দিলরুবা শাহানা
(এই কাহিনীর সূত্রপাত পত্রিকান্তরে প্রকাশিত পুরাকীর্তি পাচার সংক্রান্ত কিছু খবর ও একবার কোন এক এয়ারপোর্টে কেউ একজনের ভয়ংকর ঝামেলায় জড়ানোর অভিজ্ঞতার বয়ান থেকে।)
ইমরুল অপেক্ষা করে করে অধৈর্য। বিরক্ত, বিভ্রান্তও সে। এমনটাই হওয়ার কথা। যে কোন আত্মসম্মান জ্ঞানী মানুষের জন্য এমন এক সম্ভ্রান্ত ক্যাফেতে চা-কফির অর্ডার না দিয়ে হাবার মত বসে থাকা চরম অস্বস্তিকর। ক্যাফের বাইরের চত্বরে এই ঠাণ্ডায়ও স্ট্যান্ডের জ্বলজ্বলে গ্যাস হিটার মাথার উপর উষ্ণ নিঃশ্বাসের মত উত্তাপ ছড়িয়ে দিচ্ছে। ইমরুলের পক্ষে চট করে উঠে যাওয়াও সম্ভব নয়। সে তো একজনের জন্য অপেক্ষা করছে। যখন সে দুশ্চিন্তায় ব্যাকুল তখনি ক্যাফের ওয়েট্রেস, যে আগেও দু’একবার ইমরুলকে ডায়ানের সাথে দেখেছে, এসে পাশে দাঁড়ালো। মেয়েটি ইমরুলের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো -ডায়ান উইলস তো গত শুক্রবারে মারা গেছেন, তুমি জান না? মেয়েটির গলায় বিস্ময় মেশানো প্রশ্ন। ইমরুলের উত্তর তক্ষুনি চলে এল এবং যা সত্যি -শহরের বাইরে ছিলাম তো তাই জানতে পারিনি। ওয়েট্রেস ধরেই নিয়েছে যে ইমরুল ডাই বা ডায়ানের অপেক্ষা করছে। মহিলার মৃত্যুর খবর শুনে ইমরুলের মুক্তির আনন্দ হল। ডানা থাকলে এখনই সে উড়ে যেতো। তবে অভিজাত স্যুটে আচ্ছাদিত ইমরুল পোশাকের কারণেই ধীর-স্থির ভাবে টেবিল ছাড়লো। ততক্ষণে মেয়েটি আরেক টেবিলে গিয়েছে অর্ডার নিতে। খুব দ্রুত ইমরুল ক্যাফের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে বড় রাস্তায় চলে আসলো।
আহা খুব আনন্দ হচ্ছে ইমরুলের। ওর মনে হচ্ছে সে যেন এক যাদুকরী মায়াবিনীর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। বাদামী চামড়া, চৌকো মুখাবয়বের দীর্ঘদেহী পুরুষ ইমরুল কপালে ঝুঁকে পড়া চুলগুলো সামান্য মাথা ঝাঁকিয়ে পিছনে ঠেলে দিল। চকচকে কালো চোখে নীল আকাশ দেখলো। দ্রুত বাসস্টপের দিকে পা চালালো। গাড়ী নিয়ে সে এখানে আসেনি। ভয় যদি কেউ গাড়ী দেখে ফেলে প্রশ্ন করবে অফিসের সময়ে তার গাড়ী এই এলাকাতে কি করছে? গত দু’মাসে কয়েকবার সে এই ক্যাফেতে এসেছে। অফিস ডে হলে নানা কাজের ছুতানাতা দেখিয়ে সে এখানে হাজিরা দিয়েছে। ওই দুষ্টু নারী একদিন যেমন ছিল ইমরুলের বিপদ-তাড়িনী এখন তেমনি কি এক রহস্যময় কারণে তার কাঁধে চেপে বসেছে। কারণ কি সে জানে না। মহিলার মৃত্যুর খবরে স্বস্তি