সেভিল, ল্যুভ ও দ্যা ভিঞ্চির ‘সালভাতর মান্দি’ /দিলরুবা শাহানা
আগের অংশ
এসব শিল্পিত সৃজন দেখে মনে হল ক্ষমতাবানেরা শুধু যুদ্ধবিগ্রহ আর খুনোখুনিতে শক্তি ব্যয় না করে এমন সুন্দরের সৃষ্টিতে আরও বেশী করে মনোনিবেশ করলে, তা সব জনসাধারণ্যে ছড়িয়ে দিলে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে মুগ্ধতায় আবিষ্ট করে রাখতে পারতো। এসব নির্মাণ হয়তো নতুন কিছু তৈরিরও প্রণোদনা দিয়ে যেতো লোকজনকে। এমন আনন্দদায়ক ও স্বস্তিদায়িনী সব সৃষ্টি মন ও চোখ ভরে দেখতে হলে হাঁটতে হবে আর সেভিল ছোট্ট ছিমছাম স্নিগ্ধ শহর বলে হাঁটাটা ক্লান্তিকর লাগেনি।
সেভিলের আল কাজার প্রাসাদের পিছনের দেয়ালের কাছেই আবাসিক হোটেলে ছিল আমাদের অবস্থান। তা হোটেল ছাড়তে হল ভোর পাঁচটায়। ট্যাক্সি ঠিক সময়ে আমাদের তুলতে আসলো। জানি না কোথায় যাচ্ছি, কোন বাহনে আমরা গন্তব্যে পৌঁছাব কোন ধারনা নাই। অতি ভোরে ঘুম ভেঙ্গে এক ঘোরের মাঝে রওয়ানা। ট্যাক্সি চালক স্যুট টাই পরা মাঝবয়সী স্প্যানীয় ভদ্রলোক। সে বেচারা বিদেশী যাত্রী পেয়ে তার ইংরেজি ভাষাটা ঝালাইয়ের জন্য উঠে পড়ে লাগলো। ‘কবে সেভিলে এসেছো?’ ‘আল কাজার ট্যুর করেছো নিশ্চয়?’ ‘গ্রানাডা যাবে কি?’ প্রতিটি প্রশ্নের পরেই জানতে চাইছে, ‘আচ্ছা আমার ইংরেজি বুঝতে পারছো তো?’ ‘ইংরেজিটা ঠিক আছে তো?’ ইত্যাদি ইত্যাদি। দুঃখ করে আরও বললো ‘এখন অর্থনীতি এখানে ভাল না, জান পাঁচ বছর কাজ ছিল না আমার; এই কাজ পেয়েছি মাত্র পাঁচ ছয় মাস’। তারপর ভদ্রলোক আমাদের চমকে দিয়ে বলে উঠলো - ‘আচ্ছা বলতো তোমাদের কোথায় নামাবো ট্রেন স্টেশনে না এয়ারপোর্টে’? ওর কথা শুনে আক্কেল গুড়ুম। ইংরেজি বলায় মত্ত থাকায় ও বেচারা ভুলেই গেছে যাত্রীদের কোথায় নামাতে হবে। এয়ারপোর্টে নামাতে হবে শুনেই স্যুটপরা ড্রাইভার ভদ্রলোকের প্রশ্ন -কোথায় যাবে তোমরা? ওর সাথে সাথে আমিও তখনি জানলাম আমরা প্যারিস যাচ্ছি এবং এ্যারোপ্লেনেই যাচ্ছি। মানে হল বাসে করে পথের দৃশ্যাবলী দেখতে দেখতে একদেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়ার আনন্দটা হচ্ছে না। ড্রাইভার লোকটির বকবকানি চলছেই - -যা অবস্থা প্যারিসে; গরীবের অবস্থা বড় কঠিন আর জিনিসপত্রের ভীষণ দাম প্যারিসে। দেখবে সেভিলের চেয়ে কয়েক গুণ বেশী। বেশী কথা বললেও লোকটি সঠিক কথাই বলেছে। প্যারিস আসলেও দামের শহর। ট্যাক্সি ভাড়া, হোটেল ভাড়া, টয়লেট ভাড়া, খাবারদাবার সবই দাম।
