয়ে হাসি মুখ তাশা দরজা খুলেই প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো
-আরে আমি তোমার কাছে যাচ্ছিলাম
সদ্য বানানো কেকের সুবাসে ঘর মো মো করছে। আভেন থেকে বের করে কেকটা সবে টেবিলে রাখা হয়েছে। তারই মজাদার খুশবু। কেক দেখিয়ে বললো
-এটাই নিয়েই যেতাম তোমার সঙ্গে বিকালের চা খাব বলে।
-তুমি কি বাড়ী ছেড়ে চলে যাচ্ছ?
তখন সব কথা তার কাছে শুনলাম। প্রায় দশ বারো বছর হল কাজ থেকে অবসর নিয়েছে সে। প্রতিবেশী হিসাবে খুব ভাল। আমার বাসার এক চাবি ওর কাছে গচ্ছিত, ওর এক চাবি আমার কাছে। যদি চাবি হারাই কেউ তবে ওই চাবি কাজে লাগবে ভেবেই রাখা।
আমরা এক সাথে চা কফি খাই, বাগান, বেড়ানোর জায়গা ইত্যাদি নিয়ে কত গল্প করি। তবে ওর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কৌতূহল দেখাইনি কখনও। তাই বলে বোধহয় ও আমাকে বেশ পছন্দ করে। ওর স্বামী-সন্তান নিয়ে কোন প্রশ্ন করে ওকে কখনো অস্বস্তিতে ফেলিনি আবার নিজের স্বামী সন্তানদের গল্প বলেও ওর বিরক্তি উৎপাদন করিনি। তবে আমার বাচ্চারা তাশার বেকিং পছন্দ করে তাই জন্য ও প্রায়ই স্কোন, কেক বেক করে দিয়ে যায়। ওরাও তাশা আন্টির জন্য নিউ ইয়ার্স আর বার্থডে গিফ্ট দিতে ভুলে না।

