পারিজাতের সুফিয়া, সুফিয়ার পারিজাত দিলরুবা শাহানা
এই অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছিল ২০১১র বাংলা নববর্ষ আগমনের প্রাক্কালে। ঢাকাতে তখন। সারাক্ষণ নানা ব্যস্ততা। তো আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখাসাক্ষাৎ তো নাটক দেখা অথবা প্রবাসে দুর্লভ দেশী জিনিসপত্র সংগ্রহের চেষ্টা। সে এক ছুটাছুটির পার্বণ।
তেমনি এক রোদেলা সকালে গাড়ীটা বিশাল গেট দিয়ে বেরিয়ে সামনের সড়কে উঠা মাত্র আমাদের কেউ একজনের সেলফোন বেজে উঠলো। সেলফোন থাকার কারণে আপনি যেখানেই থাকুন না কেন প্রার্থিত জনকে খুঁজে পাওয়া কঠিন না। গাড়ীতে আমার আত্মীয়া তার ফোন কানে লাগিয়ে কিছু শুনেই খুশীর স্বরে প্রশ্ন করলেন
‘কখন হয়েছে? ছেলে না মেয়ে?’
অপারের অশ্রুত কথা ‘.....’
‘ঠিক আছে ক্লিনিকের ঠিকানাটা এসএমএস করে দাও, আমরা কিছুক্ষণের মাঝেই চলে আসবো।’
টেলিফোন বন্ধ করেই হাসিমুখে সে বললো ‘অন্য কেনাকাটা আজকে তাহলে বাদ। বাচ্চাকে ক্লিনিকে দেখেই আমরা সমরখন্দ না সোনারগাঁ (ভৌগলিক স্থান নয় হোটেলে) যাওয়ার কথা ওখানে যাব, তার আগে ঐ পুরাতন জায়গা থেকে ওর জন্য জামা-টামা কিনে নিয়ে যাই’
আমার বিস্মিত জিজ্ঞাসা ‘পুরাতন জামা কিনবে?’
আমার কথার জবাব না দিয়ে ড্রাইভারকে গাড়ী ঘুরিয়ে অন্য কোথাও যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে তারপর আমাকে বললো ‘কুটীর থেকে শিল্প কিনবো, এই বাচ্চাটার বাবার জন্যও প্রথম জামা-কাঁথা এখান থেকেই কিনেছিলাম সে অনেক বছর আগে।’
ভাবলাম আড়ংয়ে যাওয়ার কথাই বলছে হয়তো। তবে গাড়ী সদর রাস্তাতে না উঠে উল্টো পথ ধরলো। হঠাৎ মনে পড়লো বাচ্চাটার বাবার বয়স সাতাশ/আটাশ বছর হবে। অতো বছর আগে আড়ং কি পশ্চিমা ধাঁচে ০০০০-০মাপে ছোট্ট পিচ্চিদের জন্য জামা তৈরি করতো? জিজ্ঞেস করলাম
‘আড়ংয়ে যাচ্ছি কি?’
‘না, আড়ং এখন কুটীর শিল্পের বাণিজ্যিক কারখানা। আমরা আসল কুটীর থেকে শিল্প কিনে ফিরবো’।
আমি ভাবছি এই অভিজাত পারায় কুটীর কোথায় আছে? ড্রাইভারকে বলা হলো ৩নং সড়কের ১৯নং বাড়ী বা ১৯নং সড়কের ৩নং বাড়ীতে গেলেই হবে। বেচারা যান-চালক পড়লো ফাঁপরে।
‘দুই বাড়ীতেই যাব?’
‘আরে না, ঠিকানাটা ঠিক মনে নাই তবে ঐ বাড়ীটা ভেঙ্গে এখনও এপার্টমেন্ট তৈরি হয়নি’
‘এখন বুঝছি কোন বাড়ীতে যাতি হবি, ঐখান তো কোন দোকানপাট নাই?’