ফিরে পেয়ে এলাকাটার চারদিক দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছে ইমরুল। দেখলো রাস্তার পাশেই টু ডলার শপের মত কান্ট্রি রোড ও আরও নামীদামী ব্রান্ডের দোকান। দেখে অবাক হল! তক্ষুনি মনে পড়লো এটা বড়লোকদের পাড়া। তাদের সুবিধার জন্য ঘরের দুয়ারে দোকান সাজিয়ে বসেছে এরা। এখানেই পৃথিবী-খ্যাত ক্রিকেট খেলোয়াড় শেইন ওয়ার্নের বাসস্থান। শেইন ওয়ার্নের কথা মনে পড়তেই একটা মিশ্র অনুভূতি জাগলো মনে। ওই হতভাগা ক্রিকেটারের প্রতি মায়ার টানেই সে কাদায় পড়েছিল একদিন। নাকি খেলোয়াড়ের প্রতি আগ্রহ দেখানোতেই সেদিন বড় বিপদ থেকে বেঁচেও গিয়েছিল? কি কুক্ষণে যে সেবার ওই রহস্যময় ব্যাগ, এক কেতাদুরস্ত অভিজাত নারী আর পুলিশী ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিল ইমরুল তা এক আল্লাহ-মাবুদ জানে।
সে এক মজার ঘটনা। লটারিতে প্লেনের টিকেট জিতেছিল ইমরুল। সেই বিনা পয়সায় বিমান ভ্রমণের জন্য এয়ারপোর্টে প্লেন ধরতে আসা। ইমরুল চুইংগাম চরিত্রের মানুষ। ছোটছুটি করে দেশদেশান্তরে ঘুরে বেড়ানো ওর ভাল লাগে না। বউ গেল দেশে একমাত্র ভাইয়ের বিয়েতে। ছুটি পেল না বলে ইমরুলের যাওয়া হলো না। তখন বউ তাকে জোর করে দু’দিনের জন্য নিখরচায় প্লেনে ঘুরে আসতে উৎসাহিত করলো। তো সে উৎসাহের জেরে গোল্ডকোষ্টে যাবে বলে রওয়ানা দিল। এক জায়গায় আঠার মত লেপটে থাকা ইমরুল এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে বসে ক্রিকেট জার্নাল পড়ছিলো কখনো বা মনোযোগ দিয়ে মোবাইল ফোনে কিছু ঘাটাঘাটি করছিল। হঠাৎ মনে হল নিঃশব্দে কেউ একজন ওর কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। চোখ তুলে তাকাতেই দেখে ছন্নছাড়া কিসিমের এক লোক। হাতের ব্যাগটা ইমরুলের পায়ের কাছে রেখে বললো -ব্যাগটা একটু দেখবে, আমি একটু যাচ্ছি আঙ্গুলের ইঙ্গিতে ওয়াশরুম দেখালো। বলেই ইমরুলের সম্মতির তোয়াক্কা না করে দ্রুত সরে গেল। ইমরুল ভাবলো হয়তো লোকটির জোর টয়লেট পেয়েছে তাই সম্মতি ছাড়াই ওদিকে ছুটে গেল। এবার চারদিকে সে ভাল করে তাকিয়ে দেখলো। এই মুহূর্তে লোকজন তেমন নাই। একমাত্র ওর এক আসন পরে বসা মহিলাটি ছাড়া। যার কাছ থেকে পাওয়া জার্নালটির কারণে ইমরুল এখনো এখানে বসে আছে। লোকটির ব্যাগ রেখে যাওয়ার ঘটনায় মহিলাকে একটু যেন নাখোশ মনে হল। চেহারায় বিরক্তি নিয়ে ইমরুলের দিকে তাকাচ্ছেন। অকরণে অসুখী চেহারা