bangla-sydney













আইন ও সমাজ প্রেক্ষিতে পরিবেশ-দূষণ ও ছোটরা
দিলরুবা শাহানা



লেখিকা
এল এল এম (কিয়েভ স্টেট ইউনিভার্সিটি, প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন)
এম এস সি (LSE লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিক্স, যুক্তরাজ্য)
পেশাগত অভিজ্ঞতা: আইনবিদ, ব্র্যাক হিউম্যান রাইটস এন্ড লিগ্যাল এডুকেশন প্রোগ্রামের প্রধানের দায়িত্ব পালন, অস্ট্রেলিয়ায় এসবিএস রেডিওর মেলবোর্ন প্রতিনিধি,
সমাজকর্ম: বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড সেলের প্রধানের কর্ম সম্পাদন, সদস্য আইন শালিস কেন্দ্র, সদস্য বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট নেটওয়ার্ক

(জার্মানিতে কয়লা খনির পরিধি বিস্তারের জন্য একটি লোকালয়ের আবাসন ভাঙ্গার প্রতিবাদে সমবেত পরিবেশ কর্মীরা পুলিশের হাতে আটক হন তাদের মাঝে পরিবেশ কর্মী সুইডেনের মেয়ে গ্রেটা থুনবার্গও ১৬ই জানুয়ারি ২০২৩ আটক হন। তবে পুলিশ তাকে পরে ছেড়ে দেয়। খবরটি গ্লোবাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচার হয়। বাংলাদেশের ইত্তেফাক ও ভারতের আনন্দ বাজার পত্রিকাতেও তৎক্ষণাৎ সংবাদটি ছাপা হয়। গ্রেটা থুনবার্গ যখন ১৩বছরের বালিকা তখন থেকে বিশ্ব নেতাদের পরিবেশ বাঁচানোর জন্য পদক্ষেপ নিতে দাবী ও আহ্বান জানাচ্ছেন। লেখাটি গ্রেটা থুনবার্গের সম্মানে)


গুরুত্বপূর্ণ শব্দাবলী(Key Words): পরিবেশন চেতনা, জলবায়ু উষ্ণায়ন, শিশু-কিশোর, আইন ও সমাজ

ভূমিকা: জলবায়ুর উষ্ণায়ন বা ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বিশ্ব পরিবেশের আওতাধীন সমগ্র প্রাণীজগৎ ও জীবন ধারণের প্রায় সব কার্যক্রমকে বিপন্ন করে তুলেছে। সোজা সরলভাবে বলা যায় পরিবেশের অন্তর্ভুক্ত পাহাড়-পর্বত, বন-জংগল , সমতলভূমি, সাগর-মহাসাগর, নদীসহ সবরকম পানির উৎস এবং এসব কিছুর উপর নির্ভরশীল প্রাণীকুল ইত্যাদি সব। একটি সত্য সর্বজন স্বীকৃত যে পরিবেশ দূষণে মানুষের কর্মকাণ্ডই মূলত: দায়ী। এই প্রবন্ধে মানব সমাজের উল্লেখযোগ্য অংশ শিশু-কিশোর ও তাদের উপর পরিবেশ দূষণের প্রভাব, পারস্পরিক সম্পৃক্ততা ও ছোটদের জীবনে প্রভাব বিস্তারকারী যে কোন বিষয়ে শিশু কিশোরের মতামত দানের বা বক্তব্য রাখার আইনগত অধিকার নিয়ে আলোচনা। এই আলোচনায় ইতোমধ্যে সংঘটিত বিষয়াবলীর পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনার প্রেক্ষিতে ছোটদের পরিবেশ বাঁচাও কার্যক্রমে অংশগ্রহণের অধিকার ও দায়িত্ব বিষয়ে কিছু প্রস্তাবনা উপস্থাপন।