বুঝলাম চালক বেশ চৌকশ। এলাকার নাড়িনক্ষত্র ওর মাথায় গাঁথা। কুটীরশিল্প ভাবনায় বিভোর হয়ে আন্মনা ছিলাম। আমাদের প্রায় কৈশোরে ‘কারিকা’ ‘সেতুলী’ নামের হস্তশিল্প ও কুটীরশিল্প প্রথম পাপড়ি মেলেছিল। তারপরে আরও কত কত প্রতিষ্ঠান হৃদয়কাড়া শিল্পিত পণ্যকে মনকাড়া ও কড়িটানা শিল্প-পণ্য বানিয়েছে। অনেক লোকের কর্মসংস্থান এতে হয়েছে অবশ্য। চমক ভাঙ্গলো গাড়ী থামার লয়ে। কোথায় এসেছি ৩নং সড়কের ১৯নং বাড়ী নাকি ১৯নং সড়কের ৩নং বাড়ী? জানি না। পুরনো নকশার বড় দোতলা বাড়ী। দেয়াল ঘেরা। এই আবাসিক এলাকার বাড়ীগুলো এক বিঘার কম হয়না। ডানদিকে গেট থেকেই সুড়কি-সিমেণ্টে বাঁধানো পথ গাড়ীর গ্যারাজ পর্যন্ত। বাঁদিকে সবুজ ঘাসে ঢাকা চারকোনা বহিরাঙ্গন বা ফ্রণ্টইয়ার্ড। দেয়াল ঘেঁসে অনেক রকম ছোটবড় গাছ। গাছপালা ছাওয়া বাড়ীটিতে সকালের সূর্যতাপের দর্প ম্রিয়মাণ। সকালের ঝকঝকে রোদের বদলে রয়েছে ছায়াবীথির স্নিগ্ধ প্রশান্তি। আঙ্গিনা থেকেই দু'টো সিঁড়ি বেয়ে সামান্য উঁচু মিটার দেড়েক লম্বা মোটামুটি চওড়া বারান্দায় উঠতে হয়। বিল্ডিংটা ইংরেজি বর্ণমালা ‘এল’ আকৃতির। বারান্দা থেকে ভেতরে ঢুকার পথ দু’টি। বাঁদিকের দরজা বন্ধ। সামনের দরজা দিয়ে ঢুকলেই করিডোর বা প্যাসেজ। প্যাসেজের ডানদিকের ঘরের দরজা খোলা। জানালাগুলো বন্ধ তাই লাইট জ্বালিয়ে রাখা। আমরা ঢুকলাম তাতে। প্রশস্থ মেঝে খালি রেখে তিনদিকে তিনটি টেবিল, তবে দেয়াল ঘেঁসে নয়। দেয়াল ও টেবিলের মাঝে ততোটুকু জায়গা ফাঁকা যাতে একজন লোক সহজে দাড়াতে বা হাঁটাচলা করতে পারে। টেবিলগুলোর উপর স্বচ্ছ পলিথিনে ঢাকা বাচ্চাদের জামাকাপড়। ঐ ঘরের বাঁদিকে একটি দরজা। দরজাটা খোলাই রয়েছে। আমরা দু'জন ঘরে পা রাখতেই ঐ দরজা দিয়ে একজন লোক এগিয়ে এলেন। মধ্য-তিরিশের হাফহাতা সাদা শার্ট ও হাল্কা খয়েরী রঙের প্যান্ট পরা হাসি হাসি মুখের লোকটি জানতে চাইলো
‘কি নেবেন আপনারা?’
আমার আত্মীয়া পাল্টা জানতে চাইলেন
‘উনি কোথায় যিনি মোহাম্মদপুর থেকে আসতেন? গতবার তার কাছ থেকেই কিনেছিলাম।’
ঠিক সে সময়ে করিডোরের দরজা দিয়ে আমাদের পিছনে আরেকজন ঢুকলেন। ঢুকতে ঢুকতেই বললেন
‘ঐ আপার ক্যান্সার হয়েছে তাই এখন মাঝে মাঝে শুধু খালাম্মার সাথে দেখা করতে আসেন।’
এই লোকটিও উচ্চতায় স্বাস্থ্যে আগের লোকটির কাছাকাছি তবে বয়সে একটু বড় মনে হয়। ঐ রকমই পোশাক তবে প্যান্টের পা কিছুটা গুটানো। দেখে মনে হল বাগানের কাজ ফেলে উঠে এসেছেন।
আত্মীয়া জানতে চাইলেন ‘তা হলে কেনাবেচার জন্য আপনাদের রেখেছেন এখন?’