বানিয়ে বসে আছেন। কার উপর বিরক্তি? ইমরুল নাকি ওই হতশ্রী ব্যাগওলার উপর? ইমরুল অবশ্য মহিলার অস্তগামী বয়স, রুচিশীল আভিজাত্য মেশানো পোশাক, বিশাল অবয়ব, মায়াময় চেহারাতে আকৃষ্ট হয় নি। সে আকৃষ্ট হয়েছিল মহিলার হাতে ক্রিকেট জার্নালটার প্রতি। মলাট জুড়ে শেইন ওয়ার্নের ছবি। ছবির দিকে ওকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মহিলা জার্নালটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন -শেইন ওয়ার্নকে পছন্দ কর? নাও ধর, পড়। ও আমার প্রতিবেশী। ধন্যবাদ দিয়ে জার্নালটি নিল। ভিতরের মলাটে কলম দিয়ে লেখা ডায়ান উইলস। সে জার্নাল পড়া শেষ করে আবার ধন্যবাদ বলে ফেরত দিল। এবার সে ওই লোকের রেখে যাওয়া ব্যাগটা আরও একটু কাছে এনে রাখার জন্য যেই ঝুকেছে অমনি চাপা তবে তীক্ষ্ণ গলায় মহিলা বলে উঠলেন -কেন ধরছো ওটা। ও নিয়ে যাবে এসে। জান তো এয়ারপোর্টে অপরিচিত মানুষের জিনিসের দায়িত্ব নিতে হয় না। ইমরুল ভাবলো সে কালো বা বাদামী বলে মহিলা তাকে লোভী ভাবছে হয়তো। মনটা খারাপ হল। তবে আরেকটা কথা ভেবে তার ভাল লাগলো যে মহিলার জাত ভাই সাদা লোকটি তো ওকে বিশ্বাস করে ব্যাগটা তার কাছে রেখে যায় নি। ভিন-জাতের হলেও তাকেই দায়িত্বটা দিয়ে গেছে। মানুষকে মানুষ কেন যে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে ভেবে পায় না। তবে এসব নিয়ে মাথাও তেমন ঘামায় না। তার বউ অবশ্য মানুষকে অপমান. অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য করাকে দারুণ অপছন্দ করে। বউটি নিজে কাউকে কখনোই অসম্মান করে না। এমন কি দজ্জাল শাশুড়ি, ড্রাইভার বা কাজের বুয়া কাউকে নয়। আর এখানে গায়ের রং সাদা বলে এদের কেউ কেউ নিজেকে মহার্ঘ কিছু ভাবে। যদিও খোলামেলা ভাবে বিদ্বেষ দেখানোটা এখানে অভদ্রতা। তবে এটা সত্যি যে সূক্ষ্মভাবে অপমান না হলেও অবজ্ঞা করার চোরা-স্রোত বয়ে যায় কখনো সখনো। ইমরুল ভাবে এদেশে আয়েসি, নিরুপদ্রব জীবন কাটানোর বিনিময়ে ওই সব অবজ্ঞা অবহেলা বা না দেখার ভান করলেই কষ্ট এড়ানো যায়। পাত্তা না দিলেই যারা এটা করে খেপানোর চেষ্টা করে তারাই হতাশ হবে। ইমরুলের বউ একবার নামীদামী রেস্টুরেন্টে খ্রীস্টমাস পার্টি সেরে ফিরে তেমনি এক ব্যাপার নিয়ে বিরক্তি ঝাড়ছিল। যা ইমরুল খেয়ালই করে নি বা ইচ্ছা করেই না দেখার ভান করেছে। পার্টিতে মাঝবয়সী এক ওয়েট্রেস ভিক্টোরিয়ান নকশার ফ্রিল লাগানো