পনেরো বছরের কম বয়সীরা প্রায় সমগ্র বিশ্বের জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশ। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশেও জনসংখ্যার শতকরা পঁচিশ ভাগের বেশী হচ্ছে পনেরো বছরের কম বয়সী শিশু কিশোররা। বলা বাহুল্য জনসংখ্যার প্রতিনিধি ছোটদের কোন কাজে সম্পৃক্ত করলে তারা হতে পারে পরিবর্তনের বাহক বা দূত এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর বিষয়ে সরব হয়ে ইতিবাচক প্রভাব আনতে পারঙ্গম হবে তারাই। এ বিষয়ে মহাত্মা গান্ধীর কথা স্মরণ করা যেতে পারে ‘You must be the change you wish to see in this world’।

জলবায়ু পরিবর্তন শুধু মানুষের জীবন, জীবিকা ও শারীরিক সুস্থতা ইত্যাদি বিষয়কেই নয় সমগ্র প্রাণীজগতের অস্তিত্বকে বিপদের মুখে ফেলে দিয়েছে। স্বাভাবিক ভাবে শিশু-কিশোররাও জলবায়ু দূষণের শিকার। সমগ্র মানব সমাজ যখন বিপন্ন তখন ছোটরাই বা রেহাই পাবে কি ভাবে?
প্রশ্ন তাই পরিবেশ-দূষণ নিয়ে কথা বলা, সুস্থ পরিবেশ রক্ষা করা. স্বাস্থ্যকর পরিবেশ গড়ে তোলা জ্ঞানী,গুণী, পন্ডিতব্যক্তিবর্গ ও বিজ্ঞানীদের কাজ কি শুধু? স্বাস্থ্যকর বায়ুতে নিঃশ্বাস কি তারাই নেবেন? স্বচ্ছ পানি পান তারাই কি করবেন? বিষয়টা ঠিক তা নয়। ধরা যাক একই সময়ে কোন এক শহরের বিত্তশীল শিক্ষিত আবাসনে ও রেল লাইনের বস্তিতে জন্ম নিল দু’টি শিশু। যদিও দু’টি শিশুর মাঝে জন্মেই প্রাপ্ত নানা সুযোগ সুবিধা ও উপকরণে থাকবে বিস্তর ব্যবধান। জন্মেই বিত্তবান পরিবারের শিশুটি সুখকর, সুন্দর নানা উপকরণ পেয়ে যাবে আর রেল লাইনের বস্তিতে জন্ম নেওয়া শিশুটির ভাগ্যে এর সামান্যও জুটবে না। দু’জনের মাঝে মিল একটিই একই দূষিত বাতাসে তাদের বাঁচতে হবে। তাইলে কেন কেবল বিজ্ঞানী, নীতিনির্ধারক, নীতি বাস্তবায়নকারীরাই নির্মল বায়ুর সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করতে প্রাণপাত করে কাজ করে যাবেন?
পরিবেশ দূষণ সর্বজনীন বৈশ্বিক সমস্যা। এই সমস্যায় সবাই কোন না কোন ভাবে জর্জরিত অর্থাৎ এটি সবার সমস্যা।
এই সমস্যা বুঝতে, এর দূরীকরণে রাষ্ট্র-যন্ত্র থেকে রাস্তার শিশু সবাইকে জড়িত করতে হবে বা করা দরকার। কেউ হয়তো বিস্মিত হয়ে বলবেন ‘শিশু? সে কি বুঝবে পরিবেশ কি বা পরিবেশকে সুস্থ রাখা দরকার কেন?’
আছে দরকার। পরিবেশ সচেতনতা ছোটদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া অত্যন্ত জরুরী। শিশুদের সচেতন করার ফলাফল হবে বেশী কার্যকর।
পাথুরে মাটিতে বীজ বুনলে ভাল ফল পাওয়া যায় কি? যায়না। অবশ্যই যাবে না। তাইতো চাষীভাই জমিতে মই দিয়ে শক্ত মাটির ঢেলা ভেঙ্গে ঝুরঝুরে করে বীজ বুনে বুনে যায়। কারণ নরম মাটিতে বীজ ছড়ালে চারা তাড়াতাড়ি জন্মায় বা গজায়। পরিবেশ সচেতনতার বীজও ছড়াতে হবে নরম মাটিতে। সে নরম মাটি হচ্ছে শিশু কিশোররা।