‘আমরাই সব করি, গাড়ী চালাই, বাগান করি, বেচাবেচি করি আর খালাম্মার দেখাশুনাও করি’
আমি জিজ্ঞেস করলাম ‘খালাম্মা কে?’
একজন ততোক্ষণে জামাকাপড় খুলে দেখাতে শুরু করেছেন। অন্যজন আমার সাথে কথাবার্তা বলতে উৎসাহী হলেন। এদের কথা বলার লোক জুটেনা বুঝলাম।
‘খালাম্মা এই বাড়ীর মালিক আর এইসবও খালাম্মার জিনিস’ প্যান্ট গুটিয়ে বাগানের কাজে ব্যস্ত মানুষটি কাজ ফেলে এসে কুটিরশিল্পের সম্ভার আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে কথাগুলো বললেন। পরপরই ব্যস্ত গলায় অন্য লোকটিকে বললেন ‘হিসাবের খাতা বার কর, লিখে রাখতে হবে না?’
খালাম্মা বিষয়ক গল্পের ঝাঁপিটি ভদ্রলোক সোৎসাহে খুলে ধরলেন। মনে হল কথা গুলো বলতে তার আনন্দ হচ্ছে।
আঙ্গুল দিয়ে উপরে ইঙ্গিত করে বললেন ‘দোতালায় থাকেন সুফিয়া খালাম্মা, তিরাশি বছর বয়স। দুই ছেলে মেয়ে উনার ঢাকাতে থাকেন তবে তারা বিদেশ ঘুরেন খুব। ঘন ঘন এসে উনারা মায়ের খোঁজখবর করেন। উনি এখন আর বাইরের কারো সাথে দেখা করেন না। খালাম্মার সেবাযত্ন করার ভাল লোক আছে। ডাক্তার-কবিরাজ দরকার হলে আমরাই ডাকি।’
‘কবিরাজ ডাকেন!’ আমার কণ্ঠে বিস্ময়।
লোকটি সরল হাস্যে বললো
‘কথার কথা আর কি। ঢাকাইয়ারা যেমন বলে ঘি গু দিয়া পাকাইছি তেমনি কথা’
ব্যাকরণ সম্মত ব্যাখ্যা নয়। হাসি পেল লোকটির বুদ্ধিমত্তা দেখে তবে হাসি চেপে জিজ্ঞেস করলাম
‘উনি কতদিন এই কাজ চালাচ্ছেন?’
‘তেতাল্লিশ বছর ধরে। ঘরে বসে মহিলারা বাচ্চাদের জন্য জামা কাঁথা সেলাই করে এখানে দিয়ে যান। তাদের পাওনা বুঝিয়ে দেওয়ার পর যা লাভ হয় তা একটা এতিমখানাতে দেওয়া হয়’।
তেতাল্লিশ বছর ধরে এমন মহৎ কাজ করে যাচ্ছেন যিনি সেই মহিলাকে দেখার ইচ্ছে হয়েছিল। তবে সুযোগ হলো না।
আমাদের কেনাকাটা শেষ হল। সদ্যোজাত শিশুর জন্য তৈরি অপূর্ব সব রঙের সুতির জামা, কাঁথা ও তিনকোণা আকৃতির সুতির ন্যাপি কেনা হল। আমরা বেরিয়ে আসলাম। লোক দু'জনও পিছু পিছু আসলেন। বারান্দা থেকে নেমে ঘাসের উপর দিয়ে হেঁটে গাড়ীর দিকে ধীরে ধীরে এগুচ্ছি। ঘাসের উপর কিছু ফুল পড়েছিল। একটি ফুল তুললাম। সাদা ঠিক নয়। হাল্কা হলুদ এক আভাও মাঝে মাঝে হঠাৎ করেই ঝলসে উঠছে অথবা হলুদ নয় যেন মাখনের রঙ চমক দিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। পরাগকেশর নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে উচ্চকিত ভাবে অর্থাৎ সে দৃষ্টি এড়াবে না। আমার কৌতূহল হল জানার। গাড়ীতে উঠতে উঠতে প্রশ্ন করলাম
‘কি ফুল এটা বলুন তো?’
