একটি চলচ্চিত্রের ব্যবচ্ছেদ: সখী, ভালবাসা এরে কয় দিলরুবা শাহানা
এক বয়স্ক প্রকাশক। তার সঙ্গে দেখা করতে এলেন একদিন অস্থির, উদভ্রান্ত একজন নারী। ওই নারীর স্বামী ছিলেন একজন লেখক। লেখকটি হঠাৎ মারা গেছেন। ভদ্রমহিলা অথৈ পাথারে পড়েছেন। কারণ তার জানা নেই স্বামীর কাজকর্মের নমুনা, প্রাপ্তির সীমানা। বাড়ী ফেরার পথে হঠাৎ আবার গাড়ীতে বসা প্রকাশকের চোখে পড়লো মহিলাকে। অসহায়, বিচলিত মহিলার চেহারা। এলোমেলো পা ফেলে হেঁটে যাচ্ছেন একা। সেই চেহারা প্রকাশককে গভীর ভাবনায় ফেলে দিল।
এদিকে বাড়ীতে ফিরে প্রকাশক দেখেন তার স্ত্রী মগ্ন গৃহস্থালিতে। প্রায় পঞ্চাশ বছরের জীবনসঙ্গিনী এই নারী। যিনি কখনো নাতীর দেখভালে আবার কখনোও বা টিভি সিরিয়াল দেখা নিয়ে মেতে থাকেন। আজ স্ত্রীর উপর বিরক্তি ঢাললেন প্রকাশক।
কি ঘটলো ভদ্রলোকের মনে? কি কারণে তিনি স্ত্রীর উপর বিরক্ত? কেন আজ তার বিতৃষ্ণা? বিবাহিত জীবন তাদের পঞ্চাশ বছরের। আজও অব্দি তার স্ত্রী স্বামীর জন্য পায়েস রাধার কাজটি নিজ হাতে সযত্নে করেন। কেন? কারণ উনি জানেন কাজের লোকের রান্না করা পায়েস তার স্বামী খেতে পারেন না। ভালবাসা এরে কয়!
তারপরও স্বামী আজ তার উপর নাখোশ। ভদ্রলোক এক পর্যায়ে স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। ওই দম্পতির বিবাহিত সন্তানেরা এই সিদ্ধান্তের কারণ খুঁজে না পেয়ে হতভম্ব, ব্যথিত।
এদিকে প্রকাশক স্ত্রীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা, বিচ্ছেদের জন্য স্ত্রীর পক্ষে উকিল নিয়োগ সবই করলেন। মজার ঘটনা ঘটলো আদালতে যাওয়ার দিনে। যে স্বামী মহিলাকে বিচ্ছেদ দিতে আদালতে যাচ্ছেন সেই স্বামীর সঙ্গে একই গাড়ীতে উনিও আদালতে রওয়ানা দিলেন। কারণ স্বামীর উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল এই নারী কোনদিন স্বামীকে ছাড়া একা বাইরে কোথাও যাননি। ভদ্রলোক স্ত্রীর দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালেন। ওই দৃষ্টিতে কি ছিল? মমতা নাকি নির্ভরশীল নারীর প্রতি হতাশা মেশানো বিরক্তি? বোধহয় দুটোই। তারপরও বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন প্রকাশক। ভদ্রলোক অন্য নারীতে আসক্ত নন, বন্ধুবান্ধবের আড্ডায় মেতে থাকতে দেখা যায়নি তাকে একবারও। মাঝেমধ্যে টিভিতে ডিসকভারি চ্যানেল দেখাটাই ছিল তার একমাত্র বিনোদন। তবে কেন? কিসের আকর্ষণে তিনি স্ত্রীকে ত্যাগ করতে চাইছেন?
ওই যে মৃত লেখকের বিধবা স্ত্রীর বিপন্ন মুখ, যে মুখ দেখে প্রকাশকের অবর্তমানে নিজের স্ত্রীর অসহায়ত্ব ও বিপন্নতার কথা ভেবেই হয়তো উনি শিহরে উঠেছিলেন, বিপন্ন বোধ করছিলেন। তার একান্ত আপন নারী নিতান্ত গৃহবধূ মাত্র। সেই স্ত্রীকে আত্মনির্ভরশীল, শক্তিময়ী করার অভিপ্রায় নিয়েই নিজেকে সরিয়ে নিলেন প্রকাশক। স্বনির্ভর, শক্তিময়ী স্ত্রীকে দেখার বাসনা! ভালবাসা এরে কয়।
স্ত্রী আদালতে নিজস্ব কোন মতামত, কোন ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন না। বৈবাহিক সম্পর্কে ক্লান্ত স্বামী বিচ্ছেদ চাইছেন। তবে তাই হোক। এটাই ছিল স্ত্রীর কথা। আদালত চূড়ান্ত বিচ্ছেদ অনুমোদন না করলেও আলাদা বা স্বতন্ত্র বসবাস অনুমোদন করলো। শুরু হল তাদের স্বতন্ত্র বসবাস।
দিন যায়। স্ত্রী ধীরে ধীরে ঘরে বাইরে সবকাজই শিখে নিলেন, সামলে উঠলেন। স্বামীকে ছাড়াই জীবন বয়ে চললো। স্বামী ফিরে এলেন একদিন স্ত্রীর কাছে। কারণ স্ত্রীকে ছাড়া জীবনযাপন তার জন্য বড় কষ্টকর। সখী, ভালবাসা এরে কয়!
এই হচ্ছে নন্দিত চলচ্চিত্র নির্মাতা নন্দিতা রায় ও শিবতোষ মুখার্জ্জীর ‘বেলাশেষে’ সিনেমার মূল গল্প। তবে এই নির্মাতা দু'জন অন্যান্য সব নির্মাতার মত ওই লেখকের স্ত্রীর করুণ মুখ বার বার পর্দায় দেখান নি বা অস্কার-বিজয়ী আসগার ফারহাদীর নিজস্ব কৌশল মত সময় নিয়ে ওই মহিলার মুখের উপর ক্যামেরা ধরে রাখেন নি।
এই পরিণত বয়সের দু’জন নরনারীর ‘অঙ্গবিহীন আলিঙ্গন’ (কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ থেকে চয়ন) হচ্ছে ছবিটির মূল প্রাণ আর তাদের ভালবাসার মূল বাঁধন। এদের দুজনের পরস্পরের কাছে সব প্রত্যাশা যে পূরণ হয়েছে তা নয়। তাদের দু’জনের অপূর্ণ বাসনার গল্প শুনে মনে হয় ভালবাসার ভুবনে সামান্য চাওয়া (সে হোক দেয়াল ঘড়ি বা পাবদা মাছের ঝোল) বা একটুকু ছোঁয়া কি অমূল্য-ধন!
(‘বেলাশেষে’ চলচ্চিত্র বিষয়ে এই ভাষ্যটি সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব বোধ থেকে উৎসারিত।)
দিলরুবা শাহানা, মেলবোর্ন
|