পরিবেশ আলোচনার শুরু ও চলমানতা:
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের তুমুল ধ্বংসযজ্ঞের পর যখন বিশ্ব সমাজে তুলনামূলক শান্তি, স্বস্তি বিরাজমান তখনই উন্নতির লক্ষ্যে জাতি সংঘ ও তার অন্যান্য অঙ্গ-সংগঠন সদস্য রাষ্ট্র সমূহের সহায়তায় ও উদ্যোগে গঠনমূলক কর্মকাণ্ড শুরু করে। এই লক্ষ্যে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের (১৭ আগস্ট-৬ সেপ্টেম্বর ১৯৪৯) বৈজ্ঞানিক কনফারেন্স ছিল কনজারভেশন এন্ড ইউটিলাইজেশন অব রিসোর্সেস। যা ছিল প্রথমবারের মত জাতিসংঘের উদ্যোগে সম্পদ সংরক্ষণ ও ব্যবহারের বিষয়ে আন্তর্জাতিক কনফারেন্স। সম্পদ আহরণ বা আয়ত্তে আনা ও তার ব্যবহারই করাই ছিল এই কনফারেন্স বা সম্মেলনের মুখ্য বিষয়। সংরক্ষণ তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না((সূত্র:From Stockholm to Kyoto: A Brief History of Climate Change by Peter Jackson,Chief Editor of the Yearbook Unit of the UN department of Public Information)।
পরবর্তী সময়ে শত বছরের বোধগম্য ধারনা ক্লাইমেটোলজী যা বিজ্ঞানের একটি জরুরী শাখা ও গ্রীনহাউস ওয়ারমিং এর বিষয়ে ধারনা আলোচনায় আসে। তখন থেকেই যে যে বিষয়ে জিওফিজিক্যাল পর্যবেক্ষণ শুরু হয় তার একটি অন্যতম ছিল বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড পরিমাপ করা। যে বিষয়টি ১৯৫৭র ইন্টারন্যাশনাল জিওফিজিক্যাল ইয়ারের কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল।(সূত্র:A History of Climate Activities by John W.Zillman)