এপ্রোন ও সাদা টুপি পরে খুড়াওলা প্লেটে মুচমুচে নানা খাবার নিয়ে ঘুরছিল। কখনো দাঁত বের করে, কখনো ঠোঁট টিপে হেসে লোকজনের সামনে প্লেট ধরছিল। কেউ ধন্যবাদ দিয়ে টুথপিকে গাথা সামান্য খাবার তুলে নিলে সে তাকে ‘বো’করে ঘুরে আরেক জনের কাছে যাচ্ছিল। মনোরম ভঙ্গিতে ক্লান্তিহীন ভাবে ‘ওয়েল কাম’ আর ‘বো’ করেই যাচ্ছে। এক সময়ে সেই মহিলা ক্রিস্টাল গ্লাসে প্যাশনফ্রুট জুস, ম্যাংগো জুস ট্রেতে করে নিয়ে এলো। ইমরুলের বউ ধন্যবাদ বলে প্যাশনফ্রুট জুস যখন নিল ওয়েট্রেস না বললো ‘ওয়েল কাম’ না করলো ‘বো’। একমাত্র ইমরুলরাই ছিল ওই কর্পোরেট পার্টিতে বাদামী চামড়ার লোক। বউয়ের ক্ষোভ শুনে ইমরুল বললো -ওই সাদা মহিলার নিশ্চয়ই মন চাইছিলো না শাড়ী পরা বাদামী-চামড়ার তোমার মত মেয়েকে খেদমত করতে। বেচারি কাজ করে ওয়েট্রেসের তোমাকে জুস সার্ভ না করেতো তার উপায়ও নাই। যেটুকু পারলো সামান্য অবজ্ঞা করার সুযোগটুকুই নিল। জান বেচারির জন্য আমার মায়া হচ্ছে। ইমরুলের ব্যাখ্যা শুনে আস্বস্ত হয়েছিল বউ। ভাবনাচিন্তা ছেড়ে প্লেনে চড়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো ইমরুল। তখনই সিকিউরিটির দু’জন লোক হাজির হল। তারা এতো কাছে এসে দাঁড়িয়েছে যে তাদের শ্বাস প্রশ্বাস ইমরুলের গায়ে লাগছিলো। একজন বললো -তোমার কাছে চোরাইমাল আছে খবর পেয়েই এসেছি। চল আমাদের সাথে। বলেই একজন ইমরুলের হ্যান্ড লাগেজ তুললো। অন্যজন তুললো ওই লোকের রেখে যাওয়া ব্যাগটা। ইমরুল বিস্ময়ে বিমূঢ়। কোনমতে বলতে পারলো -ওই ব্যাগ আমার নয় -ওই রকম কথা সব চোরাকারবারিই বলে। ইমরুলের গলা ততোক্ষণে শুকিয়ে কাঠ কাঠ। ওদের সাথে এয়ারপোর্টের নিরাপত্তা অফিসে পৌঁছে দেখে ওখানে আরও দু’জন হোমড়া-চোমড়া লোক বসে। নানা প্রশ্ন ওদের। প্রশ্নের ধাক্কায় বেকুব ইমরুল। ওরা জানালো বাংলাদেশ থেকে পুরাকীর্তি চোরাপথে বিদেশে পাচার হয়ে এসেছে। পৃথিবীর নানা দেশের এয়ারপোর্টে ইন্টারপোল তা উদ্ধারের চেষ্টায় তৎপর। মেলবোর্ন এয়ারপোর্টে হাজার বছরের পুরানো কষ্টিপাথরের বিষ্ণুমূর্তি এসেছে এমন তথ্য তাদের কাছে আছে। দুর্বল গলায় ইমরুল বললো -বাংলাদেশের পত্রিকাতে পড়লাম ক্রিমিনালরা ওই মূর্তি ভেঙ্গে ফেলেছে! তাদের একজন বললো -শোন ওসব ওদের চাল। নকল মূর্তি ভেঙ্গে আবর্জনার গাদায় ফেলেছে। সরকার, জনগণ সবাই যখন ময়লা ঘাঁটছে মূর্তির ভাঙ্গা টুকরা উদ্ধারের জন্য তখন তা পাচার হয়ে এখানে