প্যারিস এয়ারপোর্টে নেমে দেখা গেল পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বন্ধ। ফরাসীরা ইংরেজ আর ইংরেজি দু’টোই খুব একটা পছন্দ করে না। এক সময়ে তো ইংরেজি শুনলেই প্যারিসিয়ানরা নাক কুচকে সরে যেতো বলে শুনেছি। তবুও এক প্রাইভেট কারকে ইংরেজিতেই নম্র ভাবে বলে কয়ে রাজী করানো হল। প্যারিসের ন্যাশনাল একাদেমী অফ মিউজিক(Academie Nationale De Musique) হলের খুব কাছাকাছি নির্ধারিত ঠিকানায় পৌঁছাতে লাগলো প্রায় দুই আড়াই ঘণ্টা। কারণ পাবলিক ট্রান্সপোর্ট হরতালে। তাই সবাই নিজে নিজ গাড়ীতে রাস্তায় নেমে এমন যানজট তৈরি করেছে বলার মত না। এবার হোটেল নয় আমাদের আস্তানা হল এয়ারবিএনবি। তবে জায়গাটা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, সুন্দর ও সুবিধা জনক। দর্শনীয় অনেক কিছুই কাছাকাছি।
দুপুরের খাওয়ার জন্য কাছেই ছিমছাম সুন্দর ক্যাফে পাওয়া গেল যার নাম ক্যাফে আর্টিজান। লাঞ্চ টাইম হওয়াতে ক্যাফের বাইরে পর্যন্ত স্যুটেট বুটেট মানুষের লাইন।
লাইন ধরে ধীরে ধীরে আমরাও ক্যাশিয়ারের কাছে পৌঁছে খাবার অর্ডার দিলাম। ক্যাফের মতই খাবার-দাবারও ভাল। পৃথিবীজোড়া এখন ভেজিটেবল ও অর্গানিক খাবারের জয়জয়কার। ওই ক্যাফেতে চমৎকার মাল্টিগ্রেইন নরম চ্যাপটা আকৃতির বনরুটি দিয়ে বানানো ভেজিটেবল স্যান্ডউইচ আমার কাছে দারুণ সুস্বাদু লাগলো। বনরুটিতে কোন গ্রেইন বা শস্য নেই! গ্রেইনের মাঝে তিল, তিসি, কালিজিরা তো আছেই, এমন কি মিষ্টি কুমড়ার বিচিও বাদ যায় নি। স্যান্ডউইচে ছিল বেগুন, মিষ্টি কুমড়া, সাদা মিষ্টি আলু, ক্যাপসিকাম আরও কত কি। স্পেনের খাবার বলার মতো না। তবে খাঁটী স্প্যানিস সুগন্ধি জাফরান দিয়ে রাঙ্গানো চিকেন পাইয়েইয়া (Paella) দেখলাম মানুষের খুব পছন্দ। প্যারিসে ঘরের কাছে বলে আমরা দুই বেলা ওই ঝকঝকে তকতকে ছিমছাম ক্যাফেতে খেয়ে নিতাম। রাতের খাবার ঘরে তৈরি হতো। তবে ফরাসী বা বাংলা খাবার নয়। সোজাসাপ্টা ইটালিয়ান খাবার; পাসতা রেঁধে সঙ্গে সাদা গোট চিজ, অলিভ, শসা, টমেটো দিয়ে গ্রীক সালাদ দিয়ে ডিনার।
প্রথম দিকে ক্যাশিয়ার মহিলা ও তার সহকারী তরুণী মেয়েটি হাসি বিহীন ব্যাজার মুখে অর্ডার নিত, এবং তেমনি গোমড়া মুখে খাবার এনে দিত। ফ্রেঞ্চ একটু জানি তাও ধন্যবাদ বলতেও মুখ খুলতাম না। শেষদিন ব্রেকফাস্টে দেখি বয়স্ক মহিলা চাঁদমুখ করে অর্ডার নিল এবং তরুণী সহকারীও হাত নেড়ে চোখে ঝিকিমিকি আলো ছড়িয়ে সম্ভাষণ জানালো। খাবার দেওয়ার সময়ও মেয়েটি হাসি হাসি মুখে বললো ‘সিলভু্য়্যা প্লে’ ‘বন এ্যাপেতিত’ ।
আমিতো হতভম্ব। আমার বিস্মিত চাউনি দেখে ছেলে বললো ‘দুই বেলার বাঁধা কাস্টমার দেখে ওদের মুখে হাসি শেষ হচ্ছে না, বুঝলে মামনি’। ভেবে দেখলাম তাইতো। চারজন মানুষের কাছ থেকে ওরা কম ইউরো তো হাতিয়ে নিচ্ছে না। তবে ব্যাজার মুখ হউক আর যাই হোক না কেন ফরাসীদের খাবার দেখতেও ভাল, খেতেও মজা।