সুইডেনের স্টোকহোলমে ১৯৭২সালের ৬-১৬ জুন জাতিসংঘের উদ্যোগে এক বৈজ্ঞানিক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় যা আবার The First Earth Summit নামে পরিচিতি পায়। এই কনফারেন্সের গৃহীত ঘোষণার নীতিমালা ছিল মানব পরিবেশের রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্প্রসারণ এবং উল্লেখ্য যে এর কর্ম পরিকল্পনায় সুপারিশ ছিল আন্তর্জাতিক পরিবেশ কার্যক্রম। এতে একটি ধারা ছিল আন্তর্জাতিক গুরুত্ববহ দূষণকারী চিহ্নিত করণ ও নিরোধ-করণ। এটিই প্রথম আন্তর্জাতিক ঘোষণা যাতে পরিবেশ বিষয়টি উত্থাপিত হয়। এবং সরকারদের সতর্ক করে দেওয়া হয় সে সব কাজকর্মে দৃষ্টি রাখতে যা জলবায়ু পরিবর্তন বা ক্লাইমেট চেঞ্জ করে বা জলবায়ুতে পরিবর্তন ঘটায়। এছাড়া সেসব কার্যক্রমের পরিবেশ দূষণের মাত্রা মূল্যায়ন করা। উপরে উল্লেখিত ঘটনাসমূহ জাতিসংঘের ডিপার্টমেন্ট অব পাবলিক ইনফরমেশন থেকে প্রকাশিত ইয়ার বুকের সূত্র থেকে পাওয়া। এসব তথ্য পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় জলবায়ু দূষণের ভয়াবহতা সর্বসাধারণের উপলব্ধির বেশ আগে বা সাধারণের চেতনায় এর প্রভাব ধরা পড়ার আগে থেকেই এ বিষয়ে নানা পদক্ষেপ নেয়া বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছিল। তবে পরিবেশ বিষয়টি বিশেষজ্ঞ বৈজ্ঞানিকদের কর্মকাণ্ডের আওতাধীন হিসেবেই বিবেচ্য ছিল। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানই প্রথমে সমস্যা চিহ্নিত করে এবং তা সবার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য উন্মোচন করেন বৈজ্ঞানিকেরা।
তারপর আজ পর্যন্ত জলবায়ু উষ্ণায়ন ও পরিবেশ দূষণ নিয়ে ক্রমাগত নানা কার্যক্রম চলমান। ব্রাজিলের রিও ডে জেনিরোর ১৯৯২র জলবায়ু কনফারেন্স বিষয়ে ব্যাপক মানুষের মাঝে আগ্রহ তৈরি হয়। জলবায়ুর উষ্ণায়ণ অনুভূত হচ্ছে সর্বত্র তবে বিশেষজ্ঞ ও বৈজ্ঞানিকদের দেওয়া তথ্যের কল্যাণে এবার কারণটি প্রায় সবার বোধগম্য হতে শুরু করে। বায়ুমণ্ডলে কার্বন উদগীরণের ফলে ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে বিষয়টি বিপদজনক তা সাধারণ মানুষকে ভাবিত করে।
রিও জলবায়ু কনফারেন্সে পরিবেশ দূষণের গুরুত্ব অনুধাবনের ফলেই পরবর্তীতে ১৯৯৭এ কিয়োটো কনফারেন্স এবং ধারাবাহিক ভাবে অন্যান্য জলবায়ু সম্মেলন চলতে থাকে। কিয়োটো কনফারেন্সেই জলবায়ুতে দূষিত গ্যাস বৃদ্ধির মাত্রা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সদস্য রাষ্ট্র সমূহের জন্য অবশ্য পালনীয় কার্যক্রম বা কর্তব্য তৈরি করা হয়। সে কর্তব্য হচ্ছে সোজা ভাষায় ভূপৃষ্ঠের বায়ু মণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড(যা CO2 হিসেবে সহজে বোঝা যায়)এর উদগীরণ মাত্রা কমিয়ে আনা। যেহেতু বৈশ্বিক আবহে বেশী মাত্রায় CO2 উদগীরণ করার ব্যাপারে শিল্পায়িত রাষ্ট্রসমূহের দায়িত্বশীলতা বেশী তাই সে সব রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতাও বেশী। তবে সেসব সকল রাষ্ট্র এই দায়িত্ব পালনে অর্থাৎ কার্বন এ্যামিসন কমাতে যথাযথভাবে আন্তরিক নয়। বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রক্ষমতায় কে আছে তার বা সে দলের জলবায়ুর সুস্থতা রক্ষার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি সব সময় এক রকম নয়। পরিবেশ রক্ষা তাদের কাছে প্রাধান্য পায় না। শিল্পে বাণিজ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু ও পরিবেশ রক্ষায় যার ভূমিকা ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত হয়। ক্ষমতার কেন্দ্রে কে বা কোন রাজনৈতিক দল থাকে তার উপর নির্ভর করেই পরিবেশ সমস্যা কখনো গুরুত্ব পায়, কখনো বা অবহেলিত হয়। স্পষ্ট করে বলা যায় বিল ক্লিন্টন, বারাক ওবামার প্রশাসনের সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিবেশ সংরক্ষণে যতটা আগ্রহী ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে ঠিক ততোটাই নির্লিপ্ত।
তবে যে কথা আজ স্বীকৃত তা হল বৈজ্ঞানিকদের সরবরাহ করা তথ্য যে গ্যাস(প্রধানত: কার্বন ডাই অক্সাইড যা CO2 নামে বেশী বোধগম্য) উদগীরণই জলবায়ুর উষ্ণায়ণের মূল কারণ তাতে লাগাম না টানতে পারলে মানুষের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। এই জরুরী তথ্যটি সাধারণ মানুষও এখন জানে ফলে সর্বসাধারণের দাবী আজ জলবায়ু রক্ষা মানে CO2র মাত্রা কমানো। এ ব্যাপার সুইডিশ কিশোরী পরিবেশ কর্মী গ্রেটা থুনবার্গ