পাঁচ বছর আগে এই সাবার্ব বা পাড়াতে এসেছিলাম। প্রথম যে প্রতিবেশী টবে ফুলের চারা হাতে দরজায় কড়া নেড়েছিল স্বাগত জানাতে সে হচ্ছে আনাসতাসিয়া বা তাশা। সাধারনতঃ আনাসতাসিয়াকে আ্যানা বলা হয় তবে সে তাশা বলেই সবার পরিচিত।
-ওয়েলকাম টু নেইবারহুড ডিয়ার!
এই আন্তরিক মিষ্টি কথা হৃদয় ছুঁয়েছিল। যার রেশ এখনো বজায় আছে দুই প্রতিবেশীর নানা আচরণে।
এই পাঁচ বছরে তাশাকে দু’বার তার সন্তানদের সাথে খ্রীষ্টমাস ও নিউইয়ার্স কাটাতে নিউইয়র্ক ও লন্ডন যেতে দেখেছি। বাচ্চারা তার ভীষণ ব্যস্ত বলে আসতে পারে না। তাশা কাজ থেকে অবসর নেওয়ার পর ব্যস্ত তার ঘরবাড়ি সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে। বাগান থেকে শুরু করে বাড়ীর দরজা জানালা দেয়াল সব কিছু নিজ হাতে ঝকঝকে সুন্দর করে রেখেছে। তার কর্ম উদ্দীপনা প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। মাঝে মধ্যে বলতাম
-দেখ মই বেয়ে উঠে গাছের ডাল ছাটা আর জানলার কাচ মুছতে যেয়ে পড়ে যেওনা।
কিশোরীর চঞ্চলতা নিয়ে ছুটাছুটি করে কাজ করতো সে। আমার কথা শুনে তেমনি আনন্দে হেসে উঠতো। তাশাকে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখিনি কখনো। বয়স সত্তর বাহাত্তর, কাজকর্মে বত্রিশের তরুণী, আনন্দে বিশ একুশের উচ্ছলতা।
একবার বলেছিল
-আমার ছেলে কলকব্জা নিয়ে কাজ করতে ভালবাসে তাই অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে আর মেয়ে পারফর্মিং আর্ট পড়েছে শিল্প নিয়ে ব্যস্ত। লন্ডনে স্টেজ ড্রামার পোশাক ডিজাইন করে। এর জন্যও নাকি অনেক বইপত্র পড়তে ও গবেষণা করতে হয় তাই সময় পায়না।
জিজ্ঞেস করিনি ওদের বাবা কোথায়? হয়তো ওকে এই প্রশ্ন বিব্রত ও ব্যথিত করবে। সে বেড়াতে যেতো কাছের শহর জিলংএ জ্ঞাতি বোন মানে চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুপুতো কোন এক বোনের কাছে।
ধীরে ধীরে জানলাম সে সরকারের স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যবস্থাপনায় কাজ বা হেলথ ডিপার্টমেন্টের এ্যাডমিন এ কাজ করতো। ভাইবোন কোনকালেই ছিল না। মা বাবাও কবেই মারা গেছে। সন্তানরাও বহুদূর দেশে। এখানে সে একা।
তবে কারও প্রতি বিরক্তি বা বিদ্বেষ প্রকাশ করতে দেখিনি ওকে। মানুষকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে সে মনে হয় সদা প্রস্তুত। ময়লা নেওয়ার পর প্রতিবেশীর বিন বাড়ির বাইরে পড়ে আছে দেখলে নিজে ঠেলে নিয়ে দিয়ে আসে।
তাশা চলে যাবে। এই নেইবারহুডে আর ওকে চঞ্চলপায়ে হেঁটে বেড়াতে দেখা যাবে না, হয়তো একদিন ও বিস্মৃতির আড়ালেই চলে যাবে। কে সে? যাকে মনে রাখা দরকার। হ্যাঁ সে একজন বন্ধুবৎসল, হৃদয়বতী বা উদার হৃদয় মানুষ ছিল। সাদা কালো সবার সাথে মিশতো, ধর্ম-বর্ণ বাছবিচার করতো না। তার এক সময়ের সহকারী আফ্রিকার কোন এক দেশের আলফন্স। তার মেয়ে গাড়ি এক্সিডেন্ট করার পর কি পরিমাণ সাহায্য তাশা করেছে ভাবতে অবাক লাগে।
মানুষের সমস্যা বুঝতো সে। কোভিডের কারণে তার এক বন্ধুর কফি-শপের ঝমকালো ব্যবসা শুধু বন্ধ নয় শেষ হয়ে গেল একেবারে। তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। ওই পরিবারের তিন জনকে অনলাইনে অর্ডার দেওয়া খাবার ডেলিভারির কাজে উৎসাহিত করেছিল। ওরা এক ব্যবসা হারিয়ে যখন হতবুদ্ধি তখন নতুন ব্যবসা-বুদ্ধির জন্য তাশার কাছে কৃতজ্ঞ।
এরমাঝেও একদিন দেখি একটা ছোট্ট ড্রামে আগুন জ্বালিয়ে তাতে কি কি জিনিস যেন ছুড়ে ছুড়ে মারছে তাশা। দেখেও না দেখার ভান করলাম। ও নিজেই ডাকলো
-এসো দেখে যাও
-কি হচ্ছে এসব তাশা? কি পোড়াচ্ছ তুমি?
আগুন তখন নিভে এসেছে। চোখে তার বিষন্নতার ছায়া। বললো
-স্মৃতি সব পুড়িয়ে দিলাম। যাতে ওদের মন খারাপ না হয়। আমি ওদের কষ্ট দিতে চাইনা
-কাদের?
-আমার সন্তানদের
-মানে! স্মৃতি কি পুড়ানো যায়?
-শোন আমার রেখে যাওয়া সম্পদ ওদের স্বস্তি দেবে, আনন্দ দেবে আর ভালবেসে এতো বছর ওদের যে স্মৃতি আমি আগলে রেখেছি তা ওদের কাঁদাবে, কষ্ট দেবে তা আমি চাইনা
-কি কি স্মৃতি তুমি পুড়িয়ে শেষ করলে বল?
-ওদের স্কুলের কাজের পুরস্কার, হাতে বানিয়ে আমাকে দেওয়া মাদার্স ডের উপহার আর সবচেয়ে যা আমাকে একই সঙ্গে কষ্ট ও খুশী এনে দিয়েছিল তা একটা চকোলেট
-চকোলেট!
-আজ থেকে ৩৭ কি ৩৮বছর আগে পাওয়া চকোলেট হাতে নিয়ে আমি এখনো বিহ্বল হয়ে পড়ি!
-ঘটনটা বলতো?
-কষ্ট পাবে
-তাও বলো
আসলেও ভালবাসা ও কষ্টের গল্প। তাশার স্বামী যে রাত্রে জানালো সে চলে যাচ্ছে তাশা বুঝেছিল লোকটির অসহায়ত্ব কিন্তু সন্তানরা তাদের ভাল বাবাকে হারানোর কষ্টে দুঃখিত ও আতংকিত ছিল। তাশা লোকটিকে ভালোবাসতো ভীষণ কিন্তু যখন জানলো সে মুখোশ পরে জীবন কাটাচ্ছে তখন সে তাকে কষ্ট থেকে মুক্তি দিল। স্বামী চলে গেল তার ভালবাসার মানুষটির কাছে। সন্তানদের অসহায় চেহারা দেখে তাশা নিজের কাছে নিজেই প্রতিজ্ঞা করলো বাকী জীবন সে তাদের হাসিখুশি রাখতে চায়। তাই সে করেছে। তারা জেনেছে মা তাদের অসহায় করে ফেলে রেখে যাবেনা, যায়নি। তাশা কোন পুরুষের সাথে জড়ায়নি আর। অর্থ রোজগারের জন্য কাজের সময় ছাড়া বাকী সময়টুকু ছিল দুই সন্তান এ্যানা আর এডির জন্য। ওদের বাবা চলে গেল যেদিন সে দিন স্কুল থেকে ফেরার সময় তখনো সাত হয়নি যে এডির সে মায়ের জন্য স্কুল ক্যান্টিন থেকে একটা চকোলেট কিনে এনেছিল। মাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা গুঁজে বলেছিল
-আমি তোমাকে রেখে কখখনো কোথাও যাবনা মা।
মেয়েও তখনি পিছন দিক থেকে ঝাপটে ধরে মায়ের কাঁধে মুখ রেখে একই কথা বলেছিল। তিনজন এক সাথে কান্না শেষ করে সেদিন সন্ধ্যায় পাড়ার ফিস এন্ড চিপস’র দোকানে গিয়ে রাতের খাওয়া খেলো।