ঘুরাঘুরি করতে বের হয়ে দেখা গেল পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বন্ধ। পুলিশ চারদিকে। প্যারিসের নামী দামী শপিং সেন্টার লা ল্যাফাইয়েলের সামনে স্ট্যানগান হাতে সৈনিকরা পাহারায়। কিসের জন্য এতো সতর্কতা! ন্যায়সঙ্গত পেনসন দাবীদাররা কি এতোই ভয়ংকর যে তাদের তাড়ানোর জন্য স্টেনগান-ধারী দরকার? নাহ তা নয়। এটা হচ্ছে ‘সন্ত্রাসী’ দমনের জন্য।
আগুনে পুড়ে যাওয়া নোটরড্যাম গির্জা তখনও অর্থাৎ ডিসেম্বর ২০১৯ শেও দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত হয়নি। বাইরে থেকে ঘুরে ঘুরে দেখলাম, আর ছোটবেলায় পড়া ভিক্টর হুগোর চরিত্র ‘হাঞ্চব্যাক অব নোটারড্যাম’কে কল্পনায় খুঁজলাম।
নোটরড্যাম গির্জার পর ল্যুভ আর্ট গ্যালারী হচ্ছে গন্তব্য। হাঁটা হয়েছে অনেকটা। এবার কাছের শপিং মলের ঝলমলে এক ক্যাফেতে কফি আর সুস্বাদু ফ্রেঞ্চ ক্রোসো খাবার ইচ্ছা হল। খাওয়ার শেষে মনে হল প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে তবেই আর্ট গ্যালারীতে যাত্রা হবে বুদ্ধিমানের কাজ। ওখানেও তো হাঁটতে হবে। সামনেই আসছে ক্রিস্টমাস তাই শপিং মলের ভিতর আলোর বন্যা বইছে। টয়লেটেও তাই। আলো ঝলমল টয়লেট ব্যবহার করতে হলে এক ইউরো যথেষ্ট নয় দিতে হবে এক ইউরো দশ। সেভিল, মাদ্রিদ, গ্রানাডাতে টয়লেটে যেতে এক ইউরোর বেশী কখনোই দিতে হয়নি। সেভিলে গাড়ীর চালক ঠিকই বলেছিল প্যারিসে সবই দাম।
ল্যুভ গ্যালারিতে যেতে যেতে দেয়ালে লিওনার্দোর চিত্র প্রদর্শনীর পোষ্টার চোখে পড়লো। শুরু হয়েছে অক্টোবর ২০১৯এ চলবে ফেব্রুয়ারি ২০২০ পর্যন্ত। প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছে দা ভিঞ্চির মৃত্যুর পাঁচশত বছর পূর্তি উপলক্ষে। এই প্রদর্শনীতে ‘মোনালিসা’তো থাকবেই। তবে নিশ্চিত জানি লিওনার্দো দা ভিঞ্চির ‘সালভাতর মান্দি’(ল্যাটিন ভাষায় ‘সেভিয়র অব দ্যা ওয়ার্ল্ড’) শিরোনামের চিত্রকর্মটি এখানে থাকবে না। প্রথমত: দা ভিঞ্চির বিখ্যাত ১৫/২০টি চিত্রকর্মের মধ্যে এই শিল্প কর্মটিই ব্যক্তি মালিকানায় ছিল ও আছে। দ্বিতীয়ত: নিউ ইয়র্কের ক্রিস্টির ২০১৭র মার্চের অকশনে সর্ব্বোচ্চ মূল্যে বিক্রিত হওয়ার পর ‘সালভাতর মান্দি’কোথায় আছে তার হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না। এ পর্যন্ত যত চিত্রকর্ম পৃথিবীতে বিক্রি হয়েছে তার মধ্যে এটি ছিল সবচেয়ে দামী। এর বিক্রয় মূল্য হল ৪৫০,০০০,০০০ ইউএস ডলার!