মাদ্রিদ ২০১৯র জলবায়ু কনফারেন্সে কতিপয় কার্বন উদগীরণকারী রাষ্ট্রের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার ঘটনায় হতাশা প্রকাশ করে বলে
The science is clear, but the science is being ignored. Whatever happens we will never give up. We have only just begun(সূত্র: COP25, World leaders answer young activists’ cry with a whisper by Andrea Barolini2019)

পরিবেশ দূষণের বিপদজনক প্রভাব:
মানব সভ্যতার অগ্রগতির এক পর্যায়ে যুগান্তকারী কর্মযোগ হচ্ছে শিল্প বিপ্লব। শিল্প বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে অজস্র কলকারখানা তৈরি হয়েছে, উৎপাদনে নতুন নতুন বিষয়াবলী যোগ হয়েছে যা এক শ্রেণীর মানুষের কর্মসংস্থান করেছে এবং আরেক শ্রেণীকে বিত্ত বৈভবে সমৃদ্ধ করেছে তাতে কোন দ্বিমত নেই। শিল্প-বিপ্লবের দৃশ্যমান আপাতঃ অবদান ভাল ছাড়া মন্দ নয়। এর সার্বিক ফলাফল কি হতে পারে আগে থেকে বোঝা যায়নি বা বোঝা ও জানার চেষ্টাও করা যায়নি যার ফলে কারখানায় উৎপাদিত পণ্য ও সম্পদ দ্রুত আয়েসসাধ্য জীবনোপকরণ জুগিয়েছে, সম্পদ বৃদ্ধি করেছে অনস্বীকার্য। উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের প্রয়োজনে অন্যান্য জিনিস নিত্যদিন যুক্ত হয়েছে ও হচ্ছে। প্লেন, রেল, বাস, গাড়ী সহ নানা যানবাহন পণ্য-বহন ও মানুষের যাতায়াত সহজ করেছে। দেখা যাচ্ছে এতে মানুষের জীবন সহজ, স্বস্তিদায়ক ও সুখকর হয়েছে তবে চট্ করে দেখা যায়না এমন নেতিবাচক বিষয়ও ঘটে চলেছে একইসাথে। গত এক থেকে দেড়শ’ বছরে অসংখ্য কলকারখানা ও যানবাহন যে ক্ষতিকর গ্যাস উদগীরণ করছে যা কার্বন এ্যামিসন বলে পরিচিত তাই পরিবেশকে ধীরে ধীরে বিপন্ন করে তুলেছে। উন্নতি-জনিত সুখ আয়েসের পাশাপাশি উন্নতিরই অবদান দম আটকানো দূষিত পরিবেশ মানব সমাজকে নানা জটিলতায় ঠেলে দিয়েছে। কেবল মাত্র কার্বন এ্যামিসন নয় কলকারখানার নির্মাণের প্রয়োজনে বন-জংগলও উচ্ছেদ হয় ও হচ্ছে। বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ও সমগ্র প্রাণীকুলের বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের উৎসস্থল ও যোগানদাতা হচ্ছে অরণ্য। অরণ্যের অভাবে একদিকে অক্সিজেনের স্বল্পতা যেমন অন্যদিকে মানুষের নির্মিত কলকারখানা, যানবাহন ইত্যাদি সবকিছু থেকে অবিরত উদগীরিত ক্ষতিকর গ্যাস ভূ-মণ্ডলের উপরিস্থিত আবহকে আচ্ছাদিত করে উঞ্চ বায়ুকে মহাশূন্যে মিলিয়ে যেতে দিচ্ছে না। ভূমণ্ডলে তাপমাত্রা আটকে যাওয়া বা আটকে থাকাকেই ‘গ্রিন হাউস এ্যাফেক্ট’ বলে। গ্রিন হাউস এ্যাফেক্টর ফলে ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সমুদ্র-বক্ষের ও মেরু-অঞ্চলের বরফ গলে যাচ্ছে ক্রমে ক্রমে। জলবায়ুর উষ্ণতার কারণে ঋতুপরিবর্তন ঠিকমত হচ্ছে না। তাই ঋতু অনুযায়ী বীজ বপন ও শস্য কেটে যথাসময়ে ঘরে তোলা যাচ্ছে না। কৃষিজীবী মানুষের জীবনযাপন অসহনীয় হয়ে পড়েছে। এমন কি নিঃশ্বাসে নিতে হচ্ছে দূষিত বাতাস।