তারপর জীবন চললো জীবনের মতো। ওরা সুআচরণ, সুচরিত্র নিয়ে বড় হয়েছে। পছন্দের কাজকর্ম করছে। ওরা সুখী। তাশার আর কিছু চাইনা। এবার জীবন গুটিয়ে নেওয়ার পালা।
ভেবেছিলাম হয়তো নিজের সন্তানদের উপর অভিমান থেকে রাগ করে সব পুড়িয়ে দিয়েছে। ওর কথা শুনে বুঝলাম বিষয়টা তা নয়।
আমি অবাক ভেবে যে কেন তাশা ভাবলো বা কি করে সে জানলো যে ভালবেসে আগলে রাখা ছোটবেলার স্মৃতিগুলো দেখলে ওদের মন খারাপ হবে? তাশা কি তোকারচুকের গল্পটা পড়েছিল?
ওকেতো বই পড়তে দেখিনি কখনো। আর তোকারচুক ২০১৯এ নোবেল-জেতা পোলিশ বা পোল্যান্ডের লেখিকা তার গল্প তাশা কোথায় পড়লো?
কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলাম
-তুমি কি ওলগা তোকারচুকের গল্পটা পড়েছো?
-সে কে? আমি তেমন বইটই পড়িনি।
আমি কথা বাড়াইনি আর। ওলগা তোকারচুকের গল্পটা পড়েও হৃদয়ে থির থির করে ব্যথা জাগে। বিস্ময় লাগছে ভেবে তাশা জানলো কি করে বা ভাবলো কেন তার সন্তানরা ব্যথিত হবে, কষ্ট পাবে। আমি ভেবেছি হয়তো ওই গল্প পড়েই তাশা সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভালবেসে আগলে রাখা সন্তানদের ছোটবেলার সব স্মৃতিময় জিনিসপত্র পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে।
বিস্ময় নিয়ে ভাবছি স্মৃতি পুড়িয়ে দেওয়া যায়! তাহলে স্মৃতি পুড়িয়ে দেওয়া যায় কষ্ট থেকে বাঁচতে।

তোকারচুকের গল্পে মায়ের মৃত্যুর পর অকর্মা ছেলেটির কোন কান্নাকাটি নাই। সাধ্যমত আয়োজন করে মায়ের শেষকৃত্যও করলো। ঘরে ফিরে মায়ের জিনিসপত্র ঘাটাঘাটি করে তাতে থাকা তার ছোটবেলার স্কুল রিপোর্ট, হোম-ওয়ার্ক খুঁজে পেয়ে একান্তে সে প্রথম কাঁদলো । মায়ের ভাণ্ডারে রক্ষিত তুচ্ছাতিতুচ্ছ ভালবাসার ধন ছেলেটিকে কাঁদালো।





দিলরুবা শাহানা, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া




Share on Facebook               Home Page             Published on: 28-Dec-2022

Coming Events:





A day full of activities, games and fun.







Blacktown Lakemba Mascot