এই চিত্রকর্মে দেখা যাচ্ছে রেনেসাঁর পোষাকে আশীর্বাদ দেয়ার ভঙ্গিতে এক হাত উত্তোলিত ও অন্য হাতে স্বচ্ছ ক্রিস্টাল বল হাতে যীশু। দীর্ঘদিন প্রায় সবার অজান্তে অন্তরালে ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে পড়ে থাকায় পরে অনেক যত্নে সাফাই ও তার আগে পাঁচ জন ভিঞ্চি শিল্পকর্মের বিশেষজ্ঞ একত্রিত হয়ে চিত্রটি আসলেই দা ভিঞ্চির অংকিত কিনা সে নিরীক্ষা করেছিলেন। আসল কি নকল সে অন্য বিতর্ক। পুনরুদ্ধার কর্ম সম্পাদন শেষে ‘সালভাতর মান্দি’কে ২০১১ সালে লন্ডনে এক প্রদর্শনীতে উপস্থাপন করা হয়। কথা হল এতো দাম দিয়ে শিল্পকর্মটি কে কিনলো? শোন যায় দুবাইয়ের সাংস্কৃতিক মন্ত্রী ক্রিস্টির অকশনে রেকর্ড মূল্যে এটি কিনেন। আর তা কেনা হয়েছিল দুবাইয়ে ল্যুভ গ্যালারীর জন্য। যা জনমানুষের জন্য প্রদর্শিত হওয়ার কথা। কিন্তু পরে বাতাসে ভেসে বেড়ানো ফিসফিসানিতে শোনা যাচ্ছে এই শিল্প কর্ম এক সৌদি রাজপুত্র দুবাইয়ের মন্ত্রীর মাধ্যমে আড়ালে থেকে কিনিয়েছেন।
বলা হয় এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে দা ভিঞ্চির ও অন্য সব ঐতিহাসিক শিল্পকর্মের উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের কায়দাকানুন প্যারিসের ল্যুভ মিউজিয়ামেরই যথাযথ ভাবে জানা। অথচ দেখভালের যোগ্যতা থাকলেও ল্যুভের হাতে ওই চিত্রকর্ম আসেনি। শিল্পকর্ম ‘সালভাতর মান্দি’ নাকি রাজপুত্রের বিলাসবহুল ব্যক্তিগত প্রমোদ তরীর সিঁড়ি সংলগ্ন দেয়ালে ঝুলানো আছে। দা ভিঞ্চির কথা বলতে বলতে পৌঁছে গেলাম ল্যুভের কাছে। সেভিলের লা স্পানার চেয়েও অনেক বড় চত্বর ল্যুভের সামনে।
চত্বরের শেষে যেখানে টিকেট দিয়ে ঢুকতে হয় তার খানিকটা পরে নব্বইয়ের দশকে ল্যুভের সামনে নির্মিত তিনটি স্বচ্ছ পিরামিড আকৃতির স্থাপনা । মাঝখানেরটি বড়, দু’পাশে দুটি ছোট। ওই পিরামিডের পরে ল্যুভের প্রবেশ পথ। কপাল ভাল বলতে হবে যে মাইনাস টেম্পারেচারের মাঝেও সূর্য দেখা দেওয়াতে পিরামিডের স্বচ্ছতা সাদামাটা ক্যামেরায়ও ধরা পড়লো।
এর পরেই দেখা হবে মিউজিয়ামের ভিতরে অপেক্ষমাণ শত শত বছরের প্রাচীন সব ম্যাজিক। তুলির আঁচড়ে ক্যানভাসে উদ্ভাসিত সে সব ম্যাজিকের গল্প আরেক সময়ে বলা যাবে।
আগের অংশ
দিলরুবা শাহানা, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
|