‘পারিজাত, খালাম্মার প্রিয় ফুল’ হাত আকাশে ছুড়ে তর্জনী তুলে দেয়াল ঘেঁষা একটি গাছ দেখালেন। চলতে শুরু করা গাড়ীর জানলা দিয়ে চোখের পলকে যেটুকু দেখলাম তাতে মনে হল গাছটি শিউলি ফুল গাছের সমতুল্য একটি গাছ। গাড়ীতে আমার আত্মীয়া ঠোঁট মুচড়ে বললেন ‘আরে পারিজাত স্বর্গীয় ফুল, এইসব ড্রাইভার-মালিরা ঐ ফুল চিনবে কি ভাবে’।
যেন প্রকৃতির স্বর্গীয় উপহার ফুল চেনার একচেটিয়া অধিকার শুধু ডিগ্রীধারী শিক্ষিত-জনদের। ডিগ্রীফিগ্রী নিয়ে আমি ঐসব শিক্ষিত-জনদের একজন হলেও বলতে লজ্জা নেই সব জাতের ফুল আমি চিনি না। আমার এই অজ্ঞতার জন্য আমি লজ্জিত নই তবে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। এখন আক্ষেপ হচ্ছে ভেবে যে কেন কিছু সময় ব্যয় করে গাছটা ভাল করে দেখলাম না।
গাছ চেনা ও তার ভেষজ গুণাবলী সম্বন্ধে প্রাজ্ঞ আমাজন জঙ্গলের অক্ষরজ্ঞানহীন এক আদিবাসীর ঘটনা মনে পড়লো। ঘটনা বর্ণিত হয়েছিল লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স এর এক লেকচার ক্লাসে। ইন্ডেজেনিয়াস নলেজ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে শিক্ষক বললেন, এক ব্রিটিশ লোক আমাজন রেইন ফরেস্ট অঞ্চলে দীর্ঘদিন কাটান। এক আদিবাসী আমাজনীয় লোক প্রতিদিন তার সাথে ঘুরে ঘুরে গাছ-লতা-গুল্ম এর নাম এবং এইগুলোর ভেষজ-তথ্য (ঔষধ হিসাবে উপকারিতা) তাকে বলে যেতো। উনি নোট টুকে রাখছিলেন তখন। পরে গুণে দেখেছেন ঐ আদিবাসী লোকটি ১৬হাজার ভেষজ গাছের তথ্যজ্ঞানে জ্ঞানী। আধুনিক জীবনোপকরন ও ডাক্তার-কবিরাজ-বদ্যিহীন গহন জঙ্গলে ঐ আদিবাসীদের রোগ-বালাই এর সাথে লড়ে জীবনযাপনে সাহায্য করে তাদের ইন্ডেজেনিয়াস নলেজ।
পরে একসময়ে পারিজাত বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু হই। অভিধান মতে পারিজাত স্বর্গীয় ফুল। দু'এক জন স্থিতধী, প্রাজ্ঞ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জেনেছি তারাও পারিজাত দেখেন নি। একজন বলেছেন হিমালয় অঞ্চলে সমতলভূমি থেকে বেশ উপরে আপনাআপনি একটি পুষ্প উদ্যান বিকশিত হয়েছে। সেই উদ্যানে শ্রাবণ মাসে ব্রহ্মকমল ফুটে। অনেকে মনে করে ব্রহ্মকমলই হচ্ছে স্বর্গীয় ফুল পারিজাত। সুফিয়ার পারিজাত দেখা হয়নি ভাল করে। লোকচক্ষুর বাইরে ও আত্মপ্রচারনার উদগ্র বাসনা এড়িয়ে মানবসেবার যে ফুল তেতাল্লিশ বছর ধরে উনি ফুটিয়ে রেখেছেন এটাও তার পারিজাত নয় কি? তবে পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলে ছায়ানটের বাংলা নববর্ষ বরনের অনুষ্ঠান তৃষিত আবেগকে পূর্ণ করেছে কতবার! কিন্তু ঐ সবুজ বৃক্ষ আচ্ছাদিত রমনায় রয়েছে অনেক দুর্লভ (কর্পূরেরও গাছ আছে ওখানে) গাছ, সেগুলোও সচেতন মন নিয়ে দেখিনি। ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া’ ‘কার্তিকের নবান্নের দেশে’ বৈশাখী আনন্দে ভেসে পারিজাতের সুফিয়াকে আর সুফিয়ার পারিজাতকে।
দিলরুবা শাহানা, মেলবোর্ন
|