এসে গেছে। একজন তখন ব্যাগ খুলে কাপড় মোড়ানো দুটি মূর্তি বের করে। টেবিলে মূল্যবান মূর্তি দুটি রেখে কর্তাব্যক্তি কঠিন গলায় জানতে চাইলো -এই ব্যাগ যে তোমার না তার কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে? হঠাৎ আলোর ঝলকানির মত ইমরুলের সে বিরক্তি মাখানো মুখটা মনে পড়লো। আগুপিছু না ভেবে সে বললো -আছে। ডায়ান উইলস। উনি আমার সাক্ষী। থাকেন ব্ল্যাকরকে শেইন ওয়ার্নের বাড়ীর পাশে। ওর প্রত্যয়-পূর্ণ উত্তর শুনে সিকিউরিটি অফিসার বিস্মিত। ইমরুলের চিন্তা হল ডায়ান নামের মহিলা বলবে কি যে ব্যাগটা অন্য একজন রেখে গিয়েছিলো। ওরা মহিলাকে ঠিকই নিয়ে আসলো। অবাক হয়ে ইমরুল দেখলো ডায়ান উইলস ইমরুলের পক্ষে দারুণ সাফাই গাইলেন। একধাপ এগিয়ে গিয়ে ইমরুলের দিকে তর্জনী তুলে বললেন -ওই বোকা লোক ব্যাগটা কাছে এনে রাখতে চেয়েছিল; আমিই ওকে নিষেধ করলাম। মনে হল মহিলা দারুণ দাপুটে তা না হলে নিরাপত্তা রক্ষীরা সহজে ইমরুলকে ছাড়তো না। পুলিশের হাত রেহাই পেলেও ডায়ান ইমরুলের কাঁধে সিন্দাবাদের ভুতের মত চেপে বসলেন। সেদিনই এয়ারপোর্টে ইমরুলকে নিজের গাড়ীতে তুললেন। ওর সুবিধা জনক জায়গায় নামিয়ে দিয়ে পরের সপ্তাহে কফি খেতে দাওয়াত দিলেন। দাওয়াত তো নয় যেন হুকুম। কৃতজ্ঞ ইমরুল রাজী হল। কফি-শপের ঠিকানা লিখে দিলেন, সময় আর তারিখ লিখতে ভুললেন না। বাড়ীতে ঢুকে স্বল্পভাষী ইমরুল ভাবলো বউ এখন না থাকাতে বেঁচে গেছে। না হলে এত কাহিনী শুনাতে শুনাতে চোয়াল ব্যথা শুরু হত। বিনা পয়সার টিকেট কাজে লাগাতে পারলো না বলে বউ হাসবে, টিটকারি দেবে। তবে বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছে শুনে স্বস্তি পাবে। কফি খেতে ডাকা অন্যায়, অনৈতিক কোন আবদার নয়। তবে উদ্দেশ্য কি তাও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না।
শুধু সময় কাটানো, খোশগল্প করার জন্যই কি ইমরুলকে আমন্ত্রণ জানানো নাকি অন্য কিছু। এসব দেশে বিত্তবান বুড়োবুড়ি অদ্ভুত উপায়ে বিনোদন খুঁজে ফেরে। শুনেছে কোন কোন ধনী বুড়ো ক্লাবে যায় নগ্ন নর্তকীর নাচ দেখতে, কিছু কিছু বিত্তবান বুড়িও যায় তেমনি তরুণ নর্তকের নাচ উপভোগ করতে। এই বয়স্কা ধনী মহিলা কোন কিসিমের হবে কে জানে। অভিজাত ক্যাফেটা মহিলার পাড়ায়। কফি খেতে খেতে জানা হল মহিলা শিক্ষকতা করতেন। পিএইচডি করেছেন। বিষয়টা খটমটে। বিষয় ছিল ‘কলোনিয়ালিজম ও ন্যাশনাল হেরিটেজ’। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা নানা জাতির পুরাকীর্তি বিষয়ে মজার মজার সব গল্প শুনালেন। বললেন -জান, বেশীর ভাগ জিনিস নানা দেশ থেকে ব্রিটিশরা লুট করে এনেছে। তবে ওরা খুব যত্নে লুটের মাল দিয়ে প্রদর্শনী সাজিয়েছে, ওগুলোর উৎস কোথায় তাও লেখা আছে। আরও বললেন -ওই যে এয়ারপোর্টে কষ্টিপাথরের স্ট্যাচু দেখলে ওগুলো অর্থের লোভে ভারত বা বাংলাদেশ থেকে অসৎ মানুষ বিদেশে পাচার করেছে । ওগুলো তো মিউজিয়ামে যাবে না। যাবে কোন ধনী অহংকারী ব্যক্তির ব্যক্তিগত সংগ্রহে। এগুলো জাতির ঐতিহ্য, সৃজনশীল শৈল্পিক কীর্তির অংশ, যা মিউজিয়ামে থাকার কথা। ডায়ান ব্রিটিশ মিউজিয়ামে তোলা ছবি দেখালেন। একটি ছবি ইমরুলের কাছেও আছে।
ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত মোঘল রাজদরবারে ব্যবহৃত সোনার হুঁকা। স্বর্ণনির্মিত তিন নর্তকী হুঁকাটি তিনদিক থেকে ধরে আছে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সভাসদরা মানে উপদেষ্টারা যারা আজকের দিনের মন্ত্রীবর্গ তারা এই হুঁকা থেকে ধূমপান করতেন। ডায়ানের বলা ‘ঐতিহ্য লুট’ ‘সাংস্কৃতিক কীর্তি চুরি’ ইত্যাদি কথাতে ইমরুলের তেমন আগ্রহ নেই। পরবাসী মানুষ সে। দেশ যে ছেড়েছে সে তার দেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কতদূর কিইবা করতে পারবে? ব্রিটিশ মিউজিয়ামে ইমরুলও দু দু’বার গিয়েছে। সব দেখেশুনে তার মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠিকই লিখেছেন ‘রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙ্গালের ধন চুরি’। তবে ঔপনিবেশিকদের কীর্তি দেখে ‘কাঙ্গালের ধন’ না বলে ‘নিরীহের ধন’ বলাই ঠিক হত।
ভাবতে ভাবতে ইমরুলের বাস এসে গেল। ওয়ালেট থেকে টিকেট বার করতে গিয়ে ঘড়ি মেরামতের দোকানের রিসিট চোখে পড়লো। ডায়ানের স্মৃতি উসকানো এই রিসিট। আবারও সে ভাবনায় পড়লো। গত সপ্তাহে মহিলা তার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া পুরান ওমেগা ঘড়িটি ইমরুলকে দিয়ে বলেছিলেন -তুমি তো সিটিতে অফিস কর ঘড়ি মেরামতের দোকানটা ওখানেই। যদি এটা ওই দোকানে দিতে পার উপকার হয়। ব্যাপারটা তেমন ভাল লাগেনি। তবে মহিলার প্রতি কেমন একটা মায়া জন্মাতে শুরু করেছে। হয়তো তার আপনজন কেউ নাই। স্বামী-সন্তান ছিল কি কোনদিন? জানা হয় নি ইমরুলের। সহমর্মিতা থেকেই ঘড়ির দোকানে গেল। দোকানে গিয়ে ঘড়ির ইতিহাস জেনে