দূষণের কারণে সবাই আজ বিপদে তবে শিশুদের বিপদ গুরুত্ব পাওয়ার কথা বা আলোচনায় আসার কথা সবার আগে। কারণ মানব জাতির ভবিষ্যৎ শিশু কিশোররা রোগ জর্জরিত, হাড় জিরজিরে হলে সভ্যতা কারা এগিয়ে নিয়ে যাবে? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮র প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে বিশ্বের ১৫ বছরের কম বয়সী শতকরা ৯৩ভাগ শিশু প্রতিদিন দূষিত বাতাসে নিঃশ্বাসে নিচ্ছে।
বাতাস দূষণ রোগ বালাই ছড়ানোর দূত বা বাহন। দূষিত আবহাওয়া শ্বাস প্রশ্বাসের সংক্রমণ ঘটায় যে কারণে হাপানী বা এ্যাজমা রোগ সারা পৃথিবী জুড়ে আজকাল প্রায় সাধারণের মাঝে ছড়ানো একটি অসুখ, যা ছোটদের মাঝেই বেশী লক্ষ্য করা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে এর কারণ এই যে বাচ্চারা বয়স্কদের চেয়েও ঘন ঘন শ্বাস প্রশ্বাস নেয় ফলে দূষিত বায়ু তাদের শরীরেই বেশী প্রবেশ করে ও প্রভাব ফেলে। দূষিত বায়ু ফুসফুসের ক্ষতি সাধন তো করেই বাচ্চাদের মস্তিষ্কের পরিপূর্ণ বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৬ সনে শ্বাস জনিত সংক্রমণে ৬০০,০০০হাজার শিশুর মৃত্যু ঘটে এবং এই সংক্রমণ ঘটার পেছনে দায়ী দূষিত বাতাস। (সূত্র:More than 90% of the world’s children breathe toxic air everyday, WHO News release,29 October 2018, Geneva)
পরিবেশের প্রতি অযত্নের ফলেই মানুষ নানা অদ্ভুত অসুখ বিমুখে জর্জরিত একথা এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। বর্তমান বিশ্বে করোনা ভাইরাস তাণ্ডব চালাচ্ছে শোনা যায় সে ভাইরাস এসেছে একটি প্রাণী থেকে যে প্রাণীকে মানুষ ইচ্ছামত ব্যবহার করেছে, কখনো খাদ্য হিসেবে, কখনো ওষুধ বানানোর উপকরণ হিসেবে। যদিও প্রকৃতি থেকে নানা বস্তু আহরণ করে মানুষ সুস্থ ও সুন্দর ভাবে বাঁচার কথা তা নয় অতি ভোগী মানুষ প্রকৃতিকে শোষণ করে তার ধ্বংস ডেকে আনছে। প্রকৃতি থেকে আহরণ নয় প্রকৃতিকে আত্মসাৎ করা হচ্ছে বর্তমান ভোগী সমাজের কাজ।
আমাজনের অরণ্য পৃথিবীর প্রাণীকুল নিঃসরিত কার্বন ডাই শোষণ করে ও ওই বৃক্ষাদি অক্সিজেন সরবরাহ করে সবাইকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে। যাকে বলা হয় পৃথিবীর ফুসফুস সে অরণ্যকে ভক্ষণের আয়োজন চলছে। কোভিড আক্রান্ত ২০২০এ রহস্যজনক আগুনে আমাজন পুড়তে শুরু করলো। পৃথিবীর নানা অঞ্চল থেকে হাহাকার উঠলো আমাজন অরণ্যর রক্ষার আবেদন নিয়ে। পরিবেশ সুহৃদ হলিউড অভিনেতা ডি ক্যাপরিও মিলিয়ন ডলার সাহায্য নিয়ে আবেদন বা দাবী রাখলেন