হতবাক। ঘড়িটা একশ’পচিশ বছরের পুরানো। ওমেগা কোম্পানি প্রায় এক শ’ ষাট কি সত্তর বছর ধরে ঘড়ি বানাচ্ছে। ডায়ানের ঘড়িটা দুষ্প্রাপ্য। কারণ সে সময় কোম্পানি এই ধরনের মাত্র ১০টি ঘড়ি তৈরি করেছিল যাকে বলে লিমিটেড এডিশন। দশটি ধনী ও বনেদী পরিবার ঘড়িগুলো কিনে নিয়েছিল। ডায়ানের পরিবার তাদের একটি। যতোই শুনছে ইমরুল ততোই চমৎকৃত হচ্ছে। শেষে এসে দোকানী বললো -ঘড়ি সারাই হয়ে গেলে আমরা ডায়ান উইলসকে জানাব। তোমাকে পাঠালে এসে নিয়ে যেও। দোকানীর কথা শুনে ইমরুল মনক্ষুন্ন হল। কি আশ্চর্য দোকানী ধরেই নিয়েছে সে ডায়ানের কর্মচারী! তাতে ইমরুলের মন ডায়ানের উপর তেতে উঠলো। আজ রিসিট হাতে নিয়ে ইমরুল ভাবছে কেন মহিলা তাকে এই ঘড়ির দায়িত্ব দিলেন। এটা কি তার সততা পরীক্ষা করার চেষ্টা; না আর কোন উদ্দেশ্যে? ইমরুল রিসিটটা এবার কুচি কুচি করে ছিঁড়ে বাসের জানলা দিয়ে ফেলে দিল। এই কাগজের সঙ্গে ইমরুলের জীবনের এক বোকামির অধ্যায় শেষ হল। একই সাথে ডায়ান নামের একজনের স্মৃতিও মুছে গেল। সে ভাবলো আর কোনদিন কারও দিকে সাহায্যের হাত বাড়াবে না।
কিছুদিন পর পত্রিকাতে ডায়ান উইলসের অবিচুয়ারি চোখে পড়লো। তার ছবি এবং সেই ওমেগা ঘড়ির ছবিও রয়েছে। লেখা হয়েছে ডায়ানের উইলে ওই ওমেগা বিক্রির টাকা ইউনেস্কোকে দান করতে বলা হয়েছিল । লন্ডনের অকশন হাউজে বিরাট মূল্যে ঘড়িটি বিক্রি হয়েছে। ডায়ানের উইল অনুযায়ী ইউনেস্কো ওই টাকা অনুন্নত দেশে শিক্ষা-সংস্কৃতির অগ্রগতির জন্য খরচ করবে। খবরটা পড়ে ইমরুলের মনে হল এই বিদুষী মহিলা হয়তো ভেবেছেন শিক্ষা, সাংস্কৃতিক উন্নয়নই মানুষকে সু-মানুষ করে, নিজেকে সম্মান করতে শেখায়। তারা হয়তো তখন ব্যক্তিগত স্বার্থে নিজ দেশের ঐতিহ্যমন্ডিত পুরাকীর্তি বিদেশে চোরাকারবারিদের হাতে তুলে দেবে না।
(শিরোনামে ব্যবহৃত চিত্রটি পত্রিকা থেকে সংগৃহীত। গল্পের ভিতরের চিত্রটি ব্রিটিশ মিউজিয়াম থেকে লেখক কর্তৃক গৃহীত)
‘চুরি যাওয়া ১৪টি মূল্যবান প্রত্ন সামগ্রী অবশেষে ভারতকে ফিরিয়ে দিচ্ছে অস্ট্রেলিয়া। প্রাচীন সম্পদগুলো অধিকাংশই চুরি যাওয়া অথবা চোরাচালানকারীদের হাত ঘুরে বিদেশে পাচার হয়। মহামূল্য প্রত্ন সম্পদ কীভাবে ভারত থেকে গায়েব হয় তা অজানাই রয়ে গেছে’। সূত্র: https://www.banglatribune.com/693195 বিদেশ ডেস্ক ২৯ জুলাই ২০২১
দিলরুবা শাহানা, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
|