আগুন নিভিয়ে অরণ্য বাঁচানোর যে খবরটি পৃথিবীর নানা বার্তা সংস্থার কল্যাণে সবার নজরে পড়েছে। তবে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে(ব্রাজিল সরকার) তেমন তৎপর করেনি। কথা হল কোন বিষয় কার কাছে প্রাধান্য পাবে তা নির্ভর করে তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের উপর। উদ্দেশ্য যদি সমষ্টির মঙ্গল সাধন হয় তবে অরণ্য বাঁচাতে অবশ্যই আন্তরিক হবে। আর যদি কতিপয় ব্যক্তির মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে অরণ্য ব্যবহার করা হয় তবে অরণ্যের মৃত্যু ঘটানো হবে স্বার্থান্বেষীদের লক্ষ্য। সে ভৌতিক ভাবে আগুন লাগিয়েই হউক বা গাছ কেটেই হউক। পরিবেশ সুহৃদরা বহু আগে থেকেই যে তথ্য প্রচারে এনেছেন তা হল যে বিশ্বজুড়ে ফার্স্ট ফুডের ব্যবসায় রাজত্ব করা ম্যাগডোনাল্ড যে কাগজের প্যাকেটে আলু চিপস সরবরাহ করে সে কাগজ তৈরি হয় আমাজন অরণ্যের গাছ কেটে।
কোন বিষয়টি গুরুত্ব পাওয়া উচিত? অরণ্য রক্ষা করে মানুষকে অক্সিজেন সমৃদ্ধ বায়ু সরবরাহ করা নাকি ফার্স্ট ফুডের কাগজের প্যাকেট তৈরির জন্য অরণ্যের গাছ কাটা? এই অতি সাদামাটা তথ্য একটি শিশুও বুঝবে যে অরণ্য থাকলে, অরণ্য বাঁচলে শিশুরা সুস্থ বাতাসে শ্বাস নিতে পারবে, স্বাস্থ্য ভাল থাকবে, তার বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটবে ভাল।
আমাজন অরণ্য পৃথিবীর জন্য মঙ্গল দায়িনী আর বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের সুন্দরবনও এশিয়া মহাদেশের জন্য উপকারী। সব প্রাকৃতিক সম্পদে গণ-মানুষের অধিকার আছে। সে অধিকার রক্ষা করা জরুরী। বাচ্চাদেরও অরণ্যে অধিকার আছে, অধিকার আছে পানির। তাদের অধিকার নিশ্চিত করাও দরকার।
দূষিত বাতাস কি ক্ষতি করছে তা কিছুটা জানা হল। উষ্ণায়নের ফলে জমাট বরফ গলছে বেশ দ্রুত। বরফ গলা এবং সাগর মহাসাগরের পানিও উষ্ণ হয়ে সম্প্রসারিত হচ্ছে ফলে সমুদ্রের পানি ফুলে ফেঁপে উঠছে। এক সময়ে সে পানি উপকূলবর্তী অঞ্চলে প্রবেশ করবে। উপকূলের অনেক দেশ পানির নীচে তলিয়ে যেতে পারে। ব্যাপারটা বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফল জ্যোতিষীর ভবিষ্যৎ বানী নয়। কারণ একটাই মানুষের কর্মকাণ্ডের ফলেই বিশ্বের জলবায়ু মণ্ডলে ব্যাপক কার্বন ডাই অক্সাইড ও অন্যান্য গ্যাস উদগীরিত হয়ে জমছে তাতে ভূ-পৃষ্ঠের উষ্ণতা শূন্যে বিলীন হতে পারছে না যে কারণে সমুদ্র বক্ষ স্ফীত হয়ে পানি বাড়ছে। এই কার্বন এ্যামিসনই গ্রীণহাউস এ্যাফেক্টের কারণ। মানুষের নিক্ষিপ্ত বর্জ্য প্লাস্টিক যা নদী নালা পেরিয়ে সমুদ্রে গিয়ে জমছে তার চাক্ষুষ ফলাফল নির্মম। জলজ প্রাণীর প্রাণ সংহারী হয়ে উঠেছে প্লাস্টিক। এবার প্লাস্টিক কি ভাবে পরিবেশকে বিপন্ন করছে দেখা যাক।

গত বছর ফিলিপিনের সমুদ্র উপকূলে বিরাট বিশাল ওজনের মৃত তিমির পেটে পাওয়া গেছে মন(৪০কেজি) ওজনের পলিথিন। মেরিন এক্সপার্ট ড্যারেল ব্লাত্চলির তোলা মৃত তিমির ছবিটি বিশ্বের নানা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনে এই ছবিসহ প্রবন্ধে(সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিন মার্চ সংখ্যা ২০১৯) প্লাস্টিকে পরিবেশ দূষণ নিয়ে বলা হয়েছে যে তিমিটির মৃত্যুর কারণ ওই পলিথিন। শুধু তিমিই নয় ইউনেস্কোর দেয়া হিসাব অনুযায়ী প্রতিবছর প্রায় ১০০,০০০হাজার সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী প্লাস্টিক বিপর্যয়ে মৃত্যু বরণ করছে। কমবেশি সবারই জানা আছে যে ওইসব পলিথিন ও প্লাস্টিক নদী নালার পানির সাথে বাহিত হয়ে সমুদ্রে মিশেছে, এছাড়া সমুদ্রতটে মানুষের অসচেতন ও বেহিসাবি আচরণও সমুদ্রকে ময়লা ফেলার বীন বা ময়লার ভাগার বানিয়ে ফেলেছে। এসবই মানুষের অবিবেচনা প্রসূত কর্মকাণ্ড। মানুষ যেসব আবর্জনা যত্রতত্র ফেলে সে সব পলিথিন ও প্লাস্টিক জলজ প্রাণীরা খাবার ভেবে গিলে ফেলে। যা তাদের মৃত্যু কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ছোট বড় সবাইকে পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল হতে হবে তা না হলে ওই বিরাট বিশাল তিমির মত মানুষও পরিবেশ বিপর্যয়ের শিকার হয়ে শেষ হয়ে যাবে একদিন।

পৃথিবীর প্রায় অনেক দেশ প্লাস্টিক নিয়ে বিপর্যস্ত, প্লাস্টিক কমানো নিয়ে বিভিন্ন দেশ নানান পদক্ষেপ গ্রহণও করেছে। অতি সম্প্রতি অর্থাৎ ২০২০সনে কানাডা প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করেছে। পরিবেশ রক্ষার চেষ্টায় চীন ২০১৮ সন থেকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ত্রিশ বছর ধরে জাহাজ ভর্তি করে আসা রিসাইকেল্ড প্লাস্টিক আনা বন্ধ করে দিয়েছে।

বাংলাদেশে বেন(বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট নেটওয়ার্ক) এবিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। সচেতন দৃষ্টিপাতে ধরা পড়ে বর্তমানে বাংলাদেশেও...


পরের অংশ





Share on Facebook               Home Page             Published on: 13-Jul-2023

Coming Events: